প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার নৈহাটি মডেল

গৌতম রায়

আরএসএস-বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস জন্মলগ্ন থেকেই আত্মনিবেদিত। তবে তৃণমূলের এই আত্মনিবেদনের চেহারাটা সময়ের নিরিখে বদলায়, মানে তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শিল্পাঞ্চলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন থাকার শেষলগ্ন থেকে যে প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল- তৃণমূল, বামফ্রন্ট পরাজিত হয়ে, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সমস্ত ধরনের ঘোমটা সরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে বিভাজনের রাজনীতির পথে সঙ্ঘ-বিজেপিকে কিভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সাহায্য করছে তা বুঝতে তাদের ‘নৈহাটি মডেলটির’ দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।

নৈহাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র অরবিন্দ রোডে দীপাবলীর সময়ের কালী প্রতিমার, পুজোর পরিচিতি উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভৌগোলিক ব্যাপ্তিকে ছাপিয়ে অনেকদূর বিস্তৃত। দেশভাগের আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৈহাটির একটা বড় গুরুত্ব ছিল। তারও আগে পণ্য আর মানুষ যাতায়াতের ক্ষেত্রে নৈহাটি-ভাটপাড়ার সীমা নির্ধারণকারী মুক্তারপুর খালের অসামান্য ভূমিকার কথা সমরেশ বসু তার ‘গঙ্গা’ উপন্যাসে অমরগাথায় গেঁথে রেখেছেন। তার ‘জগদ্দলেও’ এই খালের উল্লেখ আছে। পাটকলের বিস্তারের ইতিহাসের সঙ্গে এই খালের নাড়ির যোগ। রেলপথ পাতার ফলে সেই যুগে জলপথে পরিবহনের কতখানি ক্ষতি হয়েছিল, তা এই মুক্তারপুর খালকে কেন্দ্র করে সমরেশ দেখিয়ে গিয়েছেন।

রেলপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৈহাটি যখন গমগম করত, সেই সময়ে এই অরবিন্দ রোডে, প্রায় গঙ্গার কাছের ধর্মশালাটির ও যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। পূর্বরেল তাদের প্রথম প্রচার পুস্তিকায় পালাপার্বণে পূর্ববঙ্গসহ দূর-দূরান্তের মানুষদের নৈহাটিতে গঙ্গা স্নান করতে আসার সময়ে এই ধর্মশালাতে রাত্রিবাসের কথা লিখেছে। আজ ও দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে প্রথম এবঙ্গে এসে সেই ধর্মশালায় রাত্রিযাপন করা কিছু মানুষ জীবিত আছেন।

জাতীয় আন্দোলন যখন তুঙ্গে, যুব সমাজের ভিতরে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর তাগিদ যখন যখন তীব্র, তখন ই একটা বড় অংশের যুবকেরা সেই তাগিদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে জুড়ে দেওয়ার বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময়কালের যে প্রবণতা ছিল, তাকে আবার নতুন করে সংযুক্ত করলেন। সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তাধারার সঙ্গে উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ভাবনা সংযুক্ত হয়ে পড়ল। যে সংযোগের আভাস পেয়েই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে একদম সরিয়ে নিলেন রবীন্দ্রনাথ।

হিন্দু পুনরুত্থানবাদকে নবোউন্মোচিত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশেল ঘটানোর ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের যত না ভূমিকা এবং অবদান ছিল, তার অনুগামীরা ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের ভিতর দিয়ে সে ভাবনাকে একটা বিভাজনের সুতিকাগার হিসেবেই নির্মাণ করলেন। বঙ্কিমের জন্ম শহর নৈহাটিতে যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের ভিতরে তাই বিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা আর হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চেতনা, যার গহীনে রয়েছে সমন্বয়বাদী ভারতকে অগ্রাহ্য করবার কুমতলব, তা ক্রমেই তীব্র হতে থাকল। ভাটপাড়ার বর্ণাশ্রমের তীব্র সমর্থনবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ আশপাশের যুব সম্প্রদায়ের ভিতরেও জাতপাতের প্রাবল্য, মুসলমান বিদ্বেষ- এগুলোকেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভিতর দিয়ে সীমাবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী একটা মানসিকতা তৈরি করতে চাইল। সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফের’ অমূল্য চরিত্রটির ভিতর দিয়েই খুব সহজে বুঝতে পারা যায় যে, গোটা বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কি করে একদিকে চটকলকে কেন্দ্র করে উঠে আসা শ্রমিক আন্দোলনগুলোকে প্রতিহত করতে ব্রিটিশ বিরোধিতার ভেতর দিয়ে, ব্রিটিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করছিল।

নৈহাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র অরবিন্দ রোডে শান্তিপুরের রাসের বড় বড় মডেলের আদলে এক এক করে কালী পুজোর প্রচলন, একেকটি পুজোকে কেন্দ্র করে ওই ‘শ্রীমতী কাফের’ চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু চরিত্র ‘অমূল্যদেরই’ অঙ্গুলি হেলনের ফলশ্রুতি। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী যে ধাঁচে বিপ্লবী আন্দোলন এই অঞ্চলে শুরু করেছিলেন, তার থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাশ্রয়ী ভাবটিকে ছেঁটে ফেলে চটকল এবং সেই সময়ের অনুসারী ছোট ছোট শিল্পের শ্রমিকদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষাকারী আন্দোলন তখন এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে গড় উঠছে নিত্যানন্দ চৌধুরী, গোপাল বসুদের নেতৃত্বে।

ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ, যে সমাজকে এপথ দিয়ে ভ্রমণকালেই শ্রীচৈতন্য ‘পাষন্ডী’ আখ্যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তারা সচেষ্ট থেকেছেন, যাতে কোনোরকম প্রগতিশীল চিন্তা এই তল্লাটে দানা বাঁধতে না পারে। আরএসএসের সেই সময়ের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন ‘রামরাজ্য পরিষদের’ নেতৃত্বভার ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ্যসমাজের একটা অংশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পিছনে প্রধান অঙ্গুলি হেলন কাজ করেছিল শ্যামাপ্রসাদের। এই রামরাজ্য পরিষদের হয়ে যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেই শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কিভাবে পোষ্য সমাজবিরোধীদের দিয়ে প্রগতিশীল যুবকদের আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মোৎসবের ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছিলেন, অধ্যাপিকা ঈশিতা চট্টোপাধ্যায় তার অনুপুঙ্খ বিবরণ বেশ কিছুকাল আগে ‘মার্কসবাদী পথে’ লিখেছিলেন।

জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে একাংশের যুবকদের ভিতরে এ অঞ্চলে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা ছিল জাগ্রত শ্রমিক চেতনাবিরোধী সমস্ত শক্তির একটা রাজনৈতিক কাজ। সেই কাজে ব্রিটিশের প্রশাসনের যেমন ইন্ধন ছিল, ছিল সেকালের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের একটা বড় অংশের ভূমিকা, আর ছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের ভূমিকা ভাটপাড়াকে কেন্দ্র করে যে বর্ণাশ্রমবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল, ভাটপাড়ার অদূরবর্তী হালিশহরে কিন্তু সেই ধারায় ব্রাহ্মণ্যবাদ বিকাশ লাভ করেনি। দর্শন চর্চায় হালিসহর অঞ্চলের ব্রাহ্মণ সমাজ ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ সমাজের মতো কেবলমাত্র স্মৃতিনির্ভর চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফলে গুপ্তিপাড়া থেকে নবদ্বীপ, দর্শন চর্চার যে উদার, মানবিক ধারার প্রচলন ছিল, যা হুগলিকে কেন্দ্র করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইংরেজি শিক্ষার ধারাকে এ অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতিকে কিছুটা ভিন্নধারায় প্রবাহিত করবার চেষ্টা করেছিল। সেই ভিন্নধারার প্রবাহমানতার পরিচয় আমরা পাই শ্রমিক নেত্রী সন্তোষকুমারী গুপ্তার মাধ্যমে। সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফেতে’ সন্তোষকুমারীর এ অঞ্চলে ‘অমূল্যদের’ সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছবি আমরা পাই ‘সন্তোষ মাসি মা’ চরিত্রটির মধ্যে। আর হালিশহর অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদে ও যে নবজাগরণের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, দৈত্যকুলে যে ‘প্রহ্লাদের’ জন্ম হতে শুরু করেছে, তার ও পরিচয় আমরা পাই সমরেশ বসুরই অসামান্য সামাজিক আখ্যান’ ভানুমতীর ভিতর দিয়ে।

নানা ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করেও সামাজিক জীবনে ঐক্য বজায় রেখে শ্রমিকের অধিকারকে যখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গরিবগুর্বো, খেটেখাওয়া মানুষের মনে জাগানোর চেষ্টা করছে সমরেশের ‘গঙ্গা বাড়িউলিরা’ তখনই কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে শক্তি আরাধনার সংমিশ্রণ তৈরি করে চটকল অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য; সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষক-খেটেখাওয়া মানুষের ঐক্যকে বানচাল করতে আসরে নেমে পড়েছে- রামরাজ্য পরিষদ থেকে হিন্দু মহাসভা, স্বাধীনতার পর যতদিন শ্যামাপ্রসাদ জীবিত ছিলেন, তার ঘনিষ্ঠ অতুল্যচরণ দে, যিনি শ্যামাপ্রসাদের শেষ কাশ্মীর যাত্রা কালে, তার দিল্লি পর্যন্ত সঙ্গী হয়েছিলেন, তিনি নানা সহকর্মী জুটিয়ে সামাজিক কর্মকান্ডের নাম করে ধর্মের নামে উগ্রতাকে শক্তি জোগাতে নানাভাবে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

এই সম্মিলিত ধারাটি কালী পুজোকে কেন্দ্র করে নৈহাটিতে উৎসবের নামে এমন একটা পরিবেশ ধীরে ধীরে তৈরি করেছিল যে, পুজোর সময়কালে উৎসব পালনের আতিশয্যে নাগরিক জীবন বিড়ম্বিত হয়ে পড়ত। কোনো মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য ওই সময়কালের সন্ধ্যাবেলাগুলো ওষুধ সংগ্রহই কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। ক্রমশ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা লোকজনের একটা অংশ এক একটা কালী পুজোর মধ্যমণি হয়ে উঠত। এই ধারাটিতে লাগাম পড়ানোর ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের শাসনকালে স্থানীয় নেতৃত্ব ও যে খুব একটা নজর দিয়েছিলেন, কোনো অবস্থাতেই এই দাবি করা যাবে না।

এই রকম একটা পটভূমিকায় জনপ্রিয় ‘ভবেশ কালীকে’ একদম সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ফিল্মের আদলে মেলে ধরতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস। বাম জামানার শেষদিক থেকে তাদের এই উদ্যোগ শুরু হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব কিছুটা আড়াল রেখে নিজেদের বশংবদ লোকেদের দ্বারা এই পুজোটিকে একেবারে কব্জা করে। অতীতে দীপাবলীর সময়ে কয়েকদিন এই পুজোটি চলত। তৃণমূল ক্ষমতায় আসবার পরে পূর্বোল্লিখিত ধর্মশালাটিকে, সেটির মালিকদের পারিবারিক সংঘাত কে কাজে লাগিয়ে, ভবেশ কালীর পরিবর্তিত নাম বড়মার নামে কার্যত দখল করা হয়। ধর্মশালাটির নতুন নামকরণ হয় ‘বড়মা নিবাস’। সেখানে নিয়মিত পূজার্চনার ভিতর দিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে, মানুষের ভাবাবেগকে একটা খাতে প্রবাহিত করবার চেষ্টা চলতেই থাকে। বিপুল অর্থ খরচ করে ওই দখলিকৃত জমিতে ‘বড়মার’ মন্দির তৈরি হচ্ছে। চেষ্টা চলছে দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার। শোনা যাচ্ছে, আইন বাঁচাতে একটা ছোট ধর্মশালাও নাকি সেখানে থাকবে। যদিও তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পৌর উদ্যোগে যেসব যাত্রী নিবাস তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোতে ঘটা কর্মকান্ড ঘিরে স্থানীয় মানুষদের আপত্তির ফলে, সেগুলোর কয়েকটা নাকি বন্ধ রয়েছে।

সর্বোপরি ঐতিহ্যমন্ডিত নৈহাটি ফেরিঘাট, যে ঘাট দিয়ে ছাত্রজীবনে এবং পেশাজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র নদী পারাপার করতেন, সেই ঘাটটি নাকি এই বড়মার নামে নামাঙ্কিত করবার প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। নৈহাটির একাংশে হিন্দু আধিপত্য থাকলেও বৃহত্তর নৈহাটিতে বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলমান বহুলাংশে আছে। সর্বজনমান্য সূফী সাধক ‘চশমা বাবা’ এ অঞ্চলে বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বামফ্রন্টের শাসনকালে তার একটি ছবি নৈহাটির অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে নৈহাটি থানার আইসির ঘরে স্থাপন করা হয়েছিল।

সম্প্রীতির শহর নৈহাটিতে ঐতিহ্যমন্ডিত নৈহাটি ফেরিঘাট নতুন করে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘দেবীর’ নামে রাখা বা রাখার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের সম্প্রীতির পরিবেশকে বিনষ্ট করবার একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত। রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হঠাৎ করে ঐতিহ্যমন্ডিত, ঐতিহাসিক নৈহাটি ফেরিঘাট, একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেবীর নামে নামকরণের উদ্যোগ এ অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বিনষ্ট করবার ষড়যন্ত্র। এভাবেই তৃণমূল মুসলমান সমাজের ভাবাবেগে আঘাত করে, তাদের ক্ষেপিয়ে তুলে একটা সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিবেশ তৈরি করতে চায়; যার সুফল আগামী দিনে শুধু বারাকপুর শিল্পাঞ্চলেই নয়, গোটা রাজ্যেই ভোগ করবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

image

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ঐতিহাসিক নৈহাটি ফেরিঘাট

আরও খবর
কে কিভাবে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানবে?

শনিবার, ১৮ মার্চ ২০২৩ , ০৪ চৈত্র ১৪২৯, ২৫ শবান ১৪৪৪

প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার নৈহাটি মডেল

গৌতম রায়

image

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ঐতিহাসিক নৈহাটি ফেরিঘাট

আরএসএস-বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস জন্মলগ্ন থেকেই আত্মনিবেদিত। তবে তৃণমূলের এই আত্মনিবেদনের চেহারাটা সময়ের নিরিখে বদলায়, মানে তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শিল্পাঞ্চলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন থাকার শেষলগ্ন থেকে যে প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল- তৃণমূল, বামফ্রন্ট পরাজিত হয়ে, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সমস্ত ধরনের ঘোমটা সরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে বিভাজনের রাজনীতির পথে সঙ্ঘ-বিজেপিকে কিভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সাহায্য করছে তা বুঝতে তাদের ‘নৈহাটি মডেলটির’ দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।

নৈহাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র অরবিন্দ রোডে দীপাবলীর সময়ের কালী প্রতিমার, পুজোর পরিচিতি উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভৌগোলিক ব্যাপ্তিকে ছাপিয়ে অনেকদূর বিস্তৃত। দেশভাগের আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৈহাটির একটা বড় গুরুত্ব ছিল। তারও আগে পণ্য আর মানুষ যাতায়াতের ক্ষেত্রে নৈহাটি-ভাটপাড়ার সীমা নির্ধারণকারী মুক্তারপুর খালের অসামান্য ভূমিকার কথা সমরেশ বসু তার ‘গঙ্গা’ উপন্যাসে অমরগাথায় গেঁথে রেখেছেন। তার ‘জগদ্দলেও’ এই খালের উল্লেখ আছে। পাটকলের বিস্তারের ইতিহাসের সঙ্গে এই খালের নাড়ির যোগ। রেলপথ পাতার ফলে সেই যুগে জলপথে পরিবহনের কতখানি ক্ষতি হয়েছিল, তা এই মুক্তারপুর খালকে কেন্দ্র করে সমরেশ দেখিয়ে গিয়েছেন।

রেলপথে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৈহাটি যখন গমগম করত, সেই সময়ে এই অরবিন্দ রোডে, প্রায় গঙ্গার কাছের ধর্মশালাটির ও যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। পূর্বরেল তাদের প্রথম প্রচার পুস্তিকায় পালাপার্বণে পূর্ববঙ্গসহ দূর-দূরান্তের মানুষদের নৈহাটিতে গঙ্গা স্নান করতে আসার সময়ে এই ধর্মশালাতে রাত্রিবাসের কথা লিখেছে। আজ ও দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে প্রথম এবঙ্গে এসে সেই ধর্মশালায় রাত্রিযাপন করা কিছু মানুষ জীবিত আছেন।

জাতীয় আন্দোলন যখন তুঙ্গে, যুব সমাজের ভিতরে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানোর তাগিদ যখন যখন তীব্র, তখন ই একটা বড় অংশের যুবকেরা সেই তাগিদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে জুড়ে দেওয়ার বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময়কালের যে প্রবণতা ছিল, তাকে আবার নতুন করে সংযুক্ত করলেন। সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তাধারার সঙ্গে উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ভাবনা সংযুক্ত হয়ে পড়ল। যে সংযোগের আভাস পেয়েই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে একদম সরিয়ে নিলেন রবীন্দ্রনাথ।

হিন্দু পুনরুত্থানবাদকে নবোউন্মোচিত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশেল ঘটানোর ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের যত না ভূমিকা এবং অবদান ছিল, তার অনুগামীরা ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের ভিতর দিয়ে সে ভাবনাকে একটা বিভাজনের সুতিকাগার হিসেবেই নির্মাণ করলেন। বঙ্কিমের জন্ম শহর নৈহাটিতে যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের ভিতরে তাই বিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা আর হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চেতনা, যার গহীনে রয়েছে সমন্বয়বাদী ভারতকে অগ্রাহ্য করবার কুমতলব, তা ক্রমেই তীব্র হতে থাকল। ভাটপাড়ার বর্ণাশ্রমের তীব্র সমর্থনবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ আশপাশের যুব সম্প্রদায়ের ভিতরেও জাতপাতের প্রাবল্য, মুসলমান বিদ্বেষ- এগুলোকেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভিতর দিয়ে সীমাবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী একটা মানসিকতা তৈরি করতে চাইল। সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফের’ অমূল্য চরিত্রটির ভিতর দিয়েই খুব সহজে বুঝতে পারা যায় যে, গোটা বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কি করে একদিকে চটকলকে কেন্দ্র করে উঠে আসা শ্রমিক আন্দোলনগুলোকে প্রতিহত করতে ব্রিটিশ বিরোধিতার ভেতর দিয়ে, ব্রিটিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করছিল।

নৈহাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র অরবিন্দ রোডে শান্তিপুরের রাসের বড় বড় মডেলের আদলে এক এক করে কালী পুজোর প্রচলন, একেকটি পুজোকে কেন্দ্র করে ওই ‘শ্রীমতী কাফের’ চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু চরিত্র ‘অমূল্যদেরই’ অঙ্গুলি হেলনের ফলশ্রুতি। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী যে ধাঁচে বিপ্লবী আন্দোলন এই অঞ্চলে শুরু করেছিলেন, তার থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাশ্রয়ী ভাবটিকে ছেঁটে ফেলে চটকল এবং সেই সময়ের অনুসারী ছোট ছোট শিল্পের শ্রমিকদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষাকারী আন্দোলন তখন এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে গড় উঠছে নিত্যানন্দ চৌধুরী, গোপাল বসুদের নেতৃত্বে।

ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ, যে সমাজকে এপথ দিয়ে ভ্রমণকালেই শ্রীচৈতন্য ‘পাষন্ডী’ আখ্যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তারা সচেষ্ট থেকেছেন, যাতে কোনোরকম প্রগতিশীল চিন্তা এই তল্লাটে দানা বাঁধতে না পারে। আরএসএসের সেই সময়ের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন ‘রামরাজ্য পরিষদের’ নেতৃত্বভার ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ্যসমাজের একটা অংশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পিছনে প্রধান অঙ্গুলি হেলন কাজ করেছিল শ্যামাপ্রসাদের। এই রামরাজ্য পরিষদের হয়ে যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেই শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কিভাবে পোষ্য সমাজবিরোধীদের দিয়ে প্রগতিশীল যুবকদের আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মোৎসবের ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছিলেন, অধ্যাপিকা ঈশিতা চট্টোপাধ্যায় তার অনুপুঙ্খ বিবরণ বেশ কিছুকাল আগে ‘মার্কসবাদী পথে’ লিখেছিলেন।

জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে একাংশের যুবকদের ভিতরে এ অঞ্চলে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা ছিল জাগ্রত শ্রমিক চেতনাবিরোধী সমস্ত শক্তির একটা রাজনৈতিক কাজ। সেই কাজে ব্রিটিশের প্রশাসনের যেমন ইন্ধন ছিল, ছিল সেকালের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের একটা বড় অংশের ভূমিকা, আর ছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের ভূমিকা ভাটপাড়াকে কেন্দ্র করে যে বর্ণাশ্রমবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল, ভাটপাড়ার অদূরবর্তী হালিশহরে কিন্তু সেই ধারায় ব্রাহ্মণ্যবাদ বিকাশ লাভ করেনি। দর্শন চর্চায় হালিসহর অঞ্চলের ব্রাহ্মণ সমাজ ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ সমাজের মতো কেবলমাত্র স্মৃতিনির্ভর চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফলে গুপ্তিপাড়া থেকে নবদ্বীপ, দর্শন চর্চার যে উদার, মানবিক ধারার প্রচলন ছিল, যা হুগলিকে কেন্দ্র করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইংরেজি শিক্ষার ধারাকে এ অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতিকে কিছুটা ভিন্নধারায় প্রবাহিত করবার চেষ্টা করেছিল। সেই ভিন্নধারার প্রবাহমানতার পরিচয় আমরা পাই শ্রমিক নেত্রী সন্তোষকুমারী গুপ্তার মাধ্যমে। সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফেতে’ সন্তোষকুমারীর এ অঞ্চলে ‘অমূল্যদের’ সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছবি আমরা পাই ‘সন্তোষ মাসি মা’ চরিত্রটির মধ্যে। আর হালিশহর অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদে ও যে নবজাগরণের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, দৈত্যকুলে যে ‘প্রহ্লাদের’ জন্ম হতে শুরু করেছে, তার ও পরিচয় আমরা পাই সমরেশ বসুরই অসামান্য সামাজিক আখ্যান’ ভানুমতীর ভিতর দিয়ে।

নানা ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করেও সামাজিক জীবনে ঐক্য বজায় রেখে শ্রমিকের অধিকারকে যখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গরিবগুর্বো, খেটেখাওয়া মানুষের মনে জাগানোর চেষ্টা করছে সমরেশের ‘গঙ্গা বাড়িউলিরা’ তখনই কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে শক্তি আরাধনার সংমিশ্রণ তৈরি করে চটকল অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য; সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষক-খেটেখাওয়া মানুষের ঐক্যকে বানচাল করতে আসরে নেমে পড়েছে- রামরাজ্য পরিষদ থেকে হিন্দু মহাসভা, স্বাধীনতার পর যতদিন শ্যামাপ্রসাদ জীবিত ছিলেন, তার ঘনিষ্ঠ অতুল্যচরণ দে, যিনি শ্যামাপ্রসাদের শেষ কাশ্মীর যাত্রা কালে, তার দিল্লি পর্যন্ত সঙ্গী হয়েছিলেন, তিনি নানা সহকর্মী জুটিয়ে সামাজিক কর্মকান্ডের নাম করে ধর্মের নামে উগ্রতাকে শক্তি জোগাতে নানাভাবে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

এই সম্মিলিত ধারাটি কালী পুজোকে কেন্দ্র করে নৈহাটিতে উৎসবের নামে এমন একটা পরিবেশ ধীরে ধীরে তৈরি করেছিল যে, পুজোর সময়কালে উৎসব পালনের আতিশয্যে নাগরিক জীবন বিড়ম্বিত হয়ে পড়ত। কোনো মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য ওই সময়কালের সন্ধ্যাবেলাগুলো ওষুধ সংগ্রহই কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। ক্রমশ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা লোকজনের একটা অংশ এক একটা কালী পুজোর মধ্যমণি হয়ে উঠত। এই ধারাটিতে লাগাম পড়ানোর ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের শাসনকালে স্থানীয় নেতৃত্ব ও যে খুব একটা নজর দিয়েছিলেন, কোনো অবস্থাতেই এই দাবি করা যাবে না।

এই রকম একটা পটভূমিকায় জনপ্রিয় ‘ভবেশ কালীকে’ একদম সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ফিল্মের আদলে মেলে ধরতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস। বাম জামানার শেষদিক থেকে তাদের এই উদ্যোগ শুরু হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব কিছুটা আড়াল রেখে নিজেদের বশংবদ লোকেদের দ্বারা এই পুজোটিকে একেবারে কব্জা করে। অতীতে দীপাবলীর সময়ে কয়েকদিন এই পুজোটি চলত। তৃণমূল ক্ষমতায় আসবার পরে পূর্বোল্লিখিত ধর্মশালাটিকে, সেটির মালিকদের পারিবারিক সংঘাত কে কাজে লাগিয়ে, ভবেশ কালীর পরিবর্তিত নাম বড়মার নামে কার্যত দখল করা হয়। ধর্মশালাটির নতুন নামকরণ হয় ‘বড়মা নিবাস’। সেখানে নিয়মিত পূজার্চনার ভিতর দিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে, মানুষের ভাবাবেগকে একটা খাতে প্রবাহিত করবার চেষ্টা চলতেই থাকে। বিপুল অর্থ খরচ করে ওই দখলিকৃত জমিতে ‘বড়মার’ মন্দির তৈরি হচ্ছে। চেষ্টা চলছে দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার। শোনা যাচ্ছে, আইন বাঁচাতে একটা ছোট ধর্মশালাও নাকি সেখানে থাকবে। যদিও তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পৌর উদ্যোগে যেসব যাত্রী নিবাস তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোতে ঘটা কর্মকান্ড ঘিরে স্থানীয় মানুষদের আপত্তির ফলে, সেগুলোর কয়েকটা নাকি বন্ধ রয়েছে।

সর্বোপরি ঐতিহ্যমন্ডিত নৈহাটি ফেরিঘাট, যে ঘাট দিয়ে ছাত্রজীবনে এবং পেশাজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র নদী পারাপার করতেন, সেই ঘাটটি নাকি এই বড়মার নামে নামাঙ্কিত করবার প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। নৈহাটির একাংশে হিন্দু আধিপত্য থাকলেও বৃহত্তর নৈহাটিতে বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলমান বহুলাংশে আছে। সর্বজনমান্য সূফী সাধক ‘চশমা বাবা’ এ অঞ্চলে বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বামফ্রন্টের শাসনকালে তার একটি ছবি নৈহাটির অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে নৈহাটি থানার আইসির ঘরে স্থাপন করা হয়েছিল।

সম্প্রীতির শহর নৈহাটিতে ঐতিহ্যমন্ডিত নৈহাটি ফেরিঘাট নতুন করে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘দেবীর’ নামে রাখা বা রাখার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের সম্প্রীতির পরিবেশকে বিনষ্ট করবার একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত। রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হঠাৎ করে ঐতিহ্যমন্ডিত, ঐতিহাসিক নৈহাটি ফেরিঘাট, একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেবীর নামে নামকরণের উদ্যোগ এ অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বিনষ্ট করবার ষড়যন্ত্র। এভাবেই তৃণমূল মুসলমান সমাজের ভাবাবেগে আঘাত করে, তাদের ক্ষেপিয়ে তুলে একটা সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিবেশ তৈরি করতে চায়; যার সুফল আগামী দিনে শুধু বারাকপুর শিল্পাঞ্চলেই নয়, গোটা রাজ্যেই ভোগ করবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]