নারীর ক্ষমতায়ন ও টেকসই উন্নয়ন

জিল্লুর রহমান

এক সময় নারীরা সমাজে চরম অবহেলিত, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার পাত্র ছিল এবং শুধুমাত্র শিশু পালন ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত কাজের জন্য বিবেচনা করা হতো। তবে এখন সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাদের সমাজের মূলধারার আলোকশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা রাজনীতি, ব্যবসা, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকান্ড, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। এটা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক পদক্ষেপ। তারা সমাজের সর্বত্র এবং প্রতিটি স্তরকে আলোকিত করছে। এগুলোকে লিঙ্গ সমতার প্রতিফলনের জন্য বিবেচনা করা হয়; যা সামাজিক উন্নয়ন এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন।

নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়ন দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং লিঙ্গ সমতা অর্জন করার জন্য অপরিহার্য। অনেক বিশ্ব নেতা এবং পন্ডিত যুক্তি দিয়েছেন যে লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। টেকসই উন্নয়ন পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গ্রহণ করে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীরা পুরুষের মতো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না।

এটা বলা দরকার যে, শিক্ষা নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাদের আরও ভালো চাকরি খুঁজে পেতে সহায়তা করে এবং তারা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে উৎসাহ বোধ করে। তারা জনস্বার্থে যুক্তি তর্ক করে এবং স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য অধিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি পেশ করে। বিশেষ করে, শিক্ষা নারীদের এমন পছন্দ করার ক্ষমতা দেয় যা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য, তাদের সুস্থতা এবং সংগ্রামী জীবনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে উন্নত করে।

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও শিক্ষা সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ নয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য এখনও বজায় রয়েছে। অনেক দেশে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হল শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তা নয় বরং যারা শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করছে তাদের জন্য শিক্ষার পথও ক্ষেত্র বিশেষে সীমিত। আরও বিশেষভাবে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষায় মেয়েদের কম অংশগ্রহণ এবং শেখার অর্জনকে মোকাবেলা করার জন্য আরও প্রচেষ্টা থাকা উচিত।

বাংলাদেশে সময়ের সাথে সাথে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল যেখানে মাত্র ১০ ভাগ, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা হয়েছে ৩৬ ভাগ। অর্থাৎ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। কৃষি, তৈরি পোশাক, ব্যাংক, অফিস-আদালতসহ কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৩৬ ভাগ নারী রয়েছে। শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে নয়, অনেক অপ্রচলিত ও উদীয়মান আনুষ্ঠানিক খাতে, যেমন হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও বীমা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের নারীদের জন্য উচ্চমূল্যের চাকরির বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে।

কিন্তু শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু কারণ বাধা হিসেবে কাজ করে। অবকাঠামোর অভাব যেমন, পরিবহন, টয়লেট, শিশু যত্নের সুবিধা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার অভাব তাদের চাকরির বাজারে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাল্যবিবাহ আরেকটি কারণ, যা মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেয় না।

সমাজে নারীর ক্রমাগত অবদান সামগ্রিকভাবে সমাজকে আলোকিত করার জন্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সত্যিই চিত্তাকর্ষক এবং এটি সমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে। সরকারের উচিত তাদের অগ্রগতি ও নারীর ক্ষমতায়নের পথের জন্য তাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখা, যা তাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের গল্প হিসেবে দেখায়। কারণ একজন শিক্ষিত মা শুধু নিজেকেই নয়, একটি পরিবারকে ও ধীরে ধীরে একটি সমাজ এবং অবশেষে একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আলোর পথ দেখায়, আলোক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

[লেখক : ব্যাংকার]

আরও খবর

বুধবার, ১৫ মার্চ ২০২৩ , ৩০ ফাল্গুন ১৪২৯, ২২ শবান ১৪৪৪

নারীর ক্ষমতায়ন ও টেকসই উন্নয়ন

জিল্লুর রহমান

এক সময় নারীরা সমাজে চরম অবহেলিত, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার পাত্র ছিল এবং শুধুমাত্র শিশু পালন ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত কাজের জন্য বিবেচনা করা হতো। তবে এখন সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাদের সমাজের মূলধারার আলোকশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা রাজনীতি, ব্যবসা, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকান্ড, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। এটা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক পদক্ষেপ। তারা সমাজের সর্বত্র এবং প্রতিটি স্তরকে আলোকিত করছে। এগুলোকে লিঙ্গ সমতার প্রতিফলনের জন্য বিবেচনা করা হয়; যা সামাজিক উন্নয়ন এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন।

নারীর অগ্রযাত্রা ও ক্ষমতায়ন দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং লিঙ্গ সমতা অর্জন করার জন্য অপরিহার্য। অনেক বিশ্ব নেতা এবং পন্ডিত যুক্তি দিয়েছেন যে লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। টেকসই উন্নয়ন পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গ্রহণ করে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীরা পুরুষের মতো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না।

এটা বলা দরকার যে, শিক্ষা নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাদের আরও ভালো চাকরি খুঁজে পেতে সহায়তা করে এবং তারা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে উৎসাহ বোধ করে। তারা জনস্বার্থে যুক্তি তর্ক করে এবং স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য অধিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি পেশ করে। বিশেষ করে, শিক্ষা নারীদের এমন পছন্দ করার ক্ষমতা দেয় যা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য, তাদের সুস্থতা এবং সংগ্রামী জীবনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে উন্নত করে।

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও শিক্ষা সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ নয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য এখনও বজায় রয়েছে। অনেক দেশে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হল শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তা নয় বরং যারা শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করছে তাদের জন্য শিক্ষার পথও ক্ষেত্র বিশেষে সীমিত। আরও বিশেষভাবে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষায় মেয়েদের কম অংশগ্রহণ এবং শেখার অর্জনকে মোকাবেলা করার জন্য আরও প্রচেষ্টা থাকা উচিত।

বাংলাদেশে সময়ের সাথে সাথে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল যেখানে মাত্র ১০ ভাগ, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা হয়েছে ৩৬ ভাগ। অর্থাৎ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। কৃষি, তৈরি পোশাক, ব্যাংক, অফিস-আদালতসহ কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৩৬ ভাগ নারী রয়েছে। শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে নয়, অনেক অপ্রচলিত ও উদীয়মান আনুষ্ঠানিক খাতে, যেমন হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও বীমা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের নারীদের জন্য উচ্চমূল্যের চাকরির বাজারে প্রবেশের সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে।

কিন্তু শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু কারণ বাধা হিসেবে কাজ করে। অবকাঠামোর অভাব যেমন, পরিবহন, টয়লেট, শিশু যত্নের সুবিধা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার অভাব তাদের চাকরির বাজারে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাল্যবিবাহ আরেকটি কারণ, যা মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেয় না।

সমাজে নারীর ক্রমাগত অবদান সামগ্রিকভাবে সমাজকে আলোকিত করার জন্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সত্যিই চিত্তাকর্ষক এবং এটি সমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে। সরকারের উচিত তাদের অগ্রগতি ও নারীর ক্ষমতায়নের পথের জন্য তাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখা, যা তাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের গল্প হিসেবে দেখায়। কারণ একজন শিক্ষিত মা শুধু নিজেকেই নয়, একটি পরিবারকে ও ধীরে ধীরে একটি সমাজ এবং অবশেষে একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আলোর পথ দেখায়, আলোক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

[লেখক : ব্যাংকার]