প্লাস্টিক দূষণ : উদ্বিগ্ন বিশ্ব

জাকিয়া সুলতানা

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের নাম প্লাস্টিক দূষণ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হবে। প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সমুদ্র যে ধরনের বর্জ্য রয়েছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিকের দূষণ এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বেড়ে যাবে।

প্লাস্টিক সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রতি বছর প্রায় ১০০০০০ সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। কতিপয় সামুদ্রিক প্রাণী খাদ্য হিসেবে প্লাস্টিক গ্রহণ করছে এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষুধামন্দায় মারা যাচ্ছে। এ প্লাস্টিক বর্জ্য ক্ষতি করছে সমুদ্রের প্রবালপ্রাচীর এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা প্রজাতিসমূহকে।

প্লাস্টিক থেকে উৎপন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশে মাটি, ভূগর্ভস্থ পানি এবং অন্যান্য পানির উৎস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের একদল বিজ্ঞানী বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। ২০২২ সালে ইউরোপের এক বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণায় মানবদেহের ফুসফুসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

প্লাস্টিক দূষণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার দিকে থেকে বিশে^র শীর্ষ দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৩০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ওয়েস্ট কনসার্নের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী মাত্র শতকরা ৩৬ ভাগ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়, ৩৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায় এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী হয়ে বছরে প্রায় ৭৩০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের (২০২১) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকার প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া গেছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়, যার ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক, যার আবার ৭৮ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। উদ্বেগের বিষয় যে, বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা প্রাণিকুল ছাড়াও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছে লবণ গ্রহণের মাধ্যমে।

২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী প্রতি কেজি লবণে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সম্প্রতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বাজারের সাদা চিনির ওপর গবেষণা করে চিনিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছেন। গবেষণা অনুযায়ী শুধু চিনি গ্রহণের মাধ্যমেই বছরে ১০ দশমিক ২ টন মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বাংলাদেশের মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণকারীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কোমল পানীয় প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান কোকাকোলা। দেশে উৎপাদিত মোট প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রায় ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশই কোকাকোলার। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামক একটি বেসরকারি এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

প্লাস্টিকের দূষণ রোধে ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ১২৭টি দেশ ইতোমধ্যে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কোনো কোনো দেশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার, বিক্রয়, বিতরণ এবং ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের একাধিক অঙ্গরাজ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার, বিক্রয়, বিতরণ এবং ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই এক পরিপত্রের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিক ফুড কনটেইনার নিষিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬-এর সংশোধনীর মাধ্যমে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ভারত। নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের ব্যাগ স্ট্র, ছুরি-চামচ, ইয়ার বাড, মোড়ক, বেলুন, ক্যান্ডি এবং আইসক্রিমে ব্যবহার করা কাঠি, সিগারেটের প্যাকেটসহ আরো বেশ কিছু পণ্য রয়েছে। ‘প্লাস্টিক প্যাকেজিং, কম ইউটিলিটি এবং উচ্চ আবর্জনা ফেলার সম্ভাবনাযুক্ত একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক আইটেমগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব (EPR)-এর মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যকর এবং কার্যকর উপায়ে প্লাস্টিক দূষণ নির্মূল করার যাত্রা শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি, রপ্তানি নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করে এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সংশোধনী এনে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি, রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এবং শাস্তির বিধান সংযোজন করে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ৬ক ধারার অধীনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এবং ২০০২ সালের ১ মার্চ থেকে সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, মজুত, বিতরণ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সাময়িকভাবে এর ব্যবহার হ্রাস পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির অভাবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। উপরন্তু ১১ আগস্ট, ২০০২ সালে মোড়ক হিসেবে ১০০ মাইক্রোনের ওপরে পলিথিন শপিংব্যাগের ব্যবহার অনুমোদন দেয়ায় বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগের মধ্যে তফাত নির্ধারণে সাধারণ ক্রেতা ব্যর্থ হচ্ছে। এমন শিথিলতার সুযোগ নিয়ে বৈধ দাবি করে আবারও পলিথিন ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে এর ব্যবহার যথেচ্ছভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।

সরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১ প্রণয়ন করেছে। এ বিধিমালা বিধি ৮(৩)-এ বর্জ্য নিক্ষেপের জন্য প্লাস্টিকজাত ব্যাগের ব্যবহার রোধ করা এবং জৈব পচনশীল ব্যাগ বা মোড়ক ব্যবহারে অগ্রাধিকার প্রদান করাকে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিধি ৯(১)-এর বিধান অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের দায়িত্ব হচ্ছে উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব (EPR)-এর আওতায় জৈবিকভাবে অপচনশীল ডিসপোজেবল পণ্যের প্রস্তুতকারী বা আমদানিকারকরা টিন, গ্লাস, প্লাস্টিক, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক, পলিথিন, মালটি লেয়ার প্যাকেজিং বা মোড়ক, বোতল, ক্যান বা সমজাতীয় পণ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্জ্য গ্রাহক পর্যায় হতে সংগ্রহ করে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, পুনঃ চক্রায়ণসহ পরিত্যজন সমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা। প্লাস্টিক বর্জ্য চিরতরে নির্মূল করতে একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করতে গত ২ মার্চ, ২০২২ নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ পরিষদের সমাবেশ শেষে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করেন বিশ্বের ১৭৫টি রাষ্ট্রের নেতা, মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]

শুক্রবার, ১৭ মার্চ ২০২৩ , ০৩ চৈত্র ১৪২৯, ২৪ শবান ১৪৪৪

প্লাস্টিক দূষণ : উদ্বিগ্ন বিশ্ব

জাকিয়া সুলতানা

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের নাম প্লাস্টিক দূষণ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হবে। প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সমুদ্র যে ধরনের বর্জ্য রয়েছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিকের দূষণ এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বেড়ে যাবে।

প্লাস্টিক সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রতি বছর প্রায় ১০০০০০ সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। কতিপয় সামুদ্রিক প্রাণী খাদ্য হিসেবে প্লাস্টিক গ্রহণ করছে এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষুধামন্দায় মারা যাচ্ছে। এ প্লাস্টিক বর্জ্য ক্ষতি করছে সমুদ্রের প্রবালপ্রাচীর এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা প্রজাতিসমূহকে।

প্লাস্টিক থেকে উৎপন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশে মাটি, ভূগর্ভস্থ পানি এবং অন্যান্য পানির উৎস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ২০১৭ সালে ফ্রান্সের একদল বিজ্ঞানী বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। ২০২২ সালে ইউরোপের এক বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণায় মানবদেহের ফুসফুসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

প্লাস্টিক দূষণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার দিকে থেকে বিশে^র শীর্ষ দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৩০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ওয়েস্ট কনসার্নের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী মাত্র শতকরা ৩৬ ভাগ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়, ৩৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায় এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী হয়ে বছরে প্রায় ৭৩০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের (২০২১) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২.২৫ কেজি এবং ঢাকার প্রতিদিনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ ৬৪৬ টন, যা সমগ্র বাংলাদেশের বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া গেছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়, যার ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক, যার আবার ৭৮ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। উদ্বেগের বিষয় যে, বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা প্রাণিকুল ছাড়াও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছে লবণ গ্রহণের মাধ্যমে।

২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী প্রতি কেজি লবণে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সম্প্রতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বাজারের সাদা চিনির ওপর গবেষণা করে চিনিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছেন। গবেষণা অনুযায়ী শুধু চিনি গ্রহণের মাধ্যমেই বছরে ১০ দশমিক ২ টন মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বাংলাদেশের মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণকারীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কোমল পানীয় প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান কোকাকোলা। দেশে উৎপাদিত মোট প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রায় ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশই কোকাকোলার। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামক একটি বেসরকারি এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

প্লাস্টিকের দূষণ রোধে ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ১২৭টি দেশ ইতোমধ্যে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কোনো কোনো দেশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার, বিক্রয়, বিতরণ এবং ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের একাধিক অঙ্গরাজ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন, ব্যবহার, বিক্রয়, বিতরণ এবং ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই এক পরিপত্রের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিক ফুড কনটেইনার নিষিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬-এর সংশোধনীর মাধ্যমে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ভারত। নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের ব্যাগ স্ট্র, ছুরি-চামচ, ইয়ার বাড, মোড়ক, বেলুন, ক্যান্ডি এবং আইসক্রিমে ব্যবহার করা কাঠি, সিগারেটের প্যাকেটসহ আরো বেশ কিছু পণ্য রয়েছে। ‘প্লাস্টিক প্যাকেজিং, কম ইউটিলিটি এবং উচ্চ আবর্জনা ফেলার সম্ভাবনাযুক্ত একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক আইটেমগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব (EPR)-এর মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যকর এবং কার্যকর উপায়ে প্লাস্টিক দূষণ নির্মূল করার যাত্রা শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি, রপ্তানি নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করে এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সংশোধনী এনে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন, বিক্রয়, ক্রয়, আমদানি, রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এবং শাস্তির বিধান সংযোজন করে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ৬ক ধারার অধীনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এবং ২০০২ সালের ১ মার্চ থেকে সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, মজুত, বিতরণ এবং ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সাময়িকভাবে এর ব্যবহার হ্রাস পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির অভাবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। উপরন্তু ১১ আগস্ট, ২০০২ সালে মোড়ক হিসেবে ১০০ মাইক্রোনের ওপরে পলিথিন শপিংব্যাগের ব্যবহার অনুমোদন দেয়ায় বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগের মধ্যে তফাত নির্ধারণে সাধারণ ক্রেতা ব্যর্থ হচ্ছে। এমন শিথিলতার সুযোগ নিয়ে বৈধ দাবি করে আবারও পলিথিন ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে এর ব্যবহার যথেচ্ছভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।

সরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১ প্রণয়ন করেছে। এ বিধিমালা বিধি ৮(৩)-এ বর্জ্য নিক্ষেপের জন্য প্লাস্টিকজাত ব্যাগের ব্যবহার রোধ করা এবং জৈব পচনশীল ব্যাগ বা মোড়ক ব্যবহারে অগ্রাধিকার প্রদান করাকে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিধি ৯(১)-এর বিধান অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের দায়িত্ব হচ্ছে উৎপাদনকারীর সম্প্রসারিত দায়িত্ব (EPR)-এর আওতায় জৈবিকভাবে অপচনশীল ডিসপোজেবল পণ্যের প্রস্তুতকারী বা আমদানিকারকরা টিন, গ্লাস, প্লাস্টিক, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক, পলিথিন, মালটি লেয়ার প্যাকেজিং বা মোড়ক, বোতল, ক্যান বা সমজাতীয় পণ্যের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্জ্য গ্রাহক পর্যায় হতে সংগ্রহ করে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, পুনঃ চক্রায়ণসহ পরিত্যজন সমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা। প্লাস্টিক বর্জ্য চিরতরে নির্মূল করতে একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করতে গত ২ মার্চ, ২০২২ নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ পরিষদের সমাবেশ শেষে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করেন বিশ্বের ১৭৫টি রাষ্ট্রের নেতা, মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা।

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]