সে রাতের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জেগে উঠে বাঙালির প্রতিরোধের পালা
আজ ২৫ মার্চ; গণহত্যা দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। একাত্তরের এদিনে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। পাকিস্তানি দানবরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যার নীলনকশায় মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধলক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে। পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া সেই নিধনযজ্ঞ চলেছে টানা ৯ মাস। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিরোধ এসেছে। বিস্তৃৃত হয়েছে লাশের স্তূপ।
দফায় দফায় ব্যর্থ হয় বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে নিরপরাধ বাঙালিদের ওপর কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে রাত পৌনে আটটায় তিনি গোপনে বিমানে করাচি পাড়ি জমান। পাক হানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র-নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা করে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে অন্ধকার। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঘিরে ফেলে। অভ্যর্থনা ডেস্কে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন ক্যাপ্টেন লিখে দিল ‘বাইরে বেরুলেই গুলি’। বিদেশি সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। না কারফিউর কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও। সরকারি কোন ঘোষণাও প্রচারিত হয়নি সেদিন। গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে মিছিল-মিটিং-সেøøাগানে মুখরিত ঢাকার প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে এক Cসময়। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা।
রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং এরপর একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এর চারপাশ, ধানমন্ডি, পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাশাপাশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও। আগুন ধরিয়ে দেয় গান পাউডার ছিটিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন এলাকায়।
পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। হত্যা করা হয় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুঁড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষ। নগরজুড়েও রাতভর চলেছে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তা-ব। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুঁড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় ঢাকা। কেঁদে ওঠে শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন কেবলই মুহুর্মুহু গোলার শব্দ আর আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিকে কেবল ধ্বংস আর মর্মন্তুদ আর্তনাদ।
মধ্যরাতেই ঢাকা হয়ে যায় লাশের শহর। দেশের বড় শহরগুলোতেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকসেনারা। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। তবে ট্যাংক আর ভারি মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।
তবে ২৫ মার্চের কালরাতের পর স্বজনের লাশ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জেগে ওঠা বাঙালির প্রতিরোধের পালা শুরু হয় ২৬ মার্চ। গ্রেপ্তারের আগ মূহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শক্রর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
এর আগে ২৫ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এবং পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায়। রাত ৯টার পর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যদিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখ- পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।
এদিকে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এই বার্তা গ্রহণ করে। ঐ সময় চট্টগ্রাম অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।
অন্যদিকে রাত ১টায় পাকবাহিনীর একটি লরি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে চলে আসে। হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। পরে বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তার বাসভবন থেকে বন্দী করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়। পরে তাকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।
শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩ , ১১ চৈত্র ১৪২৯, ০২ রমজান ১৪৪৪
সে রাতের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জেগে উঠে বাঙালির প্রতিরোধের পালা
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
আজ ২৫ মার্চ; গণহত্যা দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। একাত্তরের এদিনে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। পাকিস্তানি দানবরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যার নীলনকশায় মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধলক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে। পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া সেই নিধনযজ্ঞ চলেছে টানা ৯ মাস। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিরোধ এসেছে। বিস্তৃৃত হয়েছে লাশের স্তূপ।
দফায় দফায় ব্যর্থ হয় বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে নিরপরাধ বাঙালিদের ওপর কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে রাত পৌনে আটটায় তিনি গোপনে বিমানে করাচি পাড়ি জমান। পাক হানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র-নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা করে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে অন্ধকার। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঘিরে ফেলে। অভ্যর্থনা ডেস্কে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন ক্যাপ্টেন লিখে দিল ‘বাইরে বেরুলেই গুলি’। বিদেশি সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। না কারফিউর কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও। সরকারি কোন ঘোষণাও প্রচারিত হয়নি সেদিন। গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে মিছিল-মিটিং-সেøøাগানে মুখরিত ঢাকার প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে এক Cসময়। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা।
রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং এরপর একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এর চারপাশ, ধানমন্ডি, পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাশাপাশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও। আগুন ধরিয়ে দেয় গান পাউডার ছিটিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন এলাকায়।
পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। হত্যা করা হয় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুঁড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষ। নগরজুড়েও রাতভর চলেছে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তা-ব। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুঁড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় ঢাকা। কেঁদে ওঠে শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন কেবলই মুহুর্মুহু গোলার শব্দ আর আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিকে কেবল ধ্বংস আর মর্মন্তুদ আর্তনাদ।
মধ্যরাতেই ঢাকা হয়ে যায় লাশের শহর। দেশের বড় শহরগুলোতেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকসেনারা। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। তবে ট্যাংক আর ভারি মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।
তবে ২৫ মার্চের কালরাতের পর স্বজনের লাশ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জেগে ওঠা বাঙালির প্রতিরোধের পালা শুরু হয় ২৬ মার্চ। গ্রেপ্তারের আগ মূহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শক্রর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
এর আগে ২৫ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এবং পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায়। রাত ৯টার পর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যদিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখ- পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।
এদিকে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এই বার্তা গ্রহণ করে। ঐ সময় চট্টগ্রাম অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।
অন্যদিকে রাত ১টায় পাকবাহিনীর একটি লরি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে চলে আসে। হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। পরে বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তার বাসভবন থেকে বন্দী করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়। পরে তাকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।