হুমায়ুন কবীরের অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক, মামলার প্রস্তুতি

হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় করা এক মামলায় ‘সাজাপ্রাপ্ত’ সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবীরের অর্জিত সম্পদের মধ্যে ৫০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আলোচিত এ সাবেক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক জানান, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবীরের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিজ নামে ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৬৯২ টাকার স্থাবর সম্পদ ও নগদ স্থিতিসহ ৬০ লাখ ২৬ হাজার ৭৭০ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬২ টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়া যায়। সম্পদ বিবরণীতে গৃহনির্মাণ ঋণ হিসাবে ৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭৪ টাকা দায় দেনা আছে। আর হুমায়ুন কবীরের ২ কোটি ৪৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ টাকার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ মোট অর্জিত সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ১২৫ টাকা।

দুদকের অনুসন্ধানে হুমায়ুন কবীরের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৩ কোটি ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬ টাকা। এ ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৯ টাকা বেশি পাওয়া যায়। যা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আলোচিত মহা-জালিয়াতির নাম হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্ক গ্রুপের এমন জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যা আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ডজনের বেশি মামলার প্রধান আসামি হুমায়ুন। আদালতের রায়ে একটি মামলায় ১৭ বছর সাজাও হয়েছে তার।

সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুময়ুুন কবির কর্মরত থাকাকালীন হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমি যতটুকু জানি হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটনায় অন্তত ১১টি মামলার অভিযোগপত্রে অন্যতম প্রধান আসামি তিনি। বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। যেহেতু পলাতক, তাই অনুসন্ধানকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর আর দুদকের ডাকে সাড়া দেননি কিংবা তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানকালে তার নিযুক্ত করা এক অ্যাডভোকেট সব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট সরবরাহ করেন। হুমায়ুন কবির সোনালী ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের পর ‘ফারমার্স ব্যাংকে’ যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক মাস চাকরি করার পর ‘হলমার্ক’ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক নিয়মিত মামলা ও অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও বাস্তবে ওই সম্পদের মূল্য বেশি রয়েছে।

সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সাবেক এমডি মো. হুমায়ুন কবির ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে সুদীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরি জীবনে বিদেশ ট্রেনিং ও সোনালী এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছর চাকরি করেছেন। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও কর্মসংস্থান ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে আয়েশা বেগম রীতার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী আয়েশা বেগম রীতা প্রথম জীবনে টিউশনি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন বলে আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন। যদিও পেশার ঘরে গৃহিণী লেখা রয়েছে। তার নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের বেশিরভাগ তার স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ দ্বারা অর্জিত। বর্তমানে মিরপুরে নির্মিত ৬ তলা বিশিষ্ট বাড়ির ভাড়ায় জীবনধারণ করছেন।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১ মামলা এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফান্ডেড প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আরও ২৭ মামলা দায়ের করে দুদক। পরে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। যেখানে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের আসামি করা হয়।

বুধবার, ১৫ মার্চ ২০২৩ , ৩০ ফাল্গুন ১৪২৯, ২২ শবান ১৪৪৪

সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি

হুমায়ুন কবীরের অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক, মামলার প্রস্তুতি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় করা এক মামলায় ‘সাজাপ্রাপ্ত’ সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবীরের অর্জিত সম্পদের মধ্যে ৫০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আলোচিত এ সাবেক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক জানান, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবীরের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিজ নামে ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৬৯২ টাকার স্থাবর সম্পদ ও নগদ স্থিতিসহ ৬০ লাখ ২৬ হাজার ৭৭০ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬২ টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়া যায়। সম্পদ বিবরণীতে গৃহনির্মাণ ঋণ হিসাবে ৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭৪ টাকা দায় দেনা আছে। আর হুমায়ুন কবীরের ২ কোটি ৪৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ টাকার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ মোট অর্জিত সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ১২৫ টাকা।

দুদকের অনুসন্ধানে হুমায়ুন কবীরের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৩ কোটি ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬ টাকা। এ ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৯ টাকা বেশি পাওয়া যায়। যা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আলোচিত মহা-জালিয়াতির নাম হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্ক গ্রুপের এমন জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যা আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ডজনের বেশি মামলার প্রধান আসামি হুমায়ুন। আদালতের রায়ে একটি মামলায় ১৭ বছর সাজাও হয়েছে তার।

সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুময়ুুন কবির কর্মরত থাকাকালীন হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমি যতটুকু জানি হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটনায় অন্তত ১১টি মামলার অভিযোগপত্রে অন্যতম প্রধান আসামি তিনি। বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। যেহেতু পলাতক, তাই অনুসন্ধানকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর আর দুদকের ডাকে সাড়া দেননি কিংবা তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানকালে তার নিযুক্ত করা এক অ্যাডভোকেট সব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট সরবরাহ করেন। হুমায়ুন কবির সোনালী ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের পর ‘ফারমার্স ব্যাংকে’ যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক মাস চাকরি করার পর ‘হলমার্ক’ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক নিয়মিত মামলা ও অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও বাস্তবে ওই সম্পদের মূল্য বেশি রয়েছে।

সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সাবেক এমডি মো. হুমায়ুন কবির ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে সুদীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরি জীবনে বিদেশ ট্রেনিং ও সোনালী এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছর চাকরি করেছেন। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও কর্মসংস্থান ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে আয়েশা বেগম রীতার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী আয়েশা বেগম রীতা প্রথম জীবনে টিউশনি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন বলে আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন। যদিও পেশার ঘরে গৃহিণী লেখা রয়েছে। তার নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের বেশিরভাগ তার স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ দ্বারা অর্জিত। বর্তমানে মিরপুরে নির্মিত ৬ তলা বিশিষ্ট বাড়ির ভাড়ায় জীবনধারণ করছেন।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১ মামলা এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফান্ডেড প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আরও ২৭ মামলা দায়ের করে দুদক। পরে ফান্ডেড মোট ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। যেখানে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের আসামি করা হয়।