উত্তাল মার্চশিল্পাচার্য জয়নুলের পাকিস্তান সরকারের খেতাব-পদক বর্জন

১৯৭১ সালের মার্চ মানেই দ্রোহ আর প্রতিবাদের আগুন ঝরা মাস। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক হয়ে উঠে প্রতিটি বাঙালি। রাজপথে মিছিলের পর মিছিল। মার্চের ত্রয়োদশ দিনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল- প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন। একই দিন সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিমও পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।

এদিন ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে।

সামরিক নির্দেশ জারির পর পরই মুক্তিকামী বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচন্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেয়ার শামিল।’

ঢাকার জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মোট ২৬৫ জন বিদেশি নাগরিক বিশেষ বিমানে ঢাকা (বাংলাদেশ) ত্যাগ করেন।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারের সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসভবনে শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও ফজলুল হক মণির সঙ্গে বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে কলকাতার ভবানীপুরের নর্দান পার্কের ২১ রাজেন্দ্র রোডের একটি বাসার ঠিকানা দেন এবং বলেন এই বাসাই হবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মূলকেন্দ্র। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা প্রথমে এই বাসাতেই উঠেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ সারাদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এদিন। বৈঠকে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, কাজী আরেফ আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতাদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের গোপনে যোগাযোগ হচ্ছিল। অফিসাররা আঁচ করতে পারছিলেন কী হতে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছিলেন অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে তাদেরকে নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া চলছিল। ফলে সময় ও সুযোগ বুঝে আত্মগোপন ও পাল্টা আক্রমণ করতে তারাও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩ , ২৮ ফাল্গুন ১৪২৯, ২০ শবান ১৪৪৪

উত্তাল মার্চশিল্পাচার্য জয়নুলের পাকিস্তান সরকারের খেতাব-পদক বর্জন

সাদেকুর রহমান

১৯৭১ সালের মার্চ মানেই দ্রোহ আর প্রতিবাদের আগুন ঝরা মাস। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক হয়ে উঠে প্রতিটি বাঙালি। রাজপথে মিছিলের পর মিছিল। মার্চের ত্রয়োদশ দিনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল- প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন। একই দিন সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিমও পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।

এদিন ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে।

সামরিক নির্দেশ জারির পর পরই মুক্তিকামী বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচন্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেয়ার শামিল।’

ঢাকার জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মোট ২৬৫ জন বিদেশি নাগরিক বিশেষ বিমানে ঢাকা (বাংলাদেশ) ত্যাগ করেন।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারের সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বাসভবনে শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও ফজলুল হক মণির সঙ্গে বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে কলকাতার ভবানীপুরের নর্দান পার্কের ২১ রাজেন্দ্র রোডের একটি বাসার ঠিকানা দেন এবং বলেন এই বাসাই হবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মূলকেন্দ্র। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা প্রথমে এই বাসাতেই উঠেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ সারাদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এদিন। বৈঠকে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, কাজী আরেফ আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতাদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের গোপনে যোগাযোগ হচ্ছিল। অফিসাররা আঁচ করতে পারছিলেন কী হতে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছিলেন অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে তাদেরকে নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া চলছিল। ফলে সময় ও সুযোগ বুঝে আত্মগোপন ও পাল্টা আক্রমণ করতে তারাও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।