কেটে ফেলে দেয়া চুলে কোটি টাকার ব্যবসা

ঢাকার কলাবাগানের একটি বিউটি পার্লারে ক্লায়েন্টদের চুল কাটছেন কর্মীরা আর কিছুক্ষণ পরপর মেঝেতে জমা হওয়া কাটা সে চুল ঝাড়ু দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। কিন্তু এসব চুল যায় কোথায়! জানতে চাইলে বিউটি পার্লারের মালিক তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘বড় চুল কাটা হলে মেয়েরা সংগ্রহ করে রাখে। প্রতি সপ্তাহেই লোকজন এসে এই চুল নিয়ে যায়। আমরা আগে চুল ফেলে দিলেও এখন অবশ্য সংগ্রহ করে রেখে দেই।’

প্রচলিত কিছু পণ্য ছাড়াও বাতিল বা ফেলনা জিনিসও বৈদেশিক মুদ্রা আনে দেশেরে বাজারে। এমনি একটি পণ্য হলো কেটে ফেলে দেয়া চুল। গত দুই দশক ধরে শিল্প আকারে এই ফেলনা চুল বৈদেশিক মুদ্রা আনছে বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক কালে এই বাতিল চুল সংগ্রহ এবং বিক্রি অনেকের জীবিকার উৎস হয়ে উঠেছে। শুধু দেশের বাজারেই নয়, এসব চুল থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে। এসব চুল দিয়ে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেই এখন উইগেরে রীতিমত কারখানা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ফেরি করে স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করেন। এমনকি পাড়া বা মহল্লায় চুল কিনতে ফেরিওয়ালাদের ঘুরতেও দেখা যায়। তারা এসব চুল সংগ্রহ করে উইগ বা পরচুলা তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করেন।

ঢাকার খিলগাঁওয়ের হেয়ারি উইগের মালিক মতিউর রহমান ২২ বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখন দোকানে দোকানে গিয়ে তিনি ফ্যাশন ডলের মাথায় উইগ বসানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর এখন তার কাছে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন উইগের খোঁজে। তিনি জানান, এখন বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আসছেন নিজেদের মাথার উইগ বা পরচুলা তৈরির জন্য। কেউ চাকরির ইন্টারভিউ দেবেন বা বিয়ের পাত্রী দেখতে যাবেন, আবার কেউ টেলিভিশনে খবর পরবেন এমন অনেকে নিচ্ছেন উইগ। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে অর্ডার আসছে।

কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা। বর্তমানে কোন কোন কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে। আর বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াও চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ফেলনা এসব চুল রপ্তানি করে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চুল যাচ্ছে ভারতে। রাজশাহী নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। কিন্তু ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতে ৫৫ লাখ ডলারের বেশি এ ধরণের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সংশ্লিষ্ট খাতের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৬৩.৭৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ -২৩ অর্থবছরে (জুলাই ফেব্রুয়ারি) আয় হয়েছে ৮৭.০৮ মিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী রপ্তানি বেড়েছে ২৩.২৯ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ফেলে দেয়া চুলে আয় হয়েছিল ১০৫.৮৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ খাতে রপ্তানি ক্রমবর্ধমান।

বাদ নেই ছেলেদের সেলুনও। যদিও সেখানে খুব একটা বড় চুল পাওয়া যায় না তারপরও সেখান থেকেও চুল সংগ্রহ করার জন্য ঘোরাফেরা করে ফেরিওয়ালারা, জানান বেশ কয়েকটি সেলুনের নরসুন্দর বা নাপিত। তবে বাংলাদেশে মূলত এ ধরনের চুলের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয় মেয়েদের পার্লার থেকে এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসাটির প্রচলন থাকলেও, সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ১৯৯৯-২০০০ সালের পর থেকে। আর রপ্তানি করে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা এসেছে ২০১৫ -১৬ অর্থবছরে এক কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে।

ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে তা সম্ভাবনা জাগাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

শুক্রবার, ১৭ মার্চ ২০২৩ , ০৩ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

কেটে ফেলে দেয়া চুলে কোটি টাকার ব্যবসা

রাহিমা আক্তার

image

ঢাকার কলাবাগানের একটি বিউটি পার্লারে ক্লায়েন্টদের চুল কাটছেন কর্মীরা আর কিছুক্ষণ পরপর মেঝেতে জমা হওয়া কাটা সে চুল ঝাড়ু দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। কিন্তু এসব চুল যায় কোথায়! জানতে চাইলে বিউটি পার্লারের মালিক তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘বড় চুল কাটা হলে মেয়েরা সংগ্রহ করে রাখে। প্রতি সপ্তাহেই লোকজন এসে এই চুল নিয়ে যায়। আমরা আগে চুল ফেলে দিলেও এখন অবশ্য সংগ্রহ করে রেখে দেই।’

প্রচলিত কিছু পণ্য ছাড়াও বাতিল বা ফেলনা জিনিসও বৈদেশিক মুদ্রা আনে দেশেরে বাজারে। এমনি একটি পণ্য হলো কেটে ফেলে দেয়া চুল। গত দুই দশক ধরে শিল্প আকারে এই ফেলনা চুল বৈদেশিক মুদ্রা আনছে বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক কালে এই বাতিল চুল সংগ্রহ এবং বিক্রি অনেকের জীবিকার উৎস হয়ে উঠেছে। শুধু দেশের বাজারেই নয়, এসব চুল থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে। এসব চুল দিয়ে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেই এখন উইগেরে রীতিমত কারখানা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ফেরি করে স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করেন। এমনকি পাড়া বা মহল্লায় চুল কিনতে ফেরিওয়ালাদের ঘুরতেও দেখা যায়। তারা এসব চুল সংগ্রহ করে উইগ বা পরচুলা তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করেন।

ঢাকার খিলগাঁওয়ের হেয়ারি উইগের মালিক মতিউর রহমান ২২ বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখন দোকানে দোকানে গিয়ে তিনি ফ্যাশন ডলের মাথায় উইগ বসানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর এখন তার কাছে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন উইগের খোঁজে। তিনি জানান, এখন বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আসছেন নিজেদের মাথার উইগ বা পরচুলা তৈরির জন্য। কেউ চাকরির ইন্টারভিউ দেবেন বা বিয়ের পাত্রী দেখতে যাবেন, আবার কেউ টেলিভিশনে খবর পরবেন এমন অনেকে নিচ্ছেন উইগ। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে অর্ডার আসছে।

কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা। বর্তমানে কোন কোন কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে। আর বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াও চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ফেলনা এসব চুল রপ্তানি করে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চুল যাচ্ছে ভারতে। রাজশাহী নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। কিন্তু ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতে ৫৫ লাখ ডলারের বেশি এ ধরণের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সংশ্লিষ্ট খাতের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৬৩.৭৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ -২৩ অর্থবছরে (জুলাই ফেব্রুয়ারি) আয় হয়েছে ৮৭.০৮ মিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী রপ্তানি বেড়েছে ২৩.২৯ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ফেলে দেয়া চুলে আয় হয়েছিল ১০৫.৮৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ খাতে রপ্তানি ক্রমবর্ধমান।

বাদ নেই ছেলেদের সেলুনও। যদিও সেখানে খুব একটা বড় চুল পাওয়া যায় না তারপরও সেখান থেকেও চুল সংগ্রহ করার জন্য ঘোরাফেরা করে ফেরিওয়ালারা, জানান বেশ কয়েকটি সেলুনের নরসুন্দর বা নাপিত। তবে বাংলাদেশে মূলত এ ধরনের চুলের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয় মেয়েদের পার্লার থেকে এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসাটির প্রচলন থাকলেও, সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ১৯৯৯-২০০০ সালের পর থেকে। আর রপ্তানি করে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা এসেছে ২০১৫ -১৬ অর্থবছরে এক কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে।

ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে তা সম্ভাবনা জাগাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।