উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে গম উৎপাদন

মৃন্ময় গুহ নিয়োগী

লবণাক্ত এবং সেচযোগ্য পানির অভাবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চেেলর ৪ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে পতিত থাকছে। উপকূলের এই পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া সরকারের আর্থিক সহায়তায় অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০১৭ সন থেকে বর্তমান নিবন্ধের লেখক ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে আসছে। গত ৬ মার্চ ২০২৩ সনে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ২৮ জন কৃষকের লবণাক্ত পতিত জমিতে আমার গবেষণার ফসল ‘বিনা চাষে কম খরচে রিলে পদ্ধতিতে অসামান্য গম উৎপাদন’ উপকূলীয় অঞ্চলের কলাপাড়ার বাসিন্দারা প্রত্যক্ষ করল। আমন ধানের জমিতে ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগে জমি ভিজা থাকা অবস্থায় মধ্য নভেম্বরে গমের বীজ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো- কেন ধানের জমিতে এভাবে গমের বীজ ছিটানোর প্রয়োজন হলো! গম ফসল শীত পছন্দ করে। বাংলাদেশে গম বীজ বোনার সঠিক সময় নভেম্বর মাস। গম গাছের বৃদ্ধিকালীন সময়ে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গম গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালোমানের গমের শীষ বের হতে পারে।

সে কারণে মধ্য নভেম্বরে জমিতে গম বীজ বপন করলে জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে গম গাছ তার বৃদ্ধিকালীন সময়ে ঠান্ডা তাপমাত্রা পাবে এবং ওই সময়ে গম ফসল ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হবে। যেহেতু নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে, সে কারণে তিনি মধ্য নভেম্বরেই আমন ধানের জমিতে গম বীজ ছিটিয়ে ছিলেন। এই সময়ে জমির লবণাক্ততাও অনেক কম থাকে। এতে উপযুক্ত তাপমাত্রায় এবং অনেক কম লবণাক্ততায় গম ফসল ভালোভাবে বেড়ে উঠছে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হচ্ছে। গম বীজ বোনার ২০-২৫ দিন পর ধান পেকে গেলে কৃষক ধান কেটে নেয়। ধান কাটার সময় কৃষকরা একটু উপর থেকে তাদের ধান কাটল, যাতে গমের চারাগুলো না কাটা পড়ে। গমের চারা জমিতে থেকে যায়। সঠিক সময়ে গম বীজ বোনার কারণে এবং এই সময়ে জমির লবণাক্ততা কম থাকার কারণে গম ফসল ভালো ফলন দিচ্ছে। মূলত এটিই বিনা চাষে রিলে গম উৎপাদন পদ্ধতির রহস্য। যেহেতু, রিলে গম উৎপাদন পদ্ধতি একটি সহজ এবং অত্যন্ত কম ব্যয় সম্পন্ন একটি প্রযুক্তি, তাই কৃষক সহজেই এই পদ্ধতিতে গম চাষাবাদ করে একটি অতিরিক্ত ফসল তাদের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফলাতে পারছে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছে। কৃষকরা বিঘাপ্রতি (৩৩ ডেসিমেল) সাড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ করে ৪০০ কেজি গম ঘরে তুলছেন, যার মূল্য ১০ হাজার টাকা। গম ফসল চাষাবাদে পানির প্রয়োজন খুবই কম। মাত্র ২-৩টি সেচ দিলেই ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

এই এলাকায় যেহেতু সেচযোগ্য পানির সমস্যা, তাই শুধুমাত্র সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই উপকূলের বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে কৃষক বিনাচাষে কম খরচে শুষ্ক মৌসুমে একটি অতিরিক্ত ফসল ফলাতে পারবেন। এতে কৃষকের যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ঠিক তেমনি বিপুল পরিমাণ গম আমদানি থেকে দেশ রেহাই পাবে। সরকারের কাছে উপকূলের কৃষকদের একটি মাত্র চাওয়া- লবণাক্ত পতিত জমিতে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচযোগ্য পানি নিশ্চিত করা। শুধুমাত্র সেচযোগ্য পানি নিশ্চিত করতে পারলেই উপকূলের হাজার হাজার হেক্টর পতিত কৃষিজমি বিনাচাষে অত্যন্ত সহজ এবং কম ব্যয় সম্পন্ন রিলে পদ্ধতিতে এই গম উৎপাদনের প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা যাবে।

[লেখক: স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী; ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনির্ভাসিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া]

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪

উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে গম উৎপাদন

মৃন্ময় গুহ নিয়োগী

image

রিলে গম উৎপাদন পদ্ধতি একটি সহজ এবং অত্যন্ত কম ব্যয় সম্পন্ন একটি প্রযুক্তি

লবণাক্ত এবং সেচযোগ্য পানির অভাবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চেেলর ৪ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে পতিত থাকছে। উপকূলের এই পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া সরকারের আর্থিক সহায়তায় অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০১৭ সন থেকে বর্তমান নিবন্ধের লেখক ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে আসছে। গত ৬ মার্চ ২০২৩ সনে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ২৮ জন কৃষকের লবণাক্ত পতিত জমিতে আমার গবেষণার ফসল ‘বিনা চাষে কম খরচে রিলে পদ্ধতিতে অসামান্য গম উৎপাদন’ উপকূলীয় অঞ্চলের কলাপাড়ার বাসিন্দারা প্রত্যক্ষ করল। আমন ধানের জমিতে ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগে জমি ভিজা থাকা অবস্থায় মধ্য নভেম্বরে গমের বীজ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো- কেন ধানের জমিতে এভাবে গমের বীজ ছিটানোর প্রয়োজন হলো! গম ফসল শীত পছন্দ করে। বাংলাদেশে গম বীজ বোনার সঠিক সময় নভেম্বর মাস। গম গাছের বৃদ্ধিকালীন সময়ে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গম গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালোমানের গমের শীষ বের হতে পারে।

সে কারণে মধ্য নভেম্বরে জমিতে গম বীজ বপন করলে জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে গম গাছ তার বৃদ্ধিকালীন সময়ে ঠান্ডা তাপমাত্রা পাবে এবং ওই সময়ে গম ফসল ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হবে। যেহেতু নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে, সে কারণে তিনি মধ্য নভেম্বরেই আমন ধানের জমিতে গম বীজ ছিটিয়ে ছিলেন। এই সময়ে জমির লবণাক্ততাও অনেক কম থাকে। এতে উপযুক্ত তাপমাত্রায় এবং অনেক কম লবণাক্ততায় গম ফসল ভালোভাবে বেড়ে উঠছে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হচ্ছে। গম বীজ বোনার ২০-২৫ দিন পর ধান পেকে গেলে কৃষক ধান কেটে নেয়। ধান কাটার সময় কৃষকরা একটু উপর থেকে তাদের ধান কাটল, যাতে গমের চারাগুলো না কাটা পড়ে। গমের চারা জমিতে থেকে যায়। সঠিক সময়ে গম বীজ বোনার কারণে এবং এই সময়ে জমির লবণাক্ততা কম থাকার কারণে গম ফসল ভালো ফলন দিচ্ছে। মূলত এটিই বিনা চাষে রিলে গম উৎপাদন পদ্ধতির রহস্য। যেহেতু, রিলে গম উৎপাদন পদ্ধতি একটি সহজ এবং অত্যন্ত কম ব্যয় সম্পন্ন একটি প্রযুক্তি, তাই কৃষক সহজেই এই পদ্ধতিতে গম চাষাবাদ করে একটি অতিরিক্ত ফসল তাদের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফলাতে পারছে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছে। কৃষকরা বিঘাপ্রতি (৩৩ ডেসিমেল) সাড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ করে ৪০০ কেজি গম ঘরে তুলছেন, যার মূল্য ১০ হাজার টাকা। গম ফসল চাষাবাদে পানির প্রয়োজন খুবই কম। মাত্র ২-৩টি সেচ দিলেই ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

এই এলাকায় যেহেতু সেচযোগ্য পানির সমস্যা, তাই শুধুমাত্র সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই উপকূলের বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে কৃষক বিনাচাষে কম খরচে শুষ্ক মৌসুমে একটি অতিরিক্ত ফসল ফলাতে পারবেন। এতে কৃষকের যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ঠিক তেমনি বিপুল পরিমাণ গম আমদানি থেকে দেশ রেহাই পাবে। সরকারের কাছে উপকূলের কৃষকদের একটি মাত্র চাওয়া- লবণাক্ত পতিত জমিতে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচযোগ্য পানি নিশ্চিত করা। শুধুমাত্র সেচযোগ্য পানি নিশ্চিত করতে পারলেই উপকূলের হাজার হাজার হেক্টর পতিত কৃষিজমি বিনাচাষে অত্যন্ত সহজ এবং কম ব্যয় সম্পন্ন রিলে পদ্ধতিতে এই গম উৎপাদনের প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা যাবে।

[লেখক: স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী; ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনির্ভাসিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া]