উত্তাল মার্চপাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল

১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের দ্বাদশ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থল বর্জন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা এবং সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো অব্যাহত থাকে।

ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে তাদের তেমন গতিবিধি ছিল না। পেশাজীবীরা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এদিন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করেন।

ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি জানি শেখ মুজিবর রহমান কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখুন।’

চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের নেতা ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত খাদ্য বোঝাই মার্কিন জাহাজের গতি বদলে করাচি পাঠানোর ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা প্রকাশ করেন।

বগুড়া কারাগার ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। এদিন জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে স্বদেশে পাঠানো হয়। সিএসপি ও ইপিসি সমিতি বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। এই দুই সমিতির কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে তাদের একদিনের বেতন জমা দেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এইদিন ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অপচেষ্টা বন্ধের নির্দেশ দেয়।

এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় পটুয়া কামরুল হাসান শাপলাকে জাতীয় ফুল হিসেবে প্রস্তাব করেন। সভায় তার প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ’।

একাত্তরের এদিন বিকেল ৫টায় জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) থেকে আবার বের হয় উদীচীর গণসংগীত স্কোয়াড। গণসংগীত স্কোয়াডের পাশাপাশি উদীচীর পথনাটক ‘সামনে লড়াই’ মঞ্চস্থ করতে থাকে। কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে এ নাটকের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন বিভিন্ন স্থানে। এ সময় উদীচীর আলাদা আলাদা কোন বিভাগ ছিল না। যে শিল্পীরা গান করতেন তারাই আবার নাটক করতেন। কেউ কেউ আবার আবৃত্তি পরিবেশন করতেন। এ সময় উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা গান, নাটকের পাশাপাশি সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ কবিতা দুটি বেশি বেশি আবৃত্তি করতেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩ , ২৭ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৯ শবান ১৪৪৪

উত্তাল মার্চপাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল

সাদেকুর রহমান

১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের দ্বাদশ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারীদের কর্মস্থল বর্জন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা এবং সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো অব্যাহত থাকে।

ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে তাদের তেমন গতিবিধি ছিল না। পেশাজীবীরা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এদিন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করেন।

ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি জানি শেখ মুজিবর রহমান কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখুন।’

চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের নেতা ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য প্রেরিত খাদ্য বোঝাই মার্কিন জাহাজের গতি বদলে করাচি পাঠানোর ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা প্রকাশ করেন।

বগুড়া কারাগার ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। এদিন জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে স্বদেশে পাঠানো হয়। সিএসপি ও ইপিসি সমিতি বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। এই দুই সমিতির কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে তাদের একদিনের বেতন জমা দেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এইদিন ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অপচেষ্টা বন্ধের নির্দেশ দেয়।

এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় পটুয়া কামরুল হাসান শাপলাকে জাতীয় ফুল হিসেবে প্রস্তাব করেন। সভায় তার প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ’।

একাত্তরের এদিন বিকেল ৫টায় জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) থেকে আবার বের হয় উদীচীর গণসংগীত স্কোয়াড। গণসংগীত স্কোয়াডের পাশাপাশি উদীচীর পথনাটক ‘সামনে লড়াই’ মঞ্চস্থ করতে থাকে। কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে এ নাটকের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন বিভিন্ন স্থানে। এ সময় উদীচীর আলাদা আলাদা কোন বিভাগ ছিল না। যে শিল্পীরা গান করতেন তারাই আবার নাটক করতেন। কেউ কেউ আবার আবৃত্তি পরিবেশন করতেন। এ সময় উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা গান, নাটকের পাশাপাশি সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ কবিতা দুটি বেশি বেশি আবৃত্তি করতেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।