এ এ জাফর ইকবাল
দেশের অন্যতম আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক তথ্য-সমীক্ষায় জানান দিয়েছে, বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম পৃথিবীর অন্য কোন দেশের চাইতে অনেক বেশি। সিপিডির দেয়া এ তথ্যের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে গরুর মাংসের দাম আরো বেড়েছে। ৬৭০-৮০ টাকার মাংস এখন ৮০০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। মাংসের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে শবেবরাতকে একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে সবাই পর্যায়ের মাংস ব্যবসায়ীরা। পয়সা হলে মাংসের অভাব নেই। সরবরাহ সংকট কোথাও নেই। অথচ মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
আজকাল আর একটি নতুন চমক এসেছে মাংসের বাজারে। আড়াইশ’ গ্রাম করে মাংস বিক্রির দোকান। এতে কি মূল্যবৃদ্ধির ওপর কোন প্রভাব পড়বে? নাকি মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে জায়েজ করার জন্য ভোক্তার চাহিদার ওপর কৌশল খাটানোর অপচেষ্টাবিশেষ।
শবেবরাতে গরুর মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ থাকলে কোন কারণেই দাম বাড়া উচিত নয়। অথচ আমাদের মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় আবেগকে কৌশল হিসেবে কাজে লাগিয়ে এই অপকর্মটি করছেন হর হামেশাই।
এ ঘটনা এবারই ঘটল তা নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় যথাসময়ে সঠিক সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীরা সামান্য ভুল করেনি কখনো।
রমজান প্রায় এসেই গেছে। রমজানে সর্বস্তরের ধর্মভীরু মানুষ ভাল-মন্দ খাবারের ব্যাপারে যথেষ্ট যতœবান থাকেন এবং এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। চাল, ডাল, নুন, তেল তো বটেই ইফতারের বেগুনসহ খেজুর, ছোলা এবং মাছ-মাংসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে না। প্রতিবারই ঘটছে এমন কাহিনী। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কর্তৃপক্ষ একেবারেই নির্লিপ্ত নয়। শুরুতেই তারা এই নিয়ে বিবৃতি-বক্তৃতা দেন, বাজারে বাজারে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য সরবরাহের তালিকাও টাঙানো হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আমাদের সদাশয় ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে টুঁটি চেপে ধরেন সাধারণ মানুষের। আবেগ-তাড়িত মানুষ বাধ্য হয় ব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে আত্মসমর্পণ করতে। কেউ যৎসামান্য প্রতিবাদ করলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয় না।
পুনরায় যদি গরুর মাংসের কথাই বলি, তাহলে বলতে হয়- গরু বিক্রেতা কৃষক এবং প্রান্তিক মাংস-বিক্রেতা কসাই এই মুনাফার কোন অংশ নিজেরা পায় না। কৃষক পেল না, কসাইও পেল না। মুনাফাটা করছে কে? অবধারিতভাবেই মধ্যস্বত্বভোগী। তারা গরু ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থ দাদন দেয়। গবাদিপশু আনার কাজে পরিবহন খরচা বহন করে, পথে পথে যে টাকা পরিশোধ করতে হয় কমিশন হিসেবে তারা সে টাকাও পরিশোধ করে। সবশেষে নগরকুলের পাইকারি গরুর আড়তে মধ্যস্ততার ভূমিকাও পালন করে। কৃষক হাট থেকে দড়ি ছেড়ে দিলে পশুর দাম-দস্তুরের আর কিছুই করার থাকে না। আর কসাই? ও ব্যাটার কাজ তো মহাজনের পাঠানো গরু সময়মতো জবাই করে ভোক্তার থলিতে হাড্ডি-মাংস মিশ্রিত পণ্য তুলে দেয়া। এ কাজে কেউ পায় দৈনিক মজুরি, আবার কারো কারো জোটে কেজিভিত্তিক কমিশন। মুনাফার ভাগ যথারীতি চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর মোকামে।
এ প্রক্রিয়া আজকের নয়। চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। শুধু মাংসের ব্যাপারেই নয়, পটল, বেগুন, ঝিংগার মতো তাবাৎ সবজির বাজারেও একইভাবে চলছে। আধুনিক বাজার অর্থনীতি প্রক্রিয়ায় এটা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন কাজ নয়। অথচ এই যুগে, এই অর্থনৈতিক অপকর্মকে প্রতিরোধ করার কোন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। পবিত্র রমজানে অন্যান্য মূল্যবৃদ্ধির হিসাবও ঠিক একইরকমের।
এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে কতদিন? কেউ কি এই মুনাফাখোরী ঠেকাতে যোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ খুঁজে বের করবেন না? এ ধরনের সুযোগ সন্ধানী মুনাফাখোরীর স্বার্থে করোনার বিপর্যয় কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের আদৌ কি কোন সম্পর্ক আছে?
আমাদের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম শুধুমাত্র মাছ, মাংস, তেল, ডালের বাজারের ওপর সীমিত নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি দ্রব্যের বেলাতে ঘটছে একই ধরনের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে এবং সময়োপযোগী পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে।
এখন তো পারিবারিক পর্যায়ে শিল-পাটা ও গাইলসিয়া প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের অজুহাতে হলুদ, মরিচ ও ধনের মতো পণ্যের ব্যবসায় নেমে পড়েছে কর্পোরেট হাউজগুলো। রাঙামাটির হলুদ আর বগুড়ার লাল মরিচের নাম দিয়ে তারা বাজার দখল করেছেন স্বল্পমূল্যের পণ্য আকর্ষণীয় এবং উন্নত মোড়কে বাজারজাত করে। অনেক সময় দেখা যায় পণ্যের মূল্যের চাইতে মোড়কের দাম বেশি। করপোরেট হাউজগুলো বিষয়টি যাতে আলোচনায় না আসে সে জন্য পর্যাপ্ত পয়সা খরচ করে গণমাধ্যমে এন্তার বিজ্ঞাপনে পয়সা খরচ করছে। লবণে আয়োডিন, সয়াবিনে ভিটামিন এবং হলুদে এন্টিসেপটিকের মতো উপকরণ সংযোজনের চটকদারী কথাবার্তাও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে ভোক্তাদের কাছে।
লবণ না হলে চলে না। হলুদ, মরিচ না হলে তরকারির স্বাদও পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা তো রান্নাঘর থেকে বিদায় করে দিয়েছি শিলপাটা। এখন আর উপায় নেই আকর্ষণীয় মোড়কের মসল্লা বাজার থেকে সংগ্রহ না করে; কিন্তু কেউ কি হিসেব করে দেখেছেন, প্যাকেটে যে পণ্য আছে তার গুণগতমান কেমন? তার সর্বোচ্চ মূল্য কতো হতে পারে? কিংবা কি প্রক্রিয়ায়, কোন্ উপাদান ঠিক কতোটা কিভাবে ব্যবহার করে এই পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে?
এটা হলো করপোরেট হাউজগুলোর ভোক্তার গলা কাটার প্রক্রিয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের উপমহাদেশের ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এজাতীয় পণ্য বাজারজাত করার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। আমাদের দেশে তা অনুপস্থিত।
স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকৃত করপোরেট হাউজগুলোর আকর্ষণীয় মোড়কজাত পণ্যের পাশাপাশি আমদানিকৃত অনেক পণ্যেও দেখা গেছে লাগামহীন অর্থ আহরণের নানা প্রক্রিয়া। প্রসঙ্গক্রমে হরলিক্স নামের একটি পানীয়র কথা উল্লেখ করা যায়।
শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে হরলিক্স, যুবক ও কিশোর-কিশোরীদের হাড় মজবুত করার জন্য হরলিক্স, প্রসূতিদের শারিরীক উন্নয়নে হরলিক্স, প্রবীণদের সতেজ রাখার জন্যে হরলিক্স। কোথায় নেই হরলিক্স? আসলে কোন্ হরলিক্সে কী আছে, সেটা কি খুঁজে দেখেছেন কেউ? হরলিক্সের কথা বলা হলেও পরিচিত পণ্যের উপমা সৃষ্টির প্রয়োজনে। এ ধরণের অসংখ্য পণ্য আমদানি হয়ে দেশের বাজারে ঢুকছে এবং বিভ্রান্ত করছে ভোক্তাদের।
সাধারণ ভোক্তারা জানেও না আদৌ এই হরলিক্স জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে ঠিক কতোটা জরুরি। এক সময় এ দেশে হরলিক্স আমদানি হতো না। স্বাধীনতার আগে একটিমাত্র আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক কোম্পানি কাচের বোতলে হরলিক্স উৎপাদন ও বাজারজাত করত। ধনাঢ্য, শিক্ষিত ও পুষ্টিসচেতন মানুষ স্বাস্থ্যরক্ষায় কালে-ভদ্রে এই পণ্য কিনত। তখন পণ্যটি বিক্রি হতো অত্যন্ত সীমিত পরিসরে, ছিল না কোন প্রচার ও বিজ্ঞাপনের লাগামহীন প্রতিযোগিতা।
প্রচারেই প্রসার। বাজার ব্যবস্থার এই বর্তমান প্রক্রিয়া হরলিক্সকে নিয়ে এসেছে বহুমাত্রিক অবস্থানে। যার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ভোক্তাদের করছে একধরনের মোহাচ্ছন্ন।
শুধুমাত্র হরলিক্সই নয়, এ ধরনের আরো বেশ কয়েকটি পণ্য আছে যা আমাদের বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এন্তার আমদানি হচ্ছে সবাই কর্তৃপক্ষের নাকে রশি লাগিয়ে।
আপেল, আঙুর, কমলা আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু হরলিক্সের মতো অপ্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী পথ্যের অজুহাতে। জানি না, এ প্রসঙ্গে আমাদের নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি কী! তবে বোঝা যাচ্ছে, জেগে ঘুমানোর মতো আচ্ছন্নতায় কালাতিপাত করছেন তারা।
আজকাল ওষুধ-বাণিজ্যেও এসেছে বড় বড় কোম্পানিগুলোর অসাধারণ এবং অপ্রতিরোধ্য বিপণন প্রক্রিয়ার প্রতিযোগিতা। এই করোনাকালে প্রত্যেকটি ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধ প্রশাসন একবারের জন্যও ভোক্তাদের জানান দেয়নি কোন ওষুধের দাম কত বাড়ল এবং কেন বাড়ল। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে ওষুধ প্রশাসনের একটা ভূমিকা থাকে। বলতেই হয়, আমাদের ওষুধ প্রশাসন ভোক্তা-বান্ধব নয়। তারা একেবারেই ওষুধ কোম্পানি-বান্ধব।
কোথাও কোনো লাগাম নেই। প্রয়োজনীয় কর্তৃপক্ষ অজুহাত দেখাচ্ছে করোনা-সংকট ও যুদ্ধভীতির বিষয়। আমাদের বণিক সমিতিসমূহ ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো একেবারেই নির্বিকার, মনে হচ্ছে তাদের অবস্থান ব্যবসায়ীবান্ধব। কোন অবস্থাতেই তাদের অবস্থান জনহিতকর নয়।
দুই-একটি সামাজিক সংগঠন কালে-ভদ্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দেন কিন্তু তাতে এমন কোন দিক-নির্দেশনা থাকে না, যা মূল্যবৃদ্ধির লাগামহীন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনার সহায়ক হতে পারে।
রাজনীতি যারা করেন, তাদের রুটিন ওয়ার্ক হলো- সরকারকে দায়ী করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মিটিং, মিছিল কিংবা পথসভা করা। একই ধারাবাহিকতায় যারা ক্ষমতায় আছেন তারাও প্রয়োজন মোতাবেক মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার হুংকার-ঝংকার দিয়ে থাকেন। কোন কিছুতেই সুফল আসে না। কোন দ্রব্যের মূল্য একবার বাড়লে তা আর কমে না। এ যেন এক ম্যাজিকবিশেষ যা জনসাধারণকে সময়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে এক অর্থনৈতিক নির্যাতনে ঠেসে ধরার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
জানি করোনার আক্রমণে আমরা বিধ্বস্ত। এটাও জানি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ সারাবিশে^র অর্থনীতিকে স্থবির করে ফেলেছে। পাশাপাশি স্বীকার করতেই হয়, পরিস্থিতি সামাল দিতে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের আয় সংকুচিত হয়েছে। তাদের বাঁচার পথ কি? উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং সংকট অনেক জিনিসের ঘাটতিতে এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে; কিন্তু সব পণ্যের বেলায় তা সঠিক নয়।
আমাদের বাঁচতে হবে। আনতে হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। এজন্য প্রয়োজন বাজার-অর্থনীতির ভোক্তাবান্ধব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশল। শুধু সরকার একা নয়, এই কৌশলের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হবে ব্যবসায়ী ও বণিক এবং একইসাথে পরামর্শ নিতে হবে সামাজিক সংগঠন এবং জনবান্ধব বুদ্ধিজীবীদের। নিশ্চয়ই পথ বের হয়ে আসবে। তবে সেই পথ অতিক্রমণের জন্য প্রয়োজন হবে সঠিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
টাকা থাকলে মাংস মিলছে। এর সরবরাহ সংকট নেই, অথচ দাম বেড়ে যাচ্ছে
আরও খবরশনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩ , ০৪ চৈত্র ১৪২৯, ২৫ শবান ১৪৪৪
এ এ জাফর ইকবাল
টাকা থাকলে মাংস মিলছে। এর সরবরাহ সংকট নেই, অথচ দাম বেড়ে যাচ্ছে
দেশের অন্যতম আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক তথ্য-সমীক্ষায় জানান দিয়েছে, বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম পৃথিবীর অন্য কোন দেশের চাইতে অনেক বেশি। সিপিডির দেয়া এ তথ্যের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে গরুর মাংসের দাম আরো বেড়েছে। ৬৭০-৮০ টাকার মাংস এখন ৮০০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। মাংসের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে শবেবরাতকে একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে সবাই পর্যায়ের মাংস ব্যবসায়ীরা। পয়সা হলে মাংসের অভাব নেই। সরবরাহ সংকট কোথাও নেই। অথচ মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
আজকাল আর একটি নতুন চমক এসেছে মাংসের বাজারে। আড়াইশ’ গ্রাম করে মাংস বিক্রির দোকান। এতে কি মূল্যবৃদ্ধির ওপর কোন প্রভাব পড়বে? নাকি মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে জায়েজ করার জন্য ভোক্তার চাহিদার ওপর কৌশল খাটানোর অপচেষ্টাবিশেষ।
শবেবরাতে গরুর মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ থাকলে কোন কারণেই দাম বাড়া উচিত নয়। অথচ আমাদের মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় আবেগকে কৌশল হিসেবে কাজে লাগিয়ে এই অপকর্মটি করছেন হর হামেশাই।
এ ঘটনা এবারই ঘটল তা নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় যথাসময়ে সঠিক সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীরা সামান্য ভুল করেনি কখনো।
রমজান প্রায় এসেই গেছে। রমজানে সর্বস্তরের ধর্মভীরু মানুষ ভাল-মন্দ খাবারের ব্যাপারে যথেষ্ট যতœবান থাকেন এবং এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। চাল, ডাল, নুন, তেল তো বটেই ইফতারের বেগুনসহ খেজুর, ছোলা এবং মাছ-মাংসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে না। প্রতিবারই ঘটছে এমন কাহিনী। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কর্তৃপক্ষ একেবারেই নির্লিপ্ত নয়। শুরুতেই তারা এই নিয়ে বিবৃতি-বক্তৃতা দেন, বাজারে বাজারে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য সরবরাহের তালিকাও টাঙানো হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আমাদের সদাশয় ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে টুঁটি চেপে ধরেন সাধারণ মানুষের। আবেগ-তাড়িত মানুষ বাধ্য হয় ব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে আত্মসমর্পণ করতে। কেউ যৎসামান্য প্রতিবাদ করলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয় না।
পুনরায় যদি গরুর মাংসের কথাই বলি, তাহলে বলতে হয়- গরু বিক্রেতা কৃষক এবং প্রান্তিক মাংস-বিক্রেতা কসাই এই মুনাফার কোন অংশ নিজেরা পায় না। কৃষক পেল না, কসাইও পেল না। মুনাফাটা করছে কে? অবধারিতভাবেই মধ্যস্বত্বভোগী। তারা গরু ক্রয়-বিক্রয়ে অর্থ দাদন দেয়। গবাদিপশু আনার কাজে পরিবহন খরচা বহন করে, পথে পথে যে টাকা পরিশোধ করতে হয় কমিশন হিসেবে তারা সে টাকাও পরিশোধ করে। সবশেষে নগরকুলের পাইকারি গরুর আড়তে মধ্যস্ততার ভূমিকাও পালন করে। কৃষক হাট থেকে দড়ি ছেড়ে দিলে পশুর দাম-দস্তুরের আর কিছুই করার থাকে না। আর কসাই? ও ব্যাটার কাজ তো মহাজনের পাঠানো গরু সময়মতো জবাই করে ভোক্তার থলিতে হাড্ডি-মাংস মিশ্রিত পণ্য তুলে দেয়া। এ কাজে কেউ পায় দৈনিক মজুরি, আবার কারো কারো জোটে কেজিভিত্তিক কমিশন। মুনাফার ভাগ যথারীতি চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর মোকামে।
এ প্রক্রিয়া আজকের নয়। চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। শুধু মাংসের ব্যাপারেই নয়, পটল, বেগুন, ঝিংগার মতো তাবাৎ সবজির বাজারেও একইভাবে চলছে। আধুনিক বাজার অর্থনীতি প্রক্রিয়ায় এটা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন কাজ নয়। অথচ এই যুগে, এই অর্থনৈতিক অপকর্মকে প্রতিরোধ করার কোন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। পবিত্র রমজানে অন্যান্য মূল্যবৃদ্ধির হিসাবও ঠিক একইরকমের।
এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে কতদিন? কেউ কি এই মুনাফাখোরী ঠেকাতে যোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ খুঁজে বের করবেন না? এ ধরনের সুযোগ সন্ধানী মুনাফাখোরীর স্বার্থে করোনার বিপর্যয় কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের আদৌ কি কোন সম্পর্ক আছে?
আমাদের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম শুধুমাত্র মাছ, মাংস, তেল, ডালের বাজারের ওপর সীমিত নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি দ্রব্যের বেলাতে ঘটছে একই ধরনের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে এবং সময়োপযোগী পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে।
এখন তো পারিবারিক পর্যায়ে শিল-পাটা ও গাইলসিয়া প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের অজুহাতে হলুদ, মরিচ ও ধনের মতো পণ্যের ব্যবসায় নেমে পড়েছে কর্পোরেট হাউজগুলো। রাঙামাটির হলুদ আর বগুড়ার লাল মরিচের নাম দিয়ে তারা বাজার দখল করেছেন স্বল্পমূল্যের পণ্য আকর্ষণীয় এবং উন্নত মোড়কে বাজারজাত করে। অনেক সময় দেখা যায় পণ্যের মূল্যের চাইতে মোড়কের দাম বেশি। করপোরেট হাউজগুলো বিষয়টি যাতে আলোচনায় না আসে সে জন্য পর্যাপ্ত পয়সা খরচ করে গণমাধ্যমে এন্তার বিজ্ঞাপনে পয়সা খরচ করছে। লবণে আয়োডিন, সয়াবিনে ভিটামিন এবং হলুদে এন্টিসেপটিকের মতো উপকরণ সংযোজনের চটকদারী কথাবার্তাও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে ভোক্তাদের কাছে।
লবণ না হলে চলে না। হলুদ, মরিচ না হলে তরকারির স্বাদও পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা তো রান্নাঘর থেকে বিদায় করে দিয়েছি শিলপাটা। এখন আর উপায় নেই আকর্ষণীয় মোড়কের মসল্লা বাজার থেকে সংগ্রহ না করে; কিন্তু কেউ কি হিসেব করে দেখেছেন, প্যাকেটে যে পণ্য আছে তার গুণগতমান কেমন? তার সর্বোচ্চ মূল্য কতো হতে পারে? কিংবা কি প্রক্রিয়ায়, কোন্ উপাদান ঠিক কতোটা কিভাবে ব্যবহার করে এই পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে?
এটা হলো করপোরেট হাউজগুলোর ভোক্তার গলা কাটার প্রক্রিয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের উপমহাদেশের ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এজাতীয় পণ্য বাজারজাত করার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। আমাদের দেশে তা অনুপস্থিত।
স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকৃত করপোরেট হাউজগুলোর আকর্ষণীয় মোড়কজাত পণ্যের পাশাপাশি আমদানিকৃত অনেক পণ্যেও দেখা গেছে লাগামহীন অর্থ আহরণের নানা প্রক্রিয়া। প্রসঙ্গক্রমে হরলিক্স নামের একটি পানীয়র কথা উল্লেখ করা যায়।
শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে হরলিক্স, যুবক ও কিশোর-কিশোরীদের হাড় মজবুত করার জন্য হরলিক্স, প্রসূতিদের শারিরীক উন্নয়নে হরলিক্স, প্রবীণদের সতেজ রাখার জন্যে হরলিক্স। কোথায় নেই হরলিক্স? আসলে কোন্ হরলিক্সে কী আছে, সেটা কি খুঁজে দেখেছেন কেউ? হরলিক্সের কথা বলা হলেও পরিচিত পণ্যের উপমা সৃষ্টির প্রয়োজনে। এ ধরণের অসংখ্য পণ্য আমদানি হয়ে দেশের বাজারে ঢুকছে এবং বিভ্রান্ত করছে ভোক্তাদের।
সাধারণ ভোক্তারা জানেও না আদৌ এই হরলিক্স জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে ঠিক কতোটা জরুরি। এক সময় এ দেশে হরলিক্স আমদানি হতো না। স্বাধীনতার আগে একটিমাত্র আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক কোম্পানি কাচের বোতলে হরলিক্স উৎপাদন ও বাজারজাত করত। ধনাঢ্য, শিক্ষিত ও পুষ্টিসচেতন মানুষ স্বাস্থ্যরক্ষায় কালে-ভদ্রে এই পণ্য কিনত। তখন পণ্যটি বিক্রি হতো অত্যন্ত সীমিত পরিসরে, ছিল না কোন প্রচার ও বিজ্ঞাপনের লাগামহীন প্রতিযোগিতা।
প্রচারেই প্রসার। বাজার ব্যবস্থার এই বর্তমান প্রক্রিয়া হরলিক্সকে নিয়ে এসেছে বহুমাত্রিক অবস্থানে। যার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ভোক্তাদের করছে একধরনের মোহাচ্ছন্ন।
শুধুমাত্র হরলিক্সই নয়, এ ধরনের আরো বেশ কয়েকটি পণ্য আছে যা আমাদের বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এন্তার আমদানি হচ্ছে সবাই কর্তৃপক্ষের নাকে রশি লাগিয়ে।
আপেল, আঙুর, কমলা আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু হরলিক্সের মতো অপ্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী পথ্যের অজুহাতে। জানি না, এ প্রসঙ্গে আমাদের নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি কী! তবে বোঝা যাচ্ছে, জেগে ঘুমানোর মতো আচ্ছন্নতায় কালাতিপাত করছেন তারা।
আজকাল ওষুধ-বাণিজ্যেও এসেছে বড় বড় কোম্পানিগুলোর অসাধারণ এবং অপ্রতিরোধ্য বিপণন প্রক্রিয়ার প্রতিযোগিতা। এই করোনাকালে প্রত্যেকটি ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধ প্রশাসন একবারের জন্যও ভোক্তাদের জানান দেয়নি কোন ওষুধের দাম কত বাড়ল এবং কেন বাড়ল। ওষুধের মূল্য নির্ধারণে ওষুধ প্রশাসনের একটা ভূমিকা থাকে। বলতেই হয়, আমাদের ওষুধ প্রশাসন ভোক্তা-বান্ধব নয়। তারা একেবারেই ওষুধ কোম্পানি-বান্ধব।
কোথাও কোনো লাগাম নেই। প্রয়োজনীয় কর্তৃপক্ষ অজুহাত দেখাচ্ছে করোনা-সংকট ও যুদ্ধভীতির বিষয়। আমাদের বণিক সমিতিসমূহ ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো একেবারেই নির্বিকার, মনে হচ্ছে তাদের অবস্থান ব্যবসায়ীবান্ধব। কোন অবস্থাতেই তাদের অবস্থান জনহিতকর নয়।
দুই-একটি সামাজিক সংগঠন কালে-ভদ্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দেন কিন্তু তাতে এমন কোন দিক-নির্দেশনা থাকে না, যা মূল্যবৃদ্ধির লাগামহীন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনার সহায়ক হতে পারে।
রাজনীতি যারা করেন, তাদের রুটিন ওয়ার্ক হলো- সরকারকে দায়ী করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মিটিং, মিছিল কিংবা পথসভা করা। একই ধারাবাহিকতায় যারা ক্ষমতায় আছেন তারাও প্রয়োজন মোতাবেক মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার হুংকার-ঝংকার দিয়ে থাকেন। কোন কিছুতেই সুফল আসে না। কোন দ্রব্যের মূল্য একবার বাড়লে তা আর কমে না। এ যেন এক ম্যাজিকবিশেষ যা জনসাধারণকে সময়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে এক অর্থনৈতিক নির্যাতনে ঠেসে ধরার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
জানি করোনার আক্রমণে আমরা বিধ্বস্ত। এটাও জানি রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ সারাবিশে^র অর্থনীতিকে স্থবির করে ফেলেছে। পাশাপাশি স্বীকার করতেই হয়, পরিস্থিতি সামাল দিতে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের আয় সংকুচিত হয়েছে। তাদের বাঁচার পথ কি? উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং সংকট অনেক জিনিসের ঘাটতিতে এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে; কিন্তু সব পণ্যের বেলায় তা সঠিক নয়।
আমাদের বাঁচতে হবে। আনতে হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। এজন্য প্রয়োজন বাজার-অর্থনীতির ভোক্তাবান্ধব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশল। শুধু সরকার একা নয়, এই কৌশলের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হবে ব্যবসায়ী ও বণিক এবং একইসাথে পরামর্শ নিতে হবে সামাজিক সংগঠন এবং জনবান্ধব বুদ্ধিজীবীদের। নিশ্চয়ই পথ বের হয়ে আসবে। তবে সেই পথ অতিক্রমণের জন্য প্রয়োজন হবে সঠিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]