খাদ্য পর্যটন : নবদিগন্তের হাতছানি

আউয়াল হোসেন আশিক

খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম হলো খাদ্য অন্বেষণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। এটি পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। যেসব খাবার গ্রহণের জন্য পর্যটক নির্দিষ্ট স্থানে ভ্রমণ করে তাকে আপেক্ষিক অর্থে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম বলে। ওয়ার্ল্ড ফুড ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এরিক উলফ খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজমের ওপর লেখার পর ২০০১ সাল থেকে খাদ্য পর্যটন সারা বিশ্বে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম হলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া বা পানীয় পান করার অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার : ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মুঘল খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি, সিক কাবাব, জালি কাবাব, মোগলাই, পরোটা, বড় বাপের পোলা খায়, লাচ্ছি, বাকরখানি ইত্যাদি। রাজশাহীর কলাইরুটি, হাঁসের মাংস, কালাভুনা, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, বগুড়ার দই, খুলনার বিখ্যাত চুই-ঝাল, চিংড়ি, কুমিল্লার রসমালাই, দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পিঠা, ভর্তা, আদিবাসী খাবার, বাঁশকরল, বাঁশ মুরগি রান্না, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, পদ্মার ইলিশ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অঞ্চলভেদে ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার রয়েছে, যে খাবারগুলো পর্যটকদের কাছে পরিচিত। অঞ্চলভেদে খাবারগুলো আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের খাদ্য পর্যটন পাবে এক অনন্য মাত্রা। জাতীয় ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা সম্ভব। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য রেস্টুরেন্ট ও আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলসমূহের মেনু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশে খাবারের যেসব ঐতিহ্যবাহী হোটেলসমূহ রয়েছে সেগুলো প্রদর্শনের আয়োজন করা সম্ভব।

পর্যটন খাতে খাদ্য পর্যটন উন্নতিকরণে রেস্টুরেন্ট এবং হোটেলসমূহের নেটওয়ার্ক সমন্বিত ব্যবহারে আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া খাদ্য পর্যটন বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার, ফুড ব্লগিংয়ের বদৌলতে দেশে অনেক খাবার এখন বিশ্ব দরবারে সুপরিচিত। ওয়ার্ল্ড ফুড ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গন্তব্যের ভ্রমণ সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সমস্ত পর্যটন ব্যয়ের ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ খাদ্য ও পানীয় ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করবে; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের আরও ১০% জিডিপি আয় করা সম্ভব। সুতরাং খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার ব্র্যান্ডিং ও প্রচারের মাধ্যমে পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত কারা সম্ভব হলে, খাদ্য পর্যটন দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

খাদ্য পর্যটন এবং রন্ধনশিল্পীর সম্পর্ক একে অপরের সাথে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। রন্ধন শিল্পী ছাড়া খাদ্য পর্যটন কল্পনাই করা সম্ভব নয়। যিনি রান্না করেন বাংলা ভাষায় তাকে রাঁধুনী, পাঁচক, পাঁচিকা বা বাবুর্চি বলা হয়। বাবুর্চি রান্না করতে খাবারের সব উপকরণ-সমন্বয় করে এবং আলাদা পাত্রে ও আলাদা পদ্ধতিতে খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও রঙের রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন ঘটায়। একজন রন্ধনশিল্পী পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি পর্যটন শিল্পের একজন পেশাজীবী। বাংলাদেশের খাদ্য পর্যটন বিকাশে রন্ধনশিল্পীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ রন্ধনশিল্পীই জানেন না, খাদ্য পর্যটন কী এবং তার পেশা খাদ্য পর্যটনের সাথে কিভাবে জড়িত। আমাদের দেশের নির্দিষ্ট কিছু হোটেল, রেস্টুরেন্ট ছাড়া অধিকাংশ রন্ধনশিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। হয় তারা পৈতৃক সূত্রে রন্ধন শিল্পের সাথে জড়িত, না হয় জীবিকার তাগিদে নতুনভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। অথচ আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রবাসী ইউরোপ আমেরিকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সুনামের সাথে রন্ধন শিল্পে কাজ করছে। খাদ্য পর্যটন এবং দেশীয় রন্ধনশিল্প বিকাশে রন্ধনশিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং দেশীয় রন্ধন ইনস্টিটিউট সময়ের দাবি।

[লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]

আরও খবর

বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩ , ০৮ চৈত্র ১৪২৯, ২৯ শবান ১৪৪৪

খাদ্য পর্যটন : নবদিগন্তের হাতছানি

আউয়াল হোসেন আশিক

খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম হলো খাদ্য অন্বেষণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। এটি পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। যেসব খাবার গ্রহণের জন্য পর্যটক নির্দিষ্ট স্থানে ভ্রমণ করে তাকে আপেক্ষিক অর্থে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম বলে। ওয়ার্ল্ড ফুড ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এরিক উলফ খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজমের ওপর লেখার পর ২০০১ সাল থেকে খাদ্য পর্যটন সারা বিশ্বে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম হলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া বা পানীয় পান করার অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার : ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মুঘল খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি, সিক কাবাব, জালি কাবাব, মোগলাই, পরোটা, বড় বাপের পোলা খায়, লাচ্ছি, বাকরখানি ইত্যাদি। রাজশাহীর কলাইরুটি, হাঁসের মাংস, কালাভুনা, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, বগুড়ার দই, খুলনার বিখ্যাত চুই-ঝাল, চিংড়ি, কুমিল্লার রসমালাই, দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পিঠা, ভর্তা, আদিবাসী খাবার, বাঁশকরল, বাঁশ মুরগি রান্না, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, পদ্মার ইলিশ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অঞ্চলভেদে ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার রয়েছে, যে খাবারগুলো পর্যটকদের কাছে পরিচিত। অঞ্চলভেদে খাবারগুলো আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের খাদ্য পর্যটন পাবে এক অনন্য মাত্রা। জাতীয় ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা সম্ভব। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য রেস্টুরেন্ট ও আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলসমূহের মেনু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশে খাবারের যেসব ঐতিহ্যবাহী হোটেলসমূহ রয়েছে সেগুলো প্রদর্শনের আয়োজন করা সম্ভব।

পর্যটন খাতে খাদ্য পর্যটন উন্নতিকরণে রেস্টুরেন্ট এবং হোটেলসমূহের নেটওয়ার্ক সমন্বিত ব্যবহারে আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া খাদ্য পর্যটন বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার, ফুড ব্লগিংয়ের বদৌলতে দেশে অনেক খাবার এখন বিশ্ব দরবারে সুপরিচিত। ওয়ার্ল্ড ফুড ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গন্তব্যের ভ্রমণ সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সমস্ত পর্যটন ব্যয়ের ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ খাদ্য ও পানীয় ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করবে; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের আরও ১০% জিডিপি আয় করা সম্ভব। সুতরাং খাদ্য পর্যটন বা গ্যাস্ট্রোনমি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার ব্র্যান্ডিং ও প্রচারের মাধ্যমে পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত কারা সম্ভব হলে, খাদ্য পর্যটন দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

খাদ্য পর্যটন এবং রন্ধনশিল্পীর সম্পর্ক একে অপরের সাথে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। রন্ধন শিল্পী ছাড়া খাদ্য পর্যটন কল্পনাই করা সম্ভব নয়। যিনি রান্না করেন বাংলা ভাষায় তাকে রাঁধুনী, পাঁচক, পাঁচিকা বা বাবুর্চি বলা হয়। বাবুর্চি রান্না করতে খাবারের সব উপকরণ-সমন্বয় করে এবং আলাদা পাত্রে ও আলাদা পদ্ধতিতে খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও রঙের রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন ঘটায়। একজন রন্ধনশিল্পী পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি পর্যটন শিল্পের একজন পেশাজীবী। বাংলাদেশের খাদ্য পর্যটন বিকাশে রন্ধনশিল্পীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ রন্ধনশিল্পীই জানেন না, খাদ্য পর্যটন কী এবং তার পেশা খাদ্য পর্যটনের সাথে কিভাবে জড়িত। আমাদের দেশের নির্দিষ্ট কিছু হোটেল, রেস্টুরেন্ট ছাড়া অধিকাংশ রন্ধনশিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। হয় তারা পৈতৃক সূত্রে রন্ধন শিল্পের সাথে জড়িত, না হয় জীবিকার তাগিদে নতুনভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। অথচ আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রবাসী ইউরোপ আমেরিকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সুনামের সাথে রন্ধন শিল্পে কাজ করছে। খাদ্য পর্যটন এবং দেশীয় রন্ধনশিল্প বিকাশে রন্ধনশিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং দেশীয় রন্ধন ইনস্টিটিউট সময়ের দাবি।

[লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]