জাহিদ মুস্তাফা
সমকালীন বাংলাদেশের একজন প্রধান চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী লোকান্তরিত হয়েছেন কছর কয়েক আগে। তাঁর অভাব আমরা পলে পলে অনুভব করি- আমরা যখন মানসম্পন্ন প্রকাশনা ও তার প্রচ্ছদ নিয়ে ভাবি, যখন চিত্রকলায় লোকায়ত বাংলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা কথা বলি, যখন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হয়। তিনি চলে গেছেন, তবু প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। সৃজনশিল্পী হিসেবে এখানেই তাঁর সার্থকতা।
কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রুচি নির্মাতা। আমাদের বই-পত্র-পত্রিকার অবয়বকে যিনি দৃষ্টিনন্দন করেছেন, যাঁর নন্দিত হাতের জাদুতে শিল্পের নানা শাখায় এসেছে আন্তর্জাতিক মান। হাতের কাছে থাকা বই কিংবা পত্রিকার পাতা ওল্টালেই প্রচ্ছদ বা অলংকরণে হয়তো তাঁর নাম পেয়ে যাব আমরা।
আমার পরম সৌভাগ্য, চারুকলায় আশির দশকে আমার শিক্ষাজীবনে শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পেয়েছি, আবার পেশাগত জীবনে অসংখ্যবার তাঁর দ্বারস্থ হয়ে তাঁর সস্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার লেখালেখির বিষয়ে সবসময় তাঁর সমর্থন পেয়েছি। তিনি নিজেও লিখেছেন সুললিত ভাষায়- কবিতা, ছড়া, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি।
কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় ব্যাংক কর্মকর্তা, মা সরফুন্নিসা চৌধুরানী ছিলেন গৃহিণী। চাকরিসূত্রে বাংলাদেশের নানা মহকুমা ও জেলায় বাস করেছেন সপরিবারে। কাইয়ুমও ঘুরেছেন নানা জায়গায়, পড়েছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নড়াইল, সন্দ্বীপ, নোয়াখালি, ফেনী, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাংলার প্রকৃতি ও তার বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে কাইয়ুমের।
তাঁর মানস গঠনে প্রকৃতির ভূমিকা অসামান্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন- প্রকৃতি আমার প্রথম শিক্ষক। তাঁর আঁকায়, রেখায়, লেখায় সব ক্ষেত্রে বাংলার নদীমেখলা প্রকৃতি ও মানুষের মনোরম ছবি ফুটে উঠেছে। নড়াইলের চিত্রা নদীর প্রভাব যেমন শিল্পী এস. এম. সুলতানকে মরমি শিল্পীতে পরিণত করেছে, তেমনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সৃজন জীবনে এর কলতান আমরা পেয়ে যাই। আশির দশকে তাঁর আঁকা ‘আমার গ্রাম’ সিরিজে যে নদীমেখলা রূপ দেখি তার সাথে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-চিত্রার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন কাইয়ুম চৌধুরী। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন- রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ শিল্পীকে। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন, শিক্ষক আনোয়ারুল হক ও কামরুল হাসানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তাঁর শিল্পের অনুশীলন। ১৯৫৪ সালে সাফল্যের সঙ্গে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ হয়। ছাত্রজীবনেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন কাজে সুনাম অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে প্রথমে অংকনশিল্পী হিসেবে যুক্ত হন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে। কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্যে থেকে ওই পত্রিকার নানা পাতায় ছবি এঁকে হাত পাকিয়েছেন। সে সময় শাড়ির নক্শায় কবি জসীম উদ্দীনের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬০ সালে কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পী তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এ বছরেই শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নক্শা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে কাইয়ুম তাতে নক্শাবিদ হিসেবে যোগ দেন। এখানে এসে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে, পরবর্তীতে এসবের নানা উপাদান, ফর্ম ও রঙের সমাবেশ ঘটেছে তাঁর চিত্রকলায়।
১৯৬২ সালে জয়নুল আবেদিনের আহ্বানে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট ইনস্টিউটে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ছাত্রদের গ্রাফিক কাজে পারদর্শী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু শিল্পের কাজে তাঁর ব্যস্ততা ক্রমাগত বেড়েছে। সৃজনশিল্পী হিসেবে নিয়মিত ছবি আঁকায় কখনো ছেদ পড়েনি তাঁর।
দীর্ঘ ষাট বছরের নিরন্তর চিত্রসাধনায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষশিল্পীদের একজন। আবহমান বাংলা প্রকৃতির অপূব সৌন্দর্র্য ও এই ভূন্ডখন্ডের বাসিন্দাদের তিনি চিত্রপটে তুলে এনেছেন নিজস্ব অংকনশৈলীতে। লোকশিল্পের রঙ ও রেখাকে সমকালীন আধুনিকতায় বিন্যস্ত করে নিজের একটা চিত্রভাষা তিনি নির্মাণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলা টাইপোগ্রাফির বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতায় তাঁর অবদান অসামান্য। চিত্রকলা থেকে বই ও পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার সবক্ষেত্রে তাঁর অংকনে সেই স্বকীয় অংকনরীতির প্রকাশ দেখে দেখে শৈশব থেকে আমরা পরিণত বয়সে এসেছি। আজকের শিশু থেকে বৃদ্ধরাও যারা পাঠক- তারা তাঁর গ্রাফিক্সের সৃজনশীলতার ভেতরে কোনো না কোনোভাবে মুগ্ধতার অবগাহনে আবদ্ধ।
কাইয়ুম চৌধুরীর কর্মজীবন শরু করেছিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর ছাত্রজীবনেই। পত্র-পত্রিকায় তাঁর কাজের সূত্রপাত ইংরেজি দৈনিক অবজারভার দিয়ে, তারপর একে একে দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক সন্ধানী, দৈনিক জনকণ্ঠ ও সর্বশেষ দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবজারভারে কাজ করার সময় কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্য পান। তাঁর কাছ হতে ধারণা পেয়ে কবি জসীম উদ্দীনের একটি বইয়ের প্রচ্ছদে জামদানি নক্শার শাড়ির ছবি ব্যবহার করেন এবং সে বছর ওই বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য পরস্কৃত হন। প্রথম আলোর মাস্টহেড তাঁর হাতে করা। দীর্ঘ ১৬ বছর প্রথম আলোর সাময়িকীসহ নানা পাতার পর পাতা তাঁর অসংখ্য অংকন আর নকশায় নন্দিত হয়েছে। আবহমান বাংলাকে ধারণ ক’রে, বাংলার সংগ্রাম-সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনকে উপজীব্য ক’রে দারুণ ছন্দে কবিতার মতো ছবি আঁকতেন তিনি। ১৯৯৮ সাল হতে আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকার শিল্প উপদেষ্টা ছিলেন। দেশের মানসম্মত প্রকাশনাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। তেমনি কালি ও কলমের এগারো বছরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বহু গল্প-উপন্যাস-কবিতার অক্ষরবিন্যাসসহ সচিত্রকরণ করেছেন। নিজের অংকনরীতি ঠিক রেখে সচিত্রকরণ যে কত বিচিত্র ও নান্দনিক হতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি তাঁর আঁকা বই-পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায়।
তাঁর সচিত্রকরণের দুটি বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত গল্প-উপন্যাস-রম্যলেখা-ভ্রমণ-প্রবন্ধ যাই তিনি সচিত্রকরণ করতেন, অংকনে জোর দিতেন বিষয়বস্তুর দিকে। পাঠকের পাঠের প্রাকপ্রস্তুতির কাজটি সারতেন শিল্পী, যাতে পাঠক সহজেই বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর- এ কাজে তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন তবে বিমূর্তায়নের দিকে যাননি। গ্রাফিক চিত্রকর হিসেবে এখানেই অনন্য কাইয়ুম চৌধুরী।
কালি ও কলমের পাতায় নবীন-প্রবীণ কবির কবিতার ভেতরকার বাণীর মাধুর্যের সাথে কাইয়ুমের অংকিত চিত্রমালার মিলন পাঠকের জন্য দারুণ উপভোগ্য ছিল। তেমনি গল্প-উপন্যাসের স্বাদু-বর্ণনা ও ঘটনার নাটকীয়তার সচিত্রকরণে লেখা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে। সেই কাজগুলোর নির্বাচিত অংশ দেখলে পাঠক-দর্শক হয়তো বুঝবেন- কাইয়ুম চৌধুরীর অনিবার্যতা।
চারুশিল্পের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি অসম্ভব টান ছিল তাঁর। এলপি অ্যালবাম সংগ্রহে তিনি ছিলেন দেশ সেরা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা জানিয়েই ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে ৮২ বছর বয়সে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব মঞ্চে মহান এই শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে ২০১৫-এর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব উৎসর্গ করা হয়। ছায়ানট ভবনে কণ্ঠশীলন আয়োজন করেছিল স্মরণসভা। রাষ্ট্রীয় ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন তাঁর স্মরণে গত বছর অনুষ্ঠান করেছে, এবারও করছে। অন্যান্য প্রচারমাধ্যমও গুণি এই চিত্রকরের স্মরণে নানা আয়োজন করে আসছে। মহাপ্রয়াণের দ্বিতীয় বছরে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
আরও খবরবৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪
জাহিদ মুস্তাফা
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
সমকালীন বাংলাদেশের একজন প্রধান চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী লোকান্তরিত হয়েছেন কছর কয়েক আগে। তাঁর অভাব আমরা পলে পলে অনুভব করি- আমরা যখন মানসম্পন্ন প্রকাশনা ও তার প্রচ্ছদ নিয়ে ভাবি, যখন চিত্রকলায় লোকায়ত বাংলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা কথা বলি, যখন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হয়। তিনি চলে গেছেন, তবু প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। সৃজনশিল্পী হিসেবে এখানেই তাঁর সার্থকতা।
কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রুচি নির্মাতা। আমাদের বই-পত্র-পত্রিকার অবয়বকে যিনি দৃষ্টিনন্দন করেছেন, যাঁর নন্দিত হাতের জাদুতে শিল্পের নানা শাখায় এসেছে আন্তর্জাতিক মান। হাতের কাছে থাকা বই কিংবা পত্রিকার পাতা ওল্টালেই প্রচ্ছদ বা অলংকরণে হয়তো তাঁর নাম পেয়ে যাব আমরা।
আমার পরম সৌভাগ্য, চারুকলায় আশির দশকে আমার শিক্ষাজীবনে শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পেয়েছি, আবার পেশাগত জীবনে অসংখ্যবার তাঁর দ্বারস্থ হয়ে তাঁর সস্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার লেখালেখির বিষয়ে সবসময় তাঁর সমর্থন পেয়েছি। তিনি নিজেও লিখেছেন সুললিত ভাষায়- কবিতা, ছড়া, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি।
কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় ব্যাংক কর্মকর্তা, মা সরফুন্নিসা চৌধুরানী ছিলেন গৃহিণী। চাকরিসূত্রে বাংলাদেশের নানা মহকুমা ও জেলায় বাস করেছেন সপরিবারে। কাইয়ুমও ঘুরেছেন নানা জায়গায়, পড়েছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নড়াইল, সন্দ্বীপ, নোয়াখালি, ফেনী, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাংলার প্রকৃতি ও তার বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে কাইয়ুমের।
তাঁর মানস গঠনে প্রকৃতির ভূমিকা অসামান্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন- প্রকৃতি আমার প্রথম শিক্ষক। তাঁর আঁকায়, রেখায়, লেখায় সব ক্ষেত্রে বাংলার নদীমেখলা প্রকৃতি ও মানুষের মনোরম ছবি ফুটে উঠেছে। নড়াইলের চিত্রা নদীর প্রভাব যেমন শিল্পী এস. এম. সুলতানকে মরমি শিল্পীতে পরিণত করেছে, তেমনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সৃজন জীবনে এর কলতান আমরা পেয়ে যাই। আশির দশকে তাঁর আঁকা ‘আমার গ্রাম’ সিরিজে যে নদীমেখলা রূপ দেখি তার সাথে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-চিত্রার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন কাইয়ুম চৌধুরী। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন- রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ শিল্পীকে। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন, শিক্ষক আনোয়ারুল হক ও কামরুল হাসানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তাঁর শিল্পের অনুশীলন। ১৯৫৪ সালে সাফল্যের সঙ্গে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ হয়। ছাত্রজীবনেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন কাজে সুনাম অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে প্রথমে অংকনশিল্পী হিসেবে যুক্ত হন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে। কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্যে থেকে ওই পত্রিকার নানা পাতায় ছবি এঁকে হাত পাকিয়েছেন। সে সময় শাড়ির নক্শায় কবি জসীম উদ্দীনের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬০ সালে কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পী তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এ বছরেই শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নক্শা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে কাইয়ুম তাতে নক্শাবিদ হিসেবে যোগ দেন। এখানে এসে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে, পরবর্তীতে এসবের নানা উপাদান, ফর্ম ও রঙের সমাবেশ ঘটেছে তাঁর চিত্রকলায়।
১৯৬২ সালে জয়নুল আবেদিনের আহ্বানে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট ইনস্টিউটে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ছাত্রদের গ্রাফিক কাজে পারদর্শী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু শিল্পের কাজে তাঁর ব্যস্ততা ক্রমাগত বেড়েছে। সৃজনশিল্পী হিসেবে নিয়মিত ছবি আঁকায় কখনো ছেদ পড়েনি তাঁর।
দীর্ঘ ষাট বছরের নিরন্তর চিত্রসাধনায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষশিল্পীদের একজন। আবহমান বাংলা প্রকৃতির অপূব সৌন্দর্র্য ও এই ভূন্ডখন্ডের বাসিন্দাদের তিনি চিত্রপটে তুলে এনেছেন নিজস্ব অংকনশৈলীতে। লোকশিল্পের রঙ ও রেখাকে সমকালীন আধুনিকতায় বিন্যস্ত করে নিজের একটা চিত্রভাষা তিনি নির্মাণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলা টাইপোগ্রাফির বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতায় তাঁর অবদান অসামান্য। চিত্রকলা থেকে বই ও পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার সবক্ষেত্রে তাঁর অংকনে সেই স্বকীয় অংকনরীতির প্রকাশ দেখে দেখে শৈশব থেকে আমরা পরিণত বয়সে এসেছি। আজকের শিশু থেকে বৃদ্ধরাও যারা পাঠক- তারা তাঁর গ্রাফিক্সের সৃজনশীলতার ভেতরে কোনো না কোনোভাবে মুগ্ধতার অবগাহনে আবদ্ধ।
কাইয়ুম চৌধুরীর কর্মজীবন শরু করেছিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর ছাত্রজীবনেই। পত্র-পত্রিকায় তাঁর কাজের সূত্রপাত ইংরেজি দৈনিক অবজারভার দিয়ে, তারপর একে একে দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক সন্ধানী, দৈনিক জনকণ্ঠ ও সর্বশেষ দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবজারভারে কাজ করার সময় কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্য পান। তাঁর কাছ হতে ধারণা পেয়ে কবি জসীম উদ্দীনের একটি বইয়ের প্রচ্ছদে জামদানি নক্শার শাড়ির ছবি ব্যবহার করেন এবং সে বছর ওই বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য পরস্কৃত হন। প্রথম আলোর মাস্টহেড তাঁর হাতে করা। দীর্ঘ ১৬ বছর প্রথম আলোর সাময়িকীসহ নানা পাতার পর পাতা তাঁর অসংখ্য অংকন আর নকশায় নন্দিত হয়েছে। আবহমান বাংলাকে ধারণ ক’রে, বাংলার সংগ্রাম-সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনকে উপজীব্য ক’রে দারুণ ছন্দে কবিতার মতো ছবি আঁকতেন তিনি। ১৯৯৮ সাল হতে আমৃত্যু তিনি এই পত্রিকার শিল্প উপদেষ্টা ছিলেন। দেশের মানসম্মত প্রকাশনাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। তেমনি কালি ও কলমের এগারো বছরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বহু গল্প-উপন্যাস-কবিতার অক্ষরবিন্যাসসহ সচিত্রকরণ করেছেন। নিজের অংকনরীতি ঠিক রেখে সচিত্রকরণ যে কত বিচিত্র ও নান্দনিক হতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি তাঁর আঁকা বই-পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায়।
তাঁর সচিত্রকরণের দুটি বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত গল্প-উপন্যাস-রম্যলেখা-ভ্রমণ-প্রবন্ধ যাই তিনি সচিত্রকরণ করতেন, অংকনে জোর দিতেন বিষয়বস্তুর দিকে। পাঠকের পাঠের প্রাকপ্রস্তুতির কাজটি সারতেন শিল্পী, যাতে পাঠক সহজেই বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর- এ কাজে তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন তবে বিমূর্তায়নের দিকে যাননি। গ্রাফিক চিত্রকর হিসেবে এখানেই অনন্য কাইয়ুম চৌধুরী।
কালি ও কলমের পাতায় নবীন-প্রবীণ কবির কবিতার ভেতরকার বাণীর মাধুর্যের সাথে কাইয়ুমের অংকিত চিত্রমালার মিলন পাঠকের জন্য দারুণ উপভোগ্য ছিল। তেমনি গল্প-উপন্যাসের স্বাদু-বর্ণনা ও ঘটনার নাটকীয়তার সচিত্রকরণে লেখা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে। সেই কাজগুলোর নির্বাচিত অংশ দেখলে পাঠক-দর্শক হয়তো বুঝবেন- কাইয়ুম চৌধুরীর অনিবার্যতা।
চারুশিল্পের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি অসম্ভব টান ছিল তাঁর। এলপি অ্যালবাম সংগ্রহে তিনি ছিলেন দেশ সেরা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা জানিয়েই ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর রাতে ৮২ বছর বয়সে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব মঞ্চে মহান এই শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে ২০১৫-এর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব উৎসর্গ করা হয়। ছায়ানট ভবনে কণ্ঠশীলন আয়োজন করেছিল স্মরণসভা। রাষ্ট্রীয় ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন তাঁর স্মরণে গত বছর অনুষ্ঠান করেছে, এবারও করছে। অন্যান্য প্রচারমাধ্যমও গুণি এই চিত্রকরের স্মরণে নানা আয়োজন করে আসছে। মহাপ্রয়াণের দ্বিতীয় বছরে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।