২০১৫ সালের মার্চে শরীয়তপুরের জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী চাঁদনী আক্তার হেনাকে ধর্ষণের পর হত্যার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের শনাক্তপূর্বক বিচারের আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন। এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ।
মামলার নথি সূত্রের তথ্যানুযায়ী, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার ছোট মুলনা গ্রামের আজগর খানের মেয়ে ও জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী চাঁদনী আক্তার হেনা ২০১৫ সালের ১১ মার্চ একই গ্রামের বাসিন্দা বান্ধবী পাখি আক্তারের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। পরে বান্ধবী পাখি বাড়িতে ফিরলেও চাঁদনী আর ফিরে আসেনি। পরে তিনদিন পর চাঁদনীর লাশ বাড়ির কাছেই একটি পরিত্যক্ত খালে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় চাঁদনীর বাবা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে জাজিরা থানায় মামলা করেন। এরপর তিন মাস পর তিনি শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৯ জনকে আসামি করে পুনরায় মামলা করেন। আসামিরা ছিলেন মোসা. পাখি আক্তার, মিলন ওরফে দুলাল মাদবর, জুয়েল ঢালী, মাসুদ বেপারী, ওয়াসিম তালুকদার, সোহেল ঢালী, রাজন, রুবেল তালুকদার, তোতা বেপারী। এরপর ২০১৭ সালের ১৪ জুন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে প্রধান আসামি মোসা. পাখি আক্তার ও মিলন ওরফে দুলাল মাদবরসহ ৪ জনকে বাদ দিয়ে মাসুদ ব্যাপারী, ওয়াসিম তালুকদার, জুয়েল ঢালী, রুবেল তালুকদার ও রাজন পাঠান নামের পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তখন মামলার বাদী হত্যাকন্ডের শিকার শিক্ষার্থীর বাবা আজগর খান আদালতে পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করার কথা জানালেও গত ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ব্রেইন স্ট্রোকজনিত কারণে মারা যাওয়ায় তা আর করতে পারেননি।
এরপর ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুস সালাম এই মামলাটির রায় ঘোষণা করেন সেখানে সব আসামিদের বেকসুর খালাস দিয়ে রায়ে উল্লেখ করা হয় কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাদীপক্ষের এক আইনজীবী বলেন, মামলাটির রায়ের আগে সিআইডির যে কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন, তার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি এবং আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার কারণে বিচারিক পর্যায়ে এসে মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে সব আসামিরা খালাস পেয়েছে।
চাঁদনীর মা শরীফা বেগম বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে কুকুর-শিয়ালের দল চিরে খেয়েছে, ওরা এখন আমার পরিবারকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে বেড়াচ্ছে। আমার ছোট মেয়টাকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাই। আমার বড় ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী আরেক ছেলে ঢাকা থাকে। ঢাকায় থাকা ছেলে ঠিকমত বাড়িতে এসে থাকতে পারে না। বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হয়। আমি আমার মেয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে মরতে চাই।’
জাজিরা উপজেলার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘এত বড় নৃশংসতার ঘটনায় প্রশাসন ৮ বছরেও অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারল না। এতে বুঝা যাচ্ছে আমরা কেউ নিরাপদ নই। আমাদের সন্তানরা নিরাপদ নয়। আমরা এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
চাঁদনীর বড় ভাই মো. ইকবাল খান মালয়েশিয়া থেকে মুঠোফোনে সংবাদকে বলেন, ‘আমার বোনকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। আমি প্রবাসে থাকার কারণে মামলার বিষয়টি নিয়ে কারো সহযোগিতা পাচ্ছি না। এজন্য প্রয়োজনে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আইনি লড়াই শুরু করবো। এ লড়াইয়ে আমি ও আমার পরিবার সবার সহযোগিতা চাই।
এদিকে ২০১৫ সালে চাঁদনী আক্তার হেনাকে ধর্ষণের পর হত্যার মতো নৃশংস ঘটনায় দ্রুত হত্যাকারীদের বিচার বাস্তবায়নের দাবিতে গঠিত ‘নারী নির্যাতন দমন চাঁদনী মঞ্চ’ চাঁদনীর অধ্যয়নকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আগামী ১৪-১৫ মার্চ কালো ব্যাচ ধারণসহ বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩ , ২৭ ফাল্গুন ১৪২৯, ১৯ শবান ১৪৪৪
মো. পলাশ খান, শরীয়তপুর (জাজিরা)
২০১৫ সালের মার্চে শরীয়তপুরের জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী চাঁদনী আক্তার হেনাকে ধর্ষণের পর হত্যার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও অপরাধীদের শনাক্তপূর্বক বিচারের আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন। এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ।
মামলার নথি সূত্রের তথ্যানুযায়ী, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার ছোট মুলনা গ্রামের আজগর খানের মেয়ে ও জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী চাঁদনী আক্তার হেনা ২০১৫ সালের ১১ মার্চ একই গ্রামের বাসিন্দা বান্ধবী পাখি আক্তারের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। পরে বান্ধবী পাখি বাড়িতে ফিরলেও চাঁদনী আর ফিরে আসেনি। পরে তিনদিন পর চাঁদনীর লাশ বাড়ির কাছেই একটি পরিত্যক্ত খালে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় চাঁদনীর বাবা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে জাজিরা থানায় মামলা করেন। এরপর তিন মাস পর তিনি শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৯ জনকে আসামি করে পুনরায় মামলা করেন। আসামিরা ছিলেন মোসা. পাখি আক্তার, মিলন ওরফে দুলাল মাদবর, জুয়েল ঢালী, মাসুদ বেপারী, ওয়াসিম তালুকদার, সোহেল ঢালী, রাজন, রুবেল তালুকদার, তোতা বেপারী। এরপর ২০১৭ সালের ১৪ জুন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে প্রধান আসামি মোসা. পাখি আক্তার ও মিলন ওরফে দুলাল মাদবরসহ ৪ জনকে বাদ দিয়ে মাসুদ ব্যাপারী, ওয়াসিম তালুকদার, জুয়েল ঢালী, রুবেল তালুকদার ও রাজন পাঠান নামের পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তখন মামলার বাদী হত্যাকন্ডের শিকার শিক্ষার্থীর বাবা আজগর খান আদালতে পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করার কথা জানালেও গত ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ব্রেইন স্ট্রোকজনিত কারণে মারা যাওয়ায় তা আর করতে পারেননি।
এরপর ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুস সালাম এই মামলাটির রায় ঘোষণা করেন সেখানে সব আসামিদের বেকসুর খালাস দিয়ে রায়ে উল্লেখ করা হয় কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাদীপক্ষের এক আইনজীবী বলেন, মামলাটির রায়ের আগে সিআইডির যে কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন, তার সাক্ষ্য নেয়া হয়নি এবং আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার কারণে বিচারিক পর্যায়ে এসে মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে সব আসামিরা খালাস পেয়েছে।
চাঁদনীর মা শরীফা বেগম বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে কুকুর-শিয়ালের দল চিরে খেয়েছে, ওরা এখন আমার পরিবারকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে বেড়াচ্ছে। আমার ছোট মেয়টাকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাই। আমার বড় ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী আরেক ছেলে ঢাকা থাকে। ঢাকায় থাকা ছেলে ঠিকমত বাড়িতে এসে থাকতে পারে না। বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হয়। আমি আমার মেয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে মরতে চাই।’
জাজিরা উপজেলার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘এত বড় নৃশংসতার ঘটনায় প্রশাসন ৮ বছরেও অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারল না। এতে বুঝা যাচ্ছে আমরা কেউ নিরাপদ নই। আমাদের সন্তানরা নিরাপদ নয়। আমরা এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
চাঁদনীর বড় ভাই মো. ইকবাল খান মালয়েশিয়া থেকে মুঠোফোনে সংবাদকে বলেন, ‘আমার বোনকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। আমি প্রবাসে থাকার কারণে মামলার বিষয়টি নিয়ে কারো সহযোগিতা পাচ্ছি না। এজন্য প্রয়োজনে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আইনি লড়াই শুরু করবো। এ লড়াইয়ে আমি ও আমার পরিবার সবার সহযোগিতা চাই।
এদিকে ২০১৫ সালে চাঁদনী আক্তার হেনাকে ধর্ষণের পর হত্যার মতো নৃশংস ঘটনায় দ্রুত হত্যাকারীদের বিচার বাস্তবায়নের দাবিতে গঠিত ‘নারী নির্যাতন দমন চাঁদনী মঞ্চ’ চাঁদনীর অধ্যয়নকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাজিরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আগামী ১৪-১৫ মার্চ কালো ব্যাচ ধারণসহ বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক কর্মসূচির আয়োজন করেছে।