অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা তৈরি

‘ঢাকা টেলিভিশন স্বাধিকার আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে দিয়েছে তার অভিনব গানের অনুষ্ঠান দিয়ে। এমন অনুষ্ঠান দেখি নাই কভু। ঢাকার যত প্রথম সারির নামকরা সংগীতশিল্পী- ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, খোন্দকার ফারুক আহমদ, রথীন্দ্রনাথ রায় এবং আরও অনেকে মিলে যখন গাইতে থাকেন-‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম/ চলবেই দিনরাত অবিরাম’-আর তাদের কয়েকটা চেহারা হাজার চেহারা হয়ে যায়, তখন মনে হয় বুকের মধ্যে, ঘরের মধ্যে ঝড় উঠে গেছে, সে ঝড়ের মাতামাতি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।’ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এভাবেই অঙ্কিত হয়েছে ১৮ মার্চ ১৯৭১ এর খন্ডচিত্র।

একাত্তরের টালমাটাল মার্চের অষ্টাদশ দিন ছিল বাঙালির অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। সরকারি-বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস আদালতে অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তোলেন। ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউজে ইয়াহিয়ার তখন কার্যত বন্দীদশা। বিরাট সশস্ত্র রক্ষীদল ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) তখন বঙ্গবন্ধু কিংবা তার দলের নির্দেশ ছাড়া কিছুই চলছিল না, কোন কাজই হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলিই ছিল তখন দেশের সর্বোচ্চ আইন। ইয়াহিয়া কর্তৃত্ব প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক ভুট্টো-ইয়াহিয়ার একটি সাজানো নাটক। সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে ‘অগ্রগতি’ ঘটাতে চাইছেন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো দম্ভোক্তি করছেন যে তাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা প্রতিহত করবেন।

পাকিস্তাািন শাসকগোষ্ঠী ও তার পদলেহীরা পরিস্থিতি আগে থেকেই বুঝতে পেরে ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসানকে সরিয়ে দেয়া হয়। এই দুই পদের দায়িত্ব দেয়া হয় লে. জেনারেল টিক্কা খানকে, ইতিহাসে যিনি ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছেন।

এদিন ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন বৈঠক ছিল না। তবে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। এদিনই মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পাঁচ পৃষ্ঠার একটা নীলনকশার খসড়া প্রণয়ন করেন, যার নাম পূর্বে ছিল ‘ব্লিটজ’, এবং পরে দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। দুই দিন আগে ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে লোকদেখানো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। আর এর তৃতীয় দিনের মাথায় (১৮ মার্চ) ইয়াহিয়া গংয়ের খায়েশ অনুসারে গোপনে রাজা-রাও অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা তৈরি সম্পন্ন করেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলনের গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়া, ‘পোড়ামাটি নীতি’ অনুসরণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা চিরকালের জন্য ধূলিস্যাৎ করে দেয়া। ইয়াহিয়া খান সেই প্রস্তুতির সবকিছু চূড়ান্ত করেই পঁচিশে মার্চ কালরাতে ঢাকা ছাড়েন এবং অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণ শুরুর নির্দেশনা দিয়ে যান।

স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র দ্বারা বাঙালিদের হত্যা চালানোর প্রয়াস বন্ধ করতে বলেন।

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া পরবর্তী বৈঠকের কোন সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমান। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তাদের পরিচালনকেন্দ্রেই পরিণত হয়নি, সেইসঙ্গে হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের মিলন ক্ষেত্রও।

সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হেনো।’ জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’

এদিনও বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরো সৈন্য আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি-না, জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান খান ওয়ালী খান ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন।

এরই মধ্যে রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, ‘আগামীকাল সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’

সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও এবং মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

রাতে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচারণ, তা যেকোন মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করবো না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উসকানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।’

বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামের একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান।

এদিকে, ঢাকায় বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যেকোন ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেন।

অন্যদিকে, করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের (ইয়াহিয়া খান) কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কোন জবাব না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩ , ০৪ চৈত্র ১৪২৯, ২৫ শবান ১৪৪৪

উত্তাল মার্চ

অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা তৈরি

সাদেকুর রহমান

‘ঢাকা টেলিভিশন স্বাধিকার আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে দিয়েছে তার অভিনব গানের অনুষ্ঠান দিয়ে। এমন অনুষ্ঠান দেখি নাই কভু। ঢাকার যত প্রথম সারির নামকরা সংগীতশিল্পী- ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, খোন্দকার ফারুক আহমদ, রথীন্দ্রনাথ রায় এবং আরও অনেকে মিলে যখন গাইতে থাকেন-‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম/ চলবেই দিনরাত অবিরাম’-আর তাদের কয়েকটা চেহারা হাজার চেহারা হয়ে যায়, তখন মনে হয় বুকের মধ্যে, ঘরের মধ্যে ঝড় উঠে গেছে, সে ঝড়ের মাতামাতি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।’ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এভাবেই অঙ্কিত হয়েছে ১৮ মার্চ ১৯৭১ এর খন্ডচিত্র।

একাত্তরের টালমাটাল মার্চের অষ্টাদশ দিন ছিল বাঙালির অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। সরকারি-বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস আদালতে অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তোলেন। ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউজে ইয়াহিয়ার তখন কার্যত বন্দীদশা। বিরাট সশস্ত্র রক্ষীদল ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) তখন বঙ্গবন্ধু কিংবা তার দলের নির্দেশ ছাড়া কিছুই চলছিল না, কোন কাজই হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলিই ছিল তখন দেশের সর্বোচ্চ আইন। ইয়াহিয়া কর্তৃত্ব প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক ভুট্টো-ইয়াহিয়ার একটি সাজানো নাটক। সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে ‘অগ্রগতি’ ঘটাতে চাইছেন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো দম্ভোক্তি করছেন যে তাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা প্রতিহত করবেন।

পাকিস্তাািন শাসকগোষ্ঠী ও তার পদলেহীরা পরিস্থিতি আগে থেকেই বুঝতে পেরে ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসানকে সরিয়ে দেয়া হয়। এই দুই পদের দায়িত্ব দেয়া হয় লে. জেনারেল টিক্কা খানকে, ইতিহাসে যিনি ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছেন।

এদিন ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন বৈঠক ছিল না। তবে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। এদিনই মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পাঁচ পৃষ্ঠার একটা নীলনকশার খসড়া প্রণয়ন করেন, যার নাম পূর্বে ছিল ‘ব্লিটজ’, এবং পরে দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। দুই দিন আগে ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে লোকদেখানো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। আর এর তৃতীয় দিনের মাথায় (১৮ মার্চ) ইয়াহিয়া গংয়ের খায়েশ অনুসারে গোপনে রাজা-রাও অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা তৈরি সম্পন্ন করেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলনের গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়া, ‘পোড়ামাটি নীতি’ অনুসরণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা চিরকালের জন্য ধূলিস্যাৎ করে দেয়া। ইয়াহিয়া খান সেই প্রস্তুতির সবকিছু চূড়ান্ত করেই পঁচিশে মার্চ কালরাতে ঢাকা ছাড়েন এবং অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণ শুরুর নির্দেশনা দিয়ে যান।

স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র দ্বারা বাঙালিদের হত্যা চালানোর প্রয়াস বন্ধ করতে বলেন।

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া পরবর্তী বৈঠকের কোন সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমান। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তাদের পরিচালনকেন্দ্রেই পরিণত হয়নি, সেইসঙ্গে হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের মিলন ক্ষেত্রও।

সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হেনো।’ জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’

এদিনও বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরো সৈন্য আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি-না, জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান খান ওয়ালী খান ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন।

এরই মধ্যে রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, ‘আগামীকাল সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’

সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও এবং মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

রাতে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচারণ, তা যেকোন মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করবো না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উসকানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।’

বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামের একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান।

এদিকে, ঢাকায় বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যেকোন ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেন।

অন্যদিকে, করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের (ইয়াহিয়া খান) কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কোন জবাব না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।