অনুবাদ-দপ্তর : একটি প্রস্তাব

পবিত্র সরকার

১ ভূমিকা

গত ১০ মার্চ, ‘২০২৪ তারিখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সভাঘরে শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলনের উদ্বোধন ছিল। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে, যেমন হয়, সাহিত্যের উৎকর্ষ আর আন্তর্জাতিকায়নের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভাষা বিভাগগুলির সঙ্গে যুক্ত একটি করে ‘ট্রানস্লেশন সেল’ বা অনুবাদ-দপ্তর (‘কক্ষ’, ‘প্রকোষ্ঠ’, ‘উদ্যোগ’, ‘সংস্থা’, ‘কুঠি’, ‘কৃত্যক’ ইত্যাদি পরিভাষাও ব্যবহার করা যায়) প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। যে দপ্তর বাংলা সাহিত্যের বিদেশি ভাষায় অনুবাদের আয়োজন এবং উত্তম অনুবাদের প্রকাশ করবে বা প্রকাশের উদ্যোগ নেবে। উলটোটাও করবে, অর্থাৎ বিদেশি ভাষার ভালো বইয়ের বাংলা অনুবাদের ব্যবস্থা করবে। প্রস্তাবটি অভিনব বা মৌলিক কিছু নয়, নিশ্চয় আমারও আগে এর প্রয়োজনের কথা কেউ কেউ বলে থাকবেন। সেদিন পরের বক্তৃতায় কেউ কেউ এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন, আবার তারই মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহও প্রকাশ করেছিলেন যে, এতে সত্যই কোনও কাজ হবে কি না।

এখন উৎসাহী কবি ও লেখকেরা অনেকে নিজেদের উদ্যোগে অনুবাদ করান নিজেদের রচনার, আবার ‘শব্দঘর’-এর মতো পত্রিকা নিজেরা ব্যবস্থা করেন অনুবাদের। এই পত্রিকাটির মতো এমন দ্বিভাষিক উদ্যোগ অন্যত্র খুব একটা লক্ষ্য করি না, যদিও আমি সব দেখতে পাই, তাও নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে ‘শব্দঘর’-এর মতো পত্রিকার উদ্যোগ সব সময় বেশি বাঞ্ছনীয়, কারণ পত্রিকা একটি পাবলিক স্পেস বা ‘জনপরিসর’-এর জিনিস, তার ক্ষেত্রে রচনার নির্বাচন, গুণমান ইত্যাদির জন্য পাঠকদের কাছে জবাবদিহির দায় আছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের সেটা থাকে না।

আমরা ভেবেছিলাম, যাকে জনপরিসরে সবচেয়ে বেশি হাজির থাকতে হয়, সেই রাষ্ট্র এই বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নিতে পারে কি না। তার ঝুঁকি যে নেই তা নয়, সে কথা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। কিন্তু আমার লক্ষ্য প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ এবং তার অধীনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যেগুলিতে একাধিক ভাষা ও সেই ভাষার সাহিত্য শেখানোর ব্যবস্থা আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই যে করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। বাংলা একাডেমিও এই কাজ করতে পারে, বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

১. প্রশাসনিক সংগঠন

দক্ষিণ এশিয়া ক্ষেত্রের এই অর্থসংকটের দিনে একটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ তৈরি করা যে কোনও সরকারের পক্ষেই কঠিন, কারণ মানুষের অন্নবস্ত্রআশ্রয়শিক্ষাচিকিৎসা ইত্যাদির বিপুল আয়োজন তাকে করতে হয়, আর দেশ জুড়ে পরিকাঠামো খাতে বিপুল ব্যয়ও তার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে। ফলে একটি পিরামিড সংগঠনের প্রশাসনিক কাঠামো এবং নতুন পদ সৃষ্টি ও কর্মীনিয়োগ না করে এই একটা বিকল্প কাঠামো ভাবা যেতে পারে, বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে রেখে। ভাষা বিভাগগুলির কোনও প্রবীণ অধ্যাপককে কিছু কিছু অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে এই কৃত্যকের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। স্থায়ী কর্মীর বদলে অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে বহাল কর্মীদেরই এর চিঠিপত্র টাইপ করা, ফাইল করা ও সংরক্ষণ ইত্যাদির দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এই দপ্তরের কাজ হবে মূলত চিঠিপত্র লেখা, বিশেষজ্ঞদের সভা বসানো ও তাঁদের মতামত ও সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা। সিদ্ধান্তগুলি প্রাথমিকভাবে হল কোন্ বই বাছা হবে অনুবাদের জন্য? ঐক্যমত্যের বা সংখ্যাগুরুর মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে। আমি জানি, পুরস্কারের মতো এ সব ব্যাপারেও তদ্বির চলে, রাজনৈতিক চাপও আসতে পারে, কিন্তু দপ্তরকে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যে বই নির্বাচিত হল সে সম্বন্ধে জনমতও যাচাই করতে পারে এই দপ্তর।

২. অনুবাদের জন্য গ্রন্থ নির্বাচন

বলা বাহুল্য, অনুবাদযোগ্য গ্রন্থের নির্বাচন হবে দুদিক থেকে- বাংলা থেকে কোন্ বই অনুবাদ করতে হবে, এবং অন্য ভাষা থেকে কোন্ বই বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। বাংলা থেকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের জন্য, শুধু ইংরেজিতে নয়, অন্যান্য ভাষাতেও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশেষজ্ঞ সমিতি তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এটি করতে পারে, আবার রাষ্ট্রও কেন্দ্রীয়ভাবে এই ব্যবস্থা করতে পারে। তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি কাজই হল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা। তা সে নানাবিধ পুরস্কার দিয়ে যেমন করতে পারে, তেমনই উন্নতমানের গ্রন্থের অনুবাদের ব্যবস্থা করেও তা করতে পারে- দুটি কাজ একে অন্যের বিকল্প নয়। প্রাথমিকভাবে ইংরেজি অনুবাদের কথাই ভাবা যেতে পারে, কারণ ইংরেজির মধ্য দিয়ে ভালো বই পৃথিবীর বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে সহজেই পৌঁছায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমি প্রাদেশিক বাইশটি এবং সম্ভবত আরও দুটি ভাষায়, যে বই পুরস্কৃত হয় সেগুলির অন্য সব প্রধান ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করে। আমি জানি, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের অনুবাদকেরা যথেষ্ট উদ্যোগী, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলার পাঠ-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আর, অনুবাদ শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্যের হবে না, হবে জ্ঞানভিত্তিক নানা গ্রন্থেরও। কারণ মাতৃভাষা বাংলায় সর্বস্তরের শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্ম চালাতে হলে আমাদের ভাষার জ্ঞানভিত্তিও বাড়াতে হবে, নানা উচ্চমানের পাঠ্যবই অনুবাদ করে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি এবং স্বাধীন প্রকাশকেরাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

বিদেশি ভাষা থেকে বিশেষত উচ্চমানের পাঠ্যগ্রন্থ অনুবাদের উপর জোর দিতে হবে। সাহিত্যের ক্লাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ বই হয়তো বেসরকারি প্রকাশকেরাই নিজেরা এগিয়ে এসে ছাপবেন, এখন যেমন হচ্ছে। তার, এবং নতুন মূল্যবান গ্রন্থের নির্বাচনও বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই হবে, অনুবাদের দপ্তরের কাজ হবে সেই বিশেষজ্ঞদের সমিতি গঠন করে তাঁদের পরামর্শ চাওয়া। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক ভাষাশিক্ষার কেন্দ্রগুলির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদেরও এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। তাঁরা ফরাসি, স্প্যানিশ, জাপানি, চিনা, কোরীয় ইত্যাদি ভাষার বই যেমন অনুবাদের জন্য প্রস্তাব করবেন, তেমনই বাংলা বইও ওই সব ভাষায় অনুবাদের কাজের সঙ্গে জড়িত হবেন। আর যে সমস্ত ভাষা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগগুলিতে শেখানো হয়, ক্লাসিকাল ও আধুনিক, সেগুলিতে আর সেগুলি থেকেও অনুবাদ তো চলবেই।

বাংলাদেশে একটা জিনিস লক্ষ করি যে, বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানও- ব্যাংক, শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী ইত্যাদি সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা পুরস্কার দেয় এবং আরও নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। তারাও যদি অনুবাদের জন্য (দু-দিকেই- বাংলা থেকে, আর বাংলায়) অনুবাদের জন্য পুরস্কার দেয় তা হলে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে সমর্থনের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বাংলা একাডেমিও বিদেশিদের করা বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের জন্য তাঁদের পুরস্কার দিতে পারেন, হয়তো এখনই দেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অধ্যাপক আজুমা (জাপান), দং (চিন), ফ্রান্স ভট্টাচার্য, জীন ওপেনশ’, (ফ্রান্স), ক্লিন্টন সিলি, রাল্ফ্ নিকোলাস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রভৃতিকে এর মধ্যেই পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে তাঁদের অনুবাদ-করা বইয়ের কিছু কপিও আমাদের দূতাবাসের লাইব্রেরিগুলি কিনে নিতে পারে, যেমন মাসাইয়ুকি ওনিশির করা রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’র অনুবাদের দুশো কপি জাপানের ভারতীয় দূতাবাস কিনে নিয়েছে।

৩. বিদেশি ও স্বাধীন অনুবাদকদের ভূমিকা

পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিকাগো, প্রিন্সটন, বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলাডেলফিয়ার পেন্?সিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের তোকিয়োর বিদেশি বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, এবং সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে লন্ডন বিশ্বিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের নাম উল্লেখ করতে পারি। রুশ দেশের লেনিনগ্রাদে আর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাহার চার্লস বিশ্বিদ্যালয়ে একসময় বাংলা বিভাগ ছিল, ইতালির রোম বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল। চিনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা বিভাগ এই কাজে রীতিমতো সক্রিয়। সবগুলিতে সমান শক্তি নিয়ে টিকে আছে এমন হয়তো বলা যায় না।

তবু এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ছাত্র, যাঁরা পরে লেখাপড়ার জগতে এসেছে, তারা বাংলা থেকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ শুরু করেছে, এবং তার তালিকা ক্রমবিস্তারিত হয়ে চলেছে। শিকাগোর এডোয়ার্ড ডিমক বৈষ্ণব পদাবলি অনুবাদ করেছেন, তাঁর ছাত্র ক্লিন্টন সিলি জীবনানন্দের, মাইকেল মধুসূদন দত্তের। লন্ডনের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন নতুন করে, তাঁর ছাত্র জো উইন্টারও, যিনি জীবনান্দও অনুবাদ করেছেন মুগ্ধতা নিয়ে। জাপানে প্রচুর অনুবাদ হয়ে চলেছে, শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়। আমাদের ছাত্র মাসাইযুকি ওনিশি তারাশঙ্করের গল্প অনুবাদ করেছে। খ্যাতনামা বাঙালি অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বিদেশিদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। মেলবোর্ন থেকে মেরিয়ান ম্যাডার্ন বাংলা কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।

গায়ত্রীর সূত্রে বলা উচিত যে, বহু বাঙালিও ইংরেজিতে বহুজনের কবিতা ও গল্প উপন্যাস অনুবাদ করেছেন, করে চলেছেন। সম্প্রতি তরুণ ঘটক মূল স্প্যানিশ থেকে সেরভেন্তেস-এর ‘দোন কিহোতে’র চমৎকার অনুবাদ করেছেন বাংলায়। বাংলাদেশের গোলাম হোসেন হাবীব আর আলম খোরশেদের নাম আমি জানি, যাঁরা স্বাধীনভাবে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁদের প্রকাশকেরা তাঁদের সমর্থন করে চলেছেন, সেও এক অভিনন্দনযোগ্য ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ দপ্তরে এই সব অনুবাদের একটি তথ্যভিত্তি তৈরি করতে পারে।

৪. আর কী করতে পারে

আর পারে অনুবাদ-তত্ত্ব ও প্রয়োগ সম্বন্ধে সাহিত্যের বিভাগগুলির সঙ্গে, বা বাংলা একাডেমি কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্তভাবে নানা কর্মশালা ও আলোচনাচক্রের আয়োজন করতে, যা থেকে অনুবাদে আগ্রহীরা উপকৃত হবে। অনুবাদ তত্ত্ব এখন নানা জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে, তবু সে সম্বন্ধে সাধারণ কিছু ধারণা অনুবাদ-ইচ্ছুকদের থাকা দরকার। মূল বিষয়টা খুব কঠিন নয়। দুটি ভাষা, উৎস ভাষা আর লক্ষ্য ভাষা সমানভাবে জানতে হবে, বিশেষত লেখার ভাষা। লেখার ভাষা- কবিতা হোক, গদ্য হোক- কিছুটা আলাদা ব্যাকরণ বহন করে। সেগুলি শুধু মুখের ভাষাটি জানলেই জানা যায় না। তাই অনেক সময় দুই ভাষার দু-জন অনুবাদক পরস্পরের সহযোগিতা করেন, তাতে অনুবাদের রূপগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি হয়। সমস্যার জায়গা হল ‘সাংস্কৃতিক’ অর্থবহ শব্দ ও বাক্যবন্ধ, প্রবাদ ও বাগ্?ধারা, অলংকার ও চিত্রকল্প ইত্যাদি, যেগুলি সম্বন্ধে অনুবাদ তত্ত্বে নিরন্তর আলোচনা চলে।

শুধু দুই ভাষার দুইজন অনুবাদক নয়। অনেক সময় এক ভাষার অনুবাদকেও দুজনের হাত লাগানো দরকার হয়। বিশেষত কবিতায়। একজন নিছক অনুগত অনুবাদ করে গেলেন, অন্যজন তার শৈলীগত উৎকর্ষ বিধান করলেন। এডোয়ার্ড ডিমক বৈষ্ণব কবিতার অনুবাদক In Praise of Krishna-তে মার্কিন কবি ডেনিজ লেভের্টভের সহায়তা নিয়েছিলেন বলেই তা ওদেশে অমন সাড়া ফেলেছিল এবং তথাকথিত ‘হরেকৃষ্ণ’ সম্প্রদায়ের কাছে প্রায় গীতা হয়ে উঠেছিল।

৫. শেষের কথা

আমার এই লেখা কোনও শেষ কথা বলার স্পর্ধা রাখে না। এ নিয়ে দুই বাংলার বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই আলোচনা করবেন এবং এর গ্রহণযোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা, সম্ভাব্যতা অসম্ভাব্যতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করবেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্য থেকে অনুবাদের, এবং অন্য সাহিত্য থেকে বাংলা অনুবাদের, ব্যক্তিগত প্রয়াসের বাইরেও, যে একটি সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস থাকা দরকার, সেই দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই এই ক-টি কথা পেশ করা।

image

প্রথমবারের মতো আয়োজিত শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলনে ভারতের বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ, লেখক ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকারের উদ্বোধনী বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ রূপ এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি। গত ১০ মার্চ সম্মিলনের উদ্বোধন করেন ছবিতে বাঁ দিক থেকে নেপালের বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক সুমন পোখরেল, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অধ্যাপক পবিত্র সরকার ও বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন

আরও খবর
আড্ডার আনন্দে অবগাহন
কাইয়ুম চৌধুরীকে শ্রদ্ধা
শব্দপথে মুগ্ধযাত্রা
নীল মর্গের কোরাস
‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’
করোনা কড়চা, একটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

অনুবাদ-দপ্তর : একটি প্রস্তাব

পবিত্র সরকার

image

প্রথমবারের মতো আয়োজিত শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলনে ভারতের বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ, লেখক ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকারের উদ্বোধনী বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ রূপ এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি। গত ১০ মার্চ সম্মিলনের উদ্বোধন করেন ছবিতে বাঁ দিক থেকে নেপালের বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক সুমন পোখরেল, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অধ্যাপক পবিত্র সরকার ও বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন

১ ভূমিকা

গত ১০ মার্চ, ‘২০২৪ তারিখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সভাঘরে শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলনের উদ্বোধন ছিল। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে, যেমন হয়, সাহিত্যের উৎকর্ষ আর আন্তর্জাতিকায়নের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভাষা বিভাগগুলির সঙ্গে যুক্ত একটি করে ‘ট্রানস্লেশন সেল’ বা অনুবাদ-দপ্তর (‘কক্ষ’, ‘প্রকোষ্ঠ’, ‘উদ্যোগ’, ‘সংস্থা’, ‘কুঠি’, ‘কৃত্যক’ ইত্যাদি পরিভাষাও ব্যবহার করা যায়) প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। যে দপ্তর বাংলা সাহিত্যের বিদেশি ভাষায় অনুবাদের আয়োজন এবং উত্তম অনুবাদের প্রকাশ করবে বা প্রকাশের উদ্যোগ নেবে। উলটোটাও করবে, অর্থাৎ বিদেশি ভাষার ভালো বইয়ের বাংলা অনুবাদের ব্যবস্থা করবে। প্রস্তাবটি অভিনব বা মৌলিক কিছু নয়, নিশ্চয় আমারও আগে এর প্রয়োজনের কথা কেউ কেউ বলে থাকবেন। সেদিন পরের বক্তৃতায় কেউ কেউ এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন, আবার তারই মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহও প্রকাশ করেছিলেন যে, এতে সত্যই কোনও কাজ হবে কি না।

এখন উৎসাহী কবি ও লেখকেরা অনেকে নিজেদের উদ্যোগে অনুবাদ করান নিজেদের রচনার, আবার ‘শব্দঘর’-এর মতো পত্রিকা নিজেরা ব্যবস্থা করেন অনুবাদের। এই পত্রিকাটির মতো এমন দ্বিভাষিক উদ্যোগ অন্যত্র খুব একটা লক্ষ্য করি না, যদিও আমি সব দেখতে পাই, তাও নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে ‘শব্দঘর’-এর মতো পত্রিকার উদ্যোগ সব সময় বেশি বাঞ্ছনীয়, কারণ পত্রিকা একটি পাবলিক স্পেস বা ‘জনপরিসর’-এর জিনিস, তার ক্ষেত্রে রচনার নির্বাচন, গুণমান ইত্যাদির জন্য পাঠকদের কাছে জবাবদিহির দায় আছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের সেটা থাকে না।

আমরা ভেবেছিলাম, যাকে জনপরিসরে সবচেয়ে বেশি হাজির থাকতে হয়, সেই রাষ্ট্র এই বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নিতে পারে কি না। তার ঝুঁকি যে নেই তা নয়, সে কথা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। কিন্তু আমার লক্ষ্য প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ এবং তার অধীনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যেগুলিতে একাধিক ভাষা ও সেই ভাষার সাহিত্য শেখানোর ব্যবস্থা আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই যে করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। বাংলা একাডেমিও এই কাজ করতে পারে, বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

১. প্রশাসনিক সংগঠন

দক্ষিণ এশিয়া ক্ষেত্রের এই অর্থসংকটের দিনে একটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ তৈরি করা যে কোনও সরকারের পক্ষেই কঠিন, কারণ মানুষের অন্নবস্ত্রআশ্রয়শিক্ষাচিকিৎসা ইত্যাদির বিপুল আয়োজন তাকে করতে হয়, আর দেশ জুড়ে পরিকাঠামো খাতে বিপুল ব্যয়ও তার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে। ফলে একটি পিরামিড সংগঠনের প্রশাসনিক কাঠামো এবং নতুন পদ সৃষ্টি ও কর্মীনিয়োগ না করে এই একটা বিকল্প কাঠামো ভাবা যেতে পারে, বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে রেখে। ভাষা বিভাগগুলির কোনও প্রবীণ অধ্যাপককে কিছু কিছু অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে এই কৃত্যকের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। স্থায়ী কর্মীর বদলে অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে বহাল কর্মীদেরই এর চিঠিপত্র টাইপ করা, ফাইল করা ও সংরক্ষণ ইত্যাদির দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এই দপ্তরের কাজ হবে মূলত চিঠিপত্র লেখা, বিশেষজ্ঞদের সভা বসানো ও তাঁদের মতামত ও সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা। সিদ্ধান্তগুলি প্রাথমিকভাবে হল কোন্ বই বাছা হবে অনুবাদের জন্য? ঐক্যমত্যের বা সংখ্যাগুরুর মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে। আমি জানি, পুরস্কারের মতো এ সব ব্যাপারেও তদ্বির চলে, রাজনৈতিক চাপও আসতে পারে, কিন্তু দপ্তরকে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যে বই নির্বাচিত হল সে সম্বন্ধে জনমতও যাচাই করতে পারে এই দপ্তর।

২. অনুবাদের জন্য গ্রন্থ নির্বাচন

বলা বাহুল্য, অনুবাদযোগ্য গ্রন্থের নির্বাচন হবে দুদিক থেকে- বাংলা থেকে কোন্ বই অনুবাদ করতে হবে, এবং অন্য ভাষা থেকে কোন্ বই বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। বাংলা থেকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের জন্য, শুধু ইংরেজিতে নয়, অন্যান্য ভাষাতেও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশেষজ্ঞ সমিতি তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এটি করতে পারে, আবার রাষ্ট্রও কেন্দ্রীয়ভাবে এই ব্যবস্থা করতে পারে। তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি কাজই হল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা। তা সে নানাবিধ পুরস্কার দিয়ে যেমন করতে পারে, তেমনই উন্নতমানের গ্রন্থের অনুবাদের ব্যবস্থা করেও তা করতে পারে- দুটি কাজ একে অন্যের বিকল্প নয়। প্রাথমিকভাবে ইংরেজি অনুবাদের কথাই ভাবা যেতে পারে, কারণ ইংরেজির মধ্য দিয়ে ভালো বই পৃথিবীর বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে সহজেই পৌঁছায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমি প্রাদেশিক বাইশটি এবং সম্ভবত আরও দুটি ভাষায়, যে বই পুরস্কৃত হয় সেগুলির অন্য সব প্রধান ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করে। আমি জানি, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের অনুবাদকেরা যথেষ্ট উদ্যোগী, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলার পাঠ-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আর, অনুবাদ শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্যের হবে না, হবে জ্ঞানভিত্তিক নানা গ্রন্থেরও। কারণ মাতৃভাষা বাংলায় সর্বস্তরের শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্ম চালাতে হলে আমাদের ভাষার জ্ঞানভিত্তিও বাড়াতে হবে, নানা উচ্চমানের পাঠ্যবই অনুবাদ করে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি এবং স্বাধীন প্রকাশকেরাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

বিদেশি ভাষা থেকে বিশেষত উচ্চমানের পাঠ্যগ্রন্থ অনুবাদের উপর জোর দিতে হবে। সাহিত্যের ক্লাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ বই হয়তো বেসরকারি প্রকাশকেরাই নিজেরা এগিয়ে এসে ছাপবেন, এখন যেমন হচ্ছে। তার, এবং নতুন মূল্যবান গ্রন্থের নির্বাচনও বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই হবে, অনুবাদের দপ্তরের কাজ হবে সেই বিশেষজ্ঞদের সমিতি গঠন করে তাঁদের পরামর্শ চাওয়া। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক ভাষাশিক্ষার কেন্দ্রগুলির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদেরও এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। তাঁরা ফরাসি, স্প্যানিশ, জাপানি, চিনা, কোরীয় ইত্যাদি ভাষার বই যেমন অনুবাদের জন্য প্রস্তাব করবেন, তেমনই বাংলা বইও ওই সব ভাষায় অনুবাদের কাজের সঙ্গে জড়িত হবেন। আর যে সমস্ত ভাষা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগগুলিতে শেখানো হয়, ক্লাসিকাল ও আধুনিক, সেগুলিতে আর সেগুলি থেকেও অনুবাদ তো চলবেই।

বাংলাদেশে একটা জিনিস লক্ষ করি যে, বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানও- ব্যাংক, শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী ইত্যাদি সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা পুরস্কার দেয় এবং আরও নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। তারাও যদি অনুবাদের জন্য (দু-দিকেই- বাংলা থেকে, আর বাংলায়) অনুবাদের জন্য পুরস্কার দেয় তা হলে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে সমর্থনের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বাংলা একাডেমিও বিদেশিদের করা বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের জন্য তাঁদের পুরস্কার দিতে পারেন, হয়তো এখনই দেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অধ্যাপক আজুমা (জাপান), দং (চিন), ফ্রান্স ভট্টাচার্য, জীন ওপেনশ’, (ফ্রান্স), ক্লিন্টন সিলি, রাল্ফ্ নিকোলাস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রভৃতিকে এর মধ্যেই পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে তাঁদের অনুবাদ-করা বইয়ের কিছু কপিও আমাদের দূতাবাসের লাইব্রেরিগুলি কিনে নিতে পারে, যেমন মাসাইয়ুকি ওনিশির করা রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’র অনুবাদের দুশো কপি জাপানের ভারতীয় দূতাবাস কিনে নিয়েছে।

৩. বিদেশি ও স্বাধীন অনুবাদকদের ভূমিকা

পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিকাগো, প্রিন্সটন, বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলাডেলফিয়ার পেন্?সিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের তোকিয়োর বিদেশি বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, এবং সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে লন্ডন বিশ্বিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের নাম উল্লেখ করতে পারি। রুশ দেশের লেনিনগ্রাদে আর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাহার চার্লস বিশ্বিদ্যালয়ে একসময় বাংলা বিভাগ ছিল, ইতালির রোম বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল। চিনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা বিভাগ এই কাজে রীতিমতো সক্রিয়। সবগুলিতে সমান শক্তি নিয়ে টিকে আছে এমন হয়তো বলা যায় না।

তবু এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ছাত্র, যাঁরা পরে লেখাপড়ার জগতে এসেছে, তারা বাংলা থেকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ শুরু করেছে, এবং তার তালিকা ক্রমবিস্তারিত হয়ে চলেছে। শিকাগোর এডোয়ার্ড ডিমক বৈষ্ণব পদাবলি অনুবাদ করেছেন, তাঁর ছাত্র ক্লিন্টন সিলি জীবনানন্দের, মাইকেল মধুসূদন দত্তের। লন্ডনের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন নতুন করে, তাঁর ছাত্র জো উইন্টারও, যিনি জীবনান্দও অনুবাদ করেছেন মুগ্ধতা নিয়ে। জাপানে প্রচুর অনুবাদ হয়ে চলেছে, শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়। আমাদের ছাত্র মাসাইযুকি ওনিশি তারাশঙ্করের গল্প অনুবাদ করেছে। খ্যাতনামা বাঙালি অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বিদেশিদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। মেলবোর্ন থেকে মেরিয়ান ম্যাডার্ন বাংলা কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।

গায়ত্রীর সূত্রে বলা উচিত যে, বহু বাঙালিও ইংরেজিতে বহুজনের কবিতা ও গল্প উপন্যাস অনুবাদ করেছেন, করে চলেছেন। সম্প্রতি তরুণ ঘটক মূল স্প্যানিশ থেকে সেরভেন্তেস-এর ‘দোন কিহোতে’র চমৎকার অনুবাদ করেছেন বাংলায়। বাংলাদেশের গোলাম হোসেন হাবীব আর আলম খোরশেদের নাম আমি জানি, যাঁরা স্বাধীনভাবে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁদের প্রকাশকেরা তাঁদের সমর্থন করে চলেছেন, সেও এক অভিনন্দনযোগ্য ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ দপ্তরে এই সব অনুবাদের একটি তথ্যভিত্তি তৈরি করতে পারে।

৪. আর কী করতে পারে

আর পারে অনুবাদ-তত্ত্ব ও প্রয়োগ সম্বন্ধে সাহিত্যের বিভাগগুলির সঙ্গে, বা বাংলা একাডেমি কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্তভাবে নানা কর্মশালা ও আলোচনাচক্রের আয়োজন করতে, যা থেকে অনুবাদে আগ্রহীরা উপকৃত হবে। অনুবাদ তত্ত্ব এখন নানা জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে, তবু সে সম্বন্ধে সাধারণ কিছু ধারণা অনুবাদ-ইচ্ছুকদের থাকা দরকার। মূল বিষয়টা খুব কঠিন নয়। দুটি ভাষা, উৎস ভাষা আর লক্ষ্য ভাষা সমানভাবে জানতে হবে, বিশেষত লেখার ভাষা। লেখার ভাষা- কবিতা হোক, গদ্য হোক- কিছুটা আলাদা ব্যাকরণ বহন করে। সেগুলি শুধু মুখের ভাষাটি জানলেই জানা যায় না। তাই অনেক সময় দুই ভাষার দু-জন অনুবাদক পরস্পরের সহযোগিতা করেন, তাতে অনুবাদের রূপগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি হয়। সমস্যার জায়গা হল ‘সাংস্কৃতিক’ অর্থবহ শব্দ ও বাক্যবন্ধ, প্রবাদ ও বাগ্?ধারা, অলংকার ও চিত্রকল্প ইত্যাদি, যেগুলি সম্বন্ধে অনুবাদ তত্ত্বে নিরন্তর আলোচনা চলে।

শুধু দুই ভাষার দুইজন অনুবাদক নয়। অনেক সময় এক ভাষার অনুবাদকেও দুজনের হাত লাগানো দরকার হয়। বিশেষত কবিতায়। একজন নিছক অনুগত অনুবাদ করে গেলেন, অন্যজন তার শৈলীগত উৎকর্ষ বিধান করলেন। এডোয়ার্ড ডিমক বৈষ্ণব কবিতার অনুবাদক In Praise of Krishna-তে মার্কিন কবি ডেনিজ লেভের্টভের সহায়তা নিয়েছিলেন বলেই তা ওদেশে অমন সাড়া ফেলেছিল এবং তথাকথিত ‘হরেকৃষ্ণ’ সম্প্রদায়ের কাছে প্রায় গীতা হয়ে উঠেছিল।

৫. শেষের কথা

আমার এই লেখা কোনও শেষ কথা বলার স্পর্ধা রাখে না। এ নিয়ে দুই বাংলার বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই আলোচনা করবেন এবং এর গ্রহণযোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা, সম্ভাব্যতা অসম্ভাব্যতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করবেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্য থেকে অনুবাদের, এবং অন্য সাহিত্য থেকে বাংলা অনুবাদের, ব্যক্তিগত প্রয়াসের বাইরেও, যে একটি সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস থাকা দরকার, সেই দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই এই ক-টি কথা পেশ করা।