বাঁকখালী নদীর মুক্তি ও ন্যায়বিচার

পাভেল পার্থ

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের নদী প্রণালিকে ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করেছে। পূর্ব-পাহাড়ি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ নদী বাঁকখালী। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শিরোনামে পাউবো বাংলাদেশের ৩১৪টি নদ-নদীর একটি পরিচিতিমূলক নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে। বাঁকখালী নদীর আইডি নং-২০০। উল্লিখিত বইটিতে পাউবো বাঁকখালীর দৈর্ঘ্য লিখেছে ৯০ কিলোমিটার এবং অববাহিকা ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। যদিও কোথাও কোথাও নদীটির দৈর্ঘ্য ৬৭ কিংবা ৬৯ কিলোমিটারও লেখা হয়েছে।

দেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের এই নদী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় প্রবাহিত। উইকিপিডিয়া লিখেছে- উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতধারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে মিলিত হয়ে বাঁকখালী নদী হিসেবে প্রবাহিত হয়েছে। বাঁকখালী নদী রামু ও কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে মিশেছে। ঐতিহাসিকভাবেই বাঁকখালী দুর্গতদের সুরক্ষা দিয়েছে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা আরাকান দখল করায় উদ্বাস্তু বহু শরণার্থী বাঁকখালী তীরে আশ্রয় নেয়, ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাদের পুনর্বাসন করেন।

বাঁকখালী তীরে কক্সের সমাধিটিও হারিয়ে গেছে। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, আরব কী আরাকান বণিকেরা এই নদী দিয়ে বাণিজ্য ও উপনিবেশিকতার বিস্তার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই নদীতীরে ব্রিটিশ-মার্কিন সৈন্যরা নদীতীরে জেটি তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধে এই নদী রেখেছে অনন্য ভূমিকা। এ নদী তীরেই খুরুশকুলে ২৫৩.৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে তোলা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের অন্যতম আশ্রয় কেন্দ্র। কক্সবাজারের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বাঁকখালী নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ নদীর অবববাহিকায় লবন তৈরি হয় এবং মৎস্য চাষ হয়। দেশের আর সব নদীর মতোই বাঁকখালী আজ দখলে-দূষণে জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন। ২০১৬ সনে উচ্চ আদালত বাঁকখালী নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। দখলদারদের ক্ষমতা ও বাহাদুরির প্রবল চাপে এতদিন দখলমুক্তকরেণর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারেনি। দীর্ঘদিন বাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়। দখলদারদের বাধা ও হুমকির মুখে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নদী তীরের প্রায় ৩০০ একর এলাকা দখলমুক্ত হয়েছে এবং প্রায় চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। বাঁকখালী দখলমুক্ত করবার এই সাহসী রাষ্ট্রীয় তৎপরতাকে জানাই ‘নদীময় অভিনন্দন’।

২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)’ বাঁকখালী নদীবন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বাঁকখালী তীরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসনের অনাপত্তির কারণে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর পুনরায় যৌথ জরিপ হয়। ২০১৬ সনে ৬০ দিনের ভেতর বাঁকখালী তীরের জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয় এবং এদের ভেতর ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘কক্সবাজার জেলা নদী রক্ষা কমিটি’ পুনর্গঠন করা হয়। জেলাপ্রশাসক সভাপতি এবং কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সদস্য।

কিন্তু নিদারুণভাবে বাঁকখালী দখলে বহু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের যুক্ততা প্রমাণিত হতে থাকে। গণমাধ্যমে বাঁকখালী দখলে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী থেকে শুরু করে পৌরসভার মেয়রের জড়িত থাকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাঁকখালীর ৩০০ একর নদীতীরের প্যারাবন প্রায় নিশ্চিহ্ন। ২০১৩ সাল থেকে নদীর পাড়ে পৌরসভার বর্জ্য ফেলা শুরু হয়। নিদারুণভাবে ময়লার এই ভাগাড়টি দখলে শুরু হয় ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। ২০১৮ সালে মুজিবুর রহমান কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্যারাবন উজাড় করে নদীতীর দখলে নামেন। ২০১৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ বাঁকখালীর দখলদারদের যে তালিকা তৈরি করেন সেখানে দখলদার হিসেবে মেয়রের নামও আছে। প্রতিদিন কক্সবাজার শহরের প্রায় ১৫০ টন কঠিন বর্র্জ্য বাঁকখালীর কস্তরাঘাটে ফেলা হয়। বর্জ্যরে স্তূপ ও দূষণে প্রতিদিন বাঁকখালী তার বৈশিষ্ট্য ও প্রশস্ততা হারাচ্ছে। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর, ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং ১৫ জুন ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে তিনটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

অভিযুক্ত আসামিদের ভেতর মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় গণমাধ্যম। প্রভাবশালীরা নদীদখলের প্রমাণসহ অভিযোগ, মামলা ও প্রতিবেদনকে কখনই আমলে নেননি। মেয়রের বিরুদ্ধে নদী দখলের মামলা তুলে নিতে পৌরসভায় কর্মবিরতিও পালিত হয়। অবৈধ দখল উচ্ছেদের সময় দখলদার হিসেবে অভিযুক্ত আবদুল খালেকের দল সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে অবস্থানরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালান এবং হুমকী দেন। ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান গণমাধ্যমকে জানান, সরকারি কাজে বাধা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হবে। অবৈধ দখলদার হিসেবে অভিযুক্ত আবদুল খালেক গণমাধ্যমকে জানান, তিনি দখলদার নন বরং তিনটি দলিলমতে প্রায় ১২৭ শতক জমির বৈধ মালিক তিনি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ও তার পক্ষে আছে, ১৯৯১ সাল থেকে ঘরবাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। তবে বাঁকখালী দখলমুক্ত অভিযানে কিছু মানুষ যারা দখলদারদের কাছ থেকে জমি কিনে বসতবাড়ি বানিয়েছিলেন তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। নদী তীরের মতো পাবলিক এলাকা দখল এবং পরবর্তীতে সেটি আবার বানোয়াট নথির মাধ্যমে বিক্রি করে প্রতারিত করবার বিষয়টিও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

কত নদী, কত নাম, কত সম্পর্ক, কত পরিচয়। এসবের আর কোনো হদিসই আজ নেই। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বট-পাকুড়-হিজল-তমালের ছায়ায় গ্রামীণ হাট-গঞ্জ-বাজার আজ উধাও। বরং নদীর তীর, এমনকি নদীর বুক পর্যন্ত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মারদাঙ্গা নগর আর বাণিজ্য কেন্দ্র। যেখানে নদীনির্ভর অর্থনীতির কোনো রেখাপাত নেই, কেবলি বহুজাতিক সর্বগ্রাসী বাজার। পদ্মার ইলিশ, তিস্তার পুটিতর, যাদুকাটা-রক্তির নানিদ বা কংশের মহাশোল মাছেরা যেমন নিরুদ্দেশ হয়েছে। বদলে গেছে নদীনির্ভর জীবন ও জীবিকাও। নদী হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে, অচেনা নগরের ভিড়ে স্বীকৃতিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। বহু বাঁক আছে বলে নদীটর নাম বাঁকখালী এরকম বলে থাকেন অনেকে। অনেকে বলেন, বাঁকখালী থেকে কক্সবাজারের আদিনাম হয়েছিল ‘বাকুলিয়া আইল্যান্ড’। বাঁটা মাছের জন্য বিখ্যাত এই নদীতে লইট্টা, কোরাল, খোরল, পাঙ্গাশ ও ইলিশ পাওয়া যায়।

বাঁকখালীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো উৎপত্তিস্থল থেকে সমুদ্রে মিলিত হওয়ার এক ছোট্ট যাত্রাপথে বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্রের সম্মিলন। পাহাড়, ম্যানগ্রোভ বন এবং সমুদ্র উপকূলের মতো ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের সাক্ষাত খুব কম নদীর জীবনেই ঘটে। কিন্তু উন্নয়নের নামে বাঁকখালীর বিচিত্র প্রবাহ-স্বর ও জলব্যঞ্জনা টুকরো টুকরো করা হয়েছে। বাঁকখালী প্যারাবনের তিনশ একর বনের প্রায় চল্লিশ হাজার বাইন ও কেওড়া গাছ নিখোঁজ হয়েছে। কেবল দখল বা দূষণ নয়, এমনকি খুরুশকুলের সাথে সংযোগের জন্য কস্তুরাঘাটে নির্মিত বাঁকখালী সেতু, যা এই নদীর প্রবাহ ও বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদী সংকট তৈরি করবে। নদীর প্রতি দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল না হলে এমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন আবারো দখলে দূষণে মুর্মূষু হবে বাঁকখালী। তীব্র প্রতাপ আর প্রশ্নহীন বাহাদুরির ছাপিয়ে এখনো বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের জনসংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিন্যাসে প্রতিদিন অবদান রাখছে বাঁকখালী নদী। ৩৫ প্রজাতির মাছ ও ১০ প্রজাতির চিংড়ির বিচরণস্থল এই নদী। বঙ্গোপসাগরের চার শতাধিক সামদ্রিক প্রাণীর অধিকাংশই বাঁকখালী মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে। গোলপাতা ও কেওড়ার জন্য বিখ্যাত বাঁকখালী প্যারাবন আজ বৃক্ষশূন্য।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, বাঁকখালী তীরের প্যারাবনে ১২ হাজারের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণি প্রজাতি আছে। সংবেদনশীল এই প্যারাবনে ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, শামুক-ঝিনুক ১২৬ প্রজাতির, কাঁকড়া ২১, চিংড়ি ১৯, লবস্টার ২, মাছ ২০৭, উভয়চর ১২, সরীসৃপ ১৯ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখি আছে। ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ ও প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধদের ঐতিহ্যবাহী ‘কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব’ হয় বাঁকখালী নদীতে। বাঁশ-বেত-রঙিন কাগজের তৈরি ‘কল্প জাহাজ’ ভাসানো হয় জীব ও জগতের মঙ্গল কামনায়। রামুর পূর্ব রাজারকুল, মেরংলোয়া, দ্বীপ শ্রীকুল, সীমা বিহার, মিঠাছড়ি, চেরাংঘাটা ও রাংকুটসহ আশপাশে রাখাইন জনগণ এই কৃত্য আয়োজন করেন। বাঁকখালী দখল ও দূষণ মুক্ত রাখতে লড়তে হবে আমাদের সবার। বাঁকখালী দখলমুক্তকরণে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক তৎপরতা সক্রিয় হোক দেশের সব নদী-প্রান্তরে।

[লেখক : গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩ , ০২ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

বাঁকখালী নদীর মুক্তি ও ন্যায়বিচার

পাভেল পার্থ

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের নদী প্রণালিকে ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করেছে। পূর্ব-পাহাড়ি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ নদী বাঁকখালী। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শিরোনামে পাউবো বাংলাদেশের ৩১৪টি নদ-নদীর একটি পরিচিতিমূলক নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে। বাঁকখালী নদীর আইডি নং-২০০। উল্লিখিত বইটিতে পাউবো বাঁকখালীর দৈর্ঘ্য লিখেছে ৯০ কিলোমিটার এবং অববাহিকা ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। যদিও কোথাও কোথাও নদীটির দৈর্ঘ্য ৬৭ কিংবা ৬৯ কিলোমিটারও লেখা হয়েছে।

দেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের এই নদী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় প্রবাহিত। উইকিপিডিয়া লিখেছে- উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতধারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে মিলিত হয়ে বাঁকখালী নদী হিসেবে প্রবাহিত হয়েছে। বাঁকখালী নদী রামু ও কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে মিশেছে। ঐতিহাসিকভাবেই বাঁকখালী দুর্গতদের সুরক্ষা দিয়েছে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা আরাকান দখল করায় উদ্বাস্তু বহু শরণার্থী বাঁকখালী তীরে আশ্রয় নেয়, ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাদের পুনর্বাসন করেন।

বাঁকখালী তীরে কক্সের সমাধিটিও হারিয়ে গেছে। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, আরব কী আরাকান বণিকেরা এই নদী দিয়ে বাণিজ্য ও উপনিবেশিকতার বিস্তার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই নদীতীরে ব্রিটিশ-মার্কিন সৈন্যরা নদীতীরে জেটি তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধে এই নদী রেখেছে অনন্য ভূমিকা। এ নদী তীরেই খুরুশকুলে ২৫৩.৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে তোলা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের অন্যতম আশ্রয় কেন্দ্র। কক্সবাজারের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বাঁকখালী নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ নদীর অবববাহিকায় লবন তৈরি হয় এবং মৎস্য চাষ হয়। দেশের আর সব নদীর মতোই বাঁকখালী আজ দখলে-দূষণে জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন। ২০১৬ সনে উচ্চ আদালত বাঁকখালী নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। দখলদারদের ক্ষমতা ও বাহাদুরির প্রবল চাপে এতদিন দখলমুক্তকরেণর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারেনি। দীর্ঘদিন বাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়। দখলদারদের বাধা ও হুমকির মুখে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নদী তীরের প্রায় ৩০০ একর এলাকা দখলমুক্ত হয়েছে এবং প্রায় চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। বাঁকখালী দখলমুক্ত করবার এই সাহসী রাষ্ট্রীয় তৎপরতাকে জানাই ‘নদীময় অভিনন্দন’।

২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)’ বাঁকখালী নদীবন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বাঁকখালী তীরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসনের অনাপত্তির কারণে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর পুনরায় যৌথ জরিপ হয়। ২০১৬ সনে ৬০ দিনের ভেতর বাঁকখালী তীরের জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয় এবং এদের ভেতর ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘কক্সবাজার জেলা নদী রক্ষা কমিটি’ পুনর্গঠন করা হয়। জেলাপ্রশাসক সভাপতি এবং কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সদস্য।

কিন্তু নিদারুণভাবে বাঁকখালী দখলে বহু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের যুক্ততা প্রমাণিত হতে থাকে। গণমাধ্যমে বাঁকখালী দখলে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী থেকে শুরু করে পৌরসভার মেয়রের জড়িত থাকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাঁকখালীর ৩০০ একর নদীতীরের প্যারাবন প্রায় নিশ্চিহ্ন। ২০১৩ সাল থেকে নদীর পাড়ে পৌরসভার বর্জ্য ফেলা শুরু হয়। নিদারুণভাবে ময়লার এই ভাগাড়টি দখলে শুরু হয় ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। ২০১৮ সালে মুজিবুর রহমান কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্যারাবন উজাড় করে নদীতীর দখলে নামেন। ২০১৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ বাঁকখালীর দখলদারদের যে তালিকা তৈরি করেন সেখানে দখলদার হিসেবে মেয়রের নামও আছে। প্রতিদিন কক্সবাজার শহরের প্রায় ১৫০ টন কঠিন বর্র্জ্য বাঁকখালীর কস্তরাঘাটে ফেলা হয়। বর্জ্যরে স্তূপ ও দূষণে প্রতিদিন বাঁকখালী তার বৈশিষ্ট্য ও প্রশস্ততা হারাচ্ছে। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর, ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং ১৫ জুন ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে তিনটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

অভিযুক্ত আসামিদের ভেতর মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় গণমাধ্যম। প্রভাবশালীরা নদীদখলের প্রমাণসহ অভিযোগ, মামলা ও প্রতিবেদনকে কখনই আমলে নেননি। মেয়রের বিরুদ্ধে নদী দখলের মামলা তুলে নিতে পৌরসভায় কর্মবিরতিও পালিত হয়। অবৈধ দখল উচ্ছেদের সময় দখলদার হিসেবে অভিযুক্ত আবদুল খালেকের দল সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে অবস্থানরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালান এবং হুমকী দেন। ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান গণমাধ্যমকে জানান, সরকারি কাজে বাধা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হবে। অবৈধ দখলদার হিসেবে অভিযুক্ত আবদুল খালেক গণমাধ্যমকে জানান, তিনি দখলদার নন বরং তিনটি দলিলমতে প্রায় ১২৭ শতক জমির বৈধ মালিক তিনি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ও তার পক্ষে আছে, ১৯৯১ সাল থেকে ঘরবাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। তবে বাঁকখালী দখলমুক্ত অভিযানে কিছু মানুষ যারা দখলদারদের কাছ থেকে জমি কিনে বসতবাড়ি বানিয়েছিলেন তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। নদী তীরের মতো পাবলিক এলাকা দখল এবং পরবর্তীতে সেটি আবার বানোয়াট নথির মাধ্যমে বিক্রি করে প্রতারিত করবার বিষয়টিও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

কত নদী, কত নাম, কত সম্পর্ক, কত পরিচয়। এসবের আর কোনো হদিসই আজ নেই। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বট-পাকুড়-হিজল-তমালের ছায়ায় গ্রামীণ হাট-গঞ্জ-বাজার আজ উধাও। বরং নদীর তীর, এমনকি নদীর বুক পর্যন্ত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মারদাঙ্গা নগর আর বাণিজ্য কেন্দ্র। যেখানে নদীনির্ভর অর্থনীতির কোনো রেখাপাত নেই, কেবলি বহুজাতিক সর্বগ্রাসী বাজার। পদ্মার ইলিশ, তিস্তার পুটিতর, যাদুকাটা-রক্তির নানিদ বা কংশের মহাশোল মাছেরা যেমন নিরুদ্দেশ হয়েছে। বদলে গেছে নদীনির্ভর জীবন ও জীবিকাও। নদী হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে, অচেনা নগরের ভিড়ে স্বীকৃতিহীন দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। বহু বাঁক আছে বলে নদীটর নাম বাঁকখালী এরকম বলে থাকেন অনেকে। অনেকে বলেন, বাঁকখালী থেকে কক্সবাজারের আদিনাম হয়েছিল ‘বাকুলিয়া আইল্যান্ড’। বাঁটা মাছের জন্য বিখ্যাত এই নদীতে লইট্টা, কোরাল, খোরল, পাঙ্গাশ ও ইলিশ পাওয়া যায়।

বাঁকখালীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো উৎপত্তিস্থল থেকে সমুদ্রে মিলিত হওয়ার এক ছোট্ট যাত্রাপথে বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্রের সম্মিলন। পাহাড়, ম্যানগ্রোভ বন এবং সমুদ্র উপকূলের মতো ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের সাক্ষাত খুব কম নদীর জীবনেই ঘটে। কিন্তু উন্নয়নের নামে বাঁকখালীর বিচিত্র প্রবাহ-স্বর ও জলব্যঞ্জনা টুকরো টুকরো করা হয়েছে। বাঁকখালী প্যারাবনের তিনশ একর বনের প্রায় চল্লিশ হাজার বাইন ও কেওড়া গাছ নিখোঁজ হয়েছে। কেবল দখল বা দূষণ নয়, এমনকি খুরুশকুলের সাথে সংযোগের জন্য কস্তুরাঘাটে নির্মিত বাঁকখালী সেতু, যা এই নদীর প্রবাহ ও বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদী সংকট তৈরি করবে। নদীর প্রতি দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল না হলে এমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন আবারো দখলে দূষণে মুর্মূষু হবে বাঁকখালী। তীব্র প্রতাপ আর প্রশ্নহীন বাহাদুরির ছাপিয়ে এখনো বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতের জনসংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিন্যাসে প্রতিদিন অবদান রাখছে বাঁকখালী নদী। ৩৫ প্রজাতির মাছ ও ১০ প্রজাতির চিংড়ির বিচরণস্থল এই নদী। বঙ্গোপসাগরের চার শতাধিক সামদ্রিক প্রাণীর অধিকাংশই বাঁকখালী মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে। গোলপাতা ও কেওড়ার জন্য বিখ্যাত বাঁকখালী প্যারাবন আজ বৃক্ষশূন্য।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, বাঁকখালী তীরের প্যারাবনে ১২ হাজারের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণি প্রজাতি আছে। সংবেদনশীল এই প্যারাবনে ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, শামুক-ঝিনুক ১২৬ প্রজাতির, কাঁকড়া ২১, চিংড়ি ১৯, লবস্টার ২, মাছ ২০৭, উভয়চর ১২, সরীসৃপ ১৯ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখি আছে। ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ ও প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধদের ঐতিহ্যবাহী ‘কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব’ হয় বাঁকখালী নদীতে। বাঁশ-বেত-রঙিন কাগজের তৈরি ‘কল্প জাহাজ’ ভাসানো হয় জীব ও জগতের মঙ্গল কামনায়। রামুর পূর্ব রাজারকুল, মেরংলোয়া, দ্বীপ শ্রীকুল, সীমা বিহার, মিঠাছড়ি, চেরাংঘাটা ও রাংকুটসহ আশপাশে রাখাইন জনগণ এই কৃত্য আয়োজন করেন। বাঁকখালী দখল ও দূষণ মুক্ত রাখতে লড়তে হবে আমাদের সবার। বাঁকখালী দখলমুক্তকরণে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক তৎপরতা সক্রিয় হোক দেশের সব নদী-প্রান্তরে।

[লেখক : গবেষক]