নারীর কর্মদক্ষতায় আইসিটি ও স্টেম শিক্ষা

মাহমুদুল হাছান

হাইটেক এবং কম্পিউটারাইজড বিশ্বের এই যুগে, আইসিটি এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়ার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং সকল ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সাধনের জন্য, বাংলাদেশকে অবশ্যই নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে শিক্ষিত করার ওপর বেশি জোর দিতে হবে যাতে করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুত করা যায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতায়নের জন্য নারী শিক্ষা আরও গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষাও প্রয়োজনীয়। এসডিজিতে মানসম্পন্ন শিক্ষার উন্নয়নে নারী শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা শুধুমাত্র আইসিটি এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। আইসিটি এবং স্টেম শিক্ষার মাধ্যমে, নারীরা শুধু তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে এবং তাদের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় না, বরং নারীদের বৃহত্তর উপস্থিতির মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি হয়। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার কিছুটা উন্নতি হলেও উচ্চ শিক্ষায় তাদের অগ্রগতি অনেক কম। বিবিএসের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সাক্ষরতার হারে নারীদের চেয়ে এগিয়ে আছেন দেশের পুরুষরা। বর্তমানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬.৫৬ শতাংশ হলেও নারীদের সাক্ষরতা ৭২.৮২ শতাংশ। জনশুমারী ও গৃহগণনা-২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষের আনুপাতিক হারে নারীরা এগিয়ে। তবে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নারীরা এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার হারে তারা অনেক পিছিয়ে। আইটি শিক্ষায় তাদের অবস্থান আরো নাজুক। সম্প্রতি বেসিস সফট এক্সপো উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত ‘ইনক্লুসন অফ উইমেন ইন স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় গবেষকরা বলেন, গ্রাম ও শহরে পুরুষের তুলনায় নারীরা উচ্চশিক্ষার দিক থেকে এখনো পিছিয়ে। বর্তমানে ৩০ শতাংশ নারী শুধু আইটি নিয়ে পড়াশোনা করে। দেশে ১২ শতাংশ নারী আইটি প্রফেশনাল। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা যাতে আইটিতে পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য তাদের বেশি করে পড়াশোনা করার জন্য বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে।্

বাংলাদেশে নারী শিক্ষাকে একটি আদর্শ অবস্থানে আনতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে নারীদের আইসিটি ও স্টেম শিক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। একটি জরীপে দেখা যায়, বাংলাদেশে জনসংখ্যার সিংহভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই অদক্ষ বা আধা-দক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। অনেক মহিলা যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে, এমনকি তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতার অভাবের কারণে শোষিত হয়। আইটি শিক্ষা নারীদের সঠিক চাকরি এবং তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করার আত্মবিশ্বাস দিতে সাহায্য করে। তারা পরিবারের আয়ের অবদানকারী হয়ে ওঠে যা তাদের মতামত প্রকাশ করার শক্তি দেয়।

আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা প্রকৃত অর্থে যে কোন নারীর চোখ খুলে দিতে পারে। এটি তাকে বিভিন্ন শৃঙ্খলার পথ দেখিয়ে দেয় এবং তাকে চেঞ্জমেকার হওয়ার জ্ঞান দিয়ে ক্ষমতায়ন করে। আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা একজন নারীকে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তার ন্যয্য অধিকার আদায় করতে শেখায়। এটি তাকে তার নিজের মানসিক যন্ত্রণা দূর করতে সাহায্য করে এবং কুসংস্কার এবং গোঁড়া বিশ্বাসকে প্রতিহত করতে শেখায়। এ শিক্ষা নারীদের উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে, তারা তাদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পুরুষদের সমান।

ইন্টারনেট এবং ই-কমার্সের যুগে গ্রামীণ নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের তাদের নিজস্ব ই-কমার্স এবং অন্যান্য ব্যবসা স্থাপনে আর্থিক স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করার জন্য অসংখ্য সুযোগ তৈরি করেছে, যা শেষপর্যন্ত তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সহায়ক। মোবাইল এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারা এ সুবিধা নিশ্চিত করা যায় যে, নারীরা তাদের বাড়িতে অবস্থান করে আরও সহজে তাদের ঘরের পাশাপাশি তাদের ক্যারিয়ারের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।

হামাদুন তোরে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের মহাসচিব বলেছেন, নারীদের আইসিটির শিক্ষা দেয়া অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আইসিটি শিক্ষা ও চাকরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সহজতর করে এবং স্বাস্থ্যসেবার অ্যাক্সেস এবং অর্থনীতি ও নাগরিক সমাজে তাদের অংশগ্রহণ উন্নত করে। আইসিটিতে নারীদের উৎসাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মানুষের যোগাযোগ, ব্যবসা করার এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করার পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। আইসিটি সেক্টর বিপুল সংখ্যক চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জিং ক্যারিয়ার তৈরি করেছে। আইসিটি সেক্টরে, ভৌত সম্পদের পরিবর্তে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এভাবে এই শিল্পটি বৈষম্যহীন। আইসিটি পুরুষ, মহিলা, সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে, লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে অগ্রসর করা যেতে পারে, নারীদের তথ্য খোঁজার এবং শেয়ার করার, স্বাস্থ্য সহায়তা এবং শিক্ষামূলক পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেস, আয় তৈরি, সহযোগিতা এবং তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ প্রদান করে। প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের অভাব অনেক মহিলাকে ডিজিটাল সুযোগগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হতে বাধা দেয়।

তথ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়া, বিতরণ এবং রূপান্তর করতে ব্যবহৃত পণ্য, অ্যাপ্লিকেশন এবং পরিষেবাগুলোর একটি জটিল সেটকে আইসিটি অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন প্রযুক্তির ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, শাসন ব্যবস্থার উন্নতি, বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে চারটি ভিন্ন ক্ষেত্রে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নারীদের জীবনের জন্য আইসিটির উপকারিতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান প্রমাণ রয়েছে। নারীদের জন্য বিশ্বব্যাপী, আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্বাস্থ্য উদ্যোগকে সহজতর করার জন্য আইটির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, স্বাস্থ্য প্রচারকারীরা যৌন এবং প্রজনন অধিকারসহ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের জন্য প্রযুক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার করেছে। আইটিতে কমিউনিটি অ্যাক্সেস পয়েন্টের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত স্বাস্থ্য তথ্য নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে ইদানীং স্টেম শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (ঝঞঊগ) বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নারীর কর্মশক্তি বাড়াবে। স্টেম শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। প্রযুক্তির বিকাশ মানব সভ্যতাকে প্রগতিশীল করেছে। স্টেম শিক্ষা মানুষের সৃজনশীলতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্টেম শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বলা যায়, মানুষের মধ্যে উন্নতমানের টিম ওয়ার্ক, উন্নত যোগাযোগ, কোনো কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, যেকোনো সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি ডিজিটাল জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাই হচ্ছে স্টেম শিক্ষার কাজ। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। স্টেম শিক্ষা এক সময়কার সনাতনী নিয়মে পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রবণতাকে কমিয়ে এনেছে। নারীদের স্টেম শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) মতো চাকরিতে বাংলাদেশ সরকার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দেয়। স্টেম ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বাংলাদেশের নারীরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ফোর আই আর) নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে নারী-পুরুষের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যেহেতু কোন নির্দিষ্ট দক্ষতা বিভেদ নেই, সেহেতু নারী-পুরুষ উভয়ে সমভাবে তাদের কর্মদক্ষতা অর্জন করে নিজেদের আরও বেশি পেশাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। শহর, বন্দর ও গ্রামে নারীদের প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা তথা আইসিটি ও স্টেমভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে দিতে তাদের প্রযুক্তি বিষয়ক সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নারী শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের আইসিটি এবং স্টেম বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে তৈরি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেবা প্রদানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আজকের নারীই হবে আগামী দিনের সক্ষমতার যোগ্য লালনকারী- এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল

ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

সোমবার, ১৩ মার্চ ২০২৩ , ২৮ ফাল্গুন ১৪২৯, ২০ শবান ১৪৪৪

নারীর কর্মদক্ষতায় আইসিটি ও স্টেম শিক্ষা

মাহমুদুল হাছান

হাইটেক এবং কম্পিউটারাইজড বিশ্বের এই যুগে, আইসিটি এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়ার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং সকল ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সাধনের জন্য, বাংলাদেশকে অবশ্যই নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে শিক্ষিত করার ওপর বেশি জোর দিতে হবে যাতে করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুত করা যায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতায়নের জন্য নারী শিক্ষা আরও গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষাও প্রয়োজনীয়। এসডিজিতে মানসম্পন্ন শিক্ষার উন্নয়নে নারী শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা শুধুমাত্র আইসিটি এবং স্টেমভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। আইসিটি এবং স্টেম শিক্ষার মাধ্যমে, নারীরা শুধু তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে এবং তাদের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় না, বরং নারীদের বৃহত্তর উপস্থিতির মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি হয়। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার কিছুটা উন্নতি হলেও উচ্চ শিক্ষায় তাদের অগ্রগতি অনেক কম। বিবিএসের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সাক্ষরতার হারে নারীদের চেয়ে এগিয়ে আছেন দেশের পুরুষরা। বর্তমানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬.৫৬ শতাংশ হলেও নারীদের সাক্ষরতা ৭২.৮২ শতাংশ। জনশুমারী ও গৃহগণনা-২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষের আনুপাতিক হারে নারীরা এগিয়ে। তবে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নারীরা এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার হারে তারা অনেক পিছিয়ে। আইটি শিক্ষায় তাদের অবস্থান আরো নাজুক। সম্প্রতি বেসিস সফট এক্সপো উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত ‘ইনক্লুসন অফ উইমেন ইন স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় গবেষকরা বলেন, গ্রাম ও শহরে পুরুষের তুলনায় নারীরা উচ্চশিক্ষার দিক থেকে এখনো পিছিয়ে। বর্তমানে ৩০ শতাংশ নারী শুধু আইটি নিয়ে পড়াশোনা করে। দেশে ১২ শতাংশ নারী আইটি প্রফেশনাল। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা যাতে আইটিতে পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য তাদের বেশি করে পড়াশোনা করার জন্য বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে।্

বাংলাদেশে নারী শিক্ষাকে একটি আদর্শ অবস্থানে আনতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে নারীদের আইসিটি ও স্টেম শিক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। একটি জরীপে দেখা যায়, বাংলাদেশে জনসংখ্যার সিংহভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই অদক্ষ বা আধা-দক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। অনেক মহিলা যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে, এমনকি তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতার অভাবের কারণে শোষিত হয়। আইটি শিক্ষা নারীদের সঠিক চাকরি এবং তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করার আত্মবিশ্বাস দিতে সাহায্য করে। তারা পরিবারের আয়ের অবদানকারী হয়ে ওঠে যা তাদের মতামত প্রকাশ করার শক্তি দেয়।

আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা প্রকৃত অর্থে যে কোন নারীর চোখ খুলে দিতে পারে। এটি তাকে বিভিন্ন শৃঙ্খলার পথ দেখিয়ে দেয় এবং তাকে চেঞ্জমেকার হওয়ার জ্ঞান দিয়ে ক্ষমতায়ন করে। আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা একজন নারীকে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তার ন্যয্য অধিকার আদায় করতে শেখায়। এটি তাকে তার নিজের মানসিক যন্ত্রণা দূর করতে সাহায্য করে এবং কুসংস্কার এবং গোঁড়া বিশ্বাসকে প্রতিহত করতে শেখায়। এ শিক্ষা নারীদের উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে, তারা তাদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পুরুষদের সমান।

ইন্টারনেট এবং ই-কমার্সের যুগে গ্রামীণ নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের তাদের নিজস্ব ই-কমার্স এবং অন্যান্য ব্যবসা স্থাপনে আর্থিক স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করার জন্য অসংখ্য সুযোগ তৈরি করেছে, যা শেষপর্যন্ত তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সহায়ক। মোবাইল এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারা এ সুবিধা নিশ্চিত করা যায় যে, নারীরা তাদের বাড়িতে অবস্থান করে আরও সহজে তাদের ঘরের পাশাপাশি তাদের ক্যারিয়ারের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।

হামাদুন তোরে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের মহাসচিব বলেছেন, নারীদের আইসিটির শিক্ষা দেয়া অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আইসিটি শিক্ষা ও চাকরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সহজতর করে এবং স্বাস্থ্যসেবার অ্যাক্সেস এবং অর্থনীতি ও নাগরিক সমাজে তাদের অংশগ্রহণ উন্নত করে। আইসিটিতে নারীদের উৎসাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মানুষের যোগাযোগ, ব্যবসা করার এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করার পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। আইসিটি সেক্টর বিপুল সংখ্যক চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জিং ক্যারিয়ার তৈরি করেছে। আইসিটি সেক্টরে, ভৌত সম্পদের পরিবর্তে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এভাবে এই শিল্পটি বৈষম্যহীন। আইসিটি পুরুষ, মহিলা, সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে, লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে অগ্রসর করা যেতে পারে, নারীদের তথ্য খোঁজার এবং শেয়ার করার, স্বাস্থ্য সহায়তা এবং শিক্ষামূলক পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেস, আয় তৈরি, সহযোগিতা এবং তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ প্রদান করে। প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের অভাব অনেক মহিলাকে ডিজিটাল সুযোগগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হতে বাধা দেয়।

তথ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়া, বিতরণ এবং রূপান্তর করতে ব্যবহৃত পণ্য, অ্যাপ্লিকেশন এবং পরিষেবাগুলোর একটি জটিল সেটকে আইসিটি অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন প্রযুক্তির ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, শাসন ব্যবস্থার উন্নতি, বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে চারটি ভিন্ন ক্ষেত্রে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নারীদের জীবনের জন্য আইসিটির উপকারিতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান প্রমাণ রয়েছে। নারীদের জন্য বিশ্বব্যাপী, আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্বাস্থ্য উদ্যোগকে সহজতর করার জন্য আইটির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, স্বাস্থ্য প্রচারকারীরা যৌন এবং প্রজনন অধিকারসহ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের জন্য প্রযুক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার করেছে। আইটিতে কমিউনিটি অ্যাক্সেস পয়েন্টের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত স্বাস্থ্য তথ্য নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে ইদানীং স্টেম শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (ঝঞঊগ) বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নারীর কর্মশক্তি বাড়াবে। স্টেম শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। প্রযুক্তির বিকাশ মানব সভ্যতাকে প্রগতিশীল করেছে। স্টেম শিক্ষা মানুষের সৃজনশীলতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্টেম শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বলা যায়, মানুষের মধ্যে উন্নতমানের টিম ওয়ার্ক, উন্নত যোগাযোগ, কোনো কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, যেকোনো সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি ডিজিটাল জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাই হচ্ছে স্টেম শিক্ষার কাজ। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। স্টেম শিক্ষা এক সময়কার সনাতনী নিয়মে পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রবণতাকে কমিয়ে এনেছে। নারীদের স্টেম শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) মতো চাকরিতে বাংলাদেশ সরকার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দেয়। স্টেম ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বাংলাদেশের নারীরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ফোর আই আর) নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে নারী-পুরুষের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যেহেতু কোন নির্দিষ্ট দক্ষতা বিভেদ নেই, সেহেতু নারী-পুরুষ উভয়ে সমভাবে তাদের কর্মদক্ষতা অর্জন করে নিজেদের আরও বেশি পেশাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। শহর, বন্দর ও গ্রামে নারীদের প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা তথা আইসিটি ও স্টেমভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে দিতে তাদের প্রযুক্তি বিষয়ক সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নারী শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের আইসিটি এবং স্টেম বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে তৈরি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেবা প্রদানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আজকের নারীই হবে আগামী দিনের সক্ষমতার যোগ্য লালনকারী- এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল

ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]