আড্ডার আনন্দে অবগাহন

ফারুক মাহমুদ

লেখকের মধ্যে দু’ধরনের চরিত্রই লক্ষ্য করা যায়। এক ধরনের লেখক হন নিভৃতচারী, ঘরকুনো। তাদের অন্তর্মুখীও বলা চলে। পড়েন, লেখেন ও থাকেন নিজের পরিমন্ডলের মধ্যে। আর এক ধরনের লেখক থাকেন আড্ডাপ্রিয়। আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। যারা আড্ডা দিতে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যেও আবার দু’ধরনের লেখক থাকেন। একদল আছেন, আড্ডায় ঠিকই উপস্থিত থাকেন, কথা বেশি একটা বলেন না, সবার কথা শোনেন। মাঝে-মধ্যে মন্তব্য করেন বটে। অন্য দলে যারা আছেন, তারা প্রচুর বলেন, আড্ডা মাতিয়ে রাখেন। আড্ডায় যে সব সময় সোজা-সরল কথাবার্তা হয়, তা নয়, তর্ক-বিতর্কও হয়। তর্ক-বিতর্কের রূপটা কখনও কখনও বেশ উচ্চৈঃস্বরে চলে না। তারপরও আড্ডার গুরুত্ব এবং মাহাত্ম্যের কথা ভুলে যান না আড্ডা-প্রিয় মানুষেরা।

লেখকদের আড্ডার মূল সুরটাই থাকে লেখাকেন্দ্রিক। নিজের লেখা, অন্যের লেখা- প্রসঙ্গ সবই আসে। শুধু লেখালেখির বিষয় কেন, আড্ডার আসল বিষয়ের কোনো কেন্দ্রিকতা থাকে না। আড্ডার স্রোত যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। রাজনীতি, সমাজ কী থাকে না আড্ডার স্রোতে! আড্ডার স্রোত ভাসতে ভাসতে যে কোথায় চলে যায়, অনেক সময় কী দিয়ে আড্ডার সূত্রপাত হয়েছিল, তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আড্ডা এরকমই হয়। আড্ডা দীর্ঘস্থায়ী হয়। অর্থাৎ অনেকদিন থেকে চলতে থাকে আড্ডার আয়োজন। আবার কোনো-কোনো আড্ডা বেশি বয়স পায় না, ভেঙে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এতদিনকার সমবেত হওয়া মানুষগুলো।

ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া, কিছুকাল আগ পর্যন্ত ছোট-বড় যত আড্ডা হয়েছে বা হচ্ছে, এসবের প্রায় সবগুলোতে উপস্থিত থেকেছেন বা থাকছেন এমন কিছু মানুষের খোঁজ পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কেউ কেউ তো আড্ডার ‘প্রাণপুরুষ’ হয়ে আছেন। রফিক আজাদকে সানন্দে বিখ্যাত আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাকে ঘিরে ছোট-বড় কত আড্ডা যে গড়ে উঠেছে তার হিসাব নেই।

আড্ডা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রফিক আজাদ বলছেন, “সত্যি কথা বলতে কি আড্ডাই আমার প্রাণ। আমি সেই ‘তিমি’ যার আনন্দ অপার অসীম নীলজলে অবগাহনে। আড্ডাই আমার সেই অসেতুসম্ভব নীলজল, লোকেরা যাকে ‘সমুদ্র’ বলে থাকে। আমার অবগাহন সেই অগাধ, অপার, অতল নীলজলে। যাতে মালিন্য নেই, কাদাজল নেই, শুধু আনন্দের অবগাহন আছে।”

আড্ডা রফিক আজাদের রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। বাড়ির বৈঠকখানায় সমমনা গ্রামীণ মান্যজনদের সঙ্গে প্রতিদিন হুঁকোতে খাম্বিরা তামাক সাজিয়ে আড্ডায় বসতেন। বল যায় সধূম ধুম আড্ডা। শুধু খাম্বিয়া তামাকই নয়, বাড়ির ভেতর থেকে আসত কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ-সর্ষে তেল মাখা গামলা ভর্তি মুড়ি, আদা দেওয়া চা। সেই আড্ডা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর যেন কোনো শেষ নেই। রফিক আজাদ যখন খুব ছোট, বাবার সেই আড্ডা দৃশ্য দেখে দেখে আড্ডা তাঁর নেশাতেও পরিণত হয়েছে।

রফিক আজাদ আড্ডা দিয়েছেন খুব ছোটকাল থেকেই। বাবা নিজে আড্ডা দিতে পছন্দ করলেও ছেলে তার অড্ডাবাজ হয়ে উঠবে, তা তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু এতদিনে ছেলের তো আড্ডার নেশা পেয়ে বসেছে। এই আড্ডার জন্য আড্ডাবাজ বাবার হাতের মার খেয়ে খুব ছোট্টকালেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পালানোর পেছনে আরও একটা কারণ ছিল পি.সি. সরকারের কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক’ শিখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। মাঝপথ থেকে ফিরতে হয়েছিল।

সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাসের পর যখন কালিহাতি রায়গতি শ্রীগোবিন্দ হাই স্কুলে রফিক আজাদ ভর্তি হলেন, শুরু হলো অফুরন্ত এক স্বাধীন জীবন। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বাড়তে লাগল। তখন থেকে শুরু হলো আড্ডার এক নতুন অধ্যায়। ওই বিদ্যালয়ে বরাবর যে প্রথম হয়, তার নাম মঈন উদ্দিন আহমেদ। তার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল রফিক আজাদের। রফিক আজাদের ভাষায়, “আমার বন্ধু-বান্ধবই আমার আড্ডার গুরু। আড্ডা যে কতটা আনন্দময় হতে পারে, প্রাণদায়িনী হতে পারে, তা প্রথমে মঈনের কাছ থেকেই শেখা।” আড্ডার জন্য বাবার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে পালানো ছাড়াও সেই স্কুল জীবনেও কম খেসরাত দিতে হয়নি।

বৎসরান্তে যখন পরীক্ষার ফল বের হলো রফিক আজাদের দলভুক্ত বন্ধুদের কেউ-ই ভালো করতে পারেনি। যে মঈন জীবনে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি, এবার সে নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে। বাকিরা দু-তিন সাবজেক্টের বেশি, কোনোটাতে পাস করতে পারেনি।

সেই ছোট্ট বয়স থেকে পেয়েবসা আড্ডার নেশা সারাজীবন তাঁকে অনুসরণ করেছে। রফিক আজাদ যেখানে, সেখানেই আড্ডা। তাঁর ঢাকার জীবনে, কর্মস্থলে হোক, হোক রেস্তোরাঁয়, বন্ধুবান্ধবের বৈঠকখানায়, রফিক আজাদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, অনেক ছোট-বড় আড্ডাকেন্দ্র। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, আড্ডার ব্যাপারে আমার আহ্লাদ সর্বজনবিদিত। কাজের চেয়ে অকাজ, দায়িত্ব-কর্তব্যের চেয়ে নিরঙ্কুশ আড্ডা আমাকে সমূহ টানে।

রোববার-এর আড্ডা স্থানান্তরিত হলো ঘরে-বাইরে অফিসে। কবি ইমরুল চৌধুরী কালের স্রোত নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন। রফিক আজাদ ছিলেন সেই কাগজের উপদেষ্টা সম্পাদক। কালের স্রোত অফিসেও জমে উঠল আড্ডা। ইমরুল চৌধুরী নিজেও খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ। একেই বলা যায় সোনায় সোহাগা। রফিক আজাদ আর ইমরুল চৌধুরীর আগ্রহ আর আহ্বানে জমে উঠল আড্ডা। সেই আড্ডায় প্রায়ই চলে আসতেন তাঁদের বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দ। জাহিদুল হক, সানাউল হক খান, শিহাব সরকারÑ এদের আগমনও ছিল নিয়মিত। বলাবাহুল্য, পত্রিকাকেন্দ্রিক আড্ডাগুলোর মধ্যমণি থাকতেন রফিক আজাদ। শুধু সময় কাটানোর এলোপাতাড়ি কথাবার্তা নয়। কখনও কখনও আড্ডার বিষয় হয়ে উঠত শিল্পসাহিত্য-রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতি কত কী! হালকা বিষয়ের পাশে থাকত চিরায়ত বিষয়াদিও। আমাদের-আহ্লাদে রফিক আজাদ যেমন আড্ডা মাতিয়ে রাখতে পারেন, আড্ডার মোড় ঘুরিয়ে দিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। গভীর গম্ভীর সবই চলে আসত আড্ডার উল্লসিত, উচ্ছ্বাসিত স্রোতধারায়।

রফিক আজাদ ঢাকা শহরের কোথায় না আড্ডা দিয়েছেন। বাংলাবাজার, স্টেডিয়াম, নিউমার্কেট এবং শেষের দিকে আজিজ সুপার মার্কেট ইত্যাদি জায়গাগুলো লেখকদের আনন্দময় স্থান। রফিক আজাদের এক সময়ের প্রিয় আড্ডার জায়গা ছিল নিউমার্কেট। সকালে কিংবা বিকেলে একবার নিউমার্কেটে না গেলে তাঁর যেন দিনটাই বৃথা যেত। নিউমার্কেটের বইপাড়ার খ্যাতি এবং ঐতিহ্য দুটোই ছিল। নলেজ হোম, মহীউদ্দীন অ্যান্ড সন্স ছিল লেখকদের মিলিত হওয়ার জায়গা। নলেজ হোমের স্বত্বাধিকারী এ এম খান মজলিশ ছিলেন লেখকদের গুণগ্রাহী। তরুণদের বই প্রকাশ করায় ছিলেন উদারহস্ত।

বইপাড়া ছাড়াও দুতিনটে রেস্তোরাঁ ছিল লেখকদের আড্ডাস্থল। ‘মনিকো’ নামে রেস্তোরাঁ ছিল, সারাদিন লেখকদের আড্ডায় মুখরিত থাকত। রফিক আজাদ এখানেও আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। সদ্য রচিত কবিতা নিয়ে চলে আসতেন তরুণ কবি। আড্ডার টেবিলে সেটি পাঠ, সবার মতামত নেওয়া। মনিকো’র আড্ডাটি জমজমাট হয়েছিল অন্য একটি কারণে। এ রেস্তোরাঁর একজন কর্মী কবিতা লিখতেন। তার নামের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তা-তো হয় না। এক সন্ধ্যায় সবাই মিলে সেই কবির নাম বদলে দিলেন, রফিকুল ইসলাম হলেন রফিক সিদ্দিকী। এই নামে তার কিছু কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই রফিক সিদ্দিকীর কল্যাণে মনিকো কবি-লেখকদের রেস্তোরাঁয় পরিণত হলো। টেবিলে টেবিলে আড্ডা। সারা দিন আড্ডা। সবাই টেবিল বদল করছেন চা আসছে, খাওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যায় যখন বিল দেওয়ার সময় হতো হিসাব মিলানো যেত না, কে কতবার কত কাপ চা খেয়েছে। রফিক সিদ্দিকীই আন্দাজ করে কিছু একটা ধরে দিত। তবে এটুকু বোঝা যেত, সারাদিন সব মিলিয়ে যত কাপ চা খাওয়া হয়েছে, ‘বিল’ হয়েছে সামান্যই।

নিউ মার্কেটের আড্ডা নিয়ে মহাদেব সাহা বলেছেন, “আমাদের নিউমার্কেটের আড্ডা জমজমাট হয়ে উঠল। রফিক আজাদ নানা ধরনের হাসির কথা বলতে পারেন। কৌতুক করতে পারেন, হাসাতে পারেন। আমাদের আড্ডা জমত কখনো, মনিকো কখনো লিবার্টিতে। তারপর দুপুরে আমাদের বন্ধু কবির খানের বইয়ের দোকান ‘প্রগতি’তে অন্তহীন আড্ডা চলত। প্রায় দুপুরে অভুক্ত থেকে আমরা বিস্কিট, চা এসব খেয়ে কথায় পেট ভরিয়েছি। শুধু পেট নয় মনও। হো হো দরাজ হাসি। ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠত। কখন মধ্যাহ্ন গড়িয়ে অপরাহ্ণ নেমে আসত আমরা বুঝতেই পারতাম না। সেখানে রফিক ছিলেন, সিকদার আমিনুল হক ছিলেন, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন, হুমায়ুন আজাদ ছিলেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা ছিলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন, অসীম সাহা, আবেদীন কাদের ছিলেন, মনজুরে মওলা, আতা ভাই (আতাউল হক) এরাও মাঝেমধ্যেই আসতেন। চেয়ারে কুলোত না। পাশের দোকান থেকে চেয়ার টেনে আনতে হতো।”

নিউমার্কেটের ভেতর আরও একটা রেস্তোরাঁ ছিল ‘লিভার্টি’। রফিক আজাদ অনেক সময় ওখানেও আড্ডা দিতেন। বেশ অভিজাত রেস্তোরাঁ। কাপে করে নয়, চা দেওয়া হতো পটে করে। গরম পানির পাত্র, চা-পাতা, চিনি সব আলাদা আলাদা। যে যার মতো করে চা তৈরি করে খাবে। ওখানে চায়ের বিল দেওয়া হতো সবার কাছ থেকে ‘পুল’ করে অর্থাৎ সবাই মিলে চায়ের বিল পরিশোধ করতেন।

আড্ডা নিয়ে লিখতে গিয়ে কবি সিকদার আমিনুল হক লিখেছেন, “আমরা যখন স্বাক্ষর বের করি, তখন শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমাদের ছিল সারা দিনের আড্ডা ও সখ্যের সম্পর্ক। রফিক আজাদ শহীদ কাদরীর সঙ্গে সারা রাত্রি চষে বেড়াতেন সেকালের ঢাকার রাস্তা, স্টেশন, বাজার, পার্ক।” সিকদার আমিনুল আরও এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, “প্রশান্ত, রফিক আর আমি সে সময় নিয়মিত কোনো বিশেষ আকর্ষণ ছাড়াই বলা যায় শুধু আড্ডার লোভে বিকেলে প্রথমে আমার ৪৮ এলিফ্যান্ট রোডে নির্জন একতলা বাড়িতে মিলিত হতাম। সে আড্ডা টেনে নিতাম নিউমার্কেট পর্যন্ত রাত নটা-দশটা অবধি। কোনো কোনো দিন আড্ডার প্রথম পর্বটা আমার বাড়িতে না হয়ে প্রশান্তর জগন্নাথ হলেও হতো; কারণ তাতে প্রশান্তর কিছুটা ক্ষতি হলেও আমাদের লাভ ও তৃপ্তি ছিল প্রচুর। রফিক খাওয়ায় উৎসাহী আর প্রশান্ত খাওয়াতে।’

পত্রিকা অফিস, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ছাড়াও রফিক আজাদের ছোট ছোট আড্ডার জায়গা ছিল বন্ধুবান্ধবের বাড়ি বা কারও অফিস। সিকদার আমিনুল হকের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ছাড়াও কবি অরুণাভ সরকার, রবিউল হুসাইনের ধানমন্ডির বাসা, অসীম সাহার ছাপাছাপির অফিস বা হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অফিস কক্ষ। অসীম সাহার সঙ্গে একটানা প্রায় বিশ বছর রফিক আজাদ ছিলেন নিয়মিত আড্ডার সাক্ষী।

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

আড্ডার আনন্দে অবগাহন

ফারুক মাহমুদ

image

লেখকের মধ্যে দু’ধরনের চরিত্রই লক্ষ্য করা যায়। এক ধরনের লেখক হন নিভৃতচারী, ঘরকুনো। তাদের অন্তর্মুখীও বলা চলে। পড়েন, লেখেন ও থাকেন নিজের পরিমন্ডলের মধ্যে। আর এক ধরনের লেখক থাকেন আড্ডাপ্রিয়। আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। যারা আড্ডা দিতে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যেও আবার দু’ধরনের লেখক থাকেন। একদল আছেন, আড্ডায় ঠিকই উপস্থিত থাকেন, কথা বেশি একটা বলেন না, সবার কথা শোনেন। মাঝে-মধ্যে মন্তব্য করেন বটে। অন্য দলে যারা আছেন, তারা প্রচুর বলেন, আড্ডা মাতিয়ে রাখেন। আড্ডায় যে সব সময় সোজা-সরল কথাবার্তা হয়, তা নয়, তর্ক-বিতর্কও হয়। তর্ক-বিতর্কের রূপটা কখনও কখনও বেশ উচ্চৈঃস্বরে চলে না। তারপরও আড্ডার গুরুত্ব এবং মাহাত্ম্যের কথা ভুলে যান না আড্ডা-প্রিয় মানুষেরা।

লেখকদের আড্ডার মূল সুরটাই থাকে লেখাকেন্দ্রিক। নিজের লেখা, অন্যের লেখা- প্রসঙ্গ সবই আসে। শুধু লেখালেখির বিষয় কেন, আড্ডার আসল বিষয়ের কোনো কেন্দ্রিকতা থাকে না। আড্ডার স্রোত যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। রাজনীতি, সমাজ কী থাকে না আড্ডার স্রোতে! আড্ডার স্রোত ভাসতে ভাসতে যে কোথায় চলে যায়, অনেক সময় কী দিয়ে আড্ডার সূত্রপাত হয়েছিল, তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আড্ডা এরকমই হয়। আড্ডা দীর্ঘস্থায়ী হয়। অর্থাৎ অনেকদিন থেকে চলতে থাকে আড্ডার আয়োজন। আবার কোনো-কোনো আড্ডা বেশি বয়স পায় না, ভেঙে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এতদিনকার সমবেত হওয়া মানুষগুলো।

ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া, কিছুকাল আগ পর্যন্ত ছোট-বড় যত আড্ডা হয়েছে বা হচ্ছে, এসবের প্রায় সবগুলোতে উপস্থিত থেকেছেন বা থাকছেন এমন কিছু মানুষের খোঁজ পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কেউ কেউ তো আড্ডার ‘প্রাণপুরুষ’ হয়ে আছেন। রফিক আজাদকে সানন্দে বিখ্যাত আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাকে ঘিরে ছোট-বড় কত আড্ডা যে গড়ে উঠেছে তার হিসাব নেই।

আড্ডা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রফিক আজাদ বলছেন, “সত্যি কথা বলতে কি আড্ডাই আমার প্রাণ। আমি সেই ‘তিমি’ যার আনন্দ অপার অসীম নীলজলে অবগাহনে। আড্ডাই আমার সেই অসেতুসম্ভব নীলজল, লোকেরা যাকে ‘সমুদ্র’ বলে থাকে। আমার অবগাহন সেই অগাধ, অপার, অতল নীলজলে। যাতে মালিন্য নেই, কাদাজল নেই, শুধু আনন্দের অবগাহন আছে।”

আড্ডা রফিক আজাদের রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। বাড়ির বৈঠকখানায় সমমনা গ্রামীণ মান্যজনদের সঙ্গে প্রতিদিন হুঁকোতে খাম্বিরা তামাক সাজিয়ে আড্ডায় বসতেন। বল যায় সধূম ধুম আড্ডা। শুধু খাম্বিয়া তামাকই নয়, বাড়ির ভেতর থেকে আসত কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ-সর্ষে তেল মাখা গামলা ভর্তি মুড়ি, আদা দেওয়া চা। সেই আড্ডা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর যেন কোনো শেষ নেই। রফিক আজাদ যখন খুব ছোট, বাবার সেই আড্ডা দৃশ্য দেখে দেখে আড্ডা তাঁর নেশাতেও পরিণত হয়েছে।

রফিক আজাদ আড্ডা দিয়েছেন খুব ছোটকাল থেকেই। বাবা নিজে আড্ডা দিতে পছন্দ করলেও ছেলে তার অড্ডাবাজ হয়ে উঠবে, তা তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু এতদিনে ছেলের তো আড্ডার নেশা পেয়ে বসেছে। এই আড্ডার জন্য আড্ডাবাজ বাবার হাতের মার খেয়ে খুব ছোট্টকালেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পালানোর পেছনে আরও একটা কারণ ছিল পি.সি. সরকারের কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক’ শিখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। মাঝপথ থেকে ফিরতে হয়েছিল।

সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাসের পর যখন কালিহাতি রায়গতি শ্রীগোবিন্দ হাই স্কুলে রফিক আজাদ ভর্তি হলেন, শুরু হলো অফুরন্ত এক স্বাধীন জীবন। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বাড়তে লাগল। তখন থেকে শুরু হলো আড্ডার এক নতুন অধ্যায়। ওই বিদ্যালয়ে বরাবর যে প্রথম হয়, তার নাম মঈন উদ্দিন আহমেদ। তার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল রফিক আজাদের। রফিক আজাদের ভাষায়, “আমার বন্ধু-বান্ধবই আমার আড্ডার গুরু। আড্ডা যে কতটা আনন্দময় হতে পারে, প্রাণদায়িনী হতে পারে, তা প্রথমে মঈনের কাছ থেকেই শেখা।” আড্ডার জন্য বাবার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে পালানো ছাড়াও সেই স্কুল জীবনেও কম খেসরাত দিতে হয়নি।

বৎসরান্তে যখন পরীক্ষার ফল বের হলো রফিক আজাদের দলভুক্ত বন্ধুদের কেউ-ই ভালো করতে পারেনি। যে মঈন জীবনে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি, এবার সে নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে। বাকিরা দু-তিন সাবজেক্টের বেশি, কোনোটাতে পাস করতে পারেনি।

সেই ছোট্ট বয়স থেকে পেয়েবসা আড্ডার নেশা সারাজীবন তাঁকে অনুসরণ করেছে। রফিক আজাদ যেখানে, সেখানেই আড্ডা। তাঁর ঢাকার জীবনে, কর্মস্থলে হোক, হোক রেস্তোরাঁয়, বন্ধুবান্ধবের বৈঠকখানায়, রফিক আজাদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, অনেক ছোট-বড় আড্ডাকেন্দ্র। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, আড্ডার ব্যাপারে আমার আহ্লাদ সর্বজনবিদিত। কাজের চেয়ে অকাজ, দায়িত্ব-কর্তব্যের চেয়ে নিরঙ্কুশ আড্ডা আমাকে সমূহ টানে।

রোববার-এর আড্ডা স্থানান্তরিত হলো ঘরে-বাইরে অফিসে। কবি ইমরুল চৌধুরী কালের স্রোত নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন। রফিক আজাদ ছিলেন সেই কাগজের উপদেষ্টা সম্পাদক। কালের স্রোত অফিসেও জমে উঠল আড্ডা। ইমরুল চৌধুরী নিজেও খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ। একেই বলা যায় সোনায় সোহাগা। রফিক আজাদ আর ইমরুল চৌধুরীর আগ্রহ আর আহ্বানে জমে উঠল আড্ডা। সেই আড্ডায় প্রায়ই চলে আসতেন তাঁদের বন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দ। জাহিদুল হক, সানাউল হক খান, শিহাব সরকারÑ এদের আগমনও ছিল নিয়মিত। বলাবাহুল্য, পত্রিকাকেন্দ্রিক আড্ডাগুলোর মধ্যমণি থাকতেন রফিক আজাদ। শুধু সময় কাটানোর এলোপাতাড়ি কথাবার্তা নয়। কখনও কখনও আড্ডার বিষয় হয়ে উঠত শিল্পসাহিত্য-রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতি কত কী! হালকা বিষয়ের পাশে থাকত চিরায়ত বিষয়াদিও। আমাদের-আহ্লাদে রফিক আজাদ যেমন আড্ডা মাতিয়ে রাখতে পারেন, আড্ডার মোড় ঘুরিয়ে দিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। গভীর গম্ভীর সবই চলে আসত আড্ডার উল্লসিত, উচ্ছ্বাসিত স্রোতধারায়।

রফিক আজাদ ঢাকা শহরের কোথায় না আড্ডা দিয়েছেন। বাংলাবাজার, স্টেডিয়াম, নিউমার্কেট এবং শেষের দিকে আজিজ সুপার মার্কেট ইত্যাদি জায়গাগুলো লেখকদের আনন্দময় স্থান। রফিক আজাদের এক সময়ের প্রিয় আড্ডার জায়গা ছিল নিউমার্কেট। সকালে কিংবা বিকেলে একবার নিউমার্কেটে না গেলে তাঁর যেন দিনটাই বৃথা যেত। নিউমার্কেটের বইপাড়ার খ্যাতি এবং ঐতিহ্য দুটোই ছিল। নলেজ হোম, মহীউদ্দীন অ্যান্ড সন্স ছিল লেখকদের মিলিত হওয়ার জায়গা। নলেজ হোমের স্বত্বাধিকারী এ এম খান মজলিশ ছিলেন লেখকদের গুণগ্রাহী। তরুণদের বই প্রকাশ করায় ছিলেন উদারহস্ত।

বইপাড়া ছাড়াও দুতিনটে রেস্তোরাঁ ছিল লেখকদের আড্ডাস্থল। ‘মনিকো’ নামে রেস্তোরাঁ ছিল, সারাদিন লেখকদের আড্ডায় মুখরিত থাকত। রফিক আজাদ এখানেও আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। সদ্য রচিত কবিতা নিয়ে চলে আসতেন তরুণ কবি। আড্ডার টেবিলে সেটি পাঠ, সবার মতামত নেওয়া। মনিকো’র আড্ডাটি জমজমাট হয়েছিল অন্য একটি কারণে। এ রেস্তোরাঁর একজন কর্মী কবিতা লিখতেন। তার নামের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তা-তো হয় না। এক সন্ধ্যায় সবাই মিলে সেই কবির নাম বদলে দিলেন, রফিকুল ইসলাম হলেন রফিক সিদ্দিকী। এই নামে তার কিছু কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই রফিক সিদ্দিকীর কল্যাণে মনিকো কবি-লেখকদের রেস্তোরাঁয় পরিণত হলো। টেবিলে টেবিলে আড্ডা। সারা দিন আড্ডা। সবাই টেবিল বদল করছেন চা আসছে, খাওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যায় যখন বিল দেওয়ার সময় হতো হিসাব মিলানো যেত না, কে কতবার কত কাপ চা খেয়েছে। রফিক সিদ্দিকীই আন্দাজ করে কিছু একটা ধরে দিত। তবে এটুকু বোঝা যেত, সারাদিন সব মিলিয়ে যত কাপ চা খাওয়া হয়েছে, ‘বিল’ হয়েছে সামান্যই।

নিউ মার্কেটের আড্ডা নিয়ে মহাদেব সাহা বলেছেন, “আমাদের নিউমার্কেটের আড্ডা জমজমাট হয়ে উঠল। রফিক আজাদ নানা ধরনের হাসির কথা বলতে পারেন। কৌতুক করতে পারেন, হাসাতে পারেন। আমাদের আড্ডা জমত কখনো, মনিকো কখনো লিবার্টিতে। তারপর দুপুরে আমাদের বন্ধু কবির খানের বইয়ের দোকান ‘প্রগতি’তে অন্তহীন আড্ডা চলত। প্রায় দুপুরে অভুক্ত থেকে আমরা বিস্কিট, চা এসব খেয়ে কথায় পেট ভরিয়েছি। শুধু পেট নয় মনও। হো হো দরাজ হাসি। ঘরের দেয়াল কেঁপে উঠত। কখন মধ্যাহ্ন গড়িয়ে অপরাহ্ণ নেমে আসত আমরা বুঝতেই পারতাম না। সেখানে রফিক ছিলেন, সিকদার আমিনুল হক ছিলেন, নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন, হুমায়ুন আজাদ ছিলেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা ছিলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন, অসীম সাহা, আবেদীন কাদের ছিলেন, মনজুরে মওলা, আতা ভাই (আতাউল হক) এরাও মাঝেমধ্যেই আসতেন। চেয়ারে কুলোত না। পাশের দোকান থেকে চেয়ার টেনে আনতে হতো।”

নিউমার্কেটের ভেতর আরও একটা রেস্তোরাঁ ছিল ‘লিভার্টি’। রফিক আজাদ অনেক সময় ওখানেও আড্ডা দিতেন। বেশ অভিজাত রেস্তোরাঁ। কাপে করে নয়, চা দেওয়া হতো পটে করে। গরম পানির পাত্র, চা-পাতা, চিনি সব আলাদা আলাদা। যে যার মতো করে চা তৈরি করে খাবে। ওখানে চায়ের বিল দেওয়া হতো সবার কাছ থেকে ‘পুল’ করে অর্থাৎ সবাই মিলে চায়ের বিল পরিশোধ করতেন।

আড্ডা নিয়ে লিখতে গিয়ে কবি সিকদার আমিনুল হক লিখেছেন, “আমরা যখন স্বাক্ষর বের করি, তখন শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমাদের ছিল সারা দিনের আড্ডা ও সখ্যের সম্পর্ক। রফিক আজাদ শহীদ কাদরীর সঙ্গে সারা রাত্রি চষে বেড়াতেন সেকালের ঢাকার রাস্তা, স্টেশন, বাজার, পার্ক।” সিকদার আমিনুল আরও এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, “প্রশান্ত, রফিক আর আমি সে সময় নিয়মিত কোনো বিশেষ আকর্ষণ ছাড়াই বলা যায় শুধু আড্ডার লোভে বিকেলে প্রথমে আমার ৪৮ এলিফ্যান্ট রোডে নির্জন একতলা বাড়িতে মিলিত হতাম। সে আড্ডা টেনে নিতাম নিউমার্কেট পর্যন্ত রাত নটা-দশটা অবধি। কোনো কোনো দিন আড্ডার প্রথম পর্বটা আমার বাড়িতে না হয়ে প্রশান্তর জগন্নাথ হলেও হতো; কারণ তাতে প্রশান্তর কিছুটা ক্ষতি হলেও আমাদের লাভ ও তৃপ্তি ছিল প্রচুর। রফিক খাওয়ায় উৎসাহী আর প্রশান্ত খাওয়াতে।’

পত্রিকা অফিস, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ছাড়াও রফিক আজাদের ছোট ছোট আড্ডার জায়গা ছিল বন্ধুবান্ধবের বাড়ি বা কারও অফিস। সিকদার আমিনুল হকের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ছাড়াও কবি অরুণাভ সরকার, রবিউল হুসাইনের ধানমন্ডির বাসা, অসীম সাহার ছাপাছাপির অফিস বা হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অফিস কক্ষ। অসীম সাহার সঙ্গে একটানা প্রায় বিশ বছর রফিক আজাদ ছিলেন নিয়মিত আড্ডার সাক্ষী।