উত্তাল মার্চ

অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ

সাদেকুর রহমান

১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ছিল বুধবার। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ২৩তম দিন। দেশের সর্বস্তরের পেশাজীবী-কর্মজীবী মানুষ ও সংগঠন বঙ্গবন্ধুর দেয়া কর্মসূচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সমগ্র বাংলা একটি বিস্ফোরণোন্মুখ গ্রেনেডের মতো উত্তপ্ত অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কারো যেন তর সইছিল না।

সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে ওড়ে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’- গান গাইতে গাইতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন।

ভোলা ও বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলস ব্যাটালিয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দ্রুত পৌঁছে যায় সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে। ইয়াহিয়া প্রতিশোধ আগুনে জ্বলে-পুড়ে গোপনে দেশের প্রতিটি সামরিক ছাউনিতে নির্দেশ পাঠায় যে, ‘আর সময় দেয়া যাবে না।’

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে জরুরি মিটিংয়ের কথা বলে টিক্কা খান চট্টগ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীসহ তাদের ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এটা ছিল মূলত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্রের বাঙালি নিধন নীলনকশার কাজ সমাপ্তির পথে। শেষ আঁচড়ের কাজ চলছে ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেইন রাজা ও রাও ফরমান আলী দুটি হেলিকপ্টারে সব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ব্রিগেড কমান্ডারদের নীলনকশা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে বিকেল বেলা ঢাকা ফেরত আসেন।

একাত্তরের এদিন মুক্তিকামী বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।

এর আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে ঢাকার হেয়ার রোডের প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখন্ড রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত। ভুট্টোর সবচেয়ে রহস্যময় মন্তব্যটি ছিল, ‘উই আর মেকিং সাম প্রগ্রেস।’

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনে সমাগত বিভিন্ন মিছিলকারীদের উদ্দেশে প্রায় বিরামহীন ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘শহীদের রক্তের সঙ্গে আমি বেঈমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালায়ে যাবেন।’ তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ সরকারের প্রতি তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।’

ঢাকার বাইরে পাকিস্তানি বাহিনীর এরিয়া কমান্ডাররা হত্যা-মিশন শুরু করে দেয়। ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুলগ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। এতে একশ’ জন নিহত হয় এবং সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়। ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

রংপুর হাসপাতালের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়।

করাচি থেকে ‘এম. ভি. সোয়াত’ নামের একটি জাহাজ আসে। এতে পাঁচ হাজার ৬৩০ টন সমরাস্ত্র আনা হয়। পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা জাহাজটি থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথ রোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে শ্রমিকসহ ২০০ স্বাধীনতাকামী বাঙালি শহীদ হন।

ঢাকার মিরপুরে অবাঙালিরা সাদাপোশাকধারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলি, আন্দোলনরত বাঙালির ওপর নির্যাতন, চরম দুর্ব্যবহার ও পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের চাপের মুখে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সর্বস্তরের বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী কাজ বর্জন করে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ফলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা টিভির সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতারা এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

অন্যদিকে পাকিস্তানিরা গোপনে যোগাযোগ করতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের নেতা খান-এ-সবুর, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা ইউসুফ, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানদের সঙ্গে। এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্রটি রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশজুড়ে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুশমনী শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।

গণহত্যা পরিকল্পনা শেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের সাতজনই ঢাকা ত্যাগ করেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩ , ১০ চৈত্র ১৪২৯, ০১ রমজান ১৪৪৪

উত্তাল মার্চ

অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ

সাদেকুর রহমান

image

১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ছিল বুধবার। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ২৩তম দিন। দেশের সর্বস্তরের পেশাজীবী-কর্মজীবী মানুষ ও সংগঠন বঙ্গবন্ধুর দেয়া কর্মসূচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সমগ্র বাংলা একটি বিস্ফোরণোন্মুখ গ্রেনেডের মতো উত্তপ্ত অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কারো যেন তর সইছিল না।

সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে ওড়ে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’- গান গাইতে গাইতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন।

ভোলা ও বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলস ব্যাটালিয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দ্রুত পৌঁছে যায় সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে। ইয়াহিয়া প্রতিশোধ আগুনে জ্বলে-পুড়ে গোপনে দেশের প্রতিটি সামরিক ছাউনিতে নির্দেশ পাঠায় যে, ‘আর সময় দেয়া যাবে না।’

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে জরুরি মিটিংয়ের কথা বলে টিক্কা খান চট্টগ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীসহ তাদের ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এটা ছিল মূলত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্রের বাঙালি নিধন নীলনকশার কাজ সমাপ্তির পথে। শেষ আঁচড়ের কাজ চলছে ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেইন রাজা ও রাও ফরমান আলী দুটি হেলিকপ্টারে সব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ব্রিগেড কমান্ডারদের নীলনকশা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে বিকেল বেলা ঢাকা ফেরত আসেন।

একাত্তরের এদিন মুক্তিকামী বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।

এর আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে ঢাকার হেয়ার রোডের প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তিনি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা রয়েছে। আমি তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার একটি জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে। আমি পাকিস্তান অখন্ড রাখার জন্য জীবন দান করতে প্রস্তুত। ভুট্টোর সবচেয়ে রহস্যময় মন্তব্যটি ছিল, ‘উই আর মেকিং সাম প্রগ্রেস।’

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনে সমাগত বিভিন্ন মিছিলকারীদের উদ্দেশে প্রায় বিরামহীন ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘শহীদের রক্তের সঙ্গে আমি বেঈমানি করতে পারব না। আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালায়ে যাবেন।’ তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ সরকারের প্রতি তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।’

ঢাকার বাইরে পাকিস্তানি বাহিনীর এরিয়া কমান্ডাররা হত্যা-মিশন শুরু করে দেয়। ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুলগ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। এতে একশ’ জন নিহত হয় এবং সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়। ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

রংপুর হাসপাতালের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়।

করাচি থেকে ‘এম. ভি. সোয়াত’ নামের একটি জাহাজ আসে। এতে পাঁচ হাজার ৬৩০ টন সমরাস্ত্র আনা হয়। পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা জাহাজটি থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথ রোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে শ্রমিকসহ ২০০ স্বাধীনতাকামী বাঙালি শহীদ হন।

ঢাকার মিরপুরে অবাঙালিরা সাদাপোশাকধারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলি, আন্দোলনরত বাঙালির ওপর নির্যাতন, চরম দুর্ব্যবহার ও পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের চাপের মুখে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সর্বস্তরের বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী কাজ বর্জন করে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ফলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা টিভির সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতারা এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

অন্যদিকে পাকিস্তানিরা গোপনে যোগাযোগ করতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের নেতা খান-এ-সবুর, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা ইউসুফ, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানদের সঙ্গে। এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্রটি রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশজুড়ে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুশমনী শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।

গণহত্যা পরিকল্পনা শেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের সাতজনই ঢাকা ত্যাগ করেন।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।