নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ১৩

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

কারো ভরসা করিসনে তুই (ও মন) এক আল্লাহ ভরসা কর/আল্লা যদি সহায় থাকেন (ও তোর) ভাবনা কিসের, কিসের ডর ॥

‘কারো ভরসা করিসনে তুই (ও মন) এক আল্লাহ ভরসা কর’-এটি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি হাম্দ। গানটির প্রতি চরণেই আল্লার প্রতি অনিঃশেষ ভক্তিভাব লক্ষণীয়। সর্বাবস্থায় মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ভরসা করবার আহ্বান আছে এই গানটিতে। হাম্দ শ্রেণির এই গানটির ভাষা একেবারেই সহজ-সরল। গানটির সুর ভাটিয়ালির অঙ্গের, যা মানুষের হৃদয়ের সুর, মাজাঘষা, কৃত্রিমতাবিহিীন বাণী; গ্রামবাংলার ইসলাম ধর্মবলম্বীর ভক্তদের প্রাণের কথা। যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ে হোক না কেন, তাদের মধ্যে তো কোনো সংঘাত বা বৈপরীত্য নেই। সকলেই সেই এক শক্তিমানের পূজক। ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছেন, একই বস্তুকে কেউ জল, কেউ পানি, কেউ ওয়াটার বলে মূলে কিন্তু বস্তু সেই একই। আমার গানটিতে আল্লাহর স্থানে ভগবান। নেক্নজরের স্থানে কৃপা, বাদশার সাথে মহারাজ, গোলামের স্থানে চাকর, খোদার স্থানে ঈশ্বর, রহম্-এর স্থানে কৃপা ভেবে নিলে এই গানই হিন্দু ধর্মীয় সংগীত। গানের মেজাজ একই শুধু পার্থক্য শব্দগত। তাঁর আরও অনেক বিখ্যাত হাম্দ রয়েছে-‘খোদা এই গরীবের শোন’ , ‘এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফল’, আল্লা নামের বীজ বুনেছি’ এ গানগুলোর মূল ভাব হচ্ছে আল্লাহর প্রশান্তি।

‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি’-গানটি ভাটিয়ালি সুরে রচিত। নজরুল তার সংগীতের বাণী ও সুরকে এমনভাবে সমন্বিত করেছেন মনে হয় একটি অপরটির পরিপূরক। গানটিতে তিনি পল্লি অঞ্চলের ফসল কেনাবেচা, চাষ-আবাদ, মরাই, বাঁধা এসব শব্দচয়ন করেন। এ শব্দগুলোর সাথে গ্রামবাংলার মানুষেরা পরিচিত বলেই এই সংগীতের চিত্রকল্পের সাথে একাত্ম হতে সময় লাগে না। পাশাপাশি ভাটিয়ালি সুরও গ্রামবাংলার নিজস্ব। নজরুল ইসলামি গান কেবল আল্লাহ ও নবীর মজিমাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। এখানেই তাঁর সংগীতের বৈচিত্র্য। যেমন-নবীর আবির্ভাব-‘আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে’, নবীর তিরোভাব-‘সেই রবিয়ল আউয়ালেই চাঁদ এসেছে ফিরে’, ঈদ-‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, রমজান-‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরি মোবারক মাস’, কাবা ও হজ্জ-‘পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া’, আজান-মসজিদ-নামাজ-‘মসজিদে ঐ শোন্ রে আজান চল্ নামাজে চল’, মহররম-‘এলো শোকের সেই মোর্হরম কারবালার স্মৃতি ল’য়ে’, হজরত কন্যা ফাতেমা বিষয়ক-‘খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী’, আরব-মক্কা-মদিনা সম্পর্কে-‘আল্লা নামের নায়ে চ’ড়ে যাব মদিনায়’ ইত্যাদি। তাঁর ইসলামি গানের মধ্যে হাম্দ ও নাত বাণী ও সুরের বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত মর্যাদার অধিকারী। কারণ বাণীর বৈভব ও নিরীক্ষাধর্মী সুরের প্রয়োগে নজরুল ইসলামি গানে এ ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে অতিক্রম করতে পারে বাংলার বাংলার গীতিকবিদের মধ্যে তেমন কাউকে দেখা যায় না। যদিও তাঁর পূর্বে অনেকেই ইসলামি গান রচনা করেছেন। সে সময় গোঁড়া মুসলমান সমাজে দীর্ঘদিনের সংস্কার দূরীকরণে নজরুলের গান ছিল নতুন সমাজ সৃষ্টির হাতিয়ার। এসব গান শুনে মানুষ অন্তরে প্রশান্তি অনুভব তরে। মুস্তাফা জামান আব্বাসী নজরুলের হাম্দ নিয়ে একটি প্রবন্ধে লেখেন, “...আল্লা-রাসূলের গান গেয়ে বাংলা মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আঙ্গুল দিত তাদের কানে গেল ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি’, ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মোন সা, আহমদ বোল’,কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল-‘এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ চলো ঈদগাহে’ ঘরে ঘরে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত গতে লাগল আল্লা-রাসূলের নাম।”

নাতে-রাসুল

মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা।

ঐ নামে মিটাই পিয়াসা ও নাম কওসারের পিয়ালা॥

‘মোহাম্মদ মোর নয়ন মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা’-এটি নাতে-রসুল পর্যায়ের গান। তিনি নাতে-রাসুল লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন গীতিকবি বুসাইরির দ্বারা। নজরুলের গানের বাণীর সৌকর্য অনেকটাই বুসাইরির মতো। নজরুলের গান যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে তত তাঁর সংগীতের মূল্যায়ন হবে। মোহাম্মদের প্রশস্তি করে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন, যা থেকে মোহাম্মদের প্রতি অনিঃশেষ ভালবাসা। গানটি উক্তিসর্বস্ব। গানটিজুড়েই মোহাম্মদের প্রতি ভক্তির চিত্রকল্প ফুটে ওঠে, যা পাঠক শোনামাত্রই বাণী ও সুরের সাথে ভক্তিভাবে একাত্ম হয়ে পড়ে। তিনি মোহাম্মদকে নিয়ে চিত্রকল্পসমৃদ্ধ আরও যে বিখ্যাত গানগুলো রচনা করেন-‘মোহাম্মদের নামে জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে/তাই কিরে তোর কণ্ঠেরি গান, (ওরে) এমন মধুর লাগে।।/ ওরে গোলার নিরিবিলি/নবীর কদম ছুঁয়েছিলি’, ‘মোহাম্মদ নাম যত জপি, তত মধুর লাগে,/ নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে।।/ঐ নামেরি মধু চাহি’/মন-ভ্রমরা বেড়ায় গাহি’, ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।/যে নাম নিয়ে চাঁদ-সেতারা আস্মানে খায় দোল’, ‘আমার মোহাম্মদের নামের ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়/ওগো হৃদয়ের যার রয়। খোদার সাতে গয়েছে তার গোপন পরিচয়’, ‘তৌহিদের মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।/ঐ নম জপিলেই বুঝতে পারি খোদায় কালাম’/মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম উল্লেখযোগ্য।

রমজান

ও মন রমজানে ঐ রেজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ॥

‘ও মন রমজারে ঐ রোজার শেষে এলে খুশির ঈদ’-মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের গান। নজরুল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিয়েও সংগীত রচনা করেছেন। তিনি গানটিতে রমজান, মুসলমানসহ অন্যান্য মিথ প্রসঙ্গও এনেছেন। বলা যায়, নজরুলের রচনার পর ঈদের গান হিসেবে এটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তার মর্যাদা ও আবেদন আজও একই রকমের রয়েছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর গভীর মনোযোগের সাক্ষ্য এ গানটি। ইংরেচ কবি বায়রনও রমজান, মুসলমান এ শব্দগুলো তাঁর কাব্যে তুলে ধরেন। বলা যায় মহৎ কবিদের ভেতর ভাবনাগত মিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। নিচে বায়রনের মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক কারণে তুলে ধারা হলো যেখানে নজরুলের চৈতন্যের সাথে তাঁর চেতনাগত ঐক্য লক্ষণীয়-

Just at the season Ramazani’s fast: Through the long day its penance did maintain

But when the lingering twilight hour was past,

Revel and feast assumed the role again:

Now all the bustles, and the menial train Prepared

and spread the plenteous board within;

The vacant Gallery now seemed made in vain,

But from the chambers came the mingling din.

As page and slave anon were passing out in.

নজরুল গবেষক শাহবুদ্দিনের মতে, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটিতে লক্ষণীয় প্রথম পঙ্ক্তির শব্দ ‘ঈদ’। এর সঙ্গে ২য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ৮ম, ১০ম, ১২শ, ১৪শ পঙ্ক্তিতে ‘তাগিদ’ ‘নিদ্’ ‘শহীদ’ ‘মুরিদ’ ও উম্মীদ-এ রয়েছে ছান্দিক মিল”। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে অলঙ্কার হিসেবে অনুপ্রাসের ব্যবহার করেছেন। ‘প্রথম পঙইক্ততে ‘র জ’, ‘রক্ত’, ‘শষ’, ‘শ’ তৃতীয় পঙ্ক্তিতে ‘না’, না, ‘না’, ‘ল ল ল’ ; চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘মু’, ‘মু ম’; পঞ্চম পঙ্ক্তিতে ‘ড়রর’, ‘ন ন’, ‘ম স’; ষষ্ঠ পঙ্ক্তিতে ‘ম ম ম’; সপ্তম পঙ্ক্তিতে ‘দ দ’, ‘হ হ’, ‘ম ম’ , ‘ত ত ত’’, ... এভাবে প্রতিটি পঙ্ক্তিতেই এর ছন্দ পাঠক-শ্রোতার অন্তরে দোল দেয়। গানটিতে সুরের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় বাণীর সাথে সংগতি রেখে সুর নির্বাচন। গানটি শোনামাত্রই সকল শ্রোতা এক ধরনের আনন্দ অনুভব করেন। তবে এ গানটির সবচেয়ে বড় দিক হলো-ঈদ যদিও খুশির উৎসব তবু ভুললে চলবে না সত্যিকারের আনন্দে উৎস ত্যাগ। গানটিতে কবি মুসলমানদের সেই ঈদগাহে নামাজ পড়তে বলেছেন যে ময়দানে বীর মুসলমানরা শহিদ হয়েছেন। তিনি মুসলমানদের কাছে চারটি বিষয় প্রার্থনা করেছেন-দান, আত্মত্যাগ, মুজাহিদদের সাহসী সংগ্রাম, আল্লাহ ও রসুলে বিশ্বাস এবং মানবতার জন্য বিশ্বপ্রেম-মূলত যা ইসলামের অন্তর্নিহিত আদর্শ। গানটির শেষ পঙ্ক্তিতে তিনি মনুষ্যত্ব অর্জন করার কথা বলেছেন। কেবল মনুষ্যত্ব অর্জনকারী ব্যক্তি বড় ও মহান আঘাত পেলে সে প্রত্যাঘাত করে না বরং আঘাতের বেদনার নির্যাস দিয়ে সে প্রেমের পবিত্র গৃহ মসজিদ রূপ তার বিশুদ্ধ আত্মাকে নির্মাণ করে। যে কোনো ধরনের শোকককে সে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। মানুষের যে প্রেম তা ম্লান হয় না কখনো।

মার্সিয়া

ওগো মা-ফাতেমা ছুটে আয়, তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।

দীনের শেষে বাতি নিভিয়া যায় মাগো, বুঝি আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী॥

গানটিতে পৌরাণিক চরিত্রের আশ্রয় নিয়েছেন কবি বিষয়বস্তুর ভাব-ব্যঞ্জনা প্রকাশের প্রয়াসে। মা ‘ফাতেমা’ বিশ্বময়ী রূপের বর্ণনা করেছেন এখানে এবং মা ফাতেমার ধৈর্যশক্তি দিয়ে পৃথিবীর সকল অকল্যাণ দূরীভূত করার কামনা করেছেন। গানটিতে প্রার্থনা ও নবীর ওপর নির্ভরতার আকুতি আছে এবং পুরো গানটিতে বেশ কিছু দূরান্বয়ী চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। মদিনার দুর্বিসহ পরিস্থিতি গানটিতে বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত করুণভাবে। তিনি মা ফাতেমা, নবীজির সাহায্য প্রার্থনা করেছেন গানটিতে। কারবালার প্রান্তরে নবীর দুই নাতির বিয়োগান্ত বিদায়ের ঘটনার চিত্রকল্প এই গানে।

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ১৩

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

image

কারো ভরসা করিসনে তুই (ও মন) এক আল্লাহ ভরসা কর/আল্লা যদি সহায় থাকেন (ও তোর) ভাবনা কিসের, কিসের ডর ॥

‘কারো ভরসা করিসনে তুই (ও মন) এক আল্লাহ ভরসা কর’-এটি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি হাম্দ। গানটির প্রতি চরণেই আল্লার প্রতি অনিঃশেষ ভক্তিভাব লক্ষণীয়। সর্বাবস্থায় মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ভরসা করবার আহ্বান আছে এই গানটিতে। হাম্দ শ্রেণির এই গানটির ভাষা একেবারেই সহজ-সরল। গানটির সুর ভাটিয়ালির অঙ্গের, যা মানুষের হৃদয়ের সুর, মাজাঘষা, কৃত্রিমতাবিহিীন বাণী; গ্রামবাংলার ইসলাম ধর্মবলম্বীর ভক্তদের প্রাণের কথা। যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ে হোক না কেন, তাদের মধ্যে তো কোনো সংঘাত বা বৈপরীত্য নেই। সকলেই সেই এক শক্তিমানের পূজক। ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছেন, একই বস্তুকে কেউ জল, কেউ পানি, কেউ ওয়াটার বলে মূলে কিন্তু বস্তু সেই একই। আমার গানটিতে আল্লাহর স্থানে ভগবান। নেক্নজরের স্থানে কৃপা, বাদশার সাথে মহারাজ, গোলামের স্থানে চাকর, খোদার স্থানে ঈশ্বর, রহম্-এর স্থানে কৃপা ভেবে নিলে এই গানই হিন্দু ধর্মীয় সংগীত। গানের মেজাজ একই শুধু পার্থক্য শব্দগত। তাঁর আরও অনেক বিখ্যাত হাম্দ রয়েছে-‘খোদা এই গরীবের শোন’ , ‘এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফল’, আল্লা নামের বীজ বুনেছি’ এ গানগুলোর মূল ভাব হচ্ছে আল্লাহর প্রশান্তি।

‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি’-গানটি ভাটিয়ালি সুরে রচিত। নজরুল তার সংগীতের বাণী ও সুরকে এমনভাবে সমন্বিত করেছেন মনে হয় একটি অপরটির পরিপূরক। গানটিতে তিনি পল্লি অঞ্চলের ফসল কেনাবেচা, চাষ-আবাদ, মরাই, বাঁধা এসব শব্দচয়ন করেন। এ শব্দগুলোর সাথে গ্রামবাংলার মানুষেরা পরিচিত বলেই এই সংগীতের চিত্রকল্পের সাথে একাত্ম হতে সময় লাগে না। পাশাপাশি ভাটিয়ালি সুরও গ্রামবাংলার নিজস্ব। নজরুল ইসলামি গান কেবল আল্লাহ ও নবীর মজিমাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। এখানেই তাঁর সংগীতের বৈচিত্র্য। যেমন-নবীর আবির্ভাব-‘আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে’, নবীর তিরোভাব-‘সেই রবিয়ল আউয়ালেই চাঁদ এসেছে ফিরে’, ঈদ-‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, রমজান-‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরি মোবারক মাস’, কাবা ও হজ্জ-‘পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া’, আজান-মসজিদ-নামাজ-‘মসজিদে ঐ শোন্ রে আজান চল্ নামাজে চল’, মহররম-‘এলো শোকের সেই মোর্হরম কারবালার স্মৃতি ল’য়ে’, হজরত কন্যা ফাতেমা বিষয়ক-‘খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী’, আরব-মক্কা-মদিনা সম্পর্কে-‘আল্লা নামের নায়ে চ’ড়ে যাব মদিনায়’ ইত্যাদি। তাঁর ইসলামি গানের মধ্যে হাম্দ ও নাত বাণী ও সুরের বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত মর্যাদার অধিকারী। কারণ বাণীর বৈভব ও নিরীক্ষাধর্মী সুরের প্রয়োগে নজরুল ইসলামি গানে এ ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে অতিক্রম করতে পারে বাংলার বাংলার গীতিকবিদের মধ্যে তেমন কাউকে দেখা যায় না। যদিও তাঁর পূর্বে অনেকেই ইসলামি গান রচনা করেছেন। সে সময় গোঁড়া মুসলমান সমাজে দীর্ঘদিনের সংস্কার দূরীকরণে নজরুলের গান ছিল নতুন সমাজ সৃষ্টির হাতিয়ার। এসব গান শুনে মানুষ অন্তরে প্রশান্তি অনুভব তরে। মুস্তাফা জামান আব্বাসী নজরুলের হাম্দ নিয়ে একটি প্রবন্ধে লেখেন, “...আল্লা-রাসূলের গান গেয়ে বাংলা মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আঙ্গুল দিত তাদের কানে গেল ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি’, ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মোন সা, আহমদ বোল’,কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল-‘এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ চলো ঈদগাহে’ ঘরে ঘরে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত গতে লাগল আল্লা-রাসূলের নাম।”

নাতে-রাসুল

মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা।

ঐ নামে মিটাই পিয়াসা ও নাম কওসারের পিয়ালা॥

‘মোহাম্মদ মোর নয়ন মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা’-এটি নাতে-রসুল পর্যায়ের গান। তিনি নাতে-রাসুল লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন গীতিকবি বুসাইরির দ্বারা। নজরুলের গানের বাণীর সৌকর্য অনেকটাই বুসাইরির মতো। নজরুলের গান যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে তত তাঁর সংগীতের মূল্যায়ন হবে। মোহাম্মদের প্রশস্তি করে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন, যা থেকে মোহাম্মদের প্রতি অনিঃশেষ ভালবাসা। গানটি উক্তিসর্বস্ব। গানটিজুড়েই মোহাম্মদের প্রতি ভক্তির চিত্রকল্প ফুটে ওঠে, যা পাঠক শোনামাত্রই বাণী ও সুরের সাথে ভক্তিভাবে একাত্ম হয়ে পড়ে। তিনি মোহাম্মদকে নিয়ে চিত্রকল্পসমৃদ্ধ আরও যে বিখ্যাত গানগুলো রচনা করেন-‘মোহাম্মদের নামে জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে/তাই কিরে তোর কণ্ঠেরি গান, (ওরে) এমন মধুর লাগে।।/ ওরে গোলার নিরিবিলি/নবীর কদম ছুঁয়েছিলি’, ‘মোহাম্মদ নাম যত জপি, তত মধুর লাগে,/ নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে।।/ঐ নামেরি মধু চাহি’/মন-ভ্রমরা বেড়ায় গাহি’, ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।/যে নাম নিয়ে চাঁদ-সেতারা আস্মানে খায় দোল’, ‘আমার মোহাম্মদের নামের ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়/ওগো হৃদয়ের যার রয়। খোদার সাতে গয়েছে তার গোপন পরিচয়’, ‘তৌহিদের মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।/ঐ নম জপিলেই বুঝতে পারি খোদায় কালাম’/মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম উল্লেখযোগ্য।

রমজান

ও মন রমজানে ঐ রেজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ॥

‘ও মন রমজারে ঐ রোজার শেষে এলে খুশির ঈদ’-মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের গান। নজরুল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিয়েও সংগীত রচনা করেছেন। তিনি গানটিতে রমজান, মুসলমানসহ অন্যান্য মিথ প্রসঙ্গও এনেছেন। বলা যায়, নজরুলের রচনার পর ঈদের গান হিসেবে এটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তার মর্যাদা ও আবেদন আজও একই রকমের রয়েছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর গভীর মনোযোগের সাক্ষ্য এ গানটি। ইংরেচ কবি বায়রনও রমজান, মুসলমান এ শব্দগুলো তাঁর কাব্যে তুলে ধরেন। বলা যায় মহৎ কবিদের ভেতর ভাবনাগত মিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। নিচে বায়রনের মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক কারণে তুলে ধারা হলো যেখানে নজরুলের চৈতন্যের সাথে তাঁর চেতনাগত ঐক্য লক্ষণীয়-

Just at the season Ramazani’s fast: Through the long day its penance did maintain

But when the lingering twilight hour was past,

Revel and feast assumed the role again:

Now all the bustles, and the menial train Prepared

and spread the plenteous board within;

The vacant Gallery now seemed made in vain,

But from the chambers came the mingling din.

As page and slave anon were passing out in.

নজরুল গবেষক শাহবুদ্দিনের মতে, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটিতে লক্ষণীয় প্রথম পঙ্ক্তির শব্দ ‘ঈদ’। এর সঙ্গে ২য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ৮ম, ১০ম, ১২শ, ১৪শ পঙ্ক্তিতে ‘তাগিদ’ ‘নিদ্’ ‘শহীদ’ ‘মুরিদ’ ও উম্মীদ-এ রয়েছে ছান্দিক মিল”। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে অলঙ্কার হিসেবে অনুপ্রাসের ব্যবহার করেছেন। ‘প্রথম পঙইক্ততে ‘র জ’, ‘রক্ত’, ‘শষ’, ‘শ’ তৃতীয় পঙ্ক্তিতে ‘না’, না, ‘না’, ‘ল ল ল’ ; চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘মু’, ‘মু ম’; পঞ্চম পঙ্ক্তিতে ‘ড়রর’, ‘ন ন’, ‘ম স’; ষষ্ঠ পঙ্ক্তিতে ‘ম ম ম’; সপ্তম পঙ্ক্তিতে ‘দ দ’, ‘হ হ’, ‘ম ম’ , ‘ত ত ত’’, ... এভাবে প্রতিটি পঙ্ক্তিতেই এর ছন্দ পাঠক-শ্রোতার অন্তরে দোল দেয়। গানটিতে সুরের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় বাণীর সাথে সংগতি রেখে সুর নির্বাচন। গানটি শোনামাত্রই সকল শ্রোতা এক ধরনের আনন্দ অনুভব করেন। তবে এ গানটির সবচেয়ে বড় দিক হলো-ঈদ যদিও খুশির উৎসব তবু ভুললে চলবে না সত্যিকারের আনন্দে উৎস ত্যাগ। গানটিতে কবি মুসলমানদের সেই ঈদগাহে নামাজ পড়তে বলেছেন যে ময়দানে বীর মুসলমানরা শহিদ হয়েছেন। তিনি মুসলমানদের কাছে চারটি বিষয় প্রার্থনা করেছেন-দান, আত্মত্যাগ, মুজাহিদদের সাহসী সংগ্রাম, আল্লাহ ও রসুলে বিশ্বাস এবং মানবতার জন্য বিশ্বপ্রেম-মূলত যা ইসলামের অন্তর্নিহিত আদর্শ। গানটির শেষ পঙ্ক্তিতে তিনি মনুষ্যত্ব অর্জন করার কথা বলেছেন। কেবল মনুষ্যত্ব অর্জনকারী ব্যক্তি বড় ও মহান আঘাত পেলে সে প্রত্যাঘাত করে না বরং আঘাতের বেদনার নির্যাস দিয়ে সে প্রেমের পবিত্র গৃহ মসজিদ রূপ তার বিশুদ্ধ আত্মাকে নির্মাণ করে। যে কোনো ধরনের শোকককে সে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। মানুষের যে প্রেম তা ম্লান হয় না কখনো।

মার্সিয়া

ওগো মা-ফাতেমা ছুটে আয়, তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।

দীনের শেষে বাতি নিভিয়া যায় মাগো, বুঝি আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী॥

গানটিতে পৌরাণিক চরিত্রের আশ্রয় নিয়েছেন কবি বিষয়বস্তুর ভাব-ব্যঞ্জনা প্রকাশের প্রয়াসে। মা ‘ফাতেমা’ বিশ্বময়ী রূপের বর্ণনা করেছেন এখানে এবং মা ফাতেমার ধৈর্যশক্তি দিয়ে পৃথিবীর সকল অকল্যাণ দূরীভূত করার কামনা করেছেন। গানটিতে প্রার্থনা ও নবীর ওপর নির্ভরতার আকুতি আছে এবং পুরো গানটিতে বেশ কিছু দূরান্বয়ী চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। মদিনার দুর্বিসহ পরিস্থিতি গানটিতে বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত করুণভাবে। তিনি মা ফাতেমা, নবীজির সাহায্য প্রার্থনা করেছেন গানটিতে। কারবালার প্রান্তরে নবীর দুই নাতির বিয়োগান্ত বিদায়ের ঘটনার চিত্রকল্প এই গানে।