আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে বিতর্ক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

আদানির ঝাড়খন্ড কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়েছে গত ৯ মার্চ, ২০২৩ বৃহস্পতিবার। ২০১৫ সনে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড বা পিডিবি। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশ তার পুরোটাই প্রয়োজনে কিনতে পারবে; এর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ভারতের অংশে ১০৮ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশে ১৩৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং বগুড়ায় একটি ৪০০/২৩০ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় উত্তরবঙ্গে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ হবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য ভারতর বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে ২০১৩ সাল থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে দৈনিক ১০০০ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সূর্যমণি থেকে কুমিল্লা হয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎবিষয়ক ১৬৩ পৃষ্ঠার চুক্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা আলোচনা পর্যালোচনা করছে। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই চুক্তিটি বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য প্রথমে লাভজনক বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই কম লাভজনক’। তারা আরও জানিয়েছে যে, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ ক্রয় করা না হলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু তাদের এই পর্যবেক্ষণ একপেশে, কারণ সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেই ক্যাপাসিটি চার্জ প্রযোজ্য। ক্যাপাসিটি চার্জ শুধু আদানি আদায় করবে না, সবাই বিদ্যুৎকেন্দ্রই আদায় করে থাকে। আদানির বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে ‘ন্যূনতম অফটেক গ্যারান্টি’ রয়েছে; এই গ্যারেন্টির শর্তানুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুতের কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ চাহিদা না থাকলেও কিনতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ যদি এই ৩৪ শতাংশ না কিনে তাহলেও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার খরচ দিতে হবে। এই শর্ত অযৌক্তিক নয়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ না কিনলে আদানি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি ভারতীয় রুপি বিনিয়োগ করবে কেন?

বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তির শর্তের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূলে নেই। চুক্তির সময়ে আদানির মূলধন ব্যয়, ইক্যুইটি রিটার্ন, ঋণের সুদ, অবচয়, চলতি মূলধনের সুদ, আবগারি শুল্ক, পরিষেবা কর, ভ্যাট ইত্যাদি খরচের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুতের দর ও ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে; আর কয়লার দর আন্তর্জাতিক বাজার দরে নির্ধারিত হওয়ার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশ মনে করেছিল, এই শর্ত বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে, কারণ বায়ুদূষণের নিয়ামক কয়লার ব্যবহার ক্রমে কমে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়লার দাম প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচও বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে, বর্ধিত পরিবহন খরচও যোগ হবে বিদ্যুতের দর নির্ধারণে। উপরন্তু আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে উৎপাদন বা বিদ্যুৎ ক্রয় সম্ভব না হলেও বাংলাদেশকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে; কিন্তু পায়রা ও রামপাল চুক্তি মোতাবেক এমন অবস্থায় উভয়পক্ষই একে অপরের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে।

এখন ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত কর মওকুফসহ বিভিন্ন সুবিধাদি হিসেবে নিয়ে বিদ্যুতের দর পুনর্নির্ধারণের প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আদানি গ্রুপের কতগুলো সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় আদানির নিজস্ব কয়লাখনি থেকে গোড্ডা প্ল্যান্টের জন্য কয়লার সরবরাহ করা হবে, ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আদানি পাওয়ার লিমিটেড যে ঋণ নিয়েছে তার সুদের হার অনেক কম, আমদানি করা কয়লা আনলোড হবে আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি বন্দরে, পোর্ট থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত কয়লা পরিবহনের রেললাইনও তাদের। রপ্তানিমুখী বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় আদানি গ্রুপ ভারত সরকার থেকে কর ও শুল্কের রেয়াত ছাড়াও নানাবিধ সুবিধাদি পেয়েছে। ৪২৫ হেক্টর জায়গার ওপর নির্মিত আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভারত সরকার তাদের নীতিমালা সংশোধন করে ২০১৯ সালে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আবগারি শুল্ক, রাষ্ট্রীয় পণ্য ও পরিষেবা করের ক্ষেত্রে আদানির বেশির ভাগ ব্যয় এবং প্রথম ৫ বছরের জন্য আয়করের শতভাগ মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পড়ে যাওয়ায় আদানি পাওয়ার লিমিটেডকে কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে প্রদেয় কর দিতে হবে না, এতে আদানির এক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। তবে চুক্তির সময় এই কর রেয়াত পাওয়ার অগ্রিম সংবাদ কারো কাছে ছিল না।

আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দর বৃদ্ধি এবং পরিবহনের বর্ধিত খরচের কারণে আদানির ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের দর গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিট প্রতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। ছয় বছর আগে করা আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা বা কয়লার দর কমানোর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের ফলাফল নিয়ে কোন পক্ষ থেকে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধাদির ভিত্তিতে বিদ্যুতের দর পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। আদানি পাওয়ার লিমিটেড এখনো বিদ্যুতের দর উল্লেখ করে কোন ইনভয়েস প্রেরণ করেনি, তাই বিদ্যুতের প্রকৃত দর কত হবে তা অজ্ঞাত। তারা দর না কমালে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয় স্থগিত রাখা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমার পর বিদ্যুৎ ক্রয় করা শ্রেয় হবে।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মনস্তাত্ত্বিক বিরোধিতা রয়েছে। এই বিরোধিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের মতো বিরাজমান। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র নাকি অলস পড়ে থাকবে, কারণ অদূর ভবিষ্যতে ব্যবহারের চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প শীঘ্রই উৎপাদনে যাবে। অনেকের ধারণা এত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র এখনো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সরকারের একটা সমন্বয় থাকার কথা।

বাংলাদেশে একশত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সবগুলো অঞ্চলে শিল্প কারখানা স্থাপন করা হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ অফুরন্ত নয়, তাই বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই। এছাড়া অসংখ্য জনবসতি তৈরি হচ্ছে, বিদ্যুতে মেট্রোরেল চলছে, রিকশা-বেবিটেক্সি চলছে, অদূর ভবিষ্যতে প্রায় সবাই মোটরগাড়ি চালাবে। দেশের উন্নয়ন যত বেশি হবে বিদ্যুতের চাহিদা তত বাড়বে।

বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিরোধী দলও অস্বীকার করতে পারছে না। বিরোধী দলের অভিযোগ মেগা প্রকল্পের বিরুদ্ধে নয়, মেগা দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ , ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ২৬ শবান ১৪৪৪

আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে বিতর্ক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র

আদানির ঝাড়খন্ড কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়েছে গত ৯ মার্চ, ২০২৩ বৃহস্পতিবার। ২০১৫ সনে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড বা পিডিবি। কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশ তার পুরোটাই প্রয়োজনে কিনতে পারবে; এর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ভারতের অংশে ১০৮ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশে ১৩৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং বগুড়ায় একটি ৪০০/২৩০ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় উত্তরবঙ্গে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ হবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য ভারতর বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে ২০১৩ সাল থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে দৈনিক ১০০০ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সূর্যমণি থেকে কুমিল্লা হয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎবিষয়ক ১৬৩ পৃষ্ঠার চুক্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা আলোচনা পর্যালোচনা করছে। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই চুক্তিটি বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য প্রথমে লাভজনক বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই কম লাভজনক’। তারা আরও জানিয়েছে যে, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ ক্রয় করা না হলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু তাদের এই পর্যবেক্ষণ একপেশে, কারণ সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেই ক্যাপাসিটি চার্জ প্রযোজ্য। ক্যাপাসিটি চার্জ শুধু আদানি আদায় করবে না, সবাই বিদ্যুৎকেন্দ্রই আদায় করে থাকে। আদানির বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে ‘ন্যূনতম অফটেক গ্যারান্টি’ রয়েছে; এই গ্যারেন্টির শর্তানুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুতের কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ চাহিদা না থাকলেও কিনতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ যদি এই ৩৪ শতাংশ না কিনে তাহলেও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার খরচ দিতে হবে। এই শর্ত অযৌক্তিক নয়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ না কিনলে আদানি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি ভারতীয় রুপি বিনিয়োগ করবে কেন?

বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তির শর্তের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূলে নেই। চুক্তির সময়ে আদানির মূলধন ব্যয়, ইক্যুইটি রিটার্ন, ঋণের সুদ, অবচয়, চলতি মূলধনের সুদ, আবগারি শুল্ক, পরিষেবা কর, ভ্যাট ইত্যাদি খরচের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুতের দর ও ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে; আর কয়লার দর আন্তর্জাতিক বাজার দরে নির্ধারিত হওয়ার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশ মনে করেছিল, এই শর্ত বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে, কারণ বায়ুদূষণের নিয়ামক কয়লার ব্যবহার ক্রমে কমে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়লার দাম প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচও বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে, বর্ধিত পরিবহন খরচও যোগ হবে বিদ্যুতের দর নির্ধারণে। উপরন্তু আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে উৎপাদন বা বিদ্যুৎ ক্রয় সম্ভব না হলেও বাংলাদেশকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে; কিন্তু পায়রা ও রামপাল চুক্তি মোতাবেক এমন অবস্থায় উভয়পক্ষই একে অপরের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে।

এখন ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত কর মওকুফসহ বিভিন্ন সুবিধাদি হিসেবে নিয়ে বিদ্যুতের দর পুনর্নির্ধারণের প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আদানি গ্রুপের কতগুলো সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় আদানির নিজস্ব কয়লাখনি থেকে গোড্ডা প্ল্যান্টের জন্য কয়লার সরবরাহ করা হবে, ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আদানি পাওয়ার লিমিটেড যে ঋণ নিয়েছে তার সুদের হার অনেক কম, আমদানি করা কয়লা আনলোড হবে আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি বন্দরে, পোর্ট থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত কয়লা পরিবহনের রেললাইনও তাদের। রপ্তানিমুখী বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় আদানি গ্রুপ ভারত সরকার থেকে কর ও শুল্কের রেয়াত ছাড়াও নানাবিধ সুবিধাদি পেয়েছে। ৪২৫ হেক্টর জায়গার ওপর নির্মিত আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভারত সরকার তাদের নীতিমালা সংশোধন করে ২০১৯ সালে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আবগারি শুল্ক, রাষ্ট্রীয় পণ্য ও পরিষেবা করের ক্ষেত্রে আদানির বেশির ভাগ ব্যয় এবং প্রথম ৫ বছরের জন্য আয়করের শতভাগ মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পড়ে যাওয়ায় আদানি পাওয়ার লিমিটেডকে কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে প্রদেয় কর দিতে হবে না, এতে আদানির এক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। তবে চুক্তির সময় এই কর রেয়াত পাওয়ার অগ্রিম সংবাদ কারো কাছে ছিল না।

আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দর বৃদ্ধি এবং পরিবহনের বর্ধিত খরচের কারণে আদানির ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের দর গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিট প্রতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। ছয় বছর আগে করা আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা বা কয়লার দর কমানোর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের ফলাফল নিয়ে কোন পক্ষ থেকে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুবিধাদির ভিত্তিতে বিদ্যুতের দর পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। আদানি পাওয়ার লিমিটেড এখনো বিদ্যুতের দর উল্লেখ করে কোন ইনভয়েস প্রেরণ করেনি, তাই বিদ্যুতের প্রকৃত দর কত হবে তা অজ্ঞাত। তারা দর না কমালে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয় স্থগিত রাখা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমার পর বিদ্যুৎ ক্রয় করা শ্রেয় হবে।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মনস্তাত্ত্বিক বিরোধিতা রয়েছে। এই বিরোধিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের মতো বিরাজমান। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র নাকি অলস পড়ে থাকবে, কারণ অদূর ভবিষ্যতে ব্যবহারের চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প শীঘ্রই উৎপাদনে যাবে। অনেকের ধারণা এত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র এখনো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সরকারের একটা সমন্বয় থাকার কথা।

বাংলাদেশে একশত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সবগুলো অঞ্চলে শিল্প কারখানা স্থাপন করা হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ অফুরন্ত নয়, তাই বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই। এছাড়া অসংখ্য জনবসতি তৈরি হচ্ছে, বিদ্যুতে মেট্রোরেল চলছে, রিকশা-বেবিটেক্সি চলছে, অদূর ভবিষ্যতে প্রায় সবাই মোটরগাড়ি চালাবে। দেশের উন্নয়ন যত বেশি হবে বিদ্যুতের চাহিদা তত বাড়বে।

বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিরোধী দলও অস্বীকার করতে পারছে না। বিরোধী দলের অভিযোগ মেগা প্রকল্পের বিরুদ্ধে নয়, মেগা দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]