ক্ষমতা হারানোর পর উপনির্বাচনে বাম কংগ্রেসের প্রথম সাফল্য

গৌতম রায়

বিগত ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একটা উপনির্বাচনেও একজন ও যথার্থ বিরোধী প্রার্থী জেতেননি। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে তৃণমূলের বিধায়কের মৃত্যুতে যে উপনির্বাচন হল, সেখানে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী জিতেছেন। ২০১১ এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ছিল তৃণমূলের সঙ্গে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের ভেতরেই কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কংগ্রেস মমতার মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে যায়।

২০১৬ এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে।বাম- কংগ্রেস, চিরদিন যাদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে আটকাতে সেই বাম ও কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ে। বিজেপিকে শক্তিহীন করতে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে হটানোর বাধ্যবাধকতা থেকে যে আসন সমঝোতা সেদিন হয়েছিল,তার মূল নেপথ্য কারিগর ছিলেন, শারীরিক সক্রিয়তার জেরে, তখন ও রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

এই নির্বাচনী বোঝাপড়া ভোটে ভালো ফল করেনি। কেন করেনি তা আমরা পরে বুঝেছি বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম কারবারি উমা ভারতীর মন্তব্য থেকে। উমা ’১৬র ভোটের পরে কলকাতায় এসে প্রকাশ্যে বলেছেন; একশটি আসনে তৃণমূলকে জিততে আর এস এস সম্পূর্ণ সাহায্য করেছিল তৃণমূলকে। গোটা বাম জামানা ধরে খড়গপুর কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত হতেন কংগ্রেসের জ্ঞান সিং সোহনপাল। তিনি ওই নির্বাচনে আর এস এস ঘরানার বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের কাছে পরাজিত হন। দিলীপ ঘোষের জেতার পেছনেও আর এস এস তৃণমূলের যৌথ ভূমিকার কথা কার্যত প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল উমা ভারতীর কথায়।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দলীয় স্তরে কোনো রকম বিচার বিশ্লেষণের আগেই , ভোট গণনাচলাকালীন যখন বামফ্রন্ট- কংগ্রেসের খারাপ ফলের আভাস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, তখন দলীয় সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে ধুতির কোঁচার অঙ্গভঙ্গি করে প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা বিমান বসু যেভাবে ওই আসন বোঝাপড়াকে কটাক্ষ করেছিলেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন বাদ দিলেও সেটাকে বলতেই হয়, তা তৃণমূল-বিজেপিকে হটানোর লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানানো ছিল।

সেলিম সি পি আই( এম) দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার দায়িত্বভার নেয়ার পরেই তৃণমূলের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বালিগঞ্জ কেন্দ্রে ভোট হয়। প্রয়াত সোমেন মিত্রের দলের স্বার্থ ব্যতিরেকে ,ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার গুরুত্ব না বুঝে বিমান বসুর আসন সমঝোতাকে অসংসদীয় কটাক্ষ দুই দলেরই নেতৃত্ব থেকে কর্মী প্রত্যেকের ভেতরেই এমন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যে, তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ভাঙার প্রশ্নে সেলিমের আহ্বানে সাড়া দেয়ার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার পথে সেদিন হাঁটেনি কংগ্রেস।ফলে ভোট কাটাকাটির জেরে আসানসোল দাঙ্গার নায়ক বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি থেকে তৃণমূল হয়েও জিতে যায় সেদিন। কিন্তু সি পি আই ( এম) প্রার্থীর ভোট বৃদ্ধিটা ছিল ইঙ্গিতবাহী।

সেলিম তার দলের দায়িত্ব নেয়ার পর নিজের রাজনৈতিক মেধা, সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাজী না করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা, প্রখর বাস্তববোধ, প্রজ্ঞা, পরিশ্রম, সর্বোপরি ওপর চালাকিবিহীন রাজনীতির ভেতর দিয়ে মাত্র এক বছরের ভেতরে বামপন্থী রাজনীতিকে যে জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন, সে জায়গাতে ’১১য় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামপন্থীরা আগে আদৌ পৌঁছাতে পারেনি। সেলিমের এই যে ব্যক্তিবিদ্বেষ বিহীন রাজনৈতিক স্বভাব, এই ধারার সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির পরিচয় অনেককাল ঘুঁচে গিয়েছিল। অতীতের কমিউনিস্টদের মতো এই যে অন্তহীন সমুদ্রের মতো ব্যাপ্তি ও গভীরতার হৃদয় নিয়ে রাজনীতি করা মানুষ, এমন মানুষ শুধু বামপন্থীরাই নন, যারা বামপন্থী পরিমন্ডলের নন- তারাও বহুকাল পশ্চিমবঙ্গে পাননি। ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, সদর-মফস্বলে সেলিম গেলে, রাজনৈতিক ভাবনায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা মানুষ ও সেলিমের একটু সান্নিধ্য পেতে তার কাছে ছুটে যান। আলাপ করেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেলিম ও বিরোধী শিবিরের মানুষ জেনেও তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন। কেউ সেলফি তুলতে এলে , হাসি মুখে সেলফি তোলেন। আগন্তুকের ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে দেন না।

দিমিট্রভের তত্ত্ব বাংলায় সময়োপযোগী করে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। তার ই ফসল দীর্ঘ দিনব্যাপী বামফ্রন্ট সরকার। ভারতের হিন্দি বলয়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাম রাজনীতি বিকাশের সমস্ত লক্ষণ সত্ত্বেও দিমিট্রভের তত্ত্বকে বাস্তবের রাজনীতিতে প্রয়োগ করার মতো ‘প্রমোদ দাশগুপ্ত’ সেখানে ছিলেন না- ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়ে একদিন রাইটার্সে নিজের ঘরে বসে বলেছিলেন সেলিম। আজ মনে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের পরে মনে হয়, সাতের দশকে দিমিট্রভের যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বকে সঠিকভাবে বাংলার বুকে প্রয়োগের সঠিক রূপকার প্রমোদ দাশগুপ্তই যেন নতুনভাবে ফিরে এসেছেন মহ. সেলিমের ভেতরে।

বামফ্রন্টের জন্মলগ্নে সবকিছু ভেস্তে দিতে প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে সেই সময়ের জনতা পার্টির আসন ঘিরে অন্যায় জেদ ধরাবার নেপথ্যে থাকা অশোককৃষ্ণ দত্ত দের ভূমিকা নিজের চোখে দেখেছি বলেই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলব, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতির বাস্তবতার নিরিখে সেলিম যে শুধু নেতাদের ঐক্য নন, যুগ্মভাবে ভূমিস্তরে কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেন, এটা বিগত ২০১৬ বা ২০১৯ এর বিধানসভা ভোটে সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা কী বাম, কী কংগ্রেস- কোনো দলের নেতারাই পারেননি।

সোমেন মিত্রের মতো যেমন আমহার্স্ট স্ট্রিট আর মৌলালীর বিধান ভবনে বসে দল পরিচালনা করেন না অধীর বাবু, তেমনই শুধু আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আর ফেসবুক- টুইটার দিয়েও দল চালান না সেলিম। তাই সেলিম অধীর ফ্যাক্টর আগামী দিনে বাংলায় কী মাঠঘাটের রাজনীতি, কী সংসদীয় রাজনীতিতে একটা বদল আনবেই আনবে। বামপন্থী মহল এবং কংগ্রেসের ভেতরে অনেক ‘টগর বোস্টমী’ আছে, যারা একদিকে ক্ষমতার জন্যে আঁকুপাকু করছে, অপর দিকে তাত্ত্বিকভাবে বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা দুই শিবিরের ভোট রাজনীতিতে বোঝাপড়া ঘিরেও তাদের দশা, ‘শুচি বামনীর হাজার মরণ, হেগো কাপড়ে দুগ্গা স্মরণ।’

বিগত ’১৯ এর বিধানসভা ভোটে ‘গ্রেটার ইভল’ তত্ত্ব নামিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল সি পি আই এম এল লিবারেশন। বিহার বিধানসভার ভোটে এক নীতি আর পশ্চিমবঙ্গে আর এক নীতি নিয়ে মমতাকে জিততে সাহায্য করলেও সাগরদিঘি জয়ের পরে সেলিম প্রকাশ্যে লিবারেশনের নাম করে বলেছেন, বিজেপি-তৃণমূলবিরোধী কোনো রাজনৈতিক শক্তিই অচ্ছুৎ নয়। সেলিমের এই বাস্তববোধই একজন প্রকৃত বামপন্থী নেতার বৈশিষ্ট্য। আই এস এফের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করে গত বিধানসভার ভোটে বামেরা যে লড়েছিল তা সেলিমের একার সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনো কোনো ব্যক্তিবিশেষ একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।অথচ, ভোটে সুফল না পেয়ে, ধর্মীয় পরিচয় তুলেও একাংশের বামপন্থীরাই সেলিমকে বিদ্ধ করতে, হেনস্তা করতে কম চেষ্টা করেনি।

যে ধর্ম আর জাতিসত্তার তাস খেলে মমতার রাজনীতি, তাতে ধস নামাতে আই এস এফ এবং নওশাদ সিদ্দিকি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছেন মাত্র এক বছর সময়ের ভেতরেই। আর এস এসের গেম প্ল্যানে যে মুসলমান সমাজকে মমতা ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ ভেবেছিলেন, নওশাদ কে জেলে পুড়ে রেখার দায় মমতাকে সেই মুসলমান সমাজই চুকিয়ে দিয়েছে সাগরদিঘিতে। সেই নওশাদ মমতার পুলিশের বেড়াজাল ছিঁড়ে মুক্তি পেয়েছেন হাইকোর্টের নির্দেশে। আলিপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে জেল গেটে গিয়ে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন সেলিম।

এমনটাও কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে আসার পর বামফ্রন্টের প্রথম সারির কোনো নেতার আচরণের ভেতরে দেখতে পাওয়া যায়নি। শরিকদলগুলোকে বামফ্রন্টের ভেতরে মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে যে কিংবদন্তি ভূমিকা রেখেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, একই ভূমিকা মন্ত্রীসভার ভেতরে পালন করে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। এই দুই নেতার সমন্বয়বাদী, বাস্তবমুখী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চরিত্রের সমন্বয় হলেন সেলিম। আমার পাশের শহরের প্রবীণ নেতা মলয় ভট্টাচার্য বলছিলেন; নৈহাটিতে জিবি করতে এসেছেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। সে সময়ের চব্বিশ পরগণার বাঘে গরুকে একঘাটে জল খাওয়ানো নেতা গোপাল বসু বললেন প্রমোদ বাবু কে; চলেন, বাড়িতে কমলা (গোপালপত্নী) লাউ চিংড়ি রাঁধছে। প্রমোদ বাবু বললেন; ছাড়েন আপনার লাউ চিংড়ি। কমরেডদের আনা চপ মুড়িই আমার অমৃত।

বেশি তেল মশলার খাবার খান না সেলিম। এমনকি বারবার চা-ও নয়। বলেন, মেশিনে বেশি অয়েল দিতে নেই। সেই মানুষটিই শহীদ স্মরণে মিটিং করে ফেরার পথে শরীরের কথা ভেবেও ববি রক্ষিতের বাড়িয়ে দেয়া তেলে ভাজার ঠোঙাটা ফেরাতে পারলেন না। পথে খেয়ে নিলেন।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩ , ২৬ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৮ শবান ১৪৪৪

ক্ষমতা হারানোর পর উপনির্বাচনে বাম কংগ্রেসের প্রথম সাফল্য

গৌতম রায়

বিগত ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একটা উপনির্বাচনেও একজন ও যথার্থ বিরোধী প্রার্থী জেতেননি। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে তৃণমূলের বিধায়কের মৃত্যুতে যে উপনির্বাচন হল, সেখানে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী জিতেছেন। ২০১১ এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ছিল তৃণমূলের সঙ্গে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের ভেতরেই কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কংগ্রেস মমতার মন্ত্রীসভা থেকে বেরিয়ে যায়।

২০১৬ এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে।বাম- কংগ্রেস, চিরদিন যাদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে আটকাতে সেই বাম ও কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ে। বিজেপিকে শক্তিহীন করতে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে হটানোর বাধ্যবাধকতা থেকে যে আসন সমঝোতা সেদিন হয়েছিল,তার মূল নেপথ্য কারিগর ছিলেন, শারীরিক সক্রিয়তার জেরে, তখন ও রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

এই নির্বাচনী বোঝাপড়া ভোটে ভালো ফল করেনি। কেন করেনি তা আমরা পরে বুঝেছি বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম কারবারি উমা ভারতীর মন্তব্য থেকে। উমা ’১৬র ভোটের পরে কলকাতায় এসে প্রকাশ্যে বলেছেন; একশটি আসনে তৃণমূলকে জিততে আর এস এস সম্পূর্ণ সাহায্য করেছিল তৃণমূলকে। গোটা বাম জামানা ধরে খড়গপুর কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত হতেন কংগ্রেসের জ্ঞান সিং সোহনপাল। তিনি ওই নির্বাচনে আর এস এস ঘরানার বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের কাছে পরাজিত হন। দিলীপ ঘোষের জেতার পেছনেও আর এস এস তৃণমূলের যৌথ ভূমিকার কথা কার্যত প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল উমা ভারতীর কথায়।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দলীয় স্তরে কোনো রকম বিচার বিশ্লেষণের আগেই , ভোট গণনাচলাকালীন যখন বামফ্রন্ট- কংগ্রেসের খারাপ ফলের আভাস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, তখন দলীয় সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে ধুতির কোঁচার অঙ্গভঙ্গি করে প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা বিমান বসু যেভাবে ওই আসন বোঝাপড়াকে কটাক্ষ করেছিলেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন বাদ দিলেও সেটাকে বলতেই হয়, তা তৃণমূল-বিজেপিকে হটানোর লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানানো ছিল।

সেলিম সি পি আই( এম) দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার দায়িত্বভার নেয়ার পরেই তৃণমূলের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বালিগঞ্জ কেন্দ্রে ভোট হয়। প্রয়াত সোমেন মিত্রের দলের স্বার্থ ব্যতিরেকে ,ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার গুরুত্ব না বুঝে বিমান বসুর আসন সমঝোতাকে অসংসদীয় কটাক্ষ দুই দলেরই নেতৃত্ব থেকে কর্মী প্রত্যেকের ভেতরেই এমন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যে, তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ভাঙার প্রশ্নে সেলিমের আহ্বানে সাড়া দেয়ার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার পথে সেদিন হাঁটেনি কংগ্রেস।ফলে ভোট কাটাকাটির জেরে আসানসোল দাঙ্গার নায়ক বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি থেকে তৃণমূল হয়েও জিতে যায় সেদিন। কিন্তু সি পি আই ( এম) প্রার্থীর ভোট বৃদ্ধিটা ছিল ইঙ্গিতবাহী।

সেলিম তার দলের দায়িত্ব নেয়ার পর নিজের রাজনৈতিক মেধা, সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাজী না করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা, প্রখর বাস্তববোধ, প্রজ্ঞা, পরিশ্রম, সর্বোপরি ওপর চালাকিবিহীন রাজনীতির ভেতর দিয়ে মাত্র এক বছরের ভেতরে বামপন্থী রাজনীতিকে যে জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন, সে জায়গাতে ’১১য় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামপন্থীরা আগে আদৌ পৌঁছাতে পারেনি। সেলিমের এই যে ব্যক্তিবিদ্বেষ বিহীন রাজনৈতিক স্বভাব, এই ধারার সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির পরিচয় অনেককাল ঘুঁচে গিয়েছিল। অতীতের কমিউনিস্টদের মতো এই যে অন্তহীন সমুদ্রের মতো ব্যাপ্তি ও গভীরতার হৃদয় নিয়ে রাজনীতি করা মানুষ, এমন মানুষ শুধু বামপন্থীরাই নন, যারা বামপন্থী পরিমন্ডলের নন- তারাও বহুকাল পশ্চিমবঙ্গে পাননি। ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, সদর-মফস্বলে সেলিম গেলে, রাজনৈতিক ভাবনায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা মানুষ ও সেলিমের একটু সান্নিধ্য পেতে তার কাছে ছুটে যান। আলাপ করেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেলিম ও বিরোধী শিবিরের মানুষ জেনেও তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন। কেউ সেলফি তুলতে এলে , হাসি মুখে সেলফি তোলেন। আগন্তুকের ক্যামেরা ছুড়ে ফেলে দেন না।

দিমিট্রভের তত্ত্ব বাংলায় সময়োপযোগী করে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। তার ই ফসল দীর্ঘ দিনব্যাপী বামফ্রন্ট সরকার। ভারতের হিন্দি বলয়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাম রাজনীতি বিকাশের সমস্ত লক্ষণ সত্ত্বেও দিমিট্রভের তত্ত্বকে বাস্তবের রাজনীতিতে প্রয়োগ করার মতো ‘প্রমোদ দাশগুপ্ত’ সেখানে ছিলেন না- ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়ে একদিন রাইটার্সে নিজের ঘরে বসে বলেছিলেন সেলিম। আজ মনে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের পরে মনে হয়, সাতের দশকে দিমিট্রভের যুক্তফ্রন্টের তত্ত্বকে সঠিকভাবে বাংলার বুকে প্রয়োগের সঠিক রূপকার প্রমোদ দাশগুপ্তই যেন নতুনভাবে ফিরে এসেছেন মহ. সেলিমের ভেতরে।

বামফ্রন্টের জন্মলগ্নে সবকিছু ভেস্তে দিতে প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে সেই সময়ের জনতা পার্টির আসন ঘিরে অন্যায় জেদ ধরাবার নেপথ্যে থাকা অশোককৃষ্ণ দত্ত দের ভূমিকা নিজের চোখে দেখেছি বলেই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলব, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতির বাস্তবতার নিরিখে সেলিম যে শুধু নেতাদের ঐক্য নন, যুগ্মভাবে ভূমিস্তরে কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেন, এটা বিগত ২০১৬ বা ২০১৯ এর বিধানসভা ভোটে সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা কী বাম, কী কংগ্রেস- কোনো দলের নেতারাই পারেননি।

সোমেন মিত্রের মতো যেমন আমহার্স্ট স্ট্রিট আর মৌলালীর বিধান ভবনে বসে দল পরিচালনা করেন না অধীর বাবু, তেমনই শুধু আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আর ফেসবুক- টুইটার দিয়েও দল চালান না সেলিম। তাই সেলিম অধীর ফ্যাক্টর আগামী দিনে বাংলায় কী মাঠঘাটের রাজনীতি, কী সংসদীয় রাজনীতিতে একটা বদল আনবেই আনবে। বামপন্থী মহল এবং কংগ্রেসের ভেতরে অনেক ‘টগর বোস্টমী’ আছে, যারা একদিকে ক্ষমতার জন্যে আঁকুপাকু করছে, অপর দিকে তাত্ত্বিকভাবে বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা দুই শিবিরের ভোট রাজনীতিতে বোঝাপড়া ঘিরেও তাদের দশা, ‘শুচি বামনীর হাজার মরণ, হেগো কাপড়ে দুগ্গা স্মরণ।’

বিগত ’১৯ এর বিধানসভা ভোটে ‘গ্রেটার ইভল’ তত্ত্ব নামিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল সি পি আই এম এল লিবারেশন। বিহার বিধানসভার ভোটে এক নীতি আর পশ্চিমবঙ্গে আর এক নীতি নিয়ে মমতাকে জিততে সাহায্য করলেও সাগরদিঘি জয়ের পরে সেলিম প্রকাশ্যে লিবারেশনের নাম করে বলেছেন, বিজেপি-তৃণমূলবিরোধী কোনো রাজনৈতিক শক্তিই অচ্ছুৎ নয়। সেলিমের এই বাস্তববোধই একজন প্রকৃত বামপন্থী নেতার বৈশিষ্ট্য। আই এস এফের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করে গত বিধানসভার ভোটে বামেরা যে লড়েছিল তা সেলিমের একার সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনো কোনো ব্যক্তিবিশেষ একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।অথচ, ভোটে সুফল না পেয়ে, ধর্মীয় পরিচয় তুলেও একাংশের বামপন্থীরাই সেলিমকে বিদ্ধ করতে, হেনস্তা করতে কম চেষ্টা করেনি।

যে ধর্ম আর জাতিসত্তার তাস খেলে মমতার রাজনীতি, তাতে ধস নামাতে আই এস এফ এবং নওশাদ সিদ্দিকি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছেন মাত্র এক বছর সময়ের ভেতরেই। আর এস এসের গেম প্ল্যানে যে মুসলমান সমাজকে মমতা ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ ভেবেছিলেন, নওশাদ কে জেলে পুড়ে রেখার দায় মমতাকে সেই মুসলমান সমাজই চুকিয়ে দিয়েছে সাগরদিঘিতে। সেই নওশাদ মমতার পুলিশের বেড়াজাল ছিঁড়ে মুক্তি পেয়েছেন হাইকোর্টের নির্দেশে। আলিপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে জেল গেটে গিয়ে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন সেলিম।

এমনটাও কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে আসার পর বামফ্রন্টের প্রথম সারির কোনো নেতার আচরণের ভেতরে দেখতে পাওয়া যায়নি। শরিকদলগুলোকে বামফ্রন্টের ভেতরে মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে যে কিংবদন্তি ভূমিকা রেখেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, একই ভূমিকা মন্ত্রীসভার ভেতরে পালন করে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। এই দুই নেতার সমন্বয়বাদী, বাস্তবমুখী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চরিত্রের সমন্বয় হলেন সেলিম। আমার পাশের শহরের প্রবীণ নেতা মলয় ভট্টাচার্য বলছিলেন; নৈহাটিতে জিবি করতে এসেছেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। সে সময়ের চব্বিশ পরগণার বাঘে গরুকে একঘাটে জল খাওয়ানো নেতা গোপাল বসু বললেন প্রমোদ বাবু কে; চলেন, বাড়িতে কমলা (গোপালপত্নী) লাউ চিংড়ি রাঁধছে। প্রমোদ বাবু বললেন; ছাড়েন আপনার লাউ চিংড়ি। কমরেডদের আনা চপ মুড়িই আমার অমৃত।

বেশি তেল মশলার খাবার খান না সেলিম। এমনকি বারবার চা-ও নয়। বলেন, মেশিনে বেশি অয়েল দিতে নেই। সেই মানুষটিই শহীদ স্মরণে মিটিং করে ফেরার পথে শরীরের কথা ভেবেও ববি রক্ষিতের বাড়িয়ে দেয়া তেলে ভাজার ঠোঙাটা ফেরাতে পারলেন না। পথে খেয়ে নিলেন।

[লেখক: ভারতীয় ইতিহাসবিদ]