শব্দপথে মুগ্ধযাত্রা

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

ভাষা একটি গতিশীল জিনিস। কালে কালে রঙ বদলায়। চেহারা পাল্টায়। পরিবর্তনের গ্রোতে গা ভাসায়। নিত্যনতুন উপাদান নিজের একাউন্টে জমা করে। আবার, কিছু কিছু জিনিস বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। আবর্জনা ফেলে দেয় ডাম্পস্টারে। সে ভাষাই শক্তিশালী যার নেবার উদারতা আছে, নিয়ে আত্মগত করার জোর আছে। আর আছে নানা রঙে, নানা ঢঙে নিজেকে প্রকাশ করার, মেলে ধরার, “গুটিয়ে নয়, ছুটিয়ে বাঁচার” দুরন্তপনা। পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলির সেসব শক্তিমত্তা আছে। আছে বলেই তাদের এত শান-শওকত-জৌলুশ। আর যেগুলোর নেই, সেগুলো মাজামরা। অবশ্য মাজামরা হবার অন্যান্য কারণও থাকতে পারে বা আছে। ইংরেজির কথাই ধরা যাক। দুনিয়ার সব ভাষা থেকে মাল হাতিয়ে কেমন গাট্টাগোট্টা হয়েছে! তার ঐশ্বর্যের তাজমহল দেখলে মনে খচখচানি আসে। আহা, আমার মাতৃভাষা যদি এরকম মালদার হতো! তবে ভরসার জায়গাও আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধা যায়। এর একটি হচ্ছে বাঙালির মোট জনসংখ্যা, প্রায় ৩০ কোটি। তার মানে বাংলা একটি সজীব, প্রাণবন্ত ভাষা যার পেটে প্রচ্চুর সম্পদ আছে, ট্যাপ করার বাকি। সেই সম্পদের একটি হচ্ছে শব্দ, লব্জ, প্রবাদ, প্রবচন, লোক-উক্তি, ছড়া, বাগধারা। সব ভাষার প্রাণ কিন্তু এগুলোই। বাংলার ক্ষেত্রে কথাটা একটু বেশিই সত্যি। বাংলা ভাষার ভূখন্ডজুড়ে যত রকম ডায়ালেক্ট বা উপভাষা রয়েছে, তার সব কটাই এক একটা শব্দ-নির্মাণের কারখানা। একই ভাষা এত বিচিত্র টানে, বিচিত্র শৈলীতে, বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যপ্রযুক্তি ইস্তেমাল করে বেগবান থাকতে পারে, তা চমকে চব্বিশ হবার মতই ব্যাপার।

ভাষা নিয়ে, বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। পন্ডিত, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার বুদ্ধিজীবীগণ অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ওনারা নমস্য, কদমবুসি পাবার হকদার। কিন্তু এ আনকোরা, লো-প্রোফাইল লেখকের মনে হয়েছে এ বিষয়ে কিছু ক্যাওক্যাঁচাল করা দরকার। আর দরকারই সরকার। তো আমার এ কম্মোখানি ব্যক্তিগত জোশ ও জজবার ফসল। কোনও প্রকার একাডেমিক গবেষণা তো নয়ই, গবেষণা বলাটাও বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। বড় জোর, এটাকে বলা যেতে পারে “শব্দপথে মুগ্ধযাত্রা”।

তো সফর শুরু করা যাক।

আমার জন্মস্থান নাঙ্গলকোট তিন-তিনটি জেলা, যথাঃ কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীর সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে কুমিল্লা জেলার হলেও ভাষাগত দিকে এটি নোয়াখালী প্রভাবিত। আর কে না জানে যে বাংলা ভাষার উপভাষাগুলোর মধ্যে উচ্চারণরীতি, টান আর শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে নোয়াখাইল্যা অনন্য! ইশকুলে গিয়ে যখন প্রমিত/মান বাংলার সাথে পরিচিত হই তখন থেকে পুলক লাগতে শুরু করে এ বিষয়ে যে, বাংলা ভাষার রঙ নানান কিসিমের। ভারি মজা তো! আবার, টেলিভিশনে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ শুনেও মুগ্ধ হবার অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি, আমাদের এলাকায় ফসলের মরসুমে ক্ষেতেখামারে কাজ করার জন্য উত্তর বাংলা থেকে গতরখাটা মানুষজন আসতেন। সৎ, বিনয়ী ও পরিশ্রমী মানুষগুলো স্থানীয়ভাবে “কামলা” নামে পরিচিত হতেন। তাঁদের মুখে আবার শুনতাম এক্কেবারে ভিন্ন স্বাদের জবরদস্ত বাংলা। আমার কাজ কেবলই মুগ্ধ হওয়া।

আমার মামাবাড়ি লাকসামের পশ্চিমগাঁর পাশেই। লাকসামের ডায়ালেক্ট নোয়াখাইল্যা ঘেঁষা হলেও নানা দিক থেকে স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট। আমার মা প্রায় তিরিশ বছর আমাদের গেরামে ঘরবসতি করেও তাঁর মাতৃভাষা লাকসাইম্যার আছরমুক্ত হতে পারেননি। তো এ উপভাষাটি আমার কানে ভিন্ন সুরের দ্যোতনা তৈরি করে। আবার, আত্মীয়তাসূত্রে ফেনী যাওয়ার বদৌলতে সেখানকার আলাগ ধাঁচের নোয়াখাইল্যা শুনতে পেতাম। ফলে, ভাষা ব্যাপারটার প্রতি আমার দিলনাশী পিচ্চিকাল থেকেই। এরপর কলেজে উঠে যখন শহর কুমিল্লায় আসি, আমার সামনে বাংলা ভাষার বহুবর্ণিল রূপের রঙধনু খুলে যায়। কুমিল্লার স্থানীয় ভাষাটা একটু অদ্ভুত, মজাদার। যখন কেউ সে ডায়ালেক্টে কথা বলেন, মনে হয় তার অন্তরের ধ্বনিপুঞ্জ মুখের জানালা দিয়ে বেরিয়ে দুনিয়ার বুকে গান হয়ে বেজে চলছে। এমনই তার দিলকা খাজানা। তবে কুমিল্লার অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং লাগোয়া জেলাসমূহের (বৃহত্তর কুমিল্লা)। চাঁদপুরের, বিশেষ করে। কাজেই আমাকে মিশতে ও কথা বলতে হয়েছে বিচিত্র উপভাষায় কথা বলা রকমারি মানুষের সাথে।

কুমিল্লা শহরে আসার পর প্রথম যে নতুন শব্দটি শিখি তা হলো “ঠেকবাজ”। আমি থাকতাম কণকস্তূপ বৌদ্ধবিহারের ভেতরকার মেসে। কিছু হিন্দু ও বৌদ্ধ ছাত্র মিলেজুলে থাকতাম সেখানে। আর কিছু রুম বরাবরই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অর্থাৎ, ভন্তে ও শ্রমণদের জন্য নির্ধারিত। যাহোক, মেসে ওঠার পরই দাদারা ঠেকবাজদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। এলাকায় নাকি সন্ধে নাগাদ ঠেকবাজদের দৌরাত্ম্য। কারা এ ঠেকবাজ? গোদা বাংলায়, যারা পিস্তল, ছোরা, চাকু, যাহোক একটা কিছু পেটে, পিঠে, কপালে ঠেকিয়ে আপনার পয়সাপাতি, হাজুবিজু, গয়নাগাঁটি চাঁটি করে দেয়, সে প্রতিভাবানদের ঠেকবাজ বলা হয়।

এরপর, আরেকটি অদ্ভুত কিসিমের শব্দ শিগগিরই আমার কানে আসে। সেটি হলো “বেপতার”। মনে হতে পারে, বেপরোয়া জাতীয় অর্থ হবে এর। কিন্তু, না। এর মানে হচ্ছে বেকুব, বেক্কল। বেকুব অর্থে লাকসাম, মনোহরগঞ্জ এলাকায় মক্কল কথাটিও প্রচলিত। শব্দের কিসিঞ্জারি এখানেই। কিসিঞ্জার শব্দটি সামনে এলে দুজনের কথা মনে পড়ে। একজন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব (পড়ুন মন্ত্রী) যিনি ধূর্ততার জন্য বিখ্যাত বা কুখ্যাত। আরেকজন হচ্ছেন এক সময়কার জনপ্রিয় বাংলাদেশি কৌতুকাভিনেতা হারুন কিসিঞ্জার। শেষজনের কিসিঞ্জার নামটি সম্ভবত নিজের কিংবা অন্যদের দেওয়া, অনেকটা উপাধিমূলক। ধারণা করা হয়, উপাধিটি প্রথমোক্ত কিসিঞ্জারের চরিত্রগুণেই প্রসিদ্ধ হয়েছে। বলে রাখা ভাল, হারুন কিসিঞ্জার মনোহরগঞ্জ তথা বৃহত্তর লাকসামের মানুষ। এ অঞ্চলে কিসিঞ্জার নামটি বা শব্দটি ধূর্ততা, কূটবুদ্ধি, দুষ্টবুদ্ধি, কলাকৌশল, উপস্থিতবুদ্ধি, দুরন্তপনা, দস্যিপনা, কৌতুকবাজি, রসিকতা ইত্যাদি বিষয়ের দ্যোতক। অনেকটা বিশেষণ সদৃশ। আর কিসিঞ্জারি হচ্ছে তার বিশেষ্য। উদাহরণ স্বরূপ, ‘লোকটার কিসিঞ্জারির সাথে তুই পারবি না। পাঙা নিতে যাস না।’ দেখুন, এখানে ব্যবহৃত ‘পাঙা নেওয়া’ কথাটি এসেছে হিন্দী-উর্দুর সৌজন্যে। এভাবেই পরভাষী, পরদেশী শব্দ বা ইডিয়ম আমাদের ভাষার ভিটেয় বসতি গড়ে আর হয়ে ওঠে আমাদেরই আপন। এটা বাংলা ভাষার সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ।

“শালা এক নম্বরের জাউরা।” এরকম এক্সপ্রেশান বাংলাদেশে আপনি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ‘জাউরা’ বা ‘জাইরা’ কিসিঞ্জারের মতোই দুষ্টবুদ্ধি বা চতুরালি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শব্দের উৎপত্তি বোধহয় ‘জারজ’ থেকে। উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেন, অর্থ ও ব্যঞ্জনা পাল্টে গেছে। এ বাংলার মানুষের মুখে মুখে আর নাটকে-সিনেমায় জায়গা পাক্কা করেছে এ অপশব্দ বা স্ল্যাং। সাহিত্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে কি? খোদা মালুম। ভগবান জানেন। ‘ভগবান জানেন’ কথাটিকে শর্ট করে কিন্তু পশ্চিম বাংলায় ‘ভগায় জানে’ বলেন কেউ কেউ, নিছক মজা করার জন্য বা রসিকতার অংশ হিসেবে। কথাটির শুরু কখন সেটাও ভগায় জানেন। আমার জেনে কাজ নেই। এমনিতেই অনেক ক্যাওক্যাঁচালের মধ্যে আছি। করোনা অতিমারী (প্যান্ডেমিক) আমাদের ফুটুরডুম করেই ছাড়বে মনে হচ্ছে। লোকজনের কাঁওতালি দেখেও গা রিনরিন করছে। কদিন আগে দেখলাম, বাংলাদেশে ছোট্ট এক বস্তা ত্রাণ উপহার দিতে গিয়ে দশজন হাত লাগাচ্ছে। ছবি খেঁচার জন্য। নিজেদের নুরানী চেহারা মোবারক দেখাবার খায়েশ এ চরম দুর্দিনেও অনেকে ছাড়ছে না। মজার কথা হচ্ছে এ ছবিতে ত্রাণ নিচ্ছে কে বোঝার জো নেই। আরেক ছবিতে দেখলাম, জনৈক শ্মশ্রুধারী দাতা হাতেমতাই একজন রোগী গোছের মানুষকে একটি কলা উপহার দিচ্ছেন আর ছবি তোলার জন্য পোজ মারছেন। ক্যাপশানে এক বদের হাড্ডি লিখেছে, যে, ‘ভদ্রলোক তার কলা দিচ্ছেন’। অর্থ বুঝে নাও, হে সুজন।

‘টুরিস্ট স্পটটা হেব্বি মাইরি। যেমন ছিমছাম, তেমন সাজানোগোছানো। পাহাড় আর নদীর রোমান্টিক কম্বো। কী আলো! কী হাওয়া! খাবার তো দারুণ টেস্টি! বলতে গেলেই, পুরোই মাখন।’ এ সংলাপের শেষ শব্দমালা ‘পুরোই মাখন’-এর দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখানে মাখন বলতে খাবার নয়, বরঞ্চ খাবারের গুণপনাকেই হাইলাইট করা হয়েছে। মাখনের স্বাদের পাশাপাশি তার মাখোমাখো কম্বিনেশনের দিকটি বিবেচনা করা হয়েছে। আর তাতেই বাংলায় আরেকটি নয়া ইডিয়মের জন্ম হয়েছে, হয়তো পাড়ার রকে বসে আড্ডা দেওয়া কোনও তরুণের মুখ ফসকে বেরুনো চমকদার কথারূপে। তারপর হাজার জনের মুখফেরতা শব্দটি স্থান পেয়েছে বইয়ের পাতায়, ফেসবুকারের টাইমলাইন বা সময়রেখায়। আমি পেয়েছি কলকাতার বিখ্যাত ‘সানন্দা’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গল্পে। বলতে চাইছি, প্রতিদিনই মাঠে, ময়দানে, ঘাটে, হাটে, ইশকুলে, মুশকিলে, সুখে, অসুখে, শয্যায়, লজ্জায়, গদ্যে, পদ্যে, এখানে-সেখানে, সবখানে একটি ভাষার বিশাল রাজ্যে নতুন নতুন শব্দ, প্রবাদ, কূটকথা, অতিকথা, সংলাপ, গৎ, জনবুলি, টার্ম তৈরি হয়। তার সবকটাই খাসা মাল তা নয়। কিছু ভূসিমাল ঝেড়ে ফেলে বাকিগুলোকে প্রতিষ্ঠা দিলেই ভাষার ভাঁড়ার ভরতে থাকবে। শক্ত হবে তার প্রকাশের পেশী, তেজী হবে তার ভাবের হৃৎপিন্ড।আর মুক্ত দুনিয়ার হাজারো ভাষার উর্বর জমিন থেকেও দরকার মোতাবেক শস্য আনার মতো বুদ্ধিমত্তা দেখানো চাই। একাজে কোনও প্রতিষ্ঠান কী করবে কী করবে না, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এ দায়িত্ব লেখকের, সাহিত্যিকের, ভাষাশিল্পীর, উদারমনা অধ্যাপকের।

ঠাট্টাচ্ছলে চমৎকারকে মচৎকার বলতে শোনা যায়। ফেসবুকেও কারুকে কারুকে এটা লিখতে দেখেছি। সারকাজমের জন্য ‘মচৎকার’ শব্দের ইস্তেমাল কেবল ইস্পেশাল বক্তার পক্ষেই সম্ভব। শব্দের কদর বাড়ে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিত্ব, প্রভাব, এমনকি আন্তর্জালে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর জন্যেও।

যাহোক, এবার আসি নতুন একটি শব্দে। খেলার মাঠে আমার এক বাল্যবন্ধু ও প্রতিবেশী একটি অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করতো: খাল্লিবাল্লি। বোধকরি, শব্দটি এসেছে ইংরেজি hurly-burly-এর বাঙলায়নের সিলসিলায়। ওর দাদু জীবনভর কাজ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। হয়তো তাঁর সুবাদে শব্দটি বদলে গিয়ে নাতির কাছে এসেছে, যে আবার আমাদেরকে তা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে। যেভাবেই আসুক না কেন, শব্দটি কিন্তু জোস। আলতুফালতু, আলটপকা, উল্টা পাল্টা, বেহুদা, অসংলগ্ন, অদরকারি- এসব অর্থে খাল্লিবাল্লি শব্দটি বেশ সেঁটে যায়। আমি বাপের জন্মে আর কারুর মুখে এ শব্দটি শুনিনি। যদি ধরে নেই যে, শব্দটি আমার ঐ বন্ধুরা কয়েনেজ, তাহলে সে এক বিরাট আবিষ্কার আমার দিক থেকে। এভাবে বৃহত্তর বাংলার কোনাকাঞ্চিতে কতশত সুন্দর সুন্দর শব্দের জন্ম হচ্ছে আর চর্চা ও নথিকরণের অভাবে অকালে গতাসু হচ্ছে, তার হিসেবপত্তর কোত্থাও নেই। আমি সে অকাল মরণের বিরুদ্ধে যমকাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাই।

ঢাকাই বাংলা সিনেমার খলনায়ক ডিপজলের মুখে একটি শব্দ চরকির মতো ঘুরতে থাকে। ‘এক্কেরে হান্দাইয়া দিমু’ জাতীয় সংলাপ হরহামেশাই তার মুখ থেকে বেরোয়। ‘হান্দানো’ একটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য, হুমকির জন্য জুতসই শব্দাস্ত্র। খলনায়কদের মুখে তো বটেই, ঢাকার রাস্তায় চলতে ফিরতে গিয়ে ম্যাঙ্গোজনতার মুখে আপনি এ শব্দটি শুনবেনই। এ পথচলতি খিস্তির অর্থ ঢুকিয়ে দেওয়া, গুঁজে দেওয়া, অনুপ্রবিষ্ট করা। গালি হিসেবে মোক্ষম, পাওয়ারফুল। কিন্তু, এর প্রমিত রূপ কী হতে পারে? আমি আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইতে ‘সান্ধাইয়াছি’ বলে সাধুরীতির একটি শব্দ আবিষ্কার করেছি, যা কিনা ঐ একই অর্থ বহন করে। আমার ধারণা প্রমিত রীতির চলতি শব্দ ‘সেঁধানো’ বা সিঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ ‘হান্দানো’ শব্দের শিষ্টরূপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিঁধেল চোরের যে কাজ, অর্থাৎ সিঁধ কাটা কিন্তু গর্ত খুঁড়ে গৃহস্তের ঘরে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার বিষয়। কাজেই, আমার অনুসিদ্ধান্ত হলো এ শব্দগুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট। কিন্তু, ‘তোরে হান্দাইয়া দিমু’ বললে যে ইফেক্ট তৈরি হয়, ‘তোকে সিঁধিয়ে’ দেব বললে তার অর্ধেক অভিঘাতও তৈরি হবে না। ঠিক এখানেই রাস্তার শব্দের উপযোগিতা, যা প্রমিতায়নের কৃত্রিমতায় অনেক সময়ই কাহিল হয়ে পড়ে।

এভাবে রোজ রোজ নানা শব্দ ও অভিব্যক্তি বাঙালিরা তৈয়ার ও ব্যবহার করছে। তার কতগুলো মানুষের মুখে মুখে আরও বহুদিন ঘুরতে থাকবে। কিছু হয়তো কালের হাওয়ায় উড়ে যাবে। কিন্তু আমাদের ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও লেখকগণ চাইলে তাঁদের সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়ায় এগুলোকে নতুন জীবন দিতে পারেন। আবার, কোনও কোনও লেখক কর্তৃক তৈরিকৃত বা ব্যবহৃত এরকম শব্দগুলোকে চাইলে অন্য লেখকরাও প্রয়োগ করতে পারেন। এতে শব্দগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে, পুষ্ট হবে বাংলা ভাষা। জহির রায়হানের ধলপহর, হুমায়ূন আহমেদের চান্নিপসর, নির্মলেন্দু গুণের মুঠোফোন যেভাবে আমাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে, ঠিক তেমনি আর কী! বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “বাঙ্গালা ভাষা” প্রবন্ধে যেমনটা বলেছেন:

“বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে- যতটুকু বলিবার আছে, সবটুকু বলিবে- তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না। তারপর সেই রচনাকে সৌন্দর্যবিশিষ্ট করিবে- কেন না, যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অল্প। এই উদ্দেশ্যগুলি যাহাতে সরল প্রচলিত ভাষায় সিদ্ধ হয়, সেই চেষ্টা দেখিবে- লেখক যদি লিখিতে জানেন, তবে সে চেষ্টা প্রায় সফল হইবে। আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃতবহুল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃতবহুল ভাষার আশ্রয় লইতে হবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লইবে।” বঙ্কিমের এ ভাষাচিন্তার প্রতিই আমার পক্ষপাত।

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

শব্দপথে মুগ্ধযাত্রা

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

ভাষা একটি গতিশীল জিনিস। কালে কালে রঙ বদলায়। চেহারা পাল্টায়। পরিবর্তনের গ্রোতে গা ভাসায়। নিত্যনতুন উপাদান নিজের একাউন্টে জমা করে। আবার, কিছু কিছু জিনিস বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। আবর্জনা ফেলে দেয় ডাম্পস্টারে। সে ভাষাই শক্তিশালী যার নেবার উদারতা আছে, নিয়ে আত্মগত করার জোর আছে। আর আছে নানা রঙে, নানা ঢঙে নিজেকে প্রকাশ করার, মেলে ধরার, “গুটিয়ে নয়, ছুটিয়ে বাঁচার” দুরন্তপনা। পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলির সেসব শক্তিমত্তা আছে। আছে বলেই তাদের এত শান-শওকত-জৌলুশ। আর যেগুলোর নেই, সেগুলো মাজামরা। অবশ্য মাজামরা হবার অন্যান্য কারণও থাকতে পারে বা আছে। ইংরেজির কথাই ধরা যাক। দুনিয়ার সব ভাষা থেকে মাল হাতিয়ে কেমন গাট্টাগোট্টা হয়েছে! তার ঐশ্বর্যের তাজমহল দেখলে মনে খচখচানি আসে। আহা, আমার মাতৃভাষা যদি এরকম মালদার হতো! তবে ভরসার জায়গাও আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধা যায়। এর একটি হচ্ছে বাঙালির মোট জনসংখ্যা, প্রায় ৩০ কোটি। তার মানে বাংলা একটি সজীব, প্রাণবন্ত ভাষা যার পেটে প্রচ্চুর সম্পদ আছে, ট্যাপ করার বাকি। সেই সম্পদের একটি হচ্ছে শব্দ, লব্জ, প্রবাদ, প্রবচন, লোক-উক্তি, ছড়া, বাগধারা। সব ভাষার প্রাণ কিন্তু এগুলোই। বাংলার ক্ষেত্রে কথাটা একটু বেশিই সত্যি। বাংলা ভাষার ভূখন্ডজুড়ে যত রকম ডায়ালেক্ট বা উপভাষা রয়েছে, তার সব কটাই এক একটা শব্দ-নির্মাণের কারখানা। একই ভাষা এত বিচিত্র টানে, বিচিত্র শৈলীতে, বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যপ্রযুক্তি ইস্তেমাল করে বেগবান থাকতে পারে, তা চমকে চব্বিশ হবার মতই ব্যাপার।

ভাষা নিয়ে, বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। পন্ডিত, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার বুদ্ধিজীবীগণ অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ওনারা নমস্য, কদমবুসি পাবার হকদার। কিন্তু এ আনকোরা, লো-প্রোফাইল লেখকের মনে হয়েছে এ বিষয়ে কিছু ক্যাওক্যাঁচাল করা দরকার। আর দরকারই সরকার। তো আমার এ কম্মোখানি ব্যক্তিগত জোশ ও জজবার ফসল। কোনও প্রকার একাডেমিক গবেষণা তো নয়ই, গবেষণা বলাটাও বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। বড় জোর, এটাকে বলা যেতে পারে “শব্দপথে মুগ্ধযাত্রা”।

তো সফর শুরু করা যাক।

আমার জন্মস্থান নাঙ্গলকোট তিন-তিনটি জেলা, যথাঃ কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীর সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে কুমিল্লা জেলার হলেও ভাষাগত দিকে এটি নোয়াখালী প্রভাবিত। আর কে না জানে যে বাংলা ভাষার উপভাষাগুলোর মধ্যে উচ্চারণরীতি, টান আর শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে নোয়াখাইল্যা অনন্য! ইশকুলে গিয়ে যখন প্রমিত/মান বাংলার সাথে পরিচিত হই তখন থেকে পুলক লাগতে শুরু করে এ বিষয়ে যে, বাংলা ভাষার রঙ নানান কিসিমের। ভারি মজা তো! আবার, টেলিভিশনে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ শুনেও মুগ্ধ হবার অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি, আমাদের এলাকায় ফসলের মরসুমে ক্ষেতেখামারে কাজ করার জন্য উত্তর বাংলা থেকে গতরখাটা মানুষজন আসতেন। সৎ, বিনয়ী ও পরিশ্রমী মানুষগুলো স্থানীয়ভাবে “কামলা” নামে পরিচিত হতেন। তাঁদের মুখে আবার শুনতাম এক্কেবারে ভিন্ন স্বাদের জবরদস্ত বাংলা। আমার কাজ কেবলই মুগ্ধ হওয়া।

আমার মামাবাড়ি লাকসামের পশ্চিমগাঁর পাশেই। লাকসামের ডায়ালেক্ট নোয়াখাইল্যা ঘেঁষা হলেও নানা দিক থেকে স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট। আমার মা প্রায় তিরিশ বছর আমাদের গেরামে ঘরবসতি করেও তাঁর মাতৃভাষা লাকসাইম্যার আছরমুক্ত হতে পারেননি। তো এ উপভাষাটি আমার কানে ভিন্ন সুরের দ্যোতনা তৈরি করে। আবার, আত্মীয়তাসূত্রে ফেনী যাওয়ার বদৌলতে সেখানকার আলাগ ধাঁচের নোয়াখাইল্যা শুনতে পেতাম। ফলে, ভাষা ব্যাপারটার প্রতি আমার দিলনাশী পিচ্চিকাল থেকেই। এরপর কলেজে উঠে যখন শহর কুমিল্লায় আসি, আমার সামনে বাংলা ভাষার বহুবর্ণিল রূপের রঙধনু খুলে যায়। কুমিল্লার স্থানীয় ভাষাটা একটু অদ্ভুত, মজাদার। যখন কেউ সে ডায়ালেক্টে কথা বলেন, মনে হয় তার অন্তরের ধ্বনিপুঞ্জ মুখের জানালা দিয়ে বেরিয়ে দুনিয়ার বুকে গান হয়ে বেজে চলছে। এমনই তার দিলকা খাজানা। তবে কুমিল্লার অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং লাগোয়া জেলাসমূহের (বৃহত্তর কুমিল্লা)। চাঁদপুরের, বিশেষ করে। কাজেই আমাকে মিশতে ও কথা বলতে হয়েছে বিচিত্র উপভাষায় কথা বলা রকমারি মানুষের সাথে।

কুমিল্লা শহরে আসার পর প্রথম যে নতুন শব্দটি শিখি তা হলো “ঠেকবাজ”। আমি থাকতাম কণকস্তূপ বৌদ্ধবিহারের ভেতরকার মেসে। কিছু হিন্দু ও বৌদ্ধ ছাত্র মিলেজুলে থাকতাম সেখানে। আর কিছু রুম বরাবরই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অর্থাৎ, ভন্তে ও শ্রমণদের জন্য নির্ধারিত। যাহোক, মেসে ওঠার পরই দাদারা ঠেকবাজদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। এলাকায় নাকি সন্ধে নাগাদ ঠেকবাজদের দৌরাত্ম্য। কারা এ ঠেকবাজ? গোদা বাংলায়, যারা পিস্তল, ছোরা, চাকু, যাহোক একটা কিছু পেটে, পিঠে, কপালে ঠেকিয়ে আপনার পয়সাপাতি, হাজুবিজু, গয়নাগাঁটি চাঁটি করে দেয়, সে প্রতিভাবানদের ঠেকবাজ বলা হয়।

এরপর, আরেকটি অদ্ভুত কিসিমের শব্দ শিগগিরই আমার কানে আসে। সেটি হলো “বেপতার”। মনে হতে পারে, বেপরোয়া জাতীয় অর্থ হবে এর। কিন্তু, না। এর মানে হচ্ছে বেকুব, বেক্কল। বেকুব অর্থে লাকসাম, মনোহরগঞ্জ এলাকায় মক্কল কথাটিও প্রচলিত। শব্দের কিসিঞ্জারি এখানেই। কিসিঞ্জার শব্দটি সামনে এলে দুজনের কথা মনে পড়ে। একজন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব (পড়ুন মন্ত্রী) যিনি ধূর্ততার জন্য বিখ্যাত বা কুখ্যাত। আরেকজন হচ্ছেন এক সময়কার জনপ্রিয় বাংলাদেশি কৌতুকাভিনেতা হারুন কিসিঞ্জার। শেষজনের কিসিঞ্জার নামটি সম্ভবত নিজের কিংবা অন্যদের দেওয়া, অনেকটা উপাধিমূলক। ধারণা করা হয়, উপাধিটি প্রথমোক্ত কিসিঞ্জারের চরিত্রগুণেই প্রসিদ্ধ হয়েছে। বলে রাখা ভাল, হারুন কিসিঞ্জার মনোহরগঞ্জ তথা বৃহত্তর লাকসামের মানুষ। এ অঞ্চলে কিসিঞ্জার নামটি বা শব্দটি ধূর্ততা, কূটবুদ্ধি, দুষ্টবুদ্ধি, কলাকৌশল, উপস্থিতবুদ্ধি, দুরন্তপনা, দস্যিপনা, কৌতুকবাজি, রসিকতা ইত্যাদি বিষয়ের দ্যোতক। অনেকটা বিশেষণ সদৃশ। আর কিসিঞ্জারি হচ্ছে তার বিশেষ্য। উদাহরণ স্বরূপ, ‘লোকটার কিসিঞ্জারির সাথে তুই পারবি না। পাঙা নিতে যাস না।’ দেখুন, এখানে ব্যবহৃত ‘পাঙা নেওয়া’ কথাটি এসেছে হিন্দী-উর্দুর সৌজন্যে। এভাবেই পরভাষী, পরদেশী শব্দ বা ইডিয়ম আমাদের ভাষার ভিটেয় বসতি গড়ে আর হয়ে ওঠে আমাদেরই আপন। এটা বাংলা ভাষার সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ।

“শালা এক নম্বরের জাউরা।” এরকম এক্সপ্রেশান বাংলাদেশে আপনি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ‘জাউরা’ বা ‘জাইরা’ কিসিঞ্জারের মতোই দুষ্টবুদ্ধি বা চতুরালি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শব্দের উৎপত্তি বোধহয় ‘জারজ’ থেকে। উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেন, অর্থ ও ব্যঞ্জনা পাল্টে গেছে। এ বাংলার মানুষের মুখে মুখে আর নাটকে-সিনেমায় জায়গা পাক্কা করেছে এ অপশব্দ বা স্ল্যাং। সাহিত্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে কি? খোদা মালুম। ভগবান জানেন। ‘ভগবান জানেন’ কথাটিকে শর্ট করে কিন্তু পশ্চিম বাংলায় ‘ভগায় জানে’ বলেন কেউ কেউ, নিছক মজা করার জন্য বা রসিকতার অংশ হিসেবে। কথাটির শুরু কখন সেটাও ভগায় জানেন। আমার জেনে কাজ নেই। এমনিতেই অনেক ক্যাওক্যাঁচালের মধ্যে আছি। করোনা অতিমারী (প্যান্ডেমিক) আমাদের ফুটুরডুম করেই ছাড়বে মনে হচ্ছে। লোকজনের কাঁওতালি দেখেও গা রিনরিন করছে। কদিন আগে দেখলাম, বাংলাদেশে ছোট্ট এক বস্তা ত্রাণ উপহার দিতে গিয়ে দশজন হাত লাগাচ্ছে। ছবি খেঁচার জন্য। নিজেদের নুরানী চেহারা মোবারক দেখাবার খায়েশ এ চরম দুর্দিনেও অনেকে ছাড়ছে না। মজার কথা হচ্ছে এ ছবিতে ত্রাণ নিচ্ছে কে বোঝার জো নেই। আরেক ছবিতে দেখলাম, জনৈক শ্মশ্রুধারী দাতা হাতেমতাই একজন রোগী গোছের মানুষকে একটি কলা উপহার দিচ্ছেন আর ছবি তোলার জন্য পোজ মারছেন। ক্যাপশানে এক বদের হাড্ডি লিখেছে, যে, ‘ভদ্রলোক তার কলা দিচ্ছেন’। অর্থ বুঝে নাও, হে সুজন।

‘টুরিস্ট স্পটটা হেব্বি মাইরি। যেমন ছিমছাম, তেমন সাজানোগোছানো। পাহাড় আর নদীর রোমান্টিক কম্বো। কী আলো! কী হাওয়া! খাবার তো দারুণ টেস্টি! বলতে গেলেই, পুরোই মাখন।’ এ সংলাপের শেষ শব্দমালা ‘পুরোই মাখন’-এর দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখানে মাখন বলতে খাবার নয়, বরঞ্চ খাবারের গুণপনাকেই হাইলাইট করা হয়েছে। মাখনের স্বাদের পাশাপাশি তার মাখোমাখো কম্বিনেশনের দিকটি বিবেচনা করা হয়েছে। আর তাতেই বাংলায় আরেকটি নয়া ইডিয়মের জন্ম হয়েছে, হয়তো পাড়ার রকে বসে আড্ডা দেওয়া কোনও তরুণের মুখ ফসকে বেরুনো চমকদার কথারূপে। তারপর হাজার জনের মুখফেরতা শব্দটি স্থান পেয়েছে বইয়ের পাতায়, ফেসবুকারের টাইমলাইন বা সময়রেখায়। আমি পেয়েছি কলকাতার বিখ্যাত ‘সানন্দা’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গল্পে। বলতে চাইছি, প্রতিদিনই মাঠে, ময়দানে, ঘাটে, হাটে, ইশকুলে, মুশকিলে, সুখে, অসুখে, শয্যায়, লজ্জায়, গদ্যে, পদ্যে, এখানে-সেখানে, সবখানে একটি ভাষার বিশাল রাজ্যে নতুন নতুন শব্দ, প্রবাদ, কূটকথা, অতিকথা, সংলাপ, গৎ, জনবুলি, টার্ম তৈরি হয়। তার সবকটাই খাসা মাল তা নয়। কিছু ভূসিমাল ঝেড়ে ফেলে বাকিগুলোকে প্রতিষ্ঠা দিলেই ভাষার ভাঁড়ার ভরতে থাকবে। শক্ত হবে তার প্রকাশের পেশী, তেজী হবে তার ভাবের হৃৎপিন্ড।আর মুক্ত দুনিয়ার হাজারো ভাষার উর্বর জমিন থেকেও দরকার মোতাবেক শস্য আনার মতো বুদ্ধিমত্তা দেখানো চাই। একাজে কোনও প্রতিষ্ঠান কী করবে কী করবে না, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এ দায়িত্ব লেখকের, সাহিত্যিকের, ভাষাশিল্পীর, উদারমনা অধ্যাপকের।

ঠাট্টাচ্ছলে চমৎকারকে মচৎকার বলতে শোনা যায়। ফেসবুকেও কারুকে কারুকে এটা লিখতে দেখেছি। সারকাজমের জন্য ‘মচৎকার’ শব্দের ইস্তেমাল কেবল ইস্পেশাল বক্তার পক্ষেই সম্ভব। শব্দের কদর বাড়ে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিত্ব, প্রভাব, এমনকি আন্তর্জালে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর জন্যেও।

যাহোক, এবার আসি নতুন একটি শব্দে। খেলার মাঠে আমার এক বাল্যবন্ধু ও প্রতিবেশী একটি অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করতো: খাল্লিবাল্লি। বোধকরি, শব্দটি এসেছে ইংরেজি hurly-burly-এর বাঙলায়নের সিলসিলায়। ওর দাদু জীবনভর কাজ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। হয়তো তাঁর সুবাদে শব্দটি বদলে গিয়ে নাতির কাছে এসেছে, যে আবার আমাদেরকে তা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে। যেভাবেই আসুক না কেন, শব্দটি কিন্তু জোস। আলতুফালতু, আলটপকা, উল্টা পাল্টা, বেহুদা, অসংলগ্ন, অদরকারি- এসব অর্থে খাল্লিবাল্লি শব্দটি বেশ সেঁটে যায়। আমি বাপের জন্মে আর কারুর মুখে এ শব্দটি শুনিনি। যদি ধরে নেই যে, শব্দটি আমার ঐ বন্ধুরা কয়েনেজ, তাহলে সে এক বিরাট আবিষ্কার আমার দিক থেকে। এভাবে বৃহত্তর বাংলার কোনাকাঞ্চিতে কতশত সুন্দর সুন্দর শব্দের জন্ম হচ্ছে আর চর্চা ও নথিকরণের অভাবে অকালে গতাসু হচ্ছে, তার হিসেবপত্তর কোত্থাও নেই। আমি সে অকাল মরণের বিরুদ্ধে যমকাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাই।

ঢাকাই বাংলা সিনেমার খলনায়ক ডিপজলের মুখে একটি শব্দ চরকির মতো ঘুরতে থাকে। ‘এক্কেরে হান্দাইয়া দিমু’ জাতীয় সংলাপ হরহামেশাই তার মুখ থেকে বেরোয়। ‘হান্দানো’ একটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য, হুমকির জন্য জুতসই শব্দাস্ত্র। খলনায়কদের মুখে তো বটেই, ঢাকার রাস্তায় চলতে ফিরতে গিয়ে ম্যাঙ্গোজনতার মুখে আপনি এ শব্দটি শুনবেনই। এ পথচলতি খিস্তির অর্থ ঢুকিয়ে দেওয়া, গুঁজে দেওয়া, অনুপ্রবিষ্ট করা। গালি হিসেবে মোক্ষম, পাওয়ারফুল। কিন্তু, এর প্রমিত রূপ কী হতে পারে? আমি আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইতে ‘সান্ধাইয়াছি’ বলে সাধুরীতির একটি শব্দ আবিষ্কার করেছি, যা কিনা ঐ একই অর্থ বহন করে। আমার ধারণা প্রমিত রীতির চলতি শব্দ ‘সেঁধানো’ বা সিঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ ‘হান্দানো’ শব্দের শিষ্টরূপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিঁধেল চোরের যে কাজ, অর্থাৎ সিঁধ কাটা কিন্তু গর্ত খুঁড়ে গৃহস্তের ঘরে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার বিষয়। কাজেই, আমার অনুসিদ্ধান্ত হলো এ শব্দগুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট। কিন্তু, ‘তোরে হান্দাইয়া দিমু’ বললে যে ইফেক্ট তৈরি হয়, ‘তোকে সিঁধিয়ে’ দেব বললে তার অর্ধেক অভিঘাতও তৈরি হবে না। ঠিক এখানেই রাস্তার শব্দের উপযোগিতা, যা প্রমিতায়নের কৃত্রিমতায় অনেক সময়ই কাহিল হয়ে পড়ে।

এভাবে রোজ রোজ নানা শব্দ ও অভিব্যক্তি বাঙালিরা তৈয়ার ও ব্যবহার করছে। তার কতগুলো মানুষের মুখে মুখে আরও বহুদিন ঘুরতে থাকবে। কিছু হয়তো কালের হাওয়ায় উড়ে যাবে। কিন্তু আমাদের ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও লেখকগণ চাইলে তাঁদের সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়ায় এগুলোকে নতুন জীবন দিতে পারেন। আবার, কোনও কোনও লেখক কর্তৃক তৈরিকৃত বা ব্যবহৃত এরকম শব্দগুলোকে চাইলে অন্য লেখকরাও প্রয়োগ করতে পারেন। এতে শব্দগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে, পুষ্ট হবে বাংলা ভাষা। জহির রায়হানের ধলপহর, হুমায়ূন আহমেদের চান্নিপসর, নির্মলেন্দু গুণের মুঠোফোন যেভাবে আমাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে, ঠিক তেমনি আর কী! বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “বাঙ্গালা ভাষা” প্রবন্ধে যেমনটা বলেছেন:

“বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে- যতটুকু বলিবার আছে, সবটুকু বলিবে- তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না। তারপর সেই রচনাকে সৌন্দর্যবিশিষ্ট করিবে- কেন না, যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অল্প। এই উদ্দেশ্যগুলি যাহাতে সরল প্রচলিত ভাষায় সিদ্ধ হয়, সেই চেষ্টা দেখিবে- লেখক যদি লিখিতে জানেন, তবে সে চেষ্টা প্রায় সফল হইবে। আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃতবহুল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃতবহুল ভাষার আশ্রয় লইতে হবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লইবে।” বঙ্কিমের এ ভাষাচিন্তার প্রতিই আমার পক্ষপাত।