অপহরণ যেন চলচ্চিত্রের গল্প!

কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের পাহাড় কেন্দ্রিক অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের ৬ সদস্যকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৬ মার্চ দুপুরে অপহৃত ৭ জনের মধ্যে ৩ জন সরাসরি অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। যাদের গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উদ্ধার করে পুলিশ।

গতকাল কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা পাহাড়ি এলাকা থেকে ৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর মোহাম্মদ আমির (১১) ও রিফাত উল্লাহ (১২) নামের ২ জনকে ছেড়ে দিলেও জিম্মি রাখা হয়েছিল ৭ জনকে।

পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাকি ৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন জাহাজপুরা গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন (১৭), ফজল করিম (৩৮), জাবেরুল ইসলাম (৩৫), আরিফ উল্লাহ (২২), মোহাম্মদ রশিদ (২৮), মোহাম্মদ জাফর (৩৮) ও মোহাম্মদ জায়নুল ইসলাম (৪৫)।

এ ঘটনায় অপহরণকারী চক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক, মো. সেলিম, আইয়ুব, মুসা, কালু ও নুরুল। যার মধ্যে স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক ও মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এছাড়া এ ঘটনায় অপহৃত গিয়াস উদ্দিন, জয়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ চক্রের সদস্য এবং গিয়াস চৌকিদার ইছাকের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, উদ্ধার-পরবর্তী পাওয়া তথ্যমতে অপহৃত ব্যক্তিরা বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকায় পানের বরজে পানির ব্যবস্থা করতে গেলে ৬ জন লোক এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। যারা শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আটক ছিল। তারপর তারা সবাই মিলে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ৮ ঘণ্টা ধরে ৭ জন পাহাড়ে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকে। পুলিশ তাদের কৌশলে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এই ৭ জনের মধ্যে ৩ জন সরাসরি অপহরণের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন পুলিশ সুপার। তিনি জানান, উদ্ধার হওয়া গিয়াস উদ্দিন, জয়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ কৌশলে তাদের সঙ্গে অপহরণ হয়ে অপহরণকারীদের সহায়তা করেন। এ ৩ জনের কাছে মোবাইল ছিল। যে মোবাইলের মাধ্যমে নিজের পরিবারসহ অন্য ৪ পরিবারের কাছে দফায় দফায় ফোন করে মুক্তিপণের টাকা দিতে বলে। ৭ জনের ৪ জন নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত এবং প্রহারে শিকার হলেও এ ৩ জন কোন ধরনের আঘাতের শিকার হয়নি। এমনকি তাদের জামা-কাপড় সম্পূর্ণ পরিষ্কার রয়েছে। এর মধ্যে গিয়াস উদ্দিনের বাবা স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাকও অপহরণকারী চক্রে জড়িত রয়েছে। এই চৌকিদারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চৌকিদার জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে পুলিশ সুপার জানান, চৌকিদারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন অপহৃত হলেও সে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ ছিল এবং এই সংক্রান্ত কোন সংবাদ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশকে অবহিত করেনি। চৌকিদার নিজেই অপহৃত অন্যদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দ্রুত টাকা দিতে চাপ সৃষ্টি করে। চৌকিদার তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মোবাইল ফোন থেকে সরাসরি অপহরণ চক্রের আইয়ুব নামের একজনকে সহায়তা করে। আইয়ুব এ অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণের টাকা বাহনকারী। এমনকি আইয়ুব নামের ওই ব্যক্তি চৌকিদারের দ্বিতীয় স্ত্রীর মোবাইল ব্যবহার করে টাকা আদা-প্রদানের কাজটি সরাসরি করেন। চৌকিদারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন শুক্রবার সকালে মুক্ত হওয়ার ঘটনাটি জানার পরও গোপন রাখে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে চৌকিদার এ ঘটনা স্বীকারও করেন। তার নেতৃত্বে সাড়ে ৬ লাখ টাকা সংগ্রহ হলে চৌকিদার সন্দেহ দূর করতে নিজেও টাকা প্রদান করেছেন।

পুলিশ সুপার এ ঘটনায় চক্রের অন্য সদস্য মোহাম্মদ সেলিম নামের এক জনকে গ্রেপ্তারের সত্যতা স্বীকার করে জানান, সেলিম অপহৃতদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে জমা রাখেন বাড়িতে। টাকা পৌঁছানোর ১ ঘণ্টা আগেই পাহাড়ে জিম্মি রাখা ৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর অপহৃতদের সেলিম, মুসা, কালু, নুরুল নিজ হেফাজতে নিয়ে আত্মগোপনে থাকবে বলে। যাতে পুলিশ আসল ঘটনা বের করতে না পারে। এমনকি আইয়ুব নামের ব্যক্তিকে কাকে মুক্তিপণের টাকা দিয়েছে এটা কেউ দেখেনি। মো. সেলিম, আইয়ুব, মুসা, কালু ও নুরুল জিম্মি রাখা ৭ জনের জন্য খাবার ক্রয় করে পাহাড়ে আসে এবং আত্মগোপনে রেখে দেয়। পুলিশ অভিযানে তাদের শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, এ অপহরণের নেপথ্যে আর কে কে জড়িত তাদের এবং গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে চিহ্নিত অন্য ৪ জনকেও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় নিয়মিত মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান এসপি।

এছাড়া গত ৬ মাসে টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক ৪১ জনকে নিয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা হলেও ২৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা। যেখানে ২২ জন মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসার তথ্য জানিয়েছিল।

সর্বশেষ গত ৩ মার্চ ২ শিশু অপহরণের ৮ ঘণ্টা পর ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসে। এছাড়া ২১ জানুয়ারি হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়ক পাহাড়ি ঢালার ভেতর থেকে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ , ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ২৬ শবান ১৪৪৪

অপহরণ যেন চলচ্চিত্রের গল্প!

জেলা বার্তা পরিবেশক, কক্সবাজার

কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের পাহাড় কেন্দ্রিক অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের ৬ সদস্যকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৬ মার্চ দুপুরে অপহৃত ৭ জনের মধ্যে ৩ জন সরাসরি অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। যাদের গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উদ্ধার করে পুলিশ।

গতকাল কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা পাহাড়ি এলাকা থেকে ৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর মোহাম্মদ আমির (১১) ও রিফাত উল্লাহ (১২) নামের ২ জনকে ছেড়ে দিলেও জিম্মি রাখা হয়েছিল ৭ জনকে।

পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাকি ৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন জাহাজপুরা গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন (১৭), ফজল করিম (৩৮), জাবেরুল ইসলাম (৩৫), আরিফ উল্লাহ (২২), মোহাম্মদ রশিদ (২৮), মোহাম্মদ জাফর (৩৮) ও মোহাম্মদ জায়নুল ইসলাম (৪৫)।

এ ঘটনায় অপহরণকারী চক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক, মো. সেলিম, আইয়ুব, মুসা, কালু ও নুরুল। যার মধ্যে স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক ও মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এছাড়া এ ঘটনায় অপহৃত গিয়াস উদ্দিন, জয়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ চক্রের সদস্য এবং গিয়াস চৌকিদার ইছাকের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, উদ্ধার-পরবর্তী পাওয়া তথ্যমতে অপহৃত ব্যক্তিরা বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকায় পানের বরজে পানির ব্যবস্থা করতে গেলে ৬ জন লোক এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। যারা শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আটক ছিল। তারপর তারা সবাই মিলে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ৮ ঘণ্টা ধরে ৭ জন পাহাড়ে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকে। পুলিশ তাদের কৌশলে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এই ৭ জনের মধ্যে ৩ জন সরাসরি অপহরণের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন পুলিশ সুপার। তিনি জানান, উদ্ধার হওয়া গিয়াস উদ্দিন, জয়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ কৌশলে তাদের সঙ্গে অপহরণ হয়ে অপহরণকারীদের সহায়তা করেন। এ ৩ জনের কাছে মোবাইল ছিল। যে মোবাইলের মাধ্যমে নিজের পরিবারসহ অন্য ৪ পরিবারের কাছে দফায় দফায় ফোন করে মুক্তিপণের টাকা দিতে বলে। ৭ জনের ৪ জন নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত এবং প্রহারে শিকার হলেও এ ৩ জন কোন ধরনের আঘাতের শিকার হয়নি। এমনকি তাদের জামা-কাপড় সম্পূর্ণ পরিষ্কার রয়েছে। এর মধ্যে গিয়াস উদ্দিনের বাবা স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাকও অপহরণকারী চক্রে জড়িত রয়েছে। এই চৌকিদারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চৌকিদার জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে পুলিশ সুপার জানান, চৌকিদারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন অপহৃত হলেও সে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ ছিল এবং এই সংক্রান্ত কোন সংবাদ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশকে অবহিত করেনি। চৌকিদার নিজেই অপহৃত অন্যদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দ্রুত টাকা দিতে চাপ সৃষ্টি করে। চৌকিদার তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মোবাইল ফোন থেকে সরাসরি অপহরণ চক্রের আইয়ুব নামের একজনকে সহায়তা করে। আইয়ুব এ অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণের টাকা বাহনকারী। এমনকি আইয়ুব নামের ওই ব্যক্তি চৌকিদারের দ্বিতীয় স্ত্রীর মোবাইল ব্যবহার করে টাকা আদা-প্রদানের কাজটি সরাসরি করেন। চৌকিদারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন শুক্রবার সকালে মুক্ত হওয়ার ঘটনাটি জানার পরও গোপন রাখে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে চৌকিদার এ ঘটনা স্বীকারও করেন। তার নেতৃত্বে সাড়ে ৬ লাখ টাকা সংগ্রহ হলে চৌকিদার সন্দেহ দূর করতে নিজেও টাকা প্রদান করেছেন।

পুলিশ সুপার এ ঘটনায় চক্রের অন্য সদস্য মোহাম্মদ সেলিম নামের এক জনকে গ্রেপ্তারের সত্যতা স্বীকার করে জানান, সেলিম অপহৃতদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে জমা রাখেন বাড়িতে। টাকা পৌঁছানোর ১ ঘণ্টা আগেই পাহাড়ে জিম্মি রাখা ৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর অপহৃতদের সেলিম, মুসা, কালু, নুরুল নিজ হেফাজতে নিয়ে আত্মগোপনে থাকবে বলে। যাতে পুলিশ আসল ঘটনা বের করতে না পারে। এমনকি আইয়ুব নামের ব্যক্তিকে কাকে মুক্তিপণের টাকা দিয়েছে এটা কেউ দেখেনি। মো. সেলিম, আইয়ুব, মুসা, কালু ও নুরুল জিম্মি রাখা ৭ জনের জন্য খাবার ক্রয় করে পাহাড়ে আসে এবং আত্মগোপনে রেখে দেয়। পুলিশ অভিযানে তাদের শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, এ অপহরণের নেপথ্যে আর কে কে জড়িত তাদের এবং গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে চিহ্নিত অন্য ৪ জনকেও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় নিয়মিত মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান এসপি।

এছাড়া গত ৬ মাসে টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক ৪১ জনকে নিয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা হলেও ২৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা। যেখানে ২২ জন মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসার তথ্য জানিয়েছিল।

সর্বশেষ গত ৩ মার্চ ২ শিশু অপহরণের ৮ ঘণ্টা পর ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসে। এছাড়া ২১ জানুয়ারি হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়ক পাহাড়ি ঢালার ভেতর থেকে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।