নতুন শিক্ষাবর্ষের চার মাস, দুই বই সংশোধনের জটিলতা কাটছে না

নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের জটিলতা সহসাই কাটছে না। নতুন শিক্ষাবর্ষের তিন মাস শেষ হতে গেলেও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর প্রত্যাহার হওয়া দুটি বইয়ের সংশোধনী চূড়ান্ত হয়নি। পুরোদমে কাজ শুরুর আগেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমের ভুল-ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ‘আর্থিক সীমাবদ্ধ’র কারণে এ কমিটিও ঠিকমত কাজ করতে পারছে না।

এছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বই লেখার দায়িত্বে থাকা অন্তত ৫০ জন লেখককে বাদ দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ নানাভাবে ‘প্রভাবশালী’ হওয়ায় তাদের বাদ দিতেও নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ভুল-ভ্রান্তি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গঠিত পুনর্গঠিত কমিটি থেকে আগের কমিটির সদস্য সচিবসহ দুইজন বাদ পড়েছেন। সংশোধিত কমিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ নতুন কমিটিতে এমন তিনজনকে কমিটিতে রাখা হয়েছে যাদের পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজে অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।

কমিটির কার্যক্রমেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম কমিটিকে বলা হয়েছিল তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের অসঙ্গতি, ভুল ও ত্রুটি চিহ্নিত করে সুপারিশ করবে। সংশোধিত কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা দুই শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যেসব মন্তব্য, আপত্তি পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে সেগুলো আমলে নিয়ে পুনরায় পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে।

এদিকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে শিক্ষা প্রশাসন নানা ‘সমালোচনার’র মুখে পড়লেও আগামী শিক্ষাবর্ষে এ কার্যক্রম আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ পরিস্থিতি তড়িঘড়ি করে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের পরিধি বাড়ানো হলে শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘বিতর্ক’ আরও প্রকট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা। এ নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা উদ্বিগ্ন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ একটি সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন, পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন একটি ‘ব্যাপক’ বিষয়। রাজনৈতিক কারণেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর দুটি বিষয়ের বই সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সরকারকে আরও বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। এ কারণে এসব বিষয়ে ‘ভেবে-চিন্তে’ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর কয়েকটি বিষয়ের পাঠ্যবই নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। এরপর বইগুলোর অসঙ্গতি, ভুল ও ত্রুটি চিহ্নিত করে সুপারিশ দেয়ার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।

কিন্তু পুরোদমে কাজ শুরু করার আগেই কমিটি সংশোধন করা হয়। একমাসের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। কমিটি গঠনের ২৫ দিনের মাথায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই কমিটি সংশোধন করা হয়। নতুন কমিটি ৮ সদস্য বিশিষ্ট। এ কমিটিকেও একমাস সময় দেয়া হয়েছে। এ কমিটির হাতে সময় আছে মাত্র এক সপ্তাহের মতো।

কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল হালিম সংবাদকে বলেছেন, কমিটি পরিবর্তনের পাশাপাশি কাজের পরিধিও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কমিটিতে যারা আসছেন তারা পাঠ্যপুস্তক কতটুকু বোঝেন সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এছাড়া আগে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সবকটি বই মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন কমিটিতে শুধু ষষ্ঠ ও সপ্তমের তিন-চারটি বই সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তবে কমিটির কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কোনকিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানান, নানা বিতর্কের কারণে এ বছরের পাঠ্যবইয়ে লেখক তালিকা যাচাই করা হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধশত লেখকের বিষয়ে আপত্তি উঠেছে। এজন্য পাঠ্যবই রচনার কাজ থেকে তাদের বাদ দেয়ার জন্য একমাস আগে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সুপারিশ আটকে রয়েছে।

পাঠ্যবই সংশোধনী কমিটির পক্ষ থেকে তাদের কাজের ‘সম্মানী’ হিসেবে এনসিটিবির কাছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা দাবি করে চিঠি দেয়া হয়েছে। টাকার অঙ্ক একটু বেশি হওয়ায় এনসিটিবি এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে বলে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক ড. আবদুল হালিম বলেন, শিক্ষাক্রম পরীক্ষ-নিরীক্ষার কাজে কমিটির সদস্য ছাড়াও বাইরের অনেক লেখকের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। তাদের সম্মানী দেয়ার জন্যই এনসিটিবির কাছে কিছু টাকা চাওয়া হয়েছে। এ টাকা দেয়ার দায়িত্ব এনসিটিবিরই।

গত ৩১ জানুয়ারি ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে ঢাবির আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিমকে আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) আজিজ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন আইইআরের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান, এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুৎফর রহমান, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশেনের পরিচালকের একজন প্রতিনিধি, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন্নাহার শাহীন।

এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়। ৮ সদস্যের সংশোধিত কমিটিতে আহ্বায়ক ঠিক থাকলেও বাদ দেয়া হয়েছে সদস-সচিব এবং আইইআরের একজন অধ্যাপক। এরমধ্যে সদস-সচিব ও মাউশি কর্মকর্তা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

নতুন কমিটিতে মাউশির উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. মোনালিসা খানকে সদস্য-সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন এনসিটিবির সদস্য লুৎফর রহমান, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের উপসচিব এসএম বশীর উল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশেনের পরিচালক মুহাম্মদ আবদুস সালাম, ঢাকার তেজগাঁওয়ের মদিনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুজির উদ্দিন, দিনাজপুরের ভবানীপুর কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হাসান মাসুদ এবং মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন্নাহার শাহীন।

বিতর্কের মুখে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি প্রত্যাহার করে নেয় এনসিটিবি। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ওই দুটি বইয়ের নাম একই।

এনসিটিবি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। বইগুলোর সংশোধনী ‘শীঘ্রই’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হবে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানিয়েছেন, তিনটি বইয়ের সংশোধনীর কাজ চলমান। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার দেশের প্রায় ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এনসিটিবির কর্মকর্তারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। আগামী ২০, ২১ ও ২২ মার্চ এ নিয়ে কর্মশালা থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হবে।

সবকটি মতামতের ভিত্তিতে ২৭ থেকে ৩১ মার্চ ‘পরিমার্জনের কাজ’ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তারপর সংশোধনী পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যার অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, দুটি বইয়ের সংশোধনীর পরিমাণ বেশি হলে অংশবিশেষ বা ডিউ পার্ট আকারে ছাপিয়ে স্কুল পর্যায়ে দেয়া হবে। সংশোধনী কম হলে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে তা দেয়া হবে। পাশাপাশি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে এবং উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণীতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ , ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ২৬ শবান ১৪৪৪

নতুন শিক্ষাবর্ষের চার মাস, দুই বই সংশোধনের জটিলতা কাটছে না

রাকিব উদ্দিন

নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের জটিলতা সহসাই কাটছে না। নতুন শিক্ষাবর্ষের তিন মাস শেষ হতে গেলেও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর প্রত্যাহার হওয়া দুটি বইয়ের সংশোধনী চূড়ান্ত হয়নি। পুরোদমে কাজ শুরুর আগেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমের ভুল-ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ‘আর্থিক সীমাবদ্ধ’র কারণে এ কমিটিও ঠিকমত কাজ করতে পারছে না।

এছাড়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বই লেখার দায়িত্বে থাকা অন্তত ৫০ জন লেখককে বাদ দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ নানাভাবে ‘প্রভাবশালী’ হওয়ায় তাদের বাদ দিতেও নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ভুল-ভ্রান্তি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গঠিত পুনর্গঠিত কমিটি থেকে আগের কমিটির সদস্য সচিবসহ দুইজন বাদ পড়েছেন। সংশোধিত কমিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ নতুন কমিটিতে এমন তিনজনকে কমিটিতে রাখা হয়েছে যাদের পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজে অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।

কমিটির কার্যক্রমেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম কমিটিকে বলা হয়েছিল তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের অসঙ্গতি, ভুল ও ত্রুটি চিহ্নিত করে সুপারিশ করবে। সংশোধিত কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা দুই শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যেসব মন্তব্য, আপত্তি পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে সেগুলো আমলে নিয়ে পুনরায় পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে।

এদিকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে শিক্ষা প্রশাসন নানা ‘সমালোচনার’র মুখে পড়লেও আগামী শিক্ষাবর্ষে এ কার্যক্রম আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ পরিস্থিতি তড়িঘড়ি করে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের পরিধি বাড়ানো হলে শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘বিতর্ক’ আরও প্রকট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা। এ নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা উদ্বিগ্ন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ একটি সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা সংবাদকে জানিয়েছেন, পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন একটি ‘ব্যাপক’ বিষয়। রাজনৈতিক কারণেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর দুটি বিষয়ের বই সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সরকারকে আরও বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। এ কারণে এসব বিষয়ে ‘ভেবে-চিন্তে’ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর কয়েকটি বিষয়ের পাঠ্যবই নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। এরপর বইগুলোর অসঙ্গতি, ভুল ও ত্রুটি চিহ্নিত করে সুপারিশ দেয়ার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।

কিন্তু পুরোদমে কাজ শুরু করার আগেই কমিটি সংশোধন করা হয়। একমাসের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। কমিটি গঠনের ২৫ দিনের মাথায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই কমিটি সংশোধন করা হয়। নতুন কমিটি ৮ সদস্য বিশিষ্ট। এ কমিটিকেও একমাস সময় দেয়া হয়েছে। এ কমিটির হাতে সময় আছে মাত্র এক সপ্তাহের মতো।

কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল হালিম সংবাদকে বলেছেন, কমিটি পরিবর্তনের পাশাপাশি কাজের পরিধিও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কমিটিতে যারা আসছেন তারা পাঠ্যপুস্তক কতটুকু বোঝেন সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এছাড়া আগে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সবকটি বই মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন কমিটিতে শুধু ষষ্ঠ ও সপ্তমের তিন-চারটি বই সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তবে কমিটির কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কোনকিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানান, নানা বিতর্কের কারণে এ বছরের পাঠ্যবইয়ে লেখক তালিকা যাচাই করা হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধশত লেখকের বিষয়ে আপত্তি উঠেছে। এজন্য পাঠ্যবই রচনার কাজ থেকে তাদের বাদ দেয়ার জন্য একমাস আগে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সুপারিশ আটকে রয়েছে।

পাঠ্যবই সংশোধনী কমিটির পক্ষ থেকে তাদের কাজের ‘সম্মানী’ হিসেবে এনসিটিবির কাছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা দাবি করে চিঠি দেয়া হয়েছে। টাকার অঙ্ক একটু বেশি হওয়ায় এনসিটিবি এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে বলে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক ড. আবদুল হালিম বলেন, শিক্ষাক্রম পরীক্ষ-নিরীক্ষার কাজে কমিটির সদস্য ছাড়াও বাইরের অনেক লেখকের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। তাদের সম্মানী দেয়ার জন্যই এনসিটিবির কাছে কিছু টাকা চাওয়া হয়েছে। এ টাকা দেয়ার দায়িত্ব এনসিটিবিরই।

গত ৩১ জানুয়ারি ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে ঢাবির আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিমকে আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) আজিজ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন আইইআরের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান, এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুৎফর রহমান, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশেনের পরিচালকের একজন প্রতিনিধি, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন্নাহার শাহীন।

এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়। ৮ সদস্যের সংশোধিত কমিটিতে আহ্বায়ক ঠিক থাকলেও বাদ দেয়া হয়েছে সদস-সচিব এবং আইইআরের একজন অধ্যাপক। এরমধ্যে সদস-সচিব ও মাউশি কর্মকর্তা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

নতুন কমিটিতে মাউশির উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. মোনালিসা খানকে সদস্য-সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন এনসিটিবির সদস্য লুৎফর রহমান, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের উপসচিব এসএম বশীর উল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশেনের পরিচালক মুহাম্মদ আবদুস সালাম, ঢাকার তেজগাঁওয়ের মদিনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুজির উদ্দিন, দিনাজপুরের ভবানীপুর কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হাসান মাসুদ এবং মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন্নাহার শাহীন।

বিতর্কের মুখে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুটি প্রত্যাহার করে নেয় এনসিটিবি। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ওই দুটি বইয়ের নাম একই।

এনসিটিবি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। বইগুলোর সংশোধনী ‘শীঘ্রই’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হবে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানিয়েছেন, তিনটি বইয়ের সংশোধনীর কাজ চলমান। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার দেশের প্রায় ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এনসিটিবির কর্মকর্তারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। আগামী ২০, ২১ ও ২২ মার্চ এ নিয়ে কর্মশালা থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হবে।

সবকটি মতামতের ভিত্তিতে ২৭ থেকে ৩১ মার্চ ‘পরিমার্জনের কাজ’ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তারপর সংশোধনী পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যার অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, দুটি বইয়ের সংশোধনীর পরিমাণ বেশি হলে অংশবিশেষ বা ডিউ পার্ট আকারে ছাপিয়ে স্কুল পর্যায়ে দেয়া হবে। সংশোধনী কম হলে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে তা দেয়া হবে। পাশাপাশি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে এবং উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণীতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।