পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল এখন পানিশূন্য

পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল এখন পানিশূন্য। নদীপাড়ে শুধুই হাহাকার। এককালের খরস্রোতা বড়ালের বুকে হচ্ছে ধানচাষ। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, দখল-দূষণে বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। বড়াল মজে যাওয়ায় একদিকে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে করেছে বিপর্যস্ত। তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের জীব-জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব।

এদিকে বনপাড়া ভূমি রাজস্ব অফিস বড়াল নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর জমি দখল করে করা হয়েছে হাউজিং সোসাইটি। মজে যাওয়া নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা এভাবে দখল করে পাকাপাকিভাবে যারা বসে আছেন তারা নানা কায়দায় তা দখলে রাখার জন্য তদবির করছে।

পদ্মা এবং যমুনা নদীর সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২০৪ কিলোমিটার। পদ্মার শাখা ও চলনবিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী হচ্ছে বড়াল। নদীটি রাজশাহীর চারঘাট পদ্মা থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা, নারদ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে পাবনার চাটমোহর ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর উপজেলা হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী হয়ে যুমনা নদীতে মিশেছে। বড়াল পাবনার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড়াল অববাহিকায় ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাসকালাই চাষে সারাদেশে খ্যাতিলাভ করে। বড়াল পাড়ের ফসল নৌপথে চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারয়ণগঞ্জ ও খুলনায় পাঠানো হয়। তাই বড়ালের ধারে চারঘাট, পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট, বড়াইগ্রাম, বনপাড়া, রামনগর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, মির্জাপুর, জোনাইল, বাঘা, ডেমড়া, সিলন্দাতে নদীবন্দর গড়ে উঠে। আশির দশকের শুরুর দিকেও বড়াল দিয়ে বড় বড় নৌকা, বার্জ, কার্গোতে পণ্য সামগ্রী আনা-নেয়া হতো। বড়াল নদীর ইলিশ মাছ, পাবদা, চিংড়ি, চিতল, আইড় ও বোয়াল মাছের ছিল ব্যাপক সুখ্যাতি। এখন নদীটি বলা চলে মাণচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। বর্ষায় ২ মাস পানি থাকলেও সারা বছর বলা চলে বড়াল পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তখন চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া অংশে ধান চাষ করা হয়।

নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলন সূত্র জানায়, রাজশাহীর চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে একটি সুইসগেট, ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি সুইসগেট, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় নদীর পাড় দখল, ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার চাটমোহর উপজেলার রামনগর ঘাট, বোথড় ঘাট ও নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকায় বড়ালের বুকে তিনটি ক্রসবাঁধ ও নুরনগর নামক স্থানে একটি সুইসগেট দেয়া হয়।

এই বন্যা নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করে ক্লোজার বা তিন দরজা বিশিষ্ট সুইসগেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট সুইসগেট নির্মাণ করে। এই গেটটি নির্মাণ করার ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তরের অংশে পানি চলাচল একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুঁজা এবং অন্য ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি সুইসগেট। একদিকে বড়ালের উৎসমুখে চারঘাটে সুইসগেট, অন্যদিকে দীর্ঘদিন এত বড় একটি নদীর মুখে এক দরজার একটি সুইসগেট নির্মাণ করায় বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। নদীর ভাটিতে বড়াল নদীর ওপর তৃতীয় ও চতুর্থ সুইসগেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুরা এবং চাটমোহরের দহপাড়ার কাছে। দহপাড়ার নিকটবর্তী সুইসগেটটির উভয় পাশই শুকিয়ে যায় শুকনো মৌসুমে। যেহেতু নদীটিকে এভাবে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে অতএব এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে যেখানে যতটুকু পারে নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে ঘর-বাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।

চারঘাটে সুইসগেট নির্মাণ করার পর পানি প্রবাহ কমে যায়। পদ্মার পানি বড়ালে আসা বন্ধ হয়। বন্ধ হয় যমুনার পানি বাড়ার সময় পানির চলাচল। নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে।

চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা, বোঁথড়, নতুন বাজার খেয়াঘাট, কুমারগাড়া, দোলংসহ বেশকিছু এলাকায় বড়াল নদী পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব চিত্রের কথা। কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ জানান, এক সময় বড়াল নদীর পানি দিয়ে চলত আমাদের কৃষি কাজ। এখন সেই নদীতে পানি না থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। এর বিকল্প হিসেবে নদীর তীরে ফলজ বাগান গড়ে তোলা হলেও পানির অভাবে ফলন ভালো হচ্ছে না। নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকার মৎস্যজীবী সুবল হালদার বলেন, চলনবিল ও বড়াল নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ও খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। এই নদীর মাছ বিক্রি করে সংসার চলতো আমাদের। অনেক মৎস্যজীবী ছিল এলাকায়। এখন নদী বন্ধ, মাছ নেই।

বড়াল নদী রক্ষায় ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন। জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ। ইতোমধ্যে নদীপাড়ের বিভিন্ন স্থানে, ঢাকায় অনেক সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, কনভেনশন, সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আবদ্ধ বড়াল নদীকে চলমান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নদীবিষয়ক ট্রাস্কফোর্সে এবং ভূমি মন্ত্রাণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করে নদী চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বড়াল নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি। তিনটি ক্রসবাঁধ ও নুরনগর নামক স্থানে একটি সুইসগেট দেয়ার ফলে প্রমত্তা বড়াল নদীকে কয়েকটি পুকুরে পরিণত করা হয়েছে।

নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। বিশাল গবাদিপশুর চারণভূমিতে আগের মতো মাসকালাই ও খেসারি জন্মে না। তাতে গবাদিপশু মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। বিলে পানির সংকট দেখা দেয়। চাষি ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তপ্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভা-ার হিসেবে পরিচিত চলনবিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্তপ্রায়।

সুইসগেটসমূহ অপসারণ করার দাবি উঠেছে অনেক বছর আগেই। বনপাড়া বাইপাস সড়ক ব্রিজ, বনপাড়া বাজার ব্রিজ, কৈলার খালিয়া ব্রিজ, তিরোইল ব্রিজ, আগ্রান ব্রিজসহ ছোট-বড় সব ব্রিজ ও কালভার্ট অপসারণ করা হলেই কেবল বড়াল নদী আবার চলাচলের উপযোগী হবে। নদীবিষয়ক টাস্কফোর্স আ ক ম মোজাম্মল হককে চেয়ারম্যান করেছিল। তার নেতৃত্বে ৬ দফার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে ওই টাস্কফোর্স। প্রতিবেদনটি দাখিল করাও হয় কিন্তু বিষয়টি ঝুলে থাকে দীর্ঘদিন। এরপর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘বেলা’ বড়াল নদী রক্ষায় উল্লি­খিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার জন্য উচ্চ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। উচ্চ আদালত ২০১৪ সালে এক রায়ে বড়াল নদীর সব প্রতিবন্ধকতা মুক্ত করার জন্য সরকারকে আদেশ প্রদান করে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম কয়েক দফা বড়াল নদী এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বড়াল নদী দখলমুক্ত করার জন্য রাজশাহী, পাবনাসহ ঢাকায় কয়েক দফা মিটিং করেছেন। ইতোমধ্যে চাটমোহর, ভাঙ্গুরা এলাকার আড়াআড়ি কয়েকটি বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে।

বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আবদ্ধ বড়াল নদীকে চলমান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নদীবিষয়ক ট্রাস্কফোর্সে এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করে নদী চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বড়াল নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি।

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩ , ২৯ ফাল্গুন ১৪২৯, ২১ শবান ১৪৪৪

পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল এখন পানিশূন্য

হাবিবুর রহমান স্বপন, পাবনা

image

পদ্মা-যমুনার প্লাবনভূমি বড়াল এখন পানিশূন্য। নদীপাড়ে শুধুই হাহাকার। এককালের খরস্রোতা বড়ালের বুকে হচ্ছে ধানচাষ। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, দখল-দূষণে বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। বড়াল মজে যাওয়ায় একদিকে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে করেছে বিপর্যস্ত। তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের জীব-জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব।

এদিকে বনপাড়া ভূমি রাজস্ব অফিস বড়াল নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর জমি দখল করে করা হয়েছে হাউজিং সোসাইটি। মজে যাওয়া নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা এভাবে দখল করে পাকাপাকিভাবে যারা বসে আছেন তারা নানা কায়দায় তা দখলে রাখার জন্য তদবির করছে।

পদ্মা এবং যমুনা নদীর সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২০৪ কিলোমিটার। পদ্মার শাখা ও চলনবিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী হচ্ছে বড়াল। নদীটি রাজশাহীর চারঘাট পদ্মা থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা, নারদ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে পাবনার চাটমোহর ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর উপজেলা হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী হয়ে যুমনা নদীতে মিশেছে। বড়াল পাবনার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড়াল অববাহিকায় ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাসকালাই চাষে সারাদেশে খ্যাতিলাভ করে। বড়াল পাড়ের ফসল নৌপথে চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারয়ণগঞ্জ ও খুলনায় পাঠানো হয়। তাই বড়ালের ধারে চারঘাট, পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট, বড়াইগ্রাম, বনপাড়া, রামনগর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, মির্জাপুর, জোনাইল, বাঘা, ডেমড়া, সিলন্দাতে নদীবন্দর গড়ে উঠে। আশির দশকের শুরুর দিকেও বড়াল দিয়ে বড় বড় নৌকা, বার্জ, কার্গোতে পণ্য সামগ্রী আনা-নেয়া হতো। বড়াল নদীর ইলিশ মাছ, পাবদা, চিংড়ি, চিতল, আইড় ও বোয়াল মাছের ছিল ব্যাপক সুখ্যাতি। এখন নদীটি বলা চলে মাণচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। বর্ষায় ২ মাস পানি থাকলেও সারা বছর বলা চলে বড়াল পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তখন চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া অংশে ধান চাষ করা হয়।

নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলন সূত্র জানায়, রাজশাহীর চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে একটি সুইসগেট, ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি সুইসগেট, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় নদীর পাড় দখল, ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার চাটমোহর উপজেলার রামনগর ঘাট, বোথড় ঘাট ও নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকায় বড়ালের বুকে তিনটি ক্রসবাঁধ ও নুরনগর নামক স্থানে একটি সুইসগেট দেয়া হয়।

এই বন্যা নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করে ক্লোজার বা তিন দরজা বিশিষ্ট সুইসগেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট সুইসগেট নির্মাণ করে। এই গেটটি নির্মাণ করার ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তরের অংশে পানি চলাচল একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুঁজা এবং অন্য ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি সুইসগেট। একদিকে বড়ালের উৎসমুখে চারঘাটে সুইসগেট, অন্যদিকে দীর্ঘদিন এত বড় একটি নদীর মুখে এক দরজার একটি সুইসগেট নির্মাণ করায় বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। নদীর ভাটিতে বড়াল নদীর ওপর তৃতীয় ও চতুর্থ সুইসগেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুরা এবং চাটমোহরের দহপাড়ার কাছে। দহপাড়ার নিকটবর্তী সুইসগেটটির উভয় পাশই শুকিয়ে যায় শুকনো মৌসুমে। যেহেতু নদীটিকে এভাবে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে অতএব এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে যেখানে যতটুকু পারে নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে ঘর-বাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।

চারঘাটে সুইসগেট নির্মাণ করার পর পানি প্রবাহ কমে যায়। পদ্মার পানি বড়ালে আসা বন্ধ হয়। বন্ধ হয় যমুনার পানি বাড়ার সময় পানির চলাচল। নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে।

চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা, বোঁথড়, নতুন বাজার খেয়াঘাট, কুমারগাড়া, দোলংসহ বেশকিছু এলাকায় বড়াল নদী পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব চিত্রের কথা। কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ জানান, এক সময় বড়াল নদীর পানি দিয়ে চলত আমাদের কৃষি কাজ। এখন সেই নদীতে পানি না থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। এর বিকল্প হিসেবে নদীর তীরে ফলজ বাগান গড়ে তোলা হলেও পানির অভাবে ফলন ভালো হচ্ছে না। নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকার মৎস্যজীবী সুবল হালদার বলেন, চলনবিল ও বড়াল নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ও খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। এই নদীর মাছ বিক্রি করে সংসার চলতো আমাদের। অনেক মৎস্যজীবী ছিল এলাকায়। এখন নদী বন্ধ, মাছ নেই।

বড়াল নদী রক্ষায় ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন। জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ। ইতোমধ্যে নদীপাড়ের বিভিন্ন স্থানে, ঢাকায় অনেক সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, কনভেনশন, সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আবদ্ধ বড়াল নদীকে চলমান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নদীবিষয়ক ট্রাস্কফোর্সে এবং ভূমি মন্ত্রাণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করে নদী চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বড়াল নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি। তিনটি ক্রসবাঁধ ও নুরনগর নামক স্থানে একটি সুইসগেট দেয়ার ফলে প্রমত্তা বড়াল নদীকে কয়েকটি পুকুরে পরিণত করা হয়েছে।

নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। বিশাল গবাদিপশুর চারণভূমিতে আগের মতো মাসকালাই ও খেসারি জন্মে না। তাতে গবাদিপশু মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। বিলে পানির সংকট দেখা দেয়। চাষি ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তপ্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভা-ার হিসেবে পরিচিত চলনবিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্তপ্রায়।

সুইসগেটসমূহ অপসারণ করার দাবি উঠেছে অনেক বছর আগেই। বনপাড়া বাইপাস সড়ক ব্রিজ, বনপাড়া বাজার ব্রিজ, কৈলার খালিয়া ব্রিজ, তিরোইল ব্রিজ, আগ্রান ব্রিজসহ ছোট-বড় সব ব্রিজ ও কালভার্ট অপসারণ করা হলেই কেবল বড়াল নদী আবার চলাচলের উপযোগী হবে। নদীবিষয়ক টাস্কফোর্স আ ক ম মোজাম্মল হককে চেয়ারম্যান করেছিল। তার নেতৃত্বে ৬ দফার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে ওই টাস্কফোর্স। প্রতিবেদনটি দাখিল করাও হয় কিন্তু বিষয়টি ঝুলে থাকে দীর্ঘদিন। এরপর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘বেলা’ বড়াল নদী রক্ষায় উল্লি­খিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার জন্য উচ্চ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। উচ্চ আদালত ২০১৪ সালে এক রায়ে বড়াল নদীর সব প্রতিবন্ধকতা মুক্ত করার জন্য সরকারকে আদেশ প্রদান করে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম কয়েক দফা বড়াল নদী এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বড়াল নদী দখলমুক্ত করার জন্য রাজশাহী, পাবনাসহ ঢাকায় কয়েক দফা মিটিং করেছেন। ইতোমধ্যে চাটমোহর, ভাঙ্গুরা এলাকার আড়াআড়ি কয়েকটি বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে।

বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আবদ্ধ বড়াল নদীকে চলমান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। নদীবিষয়ক ট্রাস্কফোর্সে এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করে নদী চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বড়াল নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি।