গাজীপুরের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

মুকুল কুমার মল্লিক

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ বীরত্বের অমলিন গৌরবগাথায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা, শৌর্য-বীর্যে আন্দোলন-সংগ্রামে অবর্তীর্ণ হবার অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী অনন্য এক দৃষ্টান্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে আমাদের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে (বর্তমানে গাজীপুর) সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ হঠাৎ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত করা হলে সমগ্র বাংলাদেশ মিছিলে-স্লোগানে-বিক্ষোভে-মিটিং-এ উত্তাল হয়ে ওঠে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এর ঢেউ এসে লাগে জয়দেবপুরও। আন্দোলন সংগ্রাম আরো বেগবান ও সুগঠিত করতে ২ মার্চ তৎকালীন থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায় এলাকার নেতাদের এক সভায় সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ছিল দুটি শাখা-একটি হাইকমান্ড, অপরটি অ্যাকশন কমিটি।

কমিটি গঠিত হবার পর এলাকায় আন্দোলনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, সমরাস্ত্র কারখানা ও ডিজেল প্ল্যান্টের শ্রমিক-কর্মচারীরাও আন্দোলনে সামিল হয়। এ অবস্থায় ৩ মার্চ জয়দেবপুরের রথখোলার বটতলায় এক প্রতিবাদী সভায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।

মার্চের সেই দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একদিকে যেমন চলছিল অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশাও এটে চলছিল। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা। এমন আশংকা করছিলেন জয়দেবপুর সেনানিবাসে থাকা কিছু বাঙালি অফিসার-সৈনিকও। এ আশঙ্কার কথা তারা গোপনে স্থানীয় কয়েকজন নেতাকে জানিয়েও রেখেছিলেন। তাদের এ আশংকা সত্যে পরিণত হতে দেরি হল না। কারণ কিছুদিন পূর্বে এখানকার সৈন্যদের ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেল বদলিয়ে ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেল দেয়া হয়েছিল। ৩০৩ রাইফেলগুলো জয়দেবপুর অস্ত্রাগারে জমা ছিল। ঢাকার ৫৭ ব্রিগ্রেড সদর দপ্তর থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে অস্ত্রগুলো গুলিসহ ঢাকায় জমা দিতে নির্দেশ এল।

কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক, তাই ব্রিগেড কর্তৃপক্ষকে জানানো হল এমন উত্তপ্তকর পরিস্থিতিতে ঢাকায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়া বিপদজনক হবে। কিন্তু ব্রিগেড কর্তৃপক্ষ এ অজুহাতে মোটেও সন্তুষ্ট হল না। ব্রিগেড থেকে জানানো হল ব্রিগেড কমান্ডার নিজেই রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসবেন। এ অবস্থায় ১৯ মার্চ সকালে বার্তা এল পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব সঙ্গীয় ফোর্সসহ জয়দেবপুর সেনানিবাসে আসছেন এবং সেখানে তিনি মধ্যাহ্নের আহার করবেন। বেলা ১২টার দিকে আবার বার্তা এল পথিমধ্যে অনেকগুলো ব্যারিকেড ভেঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব সঙ্গীয় ফোর্সসহ চান্দনা-চৌরাস্তা পৌঁছেছেন । এরপর বেলা দেড়টার দিকে তিনি রাজবাড়ি সেনানিবাসে উপস্থিত হন। সঙ্গে ছিল ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৭০/৮০ জন অফিসার-সৈনিক। রাজবাড়ি সেনানিবাসে ঢুকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের সতর্কাবস্থা দেখে অস্ত্র নিয়ে যাবার ব্যাপারে কিছু না বলে তাদের পরিকল্পনা বাতিল করেন। এদিকে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা জয়দেবপুর এসেছে খবরটি দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ফলে হাজার হাজার জনতা জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুর। সেদিন ছিল শুক্রবার, হাটের দিন। তাই লোক সমাগম ছিল বেশি। খবর পেয়ে সমরাস্ত্র কারখানা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও ডিজেল প্ল্যান্ট কারখানা থেকেও হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এসে হাজির হয় জয়দেবপুর। এদের প্রত্যেকের হাতে ছিল লাঠি, তীর, ধনুক, বল্লম, ছেনি, কাতরা ইত্যাদি। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কাজী আজিমউদ্দিন আহমদসহ সালাম ও সেকান্দার নামে আরো দুজন ব্যক্তি (সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে) তাদের বন্দুক নিয়ে হাজির হন। উত্তেজিত জনতা সড়কের বিভিন্ন স্থানে ইট-পাথর, গাছের গুড়ি, মাটি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এছাড়া রেলগাড়ির একটি ওয়াগন ও স্লিপার ইত্যাদি দিয়ে রেল লাইনের ওপর ব্যারিকেড দেয়া হয়। প্রতিরোধকামী জনতা কোন ক্রমেই পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র নিয়ে যেতে দেবে না ।

এদিকে সেনানিবাসে বসেই জাহানজেব রাস্তায় ব্যারিকেড দেবার খবর পান। ক্রুদ্ধ জাহানজেব ব্যারিকেড অপসারণ করার জন্য লে. কর্নেল মাসুদকে নির্দেশ দেন। লে. কর্নেল মাসুদ মেজর মইনকে পাঠান স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে ব্যারিকেড অপসারণ করতে।(কেউ কেউ এখানে মেজর শফিউল্যাহর নাম উল্লেখ করেছেন।) মেজর মইন রাস্তায় এসে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন এত বিপুল সংখ্যক জনতাকে বুঝানো বা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। মেজর মইন সেনানিবাসে ফিরে এসব বললে জাহানজেব আরো ক্রুদ্ধ হয়ে বলপ্রয়োগ প্রয়োজনে গুলি করে ব্যারিকেড অপসারণ করতে নির্দেশ দেন। এরপর জাহানজেব সামনে বাঙালি সৈন্য এবং পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। ব্যারিকেডের জন্য এগুতে না পেরে তিনি গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।

কিন্তু লে. কর্নেল মাসুদ ও মেজর মইন জনতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে তারা ‘ফায়ার ফর এ্যাকশন’ না করে ফাঁকা গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। পাঞ্জাবি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করছে মনে করে জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রবল ইট-পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় কাজী আজিমউদ্দিন আহমদ (আরো কেউ হতে পারেন) জনতার অনুরোধে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। ঠিক সে সময় টাঙ্গাইলে রেশন পৌছে দিয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি তিন টনি ট্রাক জয়দেবপুর ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ পাঁচজন বাঙালি সৈন্য ও ড্রাইভার- সহড্রাইভার ছিলেন। তাদের হাতে ছিল ১টি এসএমজি ও ৪টি চাইনিজ রাইফেল। জয়দেবপুর মসজিদের কাছে পৌঁছলে জনতা তাদের গাড়ি থামিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করে তাদের অস্ত্র দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণের অনুরোধ করে।

জনতার মনোভাব বুঝতে পেরে তারা তাদের পোশাক পাল্টিয়ে জনতার অনুরোধে অস্ত্র দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। জনতার মধ্য থেকে বন্দুক এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাল্টা গুলিবর্ষণে পাঞ্জাবি সৈন্যরা হকচকিয়ে যায়। এদিকে এতদিন বাঙালিরা শুধু মার আর গুলি খেয়ে এসেছে কিন্তু পাল্টা প্রতিরোধ বা গুলি করেনি। জয়দেবপুরের বীর জনতাই সেদিন প্রথম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি পাল্টা গুলিবর্ষণ করেছিল। এটাই ছিল স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালিদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনা। জাহানজেবের বাহিনী সেদিন বহু কষ্টে ব্যারিকেড অপসারণ করে জয়দেবপুর বাজারে পৌঁছে এবং ব্রিগেডিয়ার এলাকায় কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। এছাড়া গুলিতে আহত হন অনেকে।

জয়দেবপুরের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনা সেদিনই সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় বিবিসি থেকেও ফলাও করে এ ঘটনা প্রচার করা হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময় জয়দেবপুরের ঘটনা উল্লেখ করেন এবং এই ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানান। তিনি এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দেন। জয়দেবপুরের বীর জনতার সেই প্রতিরোধের ঘটনা সারাদেশে সে সময়ে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। তখন আন্দোলনমুখর বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

[লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক]

রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ , ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ২৬ শবান ১৪৪৪

গাজীপুরের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

মুকুল কুমার মল্লিক

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ বীরত্বের অমলিন গৌরবগাথায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা, শৌর্য-বীর্যে আন্দোলন-সংগ্রামে অবর্তীর্ণ হবার অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী অনন্য এক দৃষ্টান্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে আমাদের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে (বর্তমানে গাজীপুর) সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ হঠাৎ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত করা হলে সমগ্র বাংলাদেশ মিছিলে-স্লোগানে-বিক্ষোভে-মিটিং-এ উত্তাল হয়ে ওঠে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এর ঢেউ এসে লাগে জয়দেবপুরও। আন্দোলন সংগ্রাম আরো বেগবান ও সুগঠিত করতে ২ মার্চ তৎকালীন থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায় এলাকার নেতাদের এক সভায় সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ছিল দুটি শাখা-একটি হাইকমান্ড, অপরটি অ্যাকশন কমিটি।

কমিটি গঠিত হবার পর এলাকায় আন্দোলনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, সমরাস্ত্র কারখানা ও ডিজেল প্ল্যান্টের শ্রমিক-কর্মচারীরাও আন্দোলনে সামিল হয়। এ অবস্থায় ৩ মার্চ জয়দেবপুরের রথখোলার বটতলায় এক প্রতিবাদী সভায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।

মার্চের সেই দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একদিকে যেমন চলছিল অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশাও এটে চলছিল। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা। এমন আশংকা করছিলেন জয়দেবপুর সেনানিবাসে থাকা কিছু বাঙালি অফিসার-সৈনিকও। এ আশঙ্কার কথা তারা গোপনে স্থানীয় কয়েকজন নেতাকে জানিয়েও রেখেছিলেন। তাদের এ আশংকা সত্যে পরিণত হতে দেরি হল না। কারণ কিছুদিন পূর্বে এখানকার সৈন্যদের ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেল বদলিয়ে ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেল দেয়া হয়েছিল। ৩০৩ রাইফেলগুলো জয়দেবপুর অস্ত্রাগারে জমা ছিল। ঢাকার ৫৭ ব্রিগ্রেড সদর দপ্তর থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে অস্ত্রগুলো গুলিসহ ঢাকায় জমা দিতে নির্দেশ এল।

কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক, তাই ব্রিগেড কর্তৃপক্ষকে জানানো হল এমন উত্তপ্তকর পরিস্থিতিতে ঢাকায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়া বিপদজনক হবে। কিন্তু ব্রিগেড কর্তৃপক্ষ এ অজুহাতে মোটেও সন্তুষ্ট হল না। ব্রিগেড থেকে জানানো হল ব্রিগেড কমান্ডার নিজেই রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসবেন। এ অবস্থায় ১৯ মার্চ সকালে বার্তা এল পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব সঙ্গীয় ফোর্সসহ জয়দেবপুর সেনানিবাসে আসছেন এবং সেখানে তিনি মধ্যাহ্নের আহার করবেন। বেলা ১২টার দিকে আবার বার্তা এল পথিমধ্যে অনেকগুলো ব্যারিকেড ভেঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব সঙ্গীয় ফোর্সসহ চান্দনা-চৌরাস্তা পৌঁছেছেন । এরপর বেলা দেড়টার দিকে তিনি রাজবাড়ি সেনানিবাসে উপস্থিত হন। সঙ্গে ছিল ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৭০/৮০ জন অফিসার-সৈনিক। রাজবাড়ি সেনানিবাসে ঢুকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের সতর্কাবস্থা দেখে অস্ত্র নিয়ে যাবার ব্যাপারে কিছু না বলে তাদের পরিকল্পনা বাতিল করেন। এদিকে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা জয়দেবপুর এসেছে খবরটি দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ফলে হাজার হাজার জনতা জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুর। সেদিন ছিল শুক্রবার, হাটের দিন। তাই লোক সমাগম ছিল বেশি। খবর পেয়ে সমরাস্ত্র কারখানা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও ডিজেল প্ল্যান্ট কারখানা থেকেও হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এসে হাজির হয় জয়দেবপুর। এদের প্রত্যেকের হাতে ছিল লাঠি, তীর, ধনুক, বল্লম, ছেনি, কাতরা ইত্যাদি। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কাজী আজিমউদ্দিন আহমদসহ সালাম ও সেকান্দার নামে আরো দুজন ব্যক্তি (সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে) তাদের বন্দুক নিয়ে হাজির হন। উত্তেজিত জনতা সড়কের বিভিন্ন স্থানে ইট-পাথর, গাছের গুড়ি, মাটি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এছাড়া রেলগাড়ির একটি ওয়াগন ও স্লিপার ইত্যাদি দিয়ে রেল লাইনের ওপর ব্যারিকেড দেয়া হয়। প্রতিরোধকামী জনতা কোন ক্রমেই পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র নিয়ে যেতে দেবে না ।

এদিকে সেনানিবাসে বসেই জাহানজেব রাস্তায় ব্যারিকেড দেবার খবর পান। ক্রুদ্ধ জাহানজেব ব্যারিকেড অপসারণ করার জন্য লে. কর্নেল মাসুদকে নির্দেশ দেন। লে. কর্নেল মাসুদ মেজর মইনকে পাঠান স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে ব্যারিকেড অপসারণ করতে।(কেউ কেউ এখানে মেজর শফিউল্যাহর নাম উল্লেখ করেছেন।) মেজর মইন রাস্তায় এসে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন এত বিপুল সংখ্যক জনতাকে বুঝানো বা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। মেজর মইন সেনানিবাসে ফিরে এসব বললে জাহানজেব আরো ক্রুদ্ধ হয়ে বলপ্রয়োগ প্রয়োজনে গুলি করে ব্যারিকেড অপসারণ করতে নির্দেশ দেন। এরপর জাহানজেব সামনে বাঙালি সৈন্য এবং পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। ব্যারিকেডের জন্য এগুতে না পেরে তিনি গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।

কিন্তু লে. কর্নেল মাসুদ ও মেজর মইন জনতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে তারা ‘ফায়ার ফর এ্যাকশন’ না করে ফাঁকা গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। পাঞ্জাবি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করছে মনে করে জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রবল ইট-পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় কাজী আজিমউদ্দিন আহমদ (আরো কেউ হতে পারেন) জনতার অনুরোধে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। ঠিক সে সময় টাঙ্গাইলে রেশন পৌছে দিয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি তিন টনি ট্রাক জয়দেবপুর ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ পাঁচজন বাঙালি সৈন্য ও ড্রাইভার- সহড্রাইভার ছিলেন। তাদের হাতে ছিল ১টি এসএমজি ও ৪টি চাইনিজ রাইফেল। জয়দেবপুর মসজিদের কাছে পৌঁছলে জনতা তাদের গাড়ি থামিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করে তাদের অস্ত্র দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণের অনুরোধ করে।

জনতার মনোভাব বুঝতে পেরে তারা তাদের পোশাক পাল্টিয়ে জনতার অনুরোধে অস্ত্র দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। জনতার মধ্য থেকে বন্দুক এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাল্টা গুলিবর্ষণে পাঞ্জাবি সৈন্যরা হকচকিয়ে যায়। এদিকে এতদিন বাঙালিরা শুধু মার আর গুলি খেয়ে এসেছে কিন্তু পাল্টা প্রতিরোধ বা গুলি করেনি। জয়দেবপুরের বীর জনতাই সেদিন প্রথম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি পাল্টা গুলিবর্ষণ করেছিল। এটাই ছিল স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালিদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনা। জাহানজেবের বাহিনী সেদিন বহু কষ্টে ব্যারিকেড অপসারণ করে জয়দেবপুর বাজারে পৌঁছে এবং ব্রিগেডিয়ার এলাকায় কারফিউ জারির নির্দেশ দেয়। সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। এছাড়া গুলিতে আহত হন অনেকে।

জয়দেবপুরের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনা সেদিনই সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় বিবিসি থেকেও ফলাও করে এ ঘটনা প্রচার করা হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময় জয়দেবপুরের ঘটনা উল্লেখ করেন এবং এই ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানান। তিনি এ ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দেন। জয়দেবপুরের বীর জনতার সেই প্রতিরোধের ঘটনা সারাদেশে সে সময়ে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। তখন আন্দোলনমুখর বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

[লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক]