বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

মোস্তাফা জব্বার

পাঁচ ॥

বঙ্গবন্ধুর এই বিশাল কর্মোদ্যোগকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এর পেছনের কারণগুলো কী? বঙ্গবন্ধু কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রেসক্রিপশনে চলার মানুষ ছিলেন না। অর্থনৈতিক এই বিপ্লবটি সফল হলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে যাবে। সুতরাং শেখ মুজিবকে খতম করে বিশ্বব্যাংকের কথামতো যারা চলে তাদের নিয়ে আসা হলোও তাই। জাতি হারাল তার সবচেয়ে সুদৃঢ় নেতাকে। এর মানে দাঁড়ালো যে বাংলাদেশ যেন হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িই থেকে যায়। থেকেও যেত যদি শেখ হাসিনা বেঁচে না যেতেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেকগুলো বড় বড় পরিবর্তন আসল। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রাপ্তির যে অবিনাশী চেতনা বুকে নিয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আদিবাসী সবাই মিলে পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, অর্জন করেছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ রাতারাতি হয়ে গেল ‘ধর্মীয় বাংলাদেশ’। ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া হলো। তাই ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যাতে কোনো বিচার না হয় সেজন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এর ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়া হলো। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ককে ঘাতকদের কাছে প্রাণ দিতে হয়েছে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রনায়ককে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন করে সপরিবারে হত্যা করা হয়নি। এরপর আবার আইন করে হত্যার ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়ার নজির সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। অবৈধ সামরিক শাসকের দল তৃতীয় যে কাজটি করল তা হলো বাংলার মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর ব কীর্তিকে চিরতরে মুছে ফেলার কিছু চতুর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা।

রাষ্ট্রের সব গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো, বঙ্গবন্ধুর কথা বলা একদম বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিশ বছর রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয়নি। যেই মানুষটির কণ্ঠ বাংলার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল, যিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন, দিয়ে গিয়েছিলেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রতি যার ছিল নিরন্তর ভালোবাসা। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবাসতে পারার অসম্ভব এ ক্ষমতাটিই যাকে বাংলার গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল, সেই মানুষটিকে এক নিমেষে দেশের সব মিডিয়া, সব প্রকাশনা ভুলে গেল? সামরিক শাসকের দল সেখানেই থেমে থাকেনি, তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে নানান মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে ভরা গল্প চারদিকে ছড়িয়ে দিল।

সামরিক শাসকদের পালিত কিছু বুদ্ধিজীবী এই প্রচারের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে। আর সেসব মিথ্যা ও বিভ্রান্তি দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরতে থাকে বছরের পর বছর। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২১ বছর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই সব মিথ্যা এবং বিভ্রান্তির গল্প শুনে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সকল কীর্তিকে মুছে ফেলতে যত চেষ্টা করা দরকার তারা সব চেষ্টাই চালিয়েছে। সকল কীর্তিতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি ওরা সুকৌশলে আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল তা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যেও কিছু বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেওয়া। তারা খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গেই এই কাজটি করেছে। আমি নিশ্চিত আজ যদি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় তবে অনেকগুলো ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে; যেখানে বলা আছে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মরেনি, শেখ মুজিবুর রহমান তিন লাখের জায়গায় বাড়িয়ে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। এগুলো নিছক বিভ্রান্তি। খুব কৌশলে এই সব বিভ্রান্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বিভ্রান্তিগুলো কিন্তু আবার রীতিমতো নামকরা গবেষকদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে, দলিল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সম্বন্ধে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা পড়েছিলাম হাসান মোরশেদের ফেসবুক লেখায়। তিনি লিখেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, পৃথিবীর ভয়াবহতম এক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল মূলত দুই পরাশক্তির প্রচ্ছন্ন ভরসায়। সমাজতান্ত্রিক চীন এবং পুঁজিবাদী আমেরিকা। এই দুই শক্তির ভরসা ছাড়া পাকিস্তান কিছুই ছিল না। চীন তার বুদ্ধিবৃত্তির জায়গায় এখনো এতটা এগিয়ে নেই; কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধি রাখে, জ্ঞানের ও ইতিহাসের গুরুত্ব তারা বোঝে। তাই তাদের একটা উদ্যোগ আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ যেসব মানবতাবিরোধী ইতিহাসে তাদের অংশগ্রহণ আছে, সেগুলোর বিকল্প পাঠ তৈরি করানো। ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নামে চিহ্নিত রক্তের দাগগুলো পুরোপুরি মুছে ফেলতে না পারলেও অন্তত বিভ্রান্তি তৈরি করে রাখা।

উদাহরণ হিসেবে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের একটি বিকল্প ইতিহাস তুলে ধরেছেন যা কিনা আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও পাকিস্তানের আইএসআই অর্থায়নে করেছেন নেতাজি সুভাষ বসুর পরিবারের এক সদস্য, শর্মিলা বসুকে। সেখানে বলা হয়েছে- ‘এখানে আসলে বিহারি ও বাঙালিদের জাতিগত দাঙ্গা চলছিল একাত্তরের শুরু থেকে। যেহেতু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর বাঙালিদের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ মূলত গুন্ডাপান্ডার দল সেহেতু বিহারিরা ভয়ংকরভাবে কচুকাটা হচ্ছিল। এই অরাজকতা থামাতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অ্যাকশনে নামতে হয়েছিল। সেই অ্যাকশনে কিছু বাঙালি অস্ত্রধারী যাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তারা মারা গেছে। সংখ্যাটা খুব বেশি হলে ২৬ হাজার। বিহারিও কিন্তু মরেছে বাঙালির হাতে হাজার হাজার। আর ধর্ষণ! দু-চারটা ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে বাঙালিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের বাড়িয়ে বলার একটা বদভ্যাস ছিল।’ মিথ্যাচারের একটি সীমা থাকা উচিত।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রশ্নে কোনো আপস করা হবে না। আর তাই স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এত সহজে বিশ্বাস করবে না। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের সাদাসিধে কলামে একটি লেখার কথা এখানে বলাটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল অলি আহমেদের সঙ্গে এই প্রজন্মের একটি তরুণীর টেলিভিশনের একটি কথোপকথনের কথা নিয়ে সেখানে লেখেন। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন অলি আহমেদের এমন দাবির বিপরীতে তরুণীটি কর্নেল অলি আহমেদের প্রতি পুরো সম্মান রেখে খুব ঠান্ডা মাথায় তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে নির্জলা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত না করার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু কবে, কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি কিভাবে প্রচারিত হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসের কোন সংখ্যায় সেই ঘোষণার কথা ছাপা হয়েছে, তরুণীটি অলি আহমেদকে তা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটিতে কী বলেছিলেন- তাও অলি আহমেদকে শুনিয়েছেন। তরুণীটি এটিও বলেছেন যে, স্বাধীনতা ঘোষণা করা আর পাঠ করার মধ্যে দিনরাত পার্থক্য- এটা তো অলি আহমেদের ভালো করেই বোঝা উচিত। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তরুণীটি অলি আহমেদকে প্রশ্ন করেন- জিয়াউর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষক হন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে সেই ইতিহাস নেই কেন? কেন সেটি ১৯৯১ সালের পর থেকে শুরু হলো? তরুণীটি অলি আহমেদকে বলেছিলেন- আপনারা রাজনীতি করতে চান করুন, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করুন, কেন আপনারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চান?

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম মানেই একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, শোষণহীন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন- ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্ত সম্পৃত্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

সুতরাং সুখী-সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে গভীর গবেষণা, নিবিড় অধ্যয়ন ও তা থেকে অর্জিত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

এটি অপ্রিয় সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর এসব অমর বাণী সচরাচর আমাদের জীবনে আমরা প্রয়োগই করি না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বললেও যে মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম সেই আদর্শগুলোই আমরা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। বিশেষত আমাদের নতুন প্রজন্ম এসব বিষয় জানে বলেও মনে হয় না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িকতা ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখাই হয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বা বাকশাল গঠনের ইতিহাস ও তার বিষয়বস্তু জানাটা খুবই জরুরি।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ ২০২৩ , ২৯ ফাল্গুন ১৪২৯, ২১ শবান ১৪৪৪

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

মোস্তাফা জব্বার

পাঁচ ॥

বঙ্গবন্ধুর এই বিশাল কর্মোদ্যোগকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এর পেছনের কারণগুলো কী? বঙ্গবন্ধু কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রেসক্রিপশনে চলার মানুষ ছিলেন না। অর্থনৈতিক এই বিপ্লবটি সফল হলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে যাবে। সুতরাং শেখ মুজিবকে খতম করে বিশ্বব্যাংকের কথামতো যারা চলে তাদের নিয়ে আসা হলোও তাই। জাতি হারাল তার সবচেয়ে সুদৃঢ় নেতাকে। এর মানে দাঁড়ালো যে বাংলাদেশ যেন হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িই থেকে যায়। থেকেও যেত যদি শেখ হাসিনা বেঁচে না যেতেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেকগুলো বড় বড় পরিবর্তন আসল। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রাপ্তির যে অবিনাশী চেতনা বুকে নিয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আদিবাসী সবাই মিলে পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, অর্জন করেছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ রাতারাতি হয়ে গেল ‘ধর্মীয় বাংলাদেশ’। ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া হলো। তাই ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যাতে কোনো বিচার না হয় সেজন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এর ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়া হলো। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ককে ঘাতকদের কাছে প্রাণ দিতে হয়েছে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রনায়ককে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন করে সপরিবারে হত্যা করা হয়নি। এরপর আবার আইন করে হত্যার ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়ার নজির সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। অবৈধ সামরিক শাসকের দল তৃতীয় যে কাজটি করল তা হলো বাংলার মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর ব কীর্তিকে চিরতরে মুছে ফেলার কিছু চতুর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা।

রাষ্ট্রের সব গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো, বঙ্গবন্ধুর কথা বলা একদম বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিশ বছর রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয়নি। যেই মানুষটির কণ্ঠ বাংলার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল, যিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন, দিয়ে গিয়েছিলেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রতি যার ছিল নিরন্তর ভালোবাসা। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবাসতে পারার অসম্ভব এ ক্ষমতাটিই যাকে বাংলার গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল, সেই মানুষটিকে এক নিমেষে দেশের সব মিডিয়া, সব প্রকাশনা ভুলে গেল? সামরিক শাসকের দল সেখানেই থেমে থাকেনি, তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে নানান মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে ভরা গল্প চারদিকে ছড়িয়ে দিল।

সামরিক শাসকদের পালিত কিছু বুদ্ধিজীবী এই প্রচারের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে। আর সেসব মিথ্যা ও বিভ্রান্তি দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরতে থাকে বছরের পর বছর। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২১ বছর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই সব মিথ্যা এবং বিভ্রান্তির গল্প শুনে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সকল কীর্তিকে মুছে ফেলতে যত চেষ্টা করা দরকার তারা সব চেষ্টাই চালিয়েছে। সকল কীর্তিতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি ওরা সুকৌশলে আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল তা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যেও কিছু বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেওয়া। তারা খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গেই এই কাজটি করেছে। আমি নিশ্চিত আজ যদি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় তবে অনেকগুলো ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে; যেখানে বলা আছে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মরেনি, শেখ মুজিবুর রহমান তিন লাখের জায়গায় বাড়িয়ে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। এগুলো নিছক বিভ্রান্তি। খুব কৌশলে এই সব বিভ্রান্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ বিভ্রান্তিগুলো কিন্তু আবার রীতিমতো নামকরা গবেষকদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে, দলিল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সম্বন্ধে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা পড়েছিলাম হাসান মোরশেদের ফেসবুক লেখায়। তিনি লিখেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, পৃথিবীর ভয়াবহতম এক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল মূলত দুই পরাশক্তির প্রচ্ছন্ন ভরসায়। সমাজতান্ত্রিক চীন এবং পুঁজিবাদী আমেরিকা। এই দুই শক্তির ভরসা ছাড়া পাকিস্তান কিছুই ছিল না। চীন তার বুদ্ধিবৃত্তির জায়গায় এখনো এতটা এগিয়ে নেই; কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধি রাখে, জ্ঞানের ও ইতিহাসের গুরুত্ব তারা বোঝে। তাই তাদের একটা উদ্যোগ আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ যেসব মানবতাবিরোধী ইতিহাসে তাদের অংশগ্রহণ আছে, সেগুলোর বিকল্প পাঠ তৈরি করানো। ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নামে চিহ্নিত রক্তের দাগগুলো পুরোপুরি মুছে ফেলতে না পারলেও অন্তত বিভ্রান্তি তৈরি করে রাখা।

উদাহরণ হিসেবে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের একটি বিকল্প ইতিহাস তুলে ধরেছেন যা কিনা আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও পাকিস্তানের আইএসআই অর্থায়নে করেছেন নেতাজি সুভাষ বসুর পরিবারের এক সদস্য, শর্মিলা বসুকে। সেখানে বলা হয়েছে- ‘এখানে আসলে বিহারি ও বাঙালিদের জাতিগত দাঙ্গা চলছিল একাত্তরের শুরু থেকে। যেহেতু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর বাঙালিদের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ মূলত গুন্ডাপান্ডার দল সেহেতু বিহারিরা ভয়ংকরভাবে কচুকাটা হচ্ছিল। এই অরাজকতা থামাতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অ্যাকশনে নামতে হয়েছিল। সেই অ্যাকশনে কিছু বাঙালি অস্ত্রধারী যাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তারা মারা গেছে। সংখ্যাটা খুব বেশি হলে ২৬ হাজার। বিহারিও কিন্তু মরেছে বাঙালির হাতে হাজার হাজার। আর ধর্ষণ! দু-চারটা ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে বাঙালিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের বাড়িয়ে বলার একটা বদভ্যাস ছিল।’ মিথ্যাচারের একটি সীমা থাকা উচিত।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রশ্নে কোনো আপস করা হবে না। আর তাই স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এত সহজে বিশ্বাস করবে না। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের সাদাসিধে কলামে একটি লেখার কথা এখানে বলাটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল অলি আহমেদের সঙ্গে এই প্রজন্মের একটি তরুণীর টেলিভিশনের একটি কথোপকথনের কথা নিয়ে সেখানে লেখেন। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন অলি আহমেদের এমন দাবির বিপরীতে তরুণীটি কর্নেল অলি আহমেদের প্রতি পুরো সম্মান রেখে খুব ঠান্ডা মাথায় তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে নির্জলা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত না করার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু কবে, কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি কিভাবে প্রচারিত হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসের কোন সংখ্যায় সেই ঘোষণার কথা ছাপা হয়েছে, তরুণীটি অলি আহমেদকে তা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটিতে কী বলেছিলেন- তাও অলি আহমেদকে শুনিয়েছেন। তরুণীটি এটিও বলেছেন যে, স্বাধীনতা ঘোষণা করা আর পাঠ করার মধ্যে দিনরাত পার্থক্য- এটা তো অলি আহমেদের ভালো করেই বোঝা উচিত। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তরুণীটি অলি আহমেদকে প্রশ্ন করেন- জিয়াউর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষক হন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে সেই ইতিহাস নেই কেন? কেন সেটি ১৯৯১ সালের পর থেকে শুরু হলো? তরুণীটি অলি আহমেদকে বলেছিলেন- আপনারা রাজনীতি করতে চান করুন, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করুন, কেন আপনারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চান?

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম মানেই একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, শোষণহীন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন- ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্ত সম্পৃত্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

সুতরাং সুখী-সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে গভীর গবেষণা, নিবিড় অধ্যয়ন ও তা থেকে অর্জিত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

এটি অপ্রিয় সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর এসব অমর বাণী সচরাচর আমাদের জীবনে আমরা প্রয়োগই করি না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বললেও যে মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম সেই আদর্শগুলোই আমরা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। বিশেষত আমাদের নতুন প্রজন্ম এসব বিষয় জানে বলেও মনে হয় না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িকতা ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখাই হয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বা বাকশাল গঠনের ইতিহাস ও তার বিষয়বস্তু জানাটা খুবই জরুরি।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]