নীল মর্গের কোরাস

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

যেখানে মানুষ মৃত্যুর সীমান্ত চেকপোস্ট পেরিয়ে যায় অনাহূতভাবে, সেখানে ভগবত ডোম একজন কারিগর সেই মৃত্যুর প্রকৃতি নির্মাণে। মানুষের শবদেহ যখন রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তখন ভগবত ডোম তাদের ছাড়পত্র তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। এই ব্রহ্মান্ডে আর দশটা সাধারণ মানুষের অধিকার যেখানে শেষ হয়ে যায় প্রিয় মানুষটির কাছে যাবার, সেইখানে ভগবত ডোমের অধিকারের শুরু।

সেই ভগবত ডোম এই রাতে চোলাই মদে আকণ্ঠ ডুবে মর্গের বারান্দায় ঝিমুচ্ছে। সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে সে তার আধ নেংটো কালো কালো হাত-পা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভরা শ্রাবণের অঝোর ধারায় চারদিকে ঘন পর্দা। লাল ইটের মর্গের চিকন বারান্দা পেরিয়ে বৃষ্টি ভেদ করে হাতত্রিশেক দূরে তার টিনের চালাঘরটাও নজরে আসছে না।

ময়না ওর সাথেই ছিলো। কিছু আগে দু গ্লাস চোলাই গিলে চলে গেছে। ঘরে এখন ভগবতের বউ আর তিন মেয়ে নিয়ে ঘুমে নিপাট । যাবার আগে ময়না ওর মরদটাকে বেশ টেনেছে। ভগবতের হাতটা ওর বুকের ওপর রেখে নিজেই চাপ দিয়েছে। একবার মর্গের বারান্দায় টান মেরে শুইয়েও ফেললো। কিন্তু ভগবতের দেহে সারা জাগেনি। ময়না রাগ করে নেশায় ঢুলে ফোঁস ফোঁস করে উঠেছে, ই হারামি মরা। সালার কুত্তা মরদ। উটা কুন সালিকে গিলাইলি রে, হারামি?

এর কোনো উত্তর নাই।

ভগবত ডোম মর্গের বারান্দায় নির্ঘুম বসে। ঘরের ভিতর লাশ। আকাশ ভেঙ্গে নামা বৃষ্টির ভিতর কিছু আগে ঠেলা গাড়িতে লাশটা এসেছে। লাশটা রেখেই ভয়ার্ত লোকগুলো তড়িঘড়ি চলে গেছে।

মর্গের চৌহদ্দিতে কে-ই-বা বেশি সময় থাকতে চায়! মনে হয় চারদিকে ভূতপ্রেত গিজ গিজ করেছে। এখানে যে সকল মানুষের মৃতদেহ আসে, তাদের সবাই বেঁচে থাকার শেষ অদম্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে মৃত্যুকে অকস্মাৎ আলিঙ্গন করে। জীবনকে উপভোগের, আস্বাদের অভিলাষ তীব্রভাবে ব্রেক কষা গাড়ির মতো থেমে গেছে। তারপর সেই জীবনহীন দেহ প্রবেশ করেছে এক রূপান্তরিত লোকে।

যখন তাদের জীবনের আলো ফুরিয়ে যায়, তখন মনে হয়, এ পৃথিবীতে তারা আবার অন্য শরীরে ফিরে আসবে। হয়তো প্রতিশোধ নেবে তাদের মৃত্যু ত্বরান্বিতকারীদের ওপর। ফলে জীবনের মোহের প্রতি তৃষ্ণার্ত আত্মারা তাই মর্গের আশপাশে ঘুরেফিরে বেড়ায় বলেই মনে হয় সবার কাছে।

শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝে ঠেলাগাড়িতে লাশটা এনেই খোঁচা খোঁচা আধাপাকা দাড়ির বয়ষ্ক লোকটা ভগবতকে জিজ্ঞেস করেছে, ডোম দাদা, লাশটা কোথায় রাখবো? বাইরে তো খুব বৃষ্টি। আমার নাতনিটাকে ঘরের ভিতর রাখলে হয় না?

ভগবত মর্গের কোণটা দেখিয়ে দিলো। আরে ভিতরিই তো রাখবি। উই দিকের কুনায় রাখ।

এই রাতেরবেলা লাশ দেখে ও অবাক। সাধারণত রাতের বেলা থানা থেকে লাশ আসে না। ও নিশ্চিত এ লাশে কোনো গড়বড় আছে। তাই ঝামেলা চুকাতে রাতেই মর্গে পাঠিয়েছে।

বৃষ্টিতে ভেজা চাটাইয়ে মোড়ানো লাশটা তুলে লোকগুলো কালিপরা চিমনির হারিকেনের আলোয় পথ করে মর্গের ভিতর ঢোকে। বৃদ্ধ লোকটা ভগবতের কাছে গিয়ে করুণ আর্তি নিয়ে অনুরোধ করে, ডোম ভাই, একটু খেয়াল রাখবেন। আমার নাতনিটা বড় আদরের। একথা বলে চোখ মুছে ভগবতের হাতে গুঁজে দেয় ময়লাটে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট।

সবার মাঝে চলে যাবার তাড়া। পা বাড়িয়েই বয়ষ্ক লোকটা আবার ফিরে আসে, ডোম ভাই, ওর যেনো কষ্ট না হয়। সেলাইগুলো একটু যত্ন করে দিস রে ভাই।

আর কিছু বলতে পারেনি। হাউমাউ করে ডুকরে উঠেছে মানুষটা।

নেতিয়ে থাকা নোটটা হাতে কচলাতে কচলাতে ভগবত ডোম সাড়া দেয়, ই মানুন, কাঁদিস ক্যনে রে। হামি কি ভগমান? হামি কষ্ট দিবার কে লো? সুন, কানদিস লা রে। হামি তোর লাসটাক কষ্ট দিবো লা। হামি কারুকেই কষ্ট দি লা। যা, যা বাড়িত যা এখুন।

ভগবত আবার চোলাইর নেশায় ঝিমুতে থাকে। নেশার মাঝে সদ্য আসা লাশটা নিয়ে তার স্বভাবে কোনো ভাবান্তর নাই। কী আর এমন বিশেষত্ব আছে অপঘাতে তৈরি এই লাশের ভিতর? হয় সে বিষ খেয়ে মরেছে, হয় ফাঁস দিয়ে মরেছে; না হয় কেউ গুলি করে মেরেছে বা দায়ের কোপে ফালা ফালা করেছে- একটা কিছু হবে।

থানা থেকে লাশের সাথে আসা পুলিশ দুজন এরই মাঝে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছে। ফলে তারা লাশটার ওপর মহা খাপ্পা। নিজেদের ভিতর নিচু স্বরে বলাবলি করছে।

শালার মাগিটা মরার সময় পাইলো না। মরলি মরলি এই বৃষ্টির মইধ্যেই মরলি।

ফজুবাবু, একটা কতা বলি। এই মেয়েটা তো যাত্রা করতো, নাচতো। আমাদের বড় বাবুরও খুব পেয়ারে ছিলো। অথচ আজ এই রাইতেই বড়বাবু মর্গে পাঠালো। কী কপাল রে মাগির। মইরলো, আর সোহাগও শ্যাষ।

এই জিন্নাত মিয়া, তোমার এই কথা এইখানে ক্যান। মাগিটার দাদাটা শুনবে। আর শোন, মর্গে কেউ এমুন কথা বলে? চুপ থাক। কী থেকে কী হয়! এমনিই আমার জান খারাপ হয়ে যায় মর্গে আইসলে। দোয়া পড়তে থাক।

আরে ভয় করলি ভয়। কখনো শুনিছো যে পুলিশকে ভূতে ধরেছে। আচ্ছা শোনো, ওই ভগবতকে বলি আমরা এখন যাই। লাশটা তো ঘরে থাকলো। ভগবত তালা দিয়ে দিক, ল্যাঠা চুকে যাক এই রাতে।

এই ভগবত, ঘরের ভিতর লাশ রাইখে তালা দিয়ে দে। কাল ডাক্তার সাহেব আসার পর খুলিস। বুঝলি? ঝামেলা যেনো না হয় ।

লা, বাবু। ঝামেলা আবার হোবে ক্যানে, হামি ভগবত কি লাসটা খাইবো?

হুহ। যা তো। জঘন্য কতা বলিস না। তুই তো ভূতের মতো কতা বলিস রে, এইটা কোনো কতা হলো! ইস রে বমি আসে।

খৈনিতে দাগ পরা দাঁত মেলে ভগবত একটা নীরব হাসি দেয়। ভগবত ডোম আবার এক গ্লাস চোলাই হাতে নেয়। মুখের ভিতর চোলাইর আগুন ঢুকে পড়ে, বুকের অলিগলি দিয়ে তস্য গলি পেরিয়ে পাতালের অনন্ত গহ্বরে নামতে থাকে। ঝিম ধরে আসা মাথাটাতে প্রতিদিনের মতো আজও ফিল্মি খেলা। প্রতিরাতেই এ ঘটনাটা ঘটে ভগবতের। ফ্ল্যাশ ব্যাক। ছোটোবেলায় বাবার পাশে বসে লাশ কাটা দেখাটা মাথার ভিতর পাক খেতে থাকে।

তখন মর্গটা ছিলো সারা বছর নোংরা পানিভর্তি ঘাগরা ক্যানেলের উত্তর দিকে। পশুহাসপাতালের পাশে। একটা লাল রঙের উঁচু বারান্দার ওয়ালা ঘর। বড় বড় সবুজ রঙের জানালা। সামনেটা ছাড়া চারদিকে ঝোপঝাড়ে ভরা। বিশেষত ফণিমনসার গাছ ছিল প্রচুর। পশুহাসপাতালে লোকজন যারা আসতো, তারা আর মর্গের দিকে পা বাড়াতো না। এমনকি পারলে ওদিকে চোখও বুলাতো না। লাশের গন্ধে ঘাগরা ক্যানেলের চোরা গর্ত থেকে প্রায়ই শিয়াল এসে মর্গের চারিদিকে ঘুরঘুর করতো। তারই কোনো একটা দুঃসাহসী হয়ে পশুহাসপাতালের দিকে গেলে ভয়ে লোকজন আর্তনাত করে উঠতো।

ও যখন ওর বাবার পেটের চেয়ে একটু লম্বা হয়েছে, তখুনি একদিন তার বাবা লাশ কাটায় হাতেখড়ি দিলো। পাকিস্তান আমল। খুনখারাবি, গাড়ি দুর্ঘটনা কম বলে লাশও আসতো কম। এরই মাঝে একদিন ভগবত ওর বাবা বিধু ডোমের পাশে বসে লাশ কাটা দেখছে। লাশের ডান হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে শক্ত হয়ে যাওয়ায়, বিধু ডোম কিছুতেই বুকে ছেনিটা বসাতে পারছে না।

ভগবত, ই হাতটা ধোরতো বেটা।

ভগবত পাশেই বসা ছিলো। সে তার ছোটো হাত দিয়ে প্রাণপনে দশাসই আকারের লাশের ডান হাতটা টেনে ধরলো।

ই থাম থাম। পোরে ধর হাতটা। এই বলে বিধু ডোম প্রথামাফিক লাশের কাটা খুলির খোলে জমাট হয়ে থাকা কিছুটা রক্ত এক খাবলায় নিয়ে ঘটির পানিতে ফেললো। তারপর ভালো করে গুলিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আউড়ে ভগবতের মাথার ওপর হড়হড় করে ঢেলে দিলো। বারান্দা থেকে দৃশ্যটা দেখে পাহারায় থাকা পুলিশটা ওয়াক ওয়াক কোরে অবিরাম বমি করতে শুরু করলো।

ই রে বাবা, তু তো নামরদ রে বাবু। তু পুলিশ হলি ক্যান রে? তু তো মাইয়া হলে ভালো কোরতি। হাহ, হাহ করে প্রচন্ডভাবে সে হেসে ওঠে বিধু ডোম। তারপর আবার বলে উঠে, ই দ্যখ, হামার বাঘের বাচ্চা। উ দিখিস, হামার মতো ডোম হোবে। সুনরে বাবু, ডোমের কইলজা ইততা বড়া।

ভগতব দৃশ্যটা দেখে আর নেশার ঘোরে বিড়বিড় করে, বাপু। হামি তুর মতই হইচি রে। হামি তুর মান রাইখচি। পরক্ষণেই মনে মনে বলে, কিন্তুক হামাক ক্যানে লাস কাটার মানুন বানাইলি রে বাপু? হামাক তু অন্য কিছু বানাইতি। হামার মাইয়া তিনটা ক্যামুন করে লাশকাটা ডোম হোবে? কেমন এক করুণ আক্ষেপ নীরবে ওর কণ্ঠের ভিতর দলা পাকিয়ে থাকে।

ভগবানের ওপর অভিমান জমে। ডোমের ঘরে পুত্র সন্তান না হলে কে লাশ কাটবে? কে ডোম হবে? ওদের পরিবারকে রক্ষা করবে কে? মেয়েদের তো লাশ কাটার কোনো নিয়ম নাই। ওর সাথে ওর বউ ময়নারও এ নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তা। ময়না অনেকবার ভগবতকে অনুরোধ করেছে, তু সিভিল ডাক্তার বাবুকে বোল যে, হামিও লাস কাটবো। তু পারিস, হামি ক্যানে পাইরবো লা।

ই দেখ মুইনা, আরে সোরকার কখুনো হামাদের কোথা শুইনবে। ইটা সোরকারি কানুন। তু আর হামি চেচাইলে কী হোবে। চেচাইলেই কী তুকে মাইয়া মানুনের লাস ফাড়তে দিবে, বোল?

ক্যানে দিবেক লা? ক্যানে দিবেক লা? হামার সক্তি লাই! ঠিক আছে, সোব লাস লাই কাটবো, ঠিক আসে, সোরকারকে বোল, তুরা মরদের লাস ফারবি। আর হামারা মেয়েদের। সমান বাত।

ই বউ দেখ, তুর কোথা ইমুন কোথা যেন হামি লিজেই ইটা কানুন বানাতি পারি।

তারপর পুরো অনুরোধ আর আলোচনাটা মোড় নেয় অভিযোগ আর গালিগালাজে। ময়না ক্রোধে ভগবতকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তু তো আসলে হারামি থাকলি রে, বুঝলি লা? তু চাইলি লা ইটা। ই সুন, ভগমানের কিরা কাট, তু কি কাপড়া ফাড়ে মাইয়া লাসগুলাক দিখিস লূা? বোল? উদের সবতাতে হাত দিস। দিস লা? তুই সালা লাস চোদা কুত্তা, সুওর।

গালিগালাজ শুনে মেজাজ চড়ে যায় ভগবত ডোমের। ক্ষিপ্ত মাথায় এক লাথি কষে দেয় ময়নাকে। ময়না ছিটকে মর্গের সামনের মাটিতে পড়ে যায়। তাদের মেয়েরা দৌড়ে আসে। কিন্তু মা কে মাটি থেকে তুলে উঠায় না। ভেউ ভেউ করে ময়না কাঁদতে থাকে। এবং আরও অবিশ্রান্ত খিস্তি খেউরের ভিন্ন পর্ব শুরু করে।

তিন মাসে, ছ মাসে ময়না যখন এমন অবতারে পরিণত হয়, তখন ভগবত কখনোই বউয়ের অভিযোগ স্বীকার করে না। এসব অভিযোগের পাল্টা কথায় প্রবল প্রতিরোধও গড়ে ওঠে না তার মুখে। কেবল না পেরে এক লাথি কষিয়ে দেয় ময়নাকে শেষমেশ।

এই চল্লিশ বছরে কত যে লাশ কেটেছে ভগবত তার হিসেব নাই। নানান বয়সী লাশ। কেউ নারী, কেউ পুরুষ। কারো দেহ এমন যে দেখলে মনে হবে কোনো আঁচড় পর্যন্ত নাই। আবার কোনো কোনো লাশ একেবারেই ক্ষতবিক্ষত। কোন কোনো লাশের চেহারা মনে ছাপ ফেলে যায় দীর্ঘ দিনের জন্যে। কোন লাশ শুধু ওই একটা দিন তাকে সারাক্ষণ দোলা দেয়। বিমর্ষ করে রাখে।

সারা দিনের আফসোস ভুলতে সন্ধ্যা হলেই ভগবত চোলাই নিয়ে বসে। সাথে যোগ দেয় বউ আর মেয়ে। আবার এমনও হয়, চোলাই খেয়েও ভুলতে পারে না কোনো লাশের চেহারা। কারো মুখ ওর মনের ভিতরের খোলটাতে তোলপাড় করতে থাকে।

এক অবোধ কান্না চারাগাছের মতো গজায় ওর বুকের মাঠটাতে। কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে ওঠে, ভগমান, তুর আদমকে তু লিয়ে যা। কিন্তুক হামাক কেনে কষ্ট দিস বোল তো? হামার বাপোক তু ডোম বানাইলি। হামাক বানাইলি। হামাক তু অন্য কিছু বানাইলে তুর কী হইতো?

নতুন মর্গের বিল্ডিং-এ আসার আগে ভগবত প্রায়ই পুরোনো মর্গের ভিতরেই ঘুমাতো। কত দিন গেছে ভগবত আর ময়না পুরোন মর্গের মেঝেতে শরীরে শরীরে হুঁটোপুটি করেছে। যে মর্গের মেঝেতে মানুষের মাথার খুলি, বুক, পেট চিরে ভগবত ডোম মগজ, হৃৎপিন্ড, কলিজা, নাড়িভুঁড়ির অংশ কেটে বের করে রাখে, সেই মেঝেতেই ভগবত ডোম তার স্ত্রীর সাথে গাঢ় আবেগের আলিঙ্গনে দু দেহের সীমান্ত বিলীন করে দিতো।

ই তু ইকেবারে সুওরের মতো মরদ। ই ইখুন দিন বেলা মরদাঙ্গি মারলি রে। মানুন দেখলে কি বাত বোলবে, বোল?

তু মুইনা হামার দিলটাতে ছাপ্পা মারলি ক্যান তো, বোল?

হামি তুকে ইমুন কোরলাম, আর তু কোরলি লা?

ই মুইনা, সুন, লে আবার খেলা মারি রে। ইটা বোড়ো ভালো ঘর রে, ইখানে মানুন তো মানুন, সালার ভূত ভি আসে লা।

তারপর ময়না অস্ফুটে উচ্চারণ করে, তু হামাকে ফিলিম দিখাতি লি চোল রাইতে।

ভগবত আর ময়না আবার পরস্পরের ভিতর প্রবেশ করার জন্যে উন্মাতাল হতে থাকে। একদিন মর্গের সেই মেঝেতেই ময়নার ভিতরে ওদের প্রেমের প্রথম ফুল ফুটেছে!

ভগবতের কখনোই গাঢ় ঘুম হয় না। ঘুমের ভিতর চলে মৃত মানুষের মিছিল। ওরা আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। ওকে ঘিরে লাশগুলো গান গায়। নাচে। ওর হাত ধরে কত বিচিত্র স্থানে ভ্রমণে নিয়ে যায়। ভগবতের প্রতি কোনো লাশের কোনো অভিযোগ নাই। ভগবত তো ওদের যতœ করে। ভালোবাসে। মৃত্যুর পর এই হতভাগ্যরা ভগবতের পরম মমতা লাভ করে। ভগবত প্রতিটা লাশ কাটা শুরু করার আগে মন্ত্র পড়ে। মর্গের ধারে জবাফুলের গাছ থেকে একটা ফুল এনে লাশটার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে। তু তো মানুন রে। কিন্তুক হামি তো ডোম। তু কে হাত দিছি বুলে তু হামাক অভিসাপ দিসলা। ভগমান তু কে জিগাইলে, তু কিন্তুক ইটা বুলিস তাকে, হামি তুকে কোষ্ট দিই লাই।

এই বলে ভগবত আবার লাশটাকে প্রণাম করে এবং ঘরের কোণে তাক থেকে হাতুরি, ছেনি আর করাত টেনে নামায়।

যখন দিনের আলো ফুটে, তখন ওর মনে হয় পরিচিত লাশগুলো ওর চারপাশে ঘিরে থাকে। ওরা খিলখিল করে হাসে। লাশ কাটার কাজে উৎসাহ দেয়। কেউ আবার সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়িয়ে ধরে। কখনো কাজের মাঝেই চোলাই খেতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। বিশেষত যদি কোনো দিন একসাথে বেশি লাশ কাটার কাজ আসে।

ডাঙদার বাবু, তু ইকটু বাহার যা, হামি ইকঠু দারু পিলি।

এই ভগবত, কাজের সময় দারু খাস না। আগে কাটাকুটি শেষ কর। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ই বাবু, তু হামাক কী বুলছিস রে। তু দেখ, হামি তুরণত সবকটা লাস ফাড়বো। হামাক ইকটু পিতে দে লা বাবু। হামি কি আর মানুন রে বাবু! হামি তো যম আছি। ভগমান হামাক রাসখোস বানাইছে।

কী রে ভগতব, মন খারাপ? দরদে ভরে ওঠে ডাক্তার সালেহিনের কণ্ঠ। তোর তো এই সমস্যা আগে ছিলো না। তুই সাহস হারালে আমার কী হবে বল? আজ একটু বেশি লাশ রে, সেই জন্যে কাজটা দ্রুত করতে হবে।

ই বাবু, তু হামাদের দারু মারু পি লিবি ইকঠু?

ডাক্তার হেসে ফেলে। না রে ভগবত, তুই খা। আমি বাইরে গিয়ে বসি।

ডাঙদার বাবু, ইতু গুলা লাস কুথা থেকে আসলো রে। ইতু মরা! কোন গাড়িটা ট্রেনটাক মারছে রে বাবু?

লাশ কাটা জীবনে কতো ডাক্তারও দেখেছে সে। পোস্টমর্টেমের সময় এরা একেকজন একেক রকম আচরণ করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মন খারাপ করে থাকে। খুব গম্ভীর হয়। আবার এমন না যে, দু একটা ফিচেল ডাক্তার একাজে আসে না।

পঁচিশ বছর আগের ঘটনা তো হবেই। ভগবত তখন টগবগে যুবক। মর্গে এলো এক সুন্দরী তরুণীর লাশ। ডাক্তার লাশটা দেখে বলে উঠলো, উপস! কী সেক্সি রে বাবা। কী দরকার ছিল মরার?

ভগবত ইংরেজি বোঝে না। কিন্তু ডাক্তারের হাবভাবে বুঝতে পারে সবটা। ডাক্তারের চোখদুটো খুব চঞ্চলভাবে লাশটার সারাটা শরীর ঘুরছে। ডাক্তার হিম লাশের মুখটা নেড়ে পরীক্ষা করার ছলে জোছনার মতো ধবল নগ্ন বুকের উপর হাতটা রাখলো। মুখের ওপর দারুণ কিছু খুঁজে পাবার আভা।

ভগবত, লাশটা ভালো কোরে কাটতে হবে রে। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে যে, এটা রেইপড এন্ড হোমিসাইড কেইস। তারপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, এই শোন, লাশের কাপড় ভালো করে না সরালে তো পোস্টমর্টেম ডিফেকটিভ হবে। আমার মনে হয় বডিটার ডাউন পার্টেও আঘাতের চিহ্ন আছে।

ডাঙদার বাবু, হামি কি আগে খুলিটা ফাটাইবো?

না, না। ওটা পরে। বডিতে এখনি ব্লাড লাগানোর দরকার নাই। এক কাজ কর, বডিটা আগে পুরোটা আনটাই কর। মানে পায়জামাটাও খুলে ফেল। পুরো বডিটা আগে চেক করে নেই। পরে ব্রেইন ভিসেরা কালেক্ট করবো।

ভগবত পায়জামার ফিতা ধরে টান মারে। কোমরের জায়গাটা ঢিলা করে নেয় একটানে। সাথে সাথে ডাক্তার আঁতকে ওঠে। না, না ভগবত, ওভাবে না। ওভাবে কাপড় খুললে বডিটা আঘাত পাবে। চিহ্ন নষ্ট হবে।

মেঝেয় হামা দিয়ে বসে পড়ে ডাক্তার। হিম লাশটার পুরুষ্ট পাছার নিচে হাত রাখে। বাবাহ, অনেক ভারি। ভগবত, তুই পায়ের দিকে যা। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। ডাক্তার ক্রমান্বয়ে মেয়েটার নাভীর জায়গা থেকে আস্তে করে আকাশী রঙের পায়জামাটা নিচে সরিয়ে দিতে থাকে।

উন্মোচিত হতে থাকে অপরূপা। কী আশ্চর্য! লাশের অপরূপ রূপ থাকে এই প্রথম ভগবত ডোমডাক্তারের সাথে উপলব্ধি করলো। ভগবতের চোখটা মেয়েটা নাভীর ওপর দিয়ে পিছলে নিচে চলে গেলো। কলাগাছের উরুর মতো সুঠাম জানুটাটে চাঁদ আকৃতির গাঢ় লাল রঙের জরুল!

কত স্মৃতি ভাসে ভগবত ডোমের মনের কোণে। একবার হাত ফাঁকা ভগবতের। ছোটো মেয়েটার গায়ে জ্বর। গত সাত দিনেও একটা লাশ মর্গে আসে নাই। ভগবতের মাথা খারাপ হবার যোগাড়। ময়নার মনও খারাপ। লাশ এলেই কিছু বকসিস পাওয়া যায়। কিন্তু লাশ কই?

ময়না সারাক্ষণ বাচ্চাটার জন্যে দুশ্চিন্তা করছে। ও মনে মনে মা কালীর প্রার্থনা করে, হে মাই, কুথাউ ইকটা মারডার হয় লাই। কুথাউ কি ই কটা লাস লাই?

ওদের যখন এমন প্রার্থনা, তখন স্বয়ং ঈশ্বর যেনো ওদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা লাশ মর্গে এলো। লাশ আসার খবরে বড় ময়েটা ছুটে মাকে খবর দিতে গেলো, মাই, বোডি আসচে। মারডারের বোডি। দিখবি আয়।

এদের জীবনে একটা নতুন লাশ মানে কিছু বকসিস। বাড়তি টাকা। এই খেলায় একজনের মৃত্যু অন্য জীবন প্রদীপে জ্বালানি ভরে দেয়। দিন সাতেক পর লাশের আগমন ময়নার ভিতর আনন্দ বইয়ে দেয়। ও ছুটে এলো লাশটা দেখতে। নয় বছরের বড় মেয়টাও এসেছে। সুন আধুরি, বাবাক বোল আইজ বকসিস বেশি লিতে। ই লাশটা বেশ পয়সা উয়ালা। উ দেখ, উর সাথে মানুনেন সব কাপড়া উপরা উনেক ভালা। তোর বাবাক বোল ইটা, বুঝলি?

আধুরি মাথা নাড়ে। ছুটে যায় ভগবতের কাছে। বাবার চোখের দিকে তাকায়। ভগবত যেনো বুঝতে পারে তার মেয়ের মন। ই তু, ইখানে ক্যান? যা ইখান থিকে। এই বলে আবার মত বদলায়, ই লা, লা, শুন, তু আইজ লাস ফাড়ার সময় হামার সাথে থাকবি। দুনিয়া বদলাইছে। মাইয়া মানুন ইখন ঘোরোত থাকলে কাম হবেক লাই। আয়, আয়।

আধুরি লাশটা দেখে আর অবাক হয়। এতো সুন্দর মানুষ! সারাটা শরীর নীল হয়ে গিয়েও যেনো কাঁচা সোনা। লাশটার মা ও কী অপূর্ব সুন্দরী। তসবি হাতে শোকে পাথরের মূর্তির মতো জমাট হয়ে আছে। কোনো স্পন্দন নাই। দাঁড়িয়ে থাকা একটা মৃত প্রাণী।

এই নীরবতার মাঝেই ভগবত আবার বলে ওঠে, বাবু, আইজ হামার বেটিও কাম করবে। উকেও বকসিস দিস কিন্তুক তুরা। দেখ তুরা বড় মানুন। হামাক না দিবি তো হামরা খাবো কী, বোল? তারপর মরামাছের ঘোলাটে চোখের ওপর উচ্ছ্বাস টেনে বলে ওঠে, আধুরি কিন্তুক আইজ পরথম লাস ফাড়বে। বুঝলি?

আঁতকে ওঠে লাশের সাথে আসা একজন। না, না, ওকে দিয়ে ক্যান? ও মেয়ে মানুষ। আল্লাহরওয়াস্তে বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে তোমরা এ কাজ করাবে না। ও উল্টাপাল্টা করে কাটবে।

ই কি বুলিস তু বাবু, সুন বাবু, হামার কাজ হামরা করি, তু দেখ কিছু হবেক লাই। সান্ত¡নাটা আউড়েই ভগবত ডোম তার মেয়েকে নিয়ে মর্গের ভিতর প্রবেশ করে। আজ তাকে সনাতন আচারের মাধ্যমে নিজের মেয়ের ডোম হবার অভিষেক ঘটাতে হবে; তার বাবা বিধু ডোম একদিন যেভাবে তাকে আচার আয়োজনের মাধ্যমে লাশ কাটা ডোমের অভিষেক ঘটিয়েছিলো, তেমনিভাবে।

পোস্টমর্টেম শেষ। লাশটা চাটাইয়ে মুড়িয়ে বাইরে আনা হলো। ঠেলার ওপর তুলতেই মূর্তিটা আড়ষ্ট আকৃতি ভেঙে হুড়মুড় করে ছুটে গেলো লাশের দিকে। ছেলেটার সু উন্নত কপালে কাঁথার মতো সেলাইয়ের ফোড়। ওর মা বিস্ফারিত চোখে ঝুঁকে পড়লো তার সোনা মানিকের ওপর। এক দুই তিন। তিনটা মুহূর্ত। ঢলে পড়লো ছেলের লাশের ওপর। আর উঠলো না।

শ্রাবণের অবিশ্রান্ত জলের ফোঁটায় ভগবত ডোমের চোখ থেকে নেমে আসা জলের কণারা মিশে যেতে থাকলো। ভগবত আবার এক ঢোক চোলাই গলায় ঢাললো। বৃষ্টির ঝাপটায় ওর শরীর ভিজে যাচ্ছে।

আজ বৃত্তবন্দি মানুষের এই বৃত্তে ভগবত ডোম অশ্র“সজল মর্তের দেবদূত। ভগবতের সামনে উপস্থাপিত সত্য তাকে বারবার ভাবনার রোদপড়া প্রহরে নিক্ষিপ্ত করে চলেছে। এই লাশগুলো আজ তাদের মৃত্যুর অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে যেনো ভগবত ডোমের কাছে।

বৃষ্টির ছাঁট বাড়ছে। আসছে বারান্দাটার অনেক ভিতর। তীরের মত ধেয়ে আসা বৃষ্টির ছাঁটে মর্গের দেয়ালে সাঁটানো ধানের শীষ, নৌকা আর দাড়িপাল্লার পোস্টারগুলোও ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছে। কালো রঙের কাঁচা কালিতে মোটা হরফে লেখা ¯স্লোগানগুলোও ধুয়ে যাচ্ছে। কালি গড়িয়ে লাল রঙের মর্গটার দেয়াল এখন কালচে।

ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে ভগবতের। বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। মর্গের ভিতর লাশ ফেলে বাড়ি গিয়ে ঘুমানো ঠিক হবে না। আবার বারান্দায় বসে ভিজা কাক হয়ে থাকলেও গায়ে জ্বর এসে যেতে পারে। সময় যতই গড়াচ্ছে, বৃষ্টি যেনো ততই বাড়ছে।

হারিকেনটা হাতে নিয়ে মর্গের তালাটা খুলে ভগবত ভিতরে প্রবেশ করে। মেঝের ওপর চাটাইয়ে মোড়ানো লাশটা পড়ে আছে। বৃষ্টির শব্দ ছিঁড়ে ভগবতের কানে বয়ষ্ক লোকটার কণ্ঠ বাজতে শুরু করে হঠাৎ, ডোম ভাই, একটু খেয়াল রাখবেন। আমার নাতনিটা বড় আদরের।

ভগবত ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। ঘরের ভিতর মৃদু আলোয় তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার লাশের মুখটা দেখে। চকিতে তার কানে পুলিশ দুটোর কথা বেজে উঠলো, মেয়েটা যাত্রা করতো। নাচতো। ভগবত ভাবতে থাকে, কোন যাত্রা দল? সে নিজে কি ঐ যাত্রা দলের কোনো পালা দেখেছে? এমন নয় তো যে, সে নিজেও এই মেয়েটার নাচ দেখেছে?

গত শীতের আগের শীতে ও সেতাবগঞ্জ মেলায় যাত্রা দেখতে গিয়েছিলো। যাত্রাপালা, ‘এক পয়সার আলতা’। পালার ফাঁকে ফাঁকে লাস্যময়ী রমণীদের উদ্দাম নৃত্য। এক সময় ঘোষণা হলো, এবার নৃত্য পরিবেশন করবে ডানা কাটা পরী প্রিন্সেস চাঁদনি।

সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে প্রিন্সেস চাঁদনি মঞ্চ উজ্জ্বল করে তুললো। বাদ্য বাজনা আর দর্শকের চারদিক থেকে চিৎকার। মুখে দু আঙ্গুল পুরে শীষ। দ্রুত বাজনার তালে তালে ফর্সা নিটোল উরু দুটোর কম্পন তার মাঝে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। মেয়েটা যখন তার শরীরে নানান ভঙ্গিতে কাঁপন তুলছিলো, তখন ভগবতের মনে হয়েছিলো যে সে আর ময়নার সাথে বাস করতে পারবে না।

ভগবতের শরীরে কেমন একটা ঠান্ডা শিহরণ অনুভব হয়। এই লাশটা প্রিন্সেস চাঁদনি না তো? তার অন্তর ডুকরে ওঠে। না, না, এ হতেই পারে না। চাঁদনি মারা যাবে কেনো? আবার প্রশ্নটা তার ঝিমধরা মাথায় অস্বাভাবিক শরীর পেতে থাকে। কী করবে ভগবত এখন? লাশটা দেখবে? ইচ্ছাটাকে দমাতে পারে না। মর্গের কোন থেকে ভগবত হারিকেনটা নিয়ে ভেজা চাটাইয়ের স্তুপের দিকে এগিয়ে যায়। বসে পড়ে মেঝের ওপর। এক ঢোক চোলাই গিলে নেয়। এবার বড় ছোরাটা দিয়ে ঘচঘচ করে দড়ির বাঁধনগুলো কেটে দিতে থাকে। বাঁধন আলগা হতেই চাটাইয়ের দুপ্রান্ত ¯স্প্রিংয়ের মতো মেলে গিয়ে লাশটাকে উন্মোচিত করে দেয়।

কমলা রঙের শাড়ি পরা এক অপূর্ব মেয়ে। নিশ্চুপ নিপাট ঘুমিয়ে। ভগবত উবু হয়ে লাশটার মুখের ওপর। নিজের চোখদুটো মেলে ধরে আপ্রাণ। তার মনে হয় এ মেয়ে তার চেনা। কাজল দেয়া টানা ভ্রু। চোখ দুটো হালকা খোলা। পাপড়িগুলো চোখের কোলে শুয়ে আছে। মুখের ওপর আবিরের আলতো প্রলেপ।

ভগবত আরও নিবিড় কোরে দেখতে থাকে। গলায়, গালে অসংখ্য পিপড়া। পিপড়াগুলোকে দেখে ভগবতের বুকটা টনটন কোরে ওঠে। ভগবত এক ঢোক চোলাই আবার পেটের ভিতর চালান কোরে দেয়। তারপর ঘন কালিপরা হারিকেনেটা আরও উস্কে দিয়ে মরাজোছনার মতো আলোটা এগিয়ে নেয় মেয়েটার মুখের অনেক কাছে।

মনের ভিতরের ভাবনাটা বিশ্বাসে রূপ নিতে থাকে। এ তো প্রিন্সেস চাঁদনি। নিশ্চই সে। বিশ্বাসটা সত্যের মতো আরোপিত হতেই যন্ত্রণায় ভগবত মেঝের ওপর ধপাস কোরে বসে পড়ে। নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাথরের তৈরি হৃৎপিন্ডটা ভাঙতে থাকে। প্রবল কান্না ধেয়ে আসে ভগবতের গলার কাছে। প্রিন্সেস চাঁদনিকে কে হত্যা করলো? কোনো দিন না কাঁদা ভগবত ডোম হঠাৎ প্রবলভাবে বিলাপ কোরে ওঠে, ভগমান, হামার চাঁদনিক কে মারলো? ই ভগমান, তু কিমুন রে, তু র দিল কি পাথ্থর রে ভগমান?

কান্না সম্বরণ শেষে ভগবত আবার এগিয়ে যায় লাশটার দিকে। প্রিন্সেস চাঁদনিই তো। যে নারীকে সে কল্পনা করেছিলো উতপ্ত কামনায়, সেই নারী আজ তার সামনে নি®প্রাণ শয্যায়। প্রিয় সেই নারীর খুলি কেটে, বুক থেকে নাভিমূল পর্যন্ত ফেড়ে তার মৃত্যুর সত্য উদ্ঘাটনে ভগবতকে আজ হাতুড়ি ছেনি হাতে নিতে হবে! ভগবত আবার ভেঙে পড়ে।

চোখ মুছে ভগবত পরম মমতায় প্রিন্সেস চাঁদনির মুখের ওপর থেকে লাল পিঁপড়াগুলো সরিয়ে দেয়। কিন্তু যেই পিঁপড়া সরায়, পরক্ষণেই আবার জায়গাটা অন্য পিঁপড়ারা দখল কোরে নেয়। ভগবত আবারো পিঁপড়াগুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে। হাতের তালুর ঘর্ষণে চাঁদনির হিম ঠোঁটদুটো যেনো মেলে ওঠে। মনে হয় প্রিন্সেস চাঁদনি হাসছে। ভগবতকে দেখে মিষ্টি কোরে হাসছে, আর বলছে, ই ভগবত, তু হামাক শাদী করলি লাই কেনে?

ভগবত পিঁপড়াগুলোর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে লুঙ্গিটা খুলে পিঁপড়াগুলোর ওপর ঝাপটা মারে। ঝাপটায় হাজার হাজার পিঁপড়া চাটাই ভেদ কোরে লাশটার সারা শরীর ছেয়ে ফেলতে থাকে। ভগবত পাগলের মতো লাশটার শরীরে ঝাপটা মারতে থাকে। এতেও কাজ না হতে দেখে লাশটাকে চাটাই থেকে তুলে মেঝেতে নামায়। ওকে পিঁপড়া কামড়ে দিতে থাকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না কোরে লাশটার পরণের শাড়িটা টেনে খুলে ফেলে। শাড়িটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বাইরে। চাঁদনীর শরীর থেকে পিঁপড়াগুলো তাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে ভগবত।

লাশটার কালো ব্রা’র নিচ থেকে পিলপিল কোরে লাল পিঁপড়াগুলো বেরিয়ে আসছে। ভগবত ব্রা’র মাঝখানটা ছুরি দিয়ে একটানে কেটে ফেলে। চাঁদনির বুকের ওপর থেকে হাত দিয়ে ঝাপটা মেরে পিঁপড়াগুলো সরিয়ে দিতে শুরু করে। কিন্ত পিঁপড়াগুলো যেনো পরাজয় মানবে না। অগুনতি পিঁপড়ার আক্রমণে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ভগবত ব্রা আর পেটিকোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে জানালা দিয়ে বাইরে। পিঁপড়ার সাথে যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ভগবতের সামনে প্রিন্সেস চাঁদনি শ্বেতপাথরের এক বিবসনা নারীর মতো প্রকাশিত।

ভগবত সারাটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া পিঁপড়াগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। লুঙ্গি দিয়ে সারাটা মেঝতে ঝাপটা মারতে থাকে। পিঁপড়ার কামড়ে অস্থির হয়ে চিৎকার করতে থাকে, ই সতান পিঁপিলিকা হামার চাঁদনিক শেষ করে দিলো। তুদের হামি শেষ করে ফালাবো।

তারপর অকস্মাৎ উবু হয়ে লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অবোধভাবে বলে উঠলো, তোকে হামি বড় পেয়ার করি রে। তোকে হামি ফাড়তে পারবোক লাই। তোকে হামি বড় পেয়ার করি রে।

মর্গের মেঝেতে অশ্রুসিক্ত অবুঝ ভগবত ভেজা লাশটার বুকের ওপর বারবার মুখ ঘষে গোঙাতে লাগলো, চাঁদনি, হামি তুকে বহুত পেয়ার করি রে। হামি তুকে পেয়ার করি রে। হামি তুকে ফাড়তে পারবোক লাই। হামি পারবোক লাই।

হু হু কোরে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ দিগম্বর ভগবত মর্গ থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসে। জ্ঞানশূন্যের মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে জবা ফুলের গাছটা খুঁজতে থাকে। বৃষ্টির অঝোর ধারা ভগবতের ওপর পড়ছে। ও গাঢ় আঁধারে হাতড়ে জবাফুলের গাছ থেকে ফুল আর পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর মর্গের ভিতর ঢুকে পিঁপড়ায় প্রায় ঢেকে যাওয়া লাশটার পায়ের কাছে ভগবত জবাফুল আর পাতা পরম আদরে রেখে দেয়।

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

নীল মর্গের কোরাস

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

image

যেখানে মানুষ মৃত্যুর সীমান্ত চেকপোস্ট পেরিয়ে যায় অনাহূতভাবে, সেখানে ভগবত ডোম একজন কারিগর সেই মৃত্যুর প্রকৃতি নির্মাণে। মানুষের শবদেহ যখন রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তখন ভগবত ডোম তাদের ছাড়পত্র তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। এই ব্রহ্মান্ডে আর দশটা সাধারণ মানুষের অধিকার যেখানে শেষ হয়ে যায় প্রিয় মানুষটির কাছে যাবার, সেইখানে ভগবত ডোমের অধিকারের শুরু।

সেই ভগবত ডোম এই রাতে চোলাই মদে আকণ্ঠ ডুবে মর্গের বারান্দায় ঝিমুচ্ছে। সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে সে তার আধ নেংটো কালো কালো হাত-পা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভরা শ্রাবণের অঝোর ধারায় চারদিকে ঘন পর্দা। লাল ইটের মর্গের চিকন বারান্দা পেরিয়ে বৃষ্টি ভেদ করে হাতত্রিশেক দূরে তার টিনের চালাঘরটাও নজরে আসছে না।

ময়না ওর সাথেই ছিলো। কিছু আগে দু গ্লাস চোলাই গিলে চলে গেছে। ঘরে এখন ভগবতের বউ আর তিন মেয়ে নিয়ে ঘুমে নিপাট । যাবার আগে ময়না ওর মরদটাকে বেশ টেনেছে। ভগবতের হাতটা ওর বুকের ওপর রেখে নিজেই চাপ দিয়েছে। একবার মর্গের বারান্দায় টান মেরে শুইয়েও ফেললো। কিন্তু ভগবতের দেহে সারা জাগেনি। ময়না রাগ করে নেশায় ঢুলে ফোঁস ফোঁস করে উঠেছে, ই হারামি মরা। সালার কুত্তা মরদ। উটা কুন সালিকে গিলাইলি রে, হারামি?

এর কোনো উত্তর নাই।

ভগবত ডোম মর্গের বারান্দায় নির্ঘুম বসে। ঘরের ভিতর লাশ। আকাশ ভেঙ্গে নামা বৃষ্টির ভিতর কিছু আগে ঠেলা গাড়িতে লাশটা এসেছে। লাশটা রেখেই ভয়ার্ত লোকগুলো তড়িঘড়ি চলে গেছে।

মর্গের চৌহদ্দিতে কে-ই-বা বেশি সময় থাকতে চায়! মনে হয় চারদিকে ভূতপ্রেত গিজ গিজ করেছে। এখানে যে সকল মানুষের মৃতদেহ আসে, তাদের সবাই বেঁচে থাকার শেষ অদম্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে মৃত্যুকে অকস্মাৎ আলিঙ্গন করে। জীবনকে উপভোগের, আস্বাদের অভিলাষ তীব্রভাবে ব্রেক কষা গাড়ির মতো থেমে গেছে। তারপর সেই জীবনহীন দেহ প্রবেশ করেছে এক রূপান্তরিত লোকে।

যখন তাদের জীবনের আলো ফুরিয়ে যায়, তখন মনে হয়, এ পৃথিবীতে তারা আবার অন্য শরীরে ফিরে আসবে। হয়তো প্রতিশোধ নেবে তাদের মৃত্যু ত্বরান্বিতকারীদের ওপর। ফলে জীবনের মোহের প্রতি তৃষ্ণার্ত আত্মারা তাই মর্গের আশপাশে ঘুরেফিরে বেড়ায় বলেই মনে হয় সবার কাছে।

শ্রাবণের অঝোর ধারার মাঝে ঠেলাগাড়িতে লাশটা এনেই খোঁচা খোঁচা আধাপাকা দাড়ির বয়ষ্ক লোকটা ভগবতকে জিজ্ঞেস করেছে, ডোম দাদা, লাশটা কোথায় রাখবো? বাইরে তো খুব বৃষ্টি। আমার নাতনিটাকে ঘরের ভিতর রাখলে হয় না?

ভগবত মর্গের কোণটা দেখিয়ে দিলো। আরে ভিতরিই তো রাখবি। উই দিকের কুনায় রাখ।

এই রাতেরবেলা লাশ দেখে ও অবাক। সাধারণত রাতের বেলা থানা থেকে লাশ আসে না। ও নিশ্চিত এ লাশে কোনো গড়বড় আছে। তাই ঝামেলা চুকাতে রাতেই মর্গে পাঠিয়েছে।

বৃষ্টিতে ভেজা চাটাইয়ে মোড়ানো লাশটা তুলে লোকগুলো কালিপরা চিমনির হারিকেনের আলোয় পথ করে মর্গের ভিতর ঢোকে। বৃদ্ধ লোকটা ভগবতের কাছে গিয়ে করুণ আর্তি নিয়ে অনুরোধ করে, ডোম ভাই, একটু খেয়াল রাখবেন। আমার নাতনিটা বড় আদরের। একথা বলে চোখ মুছে ভগবতের হাতে গুঁজে দেয় ময়লাটে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট।

সবার মাঝে চলে যাবার তাড়া। পা বাড়িয়েই বয়ষ্ক লোকটা আবার ফিরে আসে, ডোম ভাই, ওর যেনো কষ্ট না হয়। সেলাইগুলো একটু যত্ন করে দিস রে ভাই।

আর কিছু বলতে পারেনি। হাউমাউ করে ডুকরে উঠেছে মানুষটা।

নেতিয়ে থাকা নোটটা হাতে কচলাতে কচলাতে ভগবত ডোম সাড়া দেয়, ই মানুন, কাঁদিস ক্যনে রে। হামি কি ভগমান? হামি কষ্ট দিবার কে লো? সুন, কানদিস লা রে। হামি তোর লাসটাক কষ্ট দিবো লা। হামি কারুকেই কষ্ট দি লা। যা, যা বাড়িত যা এখুন।

ভগবত আবার চোলাইর নেশায় ঝিমুতে থাকে। নেশার মাঝে সদ্য আসা লাশটা নিয়ে তার স্বভাবে কোনো ভাবান্তর নাই। কী আর এমন বিশেষত্ব আছে অপঘাতে তৈরি এই লাশের ভিতর? হয় সে বিষ খেয়ে মরেছে, হয় ফাঁস দিয়ে মরেছে; না হয় কেউ গুলি করে মেরেছে বা দায়ের কোপে ফালা ফালা করেছে- একটা কিছু হবে।

থানা থেকে লাশের সাথে আসা পুলিশ দুজন এরই মাঝে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছে। ফলে তারা লাশটার ওপর মহা খাপ্পা। নিজেদের ভিতর নিচু স্বরে বলাবলি করছে।

শালার মাগিটা মরার সময় পাইলো না। মরলি মরলি এই বৃষ্টির মইধ্যেই মরলি।

ফজুবাবু, একটা কতা বলি। এই মেয়েটা তো যাত্রা করতো, নাচতো। আমাদের বড় বাবুরও খুব পেয়ারে ছিলো। অথচ আজ এই রাইতেই বড়বাবু মর্গে পাঠালো। কী কপাল রে মাগির। মইরলো, আর সোহাগও শ্যাষ।

এই জিন্নাত মিয়া, তোমার এই কথা এইখানে ক্যান। মাগিটার দাদাটা শুনবে। আর শোন, মর্গে কেউ এমুন কথা বলে? চুপ থাক। কী থেকে কী হয়! এমনিই আমার জান খারাপ হয়ে যায় মর্গে আইসলে। দোয়া পড়তে থাক।

আরে ভয় করলি ভয়। কখনো শুনিছো যে পুলিশকে ভূতে ধরেছে। আচ্ছা শোনো, ওই ভগবতকে বলি আমরা এখন যাই। লাশটা তো ঘরে থাকলো। ভগবত তালা দিয়ে দিক, ল্যাঠা চুকে যাক এই রাতে।

এই ভগবত, ঘরের ভিতর লাশ রাইখে তালা দিয়ে দে। কাল ডাক্তার সাহেব আসার পর খুলিস। বুঝলি? ঝামেলা যেনো না হয় ।

লা, বাবু। ঝামেলা আবার হোবে ক্যানে, হামি ভগবত কি লাসটা খাইবো?

হুহ। যা তো। জঘন্য কতা বলিস না। তুই তো ভূতের মতো কতা বলিস রে, এইটা কোনো কতা হলো! ইস রে বমি আসে।

খৈনিতে দাগ পরা দাঁত মেলে ভগবত একটা নীরব হাসি দেয়। ভগবত ডোম আবার এক গ্লাস চোলাই হাতে নেয়। মুখের ভিতর চোলাইর আগুন ঢুকে পড়ে, বুকের অলিগলি দিয়ে তস্য গলি পেরিয়ে পাতালের অনন্ত গহ্বরে নামতে থাকে। ঝিম ধরে আসা মাথাটাতে প্রতিদিনের মতো আজও ফিল্মি খেলা। প্রতিরাতেই এ ঘটনাটা ঘটে ভগবতের। ফ্ল্যাশ ব্যাক। ছোটোবেলায় বাবার পাশে বসে লাশ কাটা দেখাটা মাথার ভিতর পাক খেতে থাকে।

তখন মর্গটা ছিলো সারা বছর নোংরা পানিভর্তি ঘাগরা ক্যানেলের উত্তর দিকে। পশুহাসপাতালের পাশে। একটা লাল রঙের উঁচু বারান্দার ওয়ালা ঘর। বড় বড় সবুজ রঙের জানালা। সামনেটা ছাড়া চারদিকে ঝোপঝাড়ে ভরা। বিশেষত ফণিমনসার গাছ ছিল প্রচুর। পশুহাসপাতালে লোকজন যারা আসতো, তারা আর মর্গের দিকে পা বাড়াতো না। এমনকি পারলে ওদিকে চোখও বুলাতো না। লাশের গন্ধে ঘাগরা ক্যানেলের চোরা গর্ত থেকে প্রায়ই শিয়াল এসে মর্গের চারিদিকে ঘুরঘুর করতো। তারই কোনো একটা দুঃসাহসী হয়ে পশুহাসপাতালের দিকে গেলে ভয়ে লোকজন আর্তনাত করে উঠতো।

ও যখন ওর বাবার পেটের চেয়ে একটু লম্বা হয়েছে, তখুনি একদিন তার বাবা লাশ কাটায় হাতেখড়ি দিলো। পাকিস্তান আমল। খুনখারাবি, গাড়ি দুর্ঘটনা কম বলে লাশও আসতো কম। এরই মাঝে একদিন ভগবত ওর বাবা বিধু ডোমের পাশে বসে লাশ কাটা দেখছে। লাশের ডান হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে শক্ত হয়ে যাওয়ায়, বিধু ডোম কিছুতেই বুকে ছেনিটা বসাতে পারছে না।

ভগবত, ই হাতটা ধোরতো বেটা।

ভগবত পাশেই বসা ছিলো। সে তার ছোটো হাত দিয়ে প্রাণপনে দশাসই আকারের লাশের ডান হাতটা টেনে ধরলো।

ই থাম থাম। পোরে ধর হাতটা। এই বলে বিধু ডোম প্রথামাফিক লাশের কাটা খুলির খোলে জমাট হয়ে থাকা কিছুটা রক্ত এক খাবলায় নিয়ে ঘটির পানিতে ফেললো। তারপর ভালো করে গুলিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আউড়ে ভগবতের মাথার ওপর হড়হড় করে ঢেলে দিলো। বারান্দা থেকে দৃশ্যটা দেখে পাহারায় থাকা পুলিশটা ওয়াক ওয়াক কোরে অবিরাম বমি করতে শুরু করলো।

ই রে বাবা, তু তো নামরদ রে বাবু। তু পুলিশ হলি ক্যান রে? তু তো মাইয়া হলে ভালো কোরতি। হাহ, হাহ করে প্রচন্ডভাবে সে হেসে ওঠে বিধু ডোম। তারপর আবার বলে উঠে, ই দ্যখ, হামার বাঘের বাচ্চা। উ দিখিস, হামার মতো ডোম হোবে। সুনরে বাবু, ডোমের কইলজা ইততা বড়া।

ভগতব দৃশ্যটা দেখে আর নেশার ঘোরে বিড়বিড় করে, বাপু। হামি তুর মতই হইচি রে। হামি তুর মান রাইখচি। পরক্ষণেই মনে মনে বলে, কিন্তুক হামাক ক্যানে লাস কাটার মানুন বানাইলি রে বাপু? হামাক তু অন্য কিছু বানাইতি। হামার মাইয়া তিনটা ক্যামুন করে লাশকাটা ডোম হোবে? কেমন এক করুণ আক্ষেপ নীরবে ওর কণ্ঠের ভিতর দলা পাকিয়ে থাকে।

ভগবানের ওপর অভিমান জমে। ডোমের ঘরে পুত্র সন্তান না হলে কে লাশ কাটবে? কে ডোম হবে? ওদের পরিবারকে রক্ষা করবে কে? মেয়েদের তো লাশ কাটার কোনো নিয়ম নাই। ওর সাথে ওর বউ ময়নারও এ নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তা। ময়না অনেকবার ভগবতকে অনুরোধ করেছে, তু সিভিল ডাক্তার বাবুকে বোল যে, হামিও লাস কাটবো। তু পারিস, হামি ক্যানে পাইরবো লা।

ই দেখ মুইনা, আরে সোরকার কখুনো হামাদের কোথা শুইনবে। ইটা সোরকারি কানুন। তু আর হামি চেচাইলে কী হোবে। চেচাইলেই কী তুকে মাইয়া মানুনের লাস ফাড়তে দিবে, বোল?

ক্যানে দিবেক লা? ক্যানে দিবেক লা? হামার সক্তি লাই! ঠিক আছে, সোব লাস লাই কাটবো, ঠিক আসে, সোরকারকে বোল, তুরা মরদের লাস ফারবি। আর হামারা মেয়েদের। সমান বাত।

ই বউ দেখ, তুর কোথা ইমুন কোথা যেন হামি লিজেই ইটা কানুন বানাতি পারি।

তারপর পুরো অনুরোধ আর আলোচনাটা মোড় নেয় অভিযোগ আর গালিগালাজে। ময়না ক্রোধে ভগবতকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তু তো আসলে হারামি থাকলি রে, বুঝলি লা? তু চাইলি লা ইটা। ই সুন, ভগমানের কিরা কাট, তু কি কাপড়া ফাড়ে মাইয়া লাসগুলাক দিখিস লূা? বোল? উদের সবতাতে হাত দিস। দিস লা? তুই সালা লাস চোদা কুত্তা, সুওর।

গালিগালাজ শুনে মেজাজ চড়ে যায় ভগবত ডোমের। ক্ষিপ্ত মাথায় এক লাথি কষে দেয় ময়নাকে। ময়না ছিটকে মর্গের সামনের মাটিতে পড়ে যায়। তাদের মেয়েরা দৌড়ে আসে। কিন্তু মা কে মাটি থেকে তুলে উঠায় না। ভেউ ভেউ করে ময়না কাঁদতে থাকে। এবং আরও অবিশ্রান্ত খিস্তি খেউরের ভিন্ন পর্ব শুরু করে।

তিন মাসে, ছ মাসে ময়না যখন এমন অবতারে পরিণত হয়, তখন ভগবত কখনোই বউয়ের অভিযোগ স্বীকার করে না। এসব অভিযোগের পাল্টা কথায় প্রবল প্রতিরোধও গড়ে ওঠে না তার মুখে। কেবল না পেরে এক লাথি কষিয়ে দেয় ময়নাকে শেষমেশ।

এই চল্লিশ বছরে কত যে লাশ কেটেছে ভগবত তার হিসেব নাই। নানান বয়সী লাশ। কেউ নারী, কেউ পুরুষ। কারো দেহ এমন যে দেখলে মনে হবে কোনো আঁচড় পর্যন্ত নাই। আবার কোনো কোনো লাশ একেবারেই ক্ষতবিক্ষত। কোন কোনো লাশের চেহারা মনে ছাপ ফেলে যায় দীর্ঘ দিনের জন্যে। কোন লাশ শুধু ওই একটা দিন তাকে সারাক্ষণ দোলা দেয়। বিমর্ষ করে রাখে।

সারা দিনের আফসোস ভুলতে সন্ধ্যা হলেই ভগবত চোলাই নিয়ে বসে। সাথে যোগ দেয় বউ আর মেয়ে। আবার এমনও হয়, চোলাই খেয়েও ভুলতে পারে না কোনো লাশের চেহারা। কারো মুখ ওর মনের ভিতরের খোলটাতে তোলপাড় করতে থাকে।

এক অবোধ কান্না চারাগাছের মতো গজায় ওর বুকের মাঠটাতে। কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে ওঠে, ভগমান, তুর আদমকে তু লিয়ে যা। কিন্তুক হামাক কেনে কষ্ট দিস বোল তো? হামার বাপোক তু ডোম বানাইলি। হামাক বানাইলি। হামাক তু অন্য কিছু বানাইলে তুর কী হইতো?

নতুন মর্গের বিল্ডিং-এ আসার আগে ভগবত প্রায়ই পুরোনো মর্গের ভিতরেই ঘুমাতো। কত দিন গেছে ভগবত আর ময়না পুরোন মর্গের মেঝেতে শরীরে শরীরে হুঁটোপুটি করেছে। যে মর্গের মেঝেতে মানুষের মাথার খুলি, বুক, পেট চিরে ভগবত ডোম মগজ, হৃৎপিন্ড, কলিজা, নাড়িভুঁড়ির অংশ কেটে বের করে রাখে, সেই মেঝেতেই ভগবত ডোম তার স্ত্রীর সাথে গাঢ় আবেগের আলিঙ্গনে দু দেহের সীমান্ত বিলীন করে দিতো।

ই তু ইকেবারে সুওরের মতো মরদ। ই ইখুন দিন বেলা মরদাঙ্গি মারলি রে। মানুন দেখলে কি বাত বোলবে, বোল?

তু মুইনা হামার দিলটাতে ছাপ্পা মারলি ক্যান তো, বোল?

হামি তুকে ইমুন কোরলাম, আর তু কোরলি লা?

ই মুইনা, সুন, লে আবার খেলা মারি রে। ইটা বোড়ো ভালো ঘর রে, ইখানে মানুন তো মানুন, সালার ভূত ভি আসে লা।

তারপর ময়না অস্ফুটে উচ্চারণ করে, তু হামাকে ফিলিম দিখাতি লি চোল রাইতে।

ভগবত আর ময়না আবার পরস্পরের ভিতর প্রবেশ করার জন্যে উন্মাতাল হতে থাকে। একদিন মর্গের সেই মেঝেতেই ময়নার ভিতরে ওদের প্রেমের প্রথম ফুল ফুটেছে!

ভগবতের কখনোই গাঢ় ঘুম হয় না। ঘুমের ভিতর চলে মৃত মানুষের মিছিল। ওরা আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। ওকে ঘিরে লাশগুলো গান গায়। নাচে। ওর হাত ধরে কত বিচিত্র স্থানে ভ্রমণে নিয়ে যায়। ভগবতের প্রতি কোনো লাশের কোনো অভিযোগ নাই। ভগবত তো ওদের যতœ করে। ভালোবাসে। মৃত্যুর পর এই হতভাগ্যরা ভগবতের পরম মমতা লাভ করে। ভগবত প্রতিটা লাশ কাটা শুরু করার আগে মন্ত্র পড়ে। মর্গের ধারে জবাফুলের গাছ থেকে একটা ফুল এনে লাশটার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে। তু তো মানুন রে। কিন্তুক হামি তো ডোম। তু কে হাত দিছি বুলে তু হামাক অভিসাপ দিসলা। ভগমান তু কে জিগাইলে, তু কিন্তুক ইটা বুলিস তাকে, হামি তুকে কোষ্ট দিই লাই।

এই বলে ভগবত আবার লাশটাকে প্রণাম করে এবং ঘরের কোণে তাক থেকে হাতুরি, ছেনি আর করাত টেনে নামায়।

যখন দিনের আলো ফুটে, তখন ওর মনে হয় পরিচিত লাশগুলো ওর চারপাশে ঘিরে থাকে। ওরা খিলখিল করে হাসে। লাশ কাটার কাজে উৎসাহ দেয়। কেউ আবার সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়িয়ে ধরে। কখনো কাজের মাঝেই চোলাই খেতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। বিশেষত যদি কোনো দিন একসাথে বেশি লাশ কাটার কাজ আসে।

ডাঙদার বাবু, তু ইকটু বাহার যা, হামি ইকঠু দারু পিলি।

এই ভগবত, কাজের সময় দারু খাস না। আগে কাটাকুটি শেষ কর। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ই বাবু, তু হামাক কী বুলছিস রে। তু দেখ, হামি তুরণত সবকটা লাস ফাড়বো। হামাক ইকটু পিতে দে লা বাবু। হামি কি আর মানুন রে বাবু! হামি তো যম আছি। ভগমান হামাক রাসখোস বানাইছে।

কী রে ভগতব, মন খারাপ? দরদে ভরে ওঠে ডাক্তার সালেহিনের কণ্ঠ। তোর তো এই সমস্যা আগে ছিলো না। তুই সাহস হারালে আমার কী হবে বল? আজ একটু বেশি লাশ রে, সেই জন্যে কাজটা দ্রুত করতে হবে।

ই বাবু, তু হামাদের দারু মারু পি লিবি ইকঠু?

ডাক্তার হেসে ফেলে। না রে ভগবত, তুই খা। আমি বাইরে গিয়ে বসি।

ডাঙদার বাবু, ইতু গুলা লাস কুথা থেকে আসলো রে। ইতু মরা! কোন গাড়িটা ট্রেনটাক মারছে রে বাবু?

লাশ কাটা জীবনে কতো ডাক্তারও দেখেছে সে। পোস্টমর্টেমের সময় এরা একেকজন একেক রকম আচরণ করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মন খারাপ করে থাকে। খুব গম্ভীর হয়। আবার এমন না যে, দু একটা ফিচেল ডাক্তার একাজে আসে না।

পঁচিশ বছর আগের ঘটনা তো হবেই। ভগবত তখন টগবগে যুবক। মর্গে এলো এক সুন্দরী তরুণীর লাশ। ডাক্তার লাশটা দেখে বলে উঠলো, উপস! কী সেক্সি রে বাবা। কী দরকার ছিল মরার?

ভগবত ইংরেজি বোঝে না। কিন্তু ডাক্তারের হাবভাবে বুঝতে পারে সবটা। ডাক্তারের চোখদুটো খুব চঞ্চলভাবে লাশটার সারাটা শরীর ঘুরছে। ডাক্তার হিম লাশের মুখটা নেড়ে পরীক্ষা করার ছলে জোছনার মতো ধবল নগ্ন বুকের উপর হাতটা রাখলো। মুখের ওপর দারুণ কিছু খুঁজে পাবার আভা।

ভগবত, লাশটা ভালো কোরে কাটতে হবে রে। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে যে, এটা রেইপড এন্ড হোমিসাইড কেইস। তারপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, এই শোন, লাশের কাপড় ভালো করে না সরালে তো পোস্টমর্টেম ডিফেকটিভ হবে। আমার মনে হয় বডিটার ডাউন পার্টেও আঘাতের চিহ্ন আছে।

ডাঙদার বাবু, হামি কি আগে খুলিটা ফাটাইবো?

না, না। ওটা পরে। বডিতে এখনি ব্লাড লাগানোর দরকার নাই। এক কাজ কর, বডিটা আগে পুরোটা আনটাই কর। মানে পায়জামাটাও খুলে ফেল। পুরো বডিটা আগে চেক করে নেই। পরে ব্রেইন ভিসেরা কালেক্ট করবো।

ভগবত পায়জামার ফিতা ধরে টান মারে। কোমরের জায়গাটা ঢিলা করে নেয় একটানে। সাথে সাথে ডাক্তার আঁতকে ওঠে। না, না ভগবত, ওভাবে না। ওভাবে কাপড় খুললে বডিটা আঘাত পাবে। চিহ্ন নষ্ট হবে।

মেঝেয় হামা দিয়ে বসে পড়ে ডাক্তার। হিম লাশটার পুরুষ্ট পাছার নিচে হাত রাখে। বাবাহ, অনেক ভারি। ভগবত, তুই পায়ের দিকে যা। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। ডাক্তার ক্রমান্বয়ে মেয়েটার নাভীর জায়গা থেকে আস্তে করে আকাশী রঙের পায়জামাটা নিচে সরিয়ে দিতে থাকে।

উন্মোচিত হতে থাকে অপরূপা। কী আশ্চর্য! লাশের অপরূপ রূপ থাকে এই প্রথম ভগবত ডোমডাক্তারের সাথে উপলব্ধি করলো। ভগবতের চোখটা মেয়েটা নাভীর ওপর দিয়ে পিছলে নিচে চলে গেলো। কলাগাছের উরুর মতো সুঠাম জানুটাটে চাঁদ আকৃতির গাঢ় লাল রঙের জরুল!

কত স্মৃতি ভাসে ভগবত ডোমের মনের কোণে। একবার হাত ফাঁকা ভগবতের। ছোটো মেয়েটার গায়ে জ্বর। গত সাত দিনেও একটা লাশ মর্গে আসে নাই। ভগবতের মাথা খারাপ হবার যোগাড়। ময়নার মনও খারাপ। লাশ এলেই কিছু বকসিস পাওয়া যায়। কিন্তু লাশ কই?

ময়না সারাক্ষণ বাচ্চাটার জন্যে দুশ্চিন্তা করছে। ও মনে মনে মা কালীর প্রার্থনা করে, হে মাই, কুথাউ ইকটা মারডার হয় লাই। কুথাউ কি ই কটা লাস লাই?

ওদের যখন এমন প্রার্থনা, তখন স্বয়ং ঈশ্বর যেনো ওদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা লাশ মর্গে এলো। লাশ আসার খবরে বড় ময়েটা ছুটে মাকে খবর দিতে গেলো, মাই, বোডি আসচে। মারডারের বোডি। দিখবি আয়।

এদের জীবনে একটা নতুন লাশ মানে কিছু বকসিস। বাড়তি টাকা। এই খেলায় একজনের মৃত্যু অন্য জীবন প্রদীপে জ্বালানি ভরে দেয়। দিন সাতেক পর লাশের আগমন ময়নার ভিতর আনন্দ বইয়ে দেয়। ও ছুটে এলো লাশটা দেখতে। নয় বছরের বড় মেয়টাও এসেছে। সুন আধুরি, বাবাক বোল আইজ বকসিস বেশি লিতে। ই লাশটা বেশ পয়সা উয়ালা। উ দেখ, উর সাথে মানুনেন সব কাপড়া উপরা উনেক ভালা। তোর বাবাক বোল ইটা, বুঝলি?

আধুরি মাথা নাড়ে। ছুটে যায় ভগবতের কাছে। বাবার চোখের দিকে তাকায়। ভগবত যেনো বুঝতে পারে তার মেয়ের মন। ই তু, ইখানে ক্যান? যা ইখান থিকে। এই বলে আবার মত বদলায়, ই লা, লা, শুন, তু আইজ লাস ফাড়ার সময় হামার সাথে থাকবি। দুনিয়া বদলাইছে। মাইয়া মানুন ইখন ঘোরোত থাকলে কাম হবেক লাই। আয়, আয়।

আধুরি লাশটা দেখে আর অবাক হয়। এতো সুন্দর মানুষ! সারাটা শরীর নীল হয়ে গিয়েও যেনো কাঁচা সোনা। লাশটার মা ও কী অপূর্ব সুন্দরী। তসবি হাতে শোকে পাথরের মূর্তির মতো জমাট হয়ে আছে। কোনো স্পন্দন নাই। দাঁড়িয়ে থাকা একটা মৃত প্রাণী।

এই নীরবতার মাঝেই ভগবত আবার বলে ওঠে, বাবু, আইজ হামার বেটিও কাম করবে। উকেও বকসিস দিস কিন্তুক তুরা। দেখ তুরা বড় মানুন। হামাক না দিবি তো হামরা খাবো কী, বোল? তারপর মরামাছের ঘোলাটে চোখের ওপর উচ্ছ্বাস টেনে বলে ওঠে, আধুরি কিন্তুক আইজ পরথম লাস ফাড়বে। বুঝলি?

আঁতকে ওঠে লাশের সাথে আসা একজন। না, না, ওকে দিয়ে ক্যান? ও মেয়ে মানুষ। আল্লাহরওয়াস্তে বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে তোমরা এ কাজ করাবে না। ও উল্টাপাল্টা করে কাটবে।

ই কি বুলিস তু বাবু, সুন বাবু, হামার কাজ হামরা করি, তু দেখ কিছু হবেক লাই। সান্ত¡নাটা আউড়েই ভগবত ডোম তার মেয়েকে নিয়ে মর্গের ভিতর প্রবেশ করে। আজ তাকে সনাতন আচারের মাধ্যমে নিজের মেয়ের ডোম হবার অভিষেক ঘটাতে হবে; তার বাবা বিধু ডোম একদিন যেভাবে তাকে আচার আয়োজনের মাধ্যমে লাশ কাটা ডোমের অভিষেক ঘটিয়েছিলো, তেমনিভাবে।

পোস্টমর্টেম শেষ। লাশটা চাটাইয়ে মুড়িয়ে বাইরে আনা হলো। ঠেলার ওপর তুলতেই মূর্তিটা আড়ষ্ট আকৃতি ভেঙে হুড়মুড় করে ছুটে গেলো লাশের দিকে। ছেলেটার সু উন্নত কপালে কাঁথার মতো সেলাইয়ের ফোড়। ওর মা বিস্ফারিত চোখে ঝুঁকে পড়লো তার সোনা মানিকের ওপর। এক দুই তিন। তিনটা মুহূর্ত। ঢলে পড়লো ছেলের লাশের ওপর। আর উঠলো না।

শ্রাবণের অবিশ্রান্ত জলের ফোঁটায় ভগবত ডোমের চোখ থেকে নেমে আসা জলের কণারা মিশে যেতে থাকলো। ভগবত আবার এক ঢোক চোলাই গলায় ঢাললো। বৃষ্টির ঝাপটায় ওর শরীর ভিজে যাচ্ছে।

আজ বৃত্তবন্দি মানুষের এই বৃত্তে ভগবত ডোম অশ্র“সজল মর্তের দেবদূত। ভগবতের সামনে উপস্থাপিত সত্য তাকে বারবার ভাবনার রোদপড়া প্রহরে নিক্ষিপ্ত করে চলেছে। এই লাশগুলো আজ তাদের মৃত্যুর অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে যেনো ভগবত ডোমের কাছে।

বৃষ্টির ছাঁট বাড়ছে। আসছে বারান্দাটার অনেক ভিতর। তীরের মত ধেয়ে আসা বৃষ্টির ছাঁটে মর্গের দেয়ালে সাঁটানো ধানের শীষ, নৌকা আর দাড়িপাল্লার পোস্টারগুলোও ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছে। কালো রঙের কাঁচা কালিতে মোটা হরফে লেখা ¯স্লোগানগুলোও ধুয়ে যাচ্ছে। কালি গড়িয়ে লাল রঙের মর্গটার দেয়াল এখন কালচে।

ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে ভগবতের। বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। মর্গের ভিতর লাশ ফেলে বাড়ি গিয়ে ঘুমানো ঠিক হবে না। আবার বারান্দায় বসে ভিজা কাক হয়ে থাকলেও গায়ে জ্বর এসে যেতে পারে। সময় যতই গড়াচ্ছে, বৃষ্টি যেনো ততই বাড়ছে।

হারিকেনটা হাতে নিয়ে মর্গের তালাটা খুলে ভগবত ভিতরে প্রবেশ করে। মেঝের ওপর চাটাইয়ে মোড়ানো লাশটা পড়ে আছে। বৃষ্টির শব্দ ছিঁড়ে ভগবতের কানে বয়ষ্ক লোকটার কণ্ঠ বাজতে শুরু করে হঠাৎ, ডোম ভাই, একটু খেয়াল রাখবেন। আমার নাতনিটা বড় আদরের।

ভগবত ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। ঘরের ভিতর মৃদু আলোয় তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার লাশের মুখটা দেখে। চকিতে তার কানে পুলিশ দুটোর কথা বেজে উঠলো, মেয়েটা যাত্রা করতো। নাচতো। ভগবত ভাবতে থাকে, কোন যাত্রা দল? সে নিজে কি ঐ যাত্রা দলের কোনো পালা দেখেছে? এমন নয় তো যে, সে নিজেও এই মেয়েটার নাচ দেখেছে?

গত শীতের আগের শীতে ও সেতাবগঞ্জ মেলায় যাত্রা দেখতে গিয়েছিলো। যাত্রাপালা, ‘এক পয়সার আলতা’। পালার ফাঁকে ফাঁকে লাস্যময়ী রমণীদের উদ্দাম নৃত্য। এক সময় ঘোষণা হলো, এবার নৃত্য পরিবেশন করবে ডানা কাটা পরী প্রিন্সেস চাঁদনি।

সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে প্রিন্সেস চাঁদনি মঞ্চ উজ্জ্বল করে তুললো। বাদ্য বাজনা আর দর্শকের চারদিক থেকে চিৎকার। মুখে দু আঙ্গুল পুরে শীষ। দ্রুত বাজনার তালে তালে ফর্সা নিটোল উরু দুটোর কম্পন তার মাঝে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। মেয়েটা যখন তার শরীরে নানান ভঙ্গিতে কাঁপন তুলছিলো, তখন ভগবতের মনে হয়েছিলো যে সে আর ময়নার সাথে বাস করতে পারবে না।

ভগবতের শরীরে কেমন একটা ঠান্ডা শিহরণ অনুভব হয়। এই লাশটা প্রিন্সেস চাঁদনি না তো? তার অন্তর ডুকরে ওঠে। না, না, এ হতেই পারে না। চাঁদনি মারা যাবে কেনো? আবার প্রশ্নটা তার ঝিমধরা মাথায় অস্বাভাবিক শরীর পেতে থাকে। কী করবে ভগবত এখন? লাশটা দেখবে? ইচ্ছাটাকে দমাতে পারে না। মর্গের কোন থেকে ভগবত হারিকেনটা নিয়ে ভেজা চাটাইয়ের স্তুপের দিকে এগিয়ে যায়। বসে পড়ে মেঝের ওপর। এক ঢোক চোলাই গিলে নেয়। এবার বড় ছোরাটা দিয়ে ঘচঘচ করে দড়ির বাঁধনগুলো কেটে দিতে থাকে। বাঁধন আলগা হতেই চাটাইয়ের দুপ্রান্ত ¯স্প্রিংয়ের মতো মেলে গিয়ে লাশটাকে উন্মোচিত করে দেয়।

কমলা রঙের শাড়ি পরা এক অপূর্ব মেয়ে। নিশ্চুপ নিপাট ঘুমিয়ে। ভগবত উবু হয়ে লাশটার মুখের ওপর। নিজের চোখদুটো মেলে ধরে আপ্রাণ। তার মনে হয় এ মেয়ে তার চেনা। কাজল দেয়া টানা ভ্রু। চোখ দুটো হালকা খোলা। পাপড়িগুলো চোখের কোলে শুয়ে আছে। মুখের ওপর আবিরের আলতো প্রলেপ।

ভগবত আরও নিবিড় কোরে দেখতে থাকে। গলায়, গালে অসংখ্য পিপড়া। পিপড়াগুলোকে দেখে ভগবতের বুকটা টনটন কোরে ওঠে। ভগবত এক ঢোক চোলাই আবার পেটের ভিতর চালান কোরে দেয়। তারপর ঘন কালিপরা হারিকেনেটা আরও উস্কে দিয়ে মরাজোছনার মতো আলোটা এগিয়ে নেয় মেয়েটার মুখের অনেক কাছে।

মনের ভিতরের ভাবনাটা বিশ্বাসে রূপ নিতে থাকে। এ তো প্রিন্সেস চাঁদনি। নিশ্চই সে। বিশ্বাসটা সত্যের মতো আরোপিত হতেই যন্ত্রণায় ভগবত মেঝের ওপর ধপাস কোরে বসে পড়ে। নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাথরের তৈরি হৃৎপিন্ডটা ভাঙতে থাকে। প্রবল কান্না ধেয়ে আসে ভগবতের গলার কাছে। প্রিন্সেস চাঁদনিকে কে হত্যা করলো? কোনো দিন না কাঁদা ভগবত ডোম হঠাৎ প্রবলভাবে বিলাপ কোরে ওঠে, ভগমান, হামার চাঁদনিক কে মারলো? ই ভগমান, তু কিমুন রে, তু র দিল কি পাথ্থর রে ভগমান?

কান্না সম্বরণ শেষে ভগবত আবার এগিয়ে যায় লাশটার দিকে। প্রিন্সেস চাঁদনিই তো। যে নারীকে সে কল্পনা করেছিলো উতপ্ত কামনায়, সেই নারী আজ তার সামনে নি®প্রাণ শয্যায়। প্রিয় সেই নারীর খুলি কেটে, বুক থেকে নাভিমূল পর্যন্ত ফেড়ে তার মৃত্যুর সত্য উদ্ঘাটনে ভগবতকে আজ হাতুড়ি ছেনি হাতে নিতে হবে! ভগবত আবার ভেঙে পড়ে।

চোখ মুছে ভগবত পরম মমতায় প্রিন্সেস চাঁদনির মুখের ওপর থেকে লাল পিঁপড়াগুলো সরিয়ে দেয়। কিন্তু যেই পিঁপড়া সরায়, পরক্ষণেই আবার জায়গাটা অন্য পিঁপড়ারা দখল কোরে নেয়। ভগবত আবারো পিঁপড়াগুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে। হাতের তালুর ঘর্ষণে চাঁদনির হিম ঠোঁটদুটো যেনো মেলে ওঠে। মনে হয় প্রিন্সেস চাঁদনি হাসছে। ভগবতকে দেখে মিষ্টি কোরে হাসছে, আর বলছে, ই ভগবত, তু হামাক শাদী করলি লাই কেনে?

ভগবত পিঁপড়াগুলোর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে লুঙ্গিটা খুলে পিঁপড়াগুলোর ওপর ঝাপটা মারে। ঝাপটায় হাজার হাজার পিঁপড়া চাটাই ভেদ কোরে লাশটার সারা শরীর ছেয়ে ফেলতে থাকে। ভগবত পাগলের মতো লাশটার শরীরে ঝাপটা মারতে থাকে। এতেও কাজ না হতে দেখে লাশটাকে চাটাই থেকে তুলে মেঝেতে নামায়। ওকে পিঁপড়া কামড়ে দিতে থাকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না কোরে লাশটার পরণের শাড়িটা টেনে খুলে ফেলে। শাড়িটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বাইরে। চাঁদনীর শরীর থেকে পিঁপড়াগুলো তাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে ভগবত।

লাশটার কালো ব্রা’র নিচ থেকে পিলপিল কোরে লাল পিঁপড়াগুলো বেরিয়ে আসছে। ভগবত ব্রা’র মাঝখানটা ছুরি দিয়ে একটানে কেটে ফেলে। চাঁদনির বুকের ওপর থেকে হাত দিয়ে ঝাপটা মেরে পিঁপড়াগুলো সরিয়ে দিতে শুরু করে। কিন্ত পিঁপড়াগুলো যেনো পরাজয় মানবে না। অগুনতি পিঁপড়ার আক্রমণে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ভগবত ব্রা আর পেটিকোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে জানালা দিয়ে বাইরে। পিঁপড়ার সাথে যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ভগবতের সামনে প্রিন্সেস চাঁদনি শ্বেতপাথরের এক বিবসনা নারীর মতো প্রকাশিত।

ভগবত সারাটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া পিঁপড়াগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। লুঙ্গি দিয়ে সারাটা মেঝতে ঝাপটা মারতে থাকে। পিঁপড়ার কামড়ে অস্থির হয়ে চিৎকার করতে থাকে, ই সতান পিঁপিলিকা হামার চাঁদনিক শেষ করে দিলো। তুদের হামি শেষ করে ফালাবো।

তারপর অকস্মাৎ উবু হয়ে লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অবোধভাবে বলে উঠলো, তোকে হামি বড় পেয়ার করি রে। তোকে হামি ফাড়তে পারবোক লাই। তোকে হামি বড় পেয়ার করি রে।

মর্গের মেঝেতে অশ্রুসিক্ত অবুঝ ভগবত ভেজা লাশটার বুকের ওপর বারবার মুখ ঘষে গোঙাতে লাগলো, চাঁদনি, হামি তুকে বহুত পেয়ার করি রে। হামি তুকে পেয়ার করি রে। হামি তুকে ফাড়তে পারবোক লাই। হামি পারবোক লাই।

হু হু কোরে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ দিগম্বর ভগবত মর্গ থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসে। জ্ঞানশূন্যের মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে জবা ফুলের গাছটা খুঁজতে থাকে। বৃষ্টির অঝোর ধারা ভগবতের ওপর পড়ছে। ও গাঢ় আঁধারে হাতড়ে জবাফুলের গাছ থেকে ফুল আর পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর মর্গের ভিতর ঢুকে পিঁপড়ায় প্রায় ঢেকে যাওয়া লাশটার পায়ের কাছে ভগবত জবাফুল আর পাতা পরম আদরে রেখে দেয়।