মূলধন সংকটে বন্ধ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক

বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। মূলধন সংকটের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এর ব্যাংকিং কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে ২০০৮ সালের আবারও ব্যাংকিং খাতে বড় বিপর্যয় দেখল যুক্তরাষ্ট্র।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এই ব্যাংকটি যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যাংকগুলোর একটি। সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি খাতের বড় কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের ঋণ আসতো এই ব্যাংক থেকে। বর্তমানে ব্যাংকটির যাবতীয় আমানতের নিয়ন্ত্রণ ইউএস ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সুরেন্স করপোরেশনের (এফডিআইসি) হাতে চলে গেছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। সিলিকন ভ্যালিতে এই ব্যাংকের কর্তৃত্ব গ্রহণের সংবাদে শিল্পকারখানায় এক ধরনের হতাশা নেমে এসেছে। ব্যাংকের গ্রাহকরা অজানা আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছেন বলে সব গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। এ ব্যর্থতার জের হিসেবে অচিরেই আরও কয়েকটি ব্যাংকে তালা ঝুলতে পারে বলে অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকে জমা করা অর্থের কী হবে, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেক কোম্পানি ও আমানতকারী। এফডিআইসি বলছে, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারী বা পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এসভিবির বীমাকৃত আমানত রক্ষা করবে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ন্যাশনাল ব্যাংক অব সান্তা ক্লারা।

এফডিআইসি সাধারণত প্রত্যেক আমানতকারীর আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত রক্ষা করে। তারা বলছে, বীমাহীন আমানতকারীরা তাদের অর্থের বিপরীতে প্রত্যয়নপত্র পাবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে অগ্রিম লভ্যাংশ হিসেবে এদের অর্থ পরিশোধ করা হবে। সিলিকন ভ্যালির সম্পদ বিক্রির সম্ভাব্য লভ্যাংশ থেকে তাদের অর্থ পরিশোধ করা হবে।

গত ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত এসভিবির সম্পদ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলারের এবং আমানত ছিল ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এসভিবির চাকা ঘোরা বন্ধ হতে থাকে গত বুধবার থেকে। এদিন ব্যাংক এক ঘোষণায় জানায়, কিছু সম্পদ বিক্রি করে তাদের ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করতে ২২৫ কোটি ডলারের নতুন শেয়ার বিক্রি করবে তারা। ওই ঘোষণার পর প্রধান কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেয় তারা। এতে এসভিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। এ ব্যাংকটি প্রযুক্তিখাতে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে মার্কিন নীতি সুদ হার বৃদ্ধির পর এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না ব্যাংকটি। সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠলে ব্যাংকের গ্রাহকরা তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে শুরু করেন।

এর মূল কারণ গুজব। গত বুধবার হঠাৎ শোনা যায়, গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে, ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের কিনারা করতেই প্রয়োজন অন্তত ২২৫ কোটি ডলার। এ গুজব ছড়িয়ে পড়তেই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার গ্রাহক টাকা তুলে নেন ব্যাংকটি থেকে।

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার এসভিপির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেয়ার পর এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার পর অবশ্য গ্রাহকদের অনেকেই আফসোস করছেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং ও আর্থিক পরিষেবাখাতের বিনিয়োগকারী রায়ান ফ্ল্যাভেই বলেন, ইউনিয়ন স্কয়্যার ভেঞ্চার্স এবং কোচুয়ে ম্যানেজমেন্টসহ কিছু মার্কিন আর্থিক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এই গুজব ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত। তারা এসভিবির বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে বলেন, ‘এসভিপি গুরুতর তারল্য সংকটে ভুগছে। যদি ব্যাংকটিতে আপনার টাকা থেকে থাকে— দ্রুত তুলে নিন।’

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ইমেইলের স্ক্রিনশট খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। গ্রাহকরাও কোন কিছু চিন্তা না করে ব্যাংক কার্যালয় কিংবা এটিম বুথ থেকে সমানে নিজেদের আমানতের টাকা তুলে নেয়া শুরু করেন।

রায়ান ফ্ল্যাভেই বলেন, ‘কেউ যদি আপনাকে বলে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিন, দেরি করলে সেই টাকার কোন হিসাব আর পাবেন না আপনি কী করবেন?’

‘মানুষজন হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মতো টাকা তুলেছে। কোন জনসমাগম পূর্ণ থিয়েটার রুমে হঠাৎ খানিকটা ধোঁয়া দেখা গেলে কেউ যদি আগুন বলে চিৎকার করেন সেক্ষেত্রে ওই থিয়েটারে যেমন হুটোপুটি শুরু হয়, এখানকার অবস্থাও ছিল অনেকটা তেমনি।’

সিলিকন ভ্যালি মূলত নতুন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদান ও সহায়তা করতো।

রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩ , ২৭ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৯ শবান ১৪৪৪

মূলধন সংকটে বন্ধ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক

মামুনুর রশিদ, সংবাদ ডেস্ক

image

বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। মূলধন সংকটের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এর ব্যাংকিং কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে ২০০৮ সালের আবারও ব্যাংকিং খাতে বড় বিপর্যয় দেখল যুক্তরাষ্ট্র।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এই ব্যাংকটি যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যাংকগুলোর একটি। সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি খাতের বড় কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের ঋণ আসতো এই ব্যাংক থেকে। বর্তমানে ব্যাংকটির যাবতীয় আমানতের নিয়ন্ত্রণ ইউএস ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সুরেন্স করপোরেশনের (এফডিআইসি) হাতে চলে গেছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। সিলিকন ভ্যালিতে এই ব্যাংকের কর্তৃত্ব গ্রহণের সংবাদে শিল্পকারখানায় এক ধরনের হতাশা নেমে এসেছে। ব্যাংকের গ্রাহকরা অজানা আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছেন বলে সব গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। এ ব্যর্থতার জের হিসেবে অচিরেই আরও কয়েকটি ব্যাংকে তালা ঝুলতে পারে বলে অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকে জমা করা অর্থের কী হবে, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেক কোম্পানি ও আমানতকারী। এফডিআইসি বলছে, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারী বা পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এসভিবির বীমাকৃত আমানত রক্ষা করবে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ন্যাশনাল ব্যাংক অব সান্তা ক্লারা।

এফডিআইসি সাধারণত প্রত্যেক আমানতকারীর আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত রক্ষা করে। তারা বলছে, বীমাহীন আমানতকারীরা তাদের অর্থের বিপরীতে প্রত্যয়নপত্র পাবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে অগ্রিম লভ্যাংশ হিসেবে এদের অর্থ পরিশোধ করা হবে। সিলিকন ভ্যালির সম্পদ বিক্রির সম্ভাব্য লভ্যাংশ থেকে তাদের অর্থ পরিশোধ করা হবে।

গত ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত এসভিবির সম্পদ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলারের এবং আমানত ছিল ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এসভিবির চাকা ঘোরা বন্ধ হতে থাকে গত বুধবার থেকে। এদিন ব্যাংক এক ঘোষণায় জানায়, কিছু সম্পদ বিক্রি করে তাদের ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করতে ২২৫ কোটি ডলারের নতুন শেয়ার বিক্রি করবে তারা। ওই ঘোষণার পর প্রধান কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেয় তারা। এতে এসভিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। এ ব্যাংকটি প্রযুক্তিখাতে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার মুখে মার্কিন নীতি সুদ হার বৃদ্ধির পর এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না ব্যাংকটি। সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠলে ব্যাংকের গ্রাহকরা তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে শুরু করেন।

এর মূল কারণ গুজব। গত বুধবার হঠাৎ শোনা যায়, গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে, ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের কিনারা করতেই প্রয়োজন অন্তত ২২৫ কোটি ডলার। এ গুজব ছড়িয়ে পড়তেই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার গ্রাহক টাকা তুলে নেন ব্যাংকটি থেকে।

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার এসভিপির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেয়ার পর এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার পর অবশ্য গ্রাহকদের অনেকেই আফসোস করছেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং ও আর্থিক পরিষেবাখাতের বিনিয়োগকারী রায়ান ফ্ল্যাভেই বলেন, ইউনিয়ন স্কয়্যার ভেঞ্চার্স এবং কোচুয়ে ম্যানেজমেন্টসহ কিছু মার্কিন আর্থিক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এই গুজব ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত। তারা এসভিবির বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে বলেন, ‘এসভিপি গুরুতর তারল্য সংকটে ভুগছে। যদি ব্যাংকটিতে আপনার টাকা থেকে থাকে— দ্রুত তুলে নিন।’

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ইমেইলের স্ক্রিনশট খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। গ্রাহকরাও কোন কিছু চিন্তা না করে ব্যাংক কার্যালয় কিংবা এটিম বুথ থেকে সমানে নিজেদের আমানতের টাকা তুলে নেয়া শুরু করেন।

রায়ান ফ্ল্যাভেই বলেন, ‘কেউ যদি আপনাকে বলে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিন, দেরি করলে সেই টাকার কোন হিসাব আর পাবেন না আপনি কী করবেন?’

‘মানুষজন হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মতো টাকা তুলেছে। কোন জনসমাগম পূর্ণ থিয়েটার রুমে হঠাৎ খানিকটা ধোঁয়া দেখা গেলে কেউ যদি আগুন বলে চিৎকার করেন সেক্ষেত্রে ওই থিয়েটারে যেমন হুটোপুটি শুরু হয়, এখানকার অবস্থাও ছিল অনেকটা তেমনি।’

সিলিকন ভ্যালি মূলত নতুন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদান ও সহায়তা করতো।