অরক্ষিত নন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি একটি বিবৃতি, যাতে স্বাক্ষর করেছেন পৃথিবীর বিশিষ্ট ৪০ জন ব্যক্তি। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, সাবেক মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির পুত্র টেড কেনেডি, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন প্রমুখ।

তারা তাদের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতা এবং সমাজসেবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করে দেয়া বিবৃতি বা খোলা চিঠিতে ড. ইউনূসের অবদানকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিয়ে তাকে বিভিন্ন তদন্তের আওতায় এনে হয়রানি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। ইতিহাসে ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া যে ৭ জন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে ড. ইউনূস অন্যতম বলে বিবৃতি দাতারা ড. ইউনূসের গুরুত্ব বোঝার ইঙ্গিত দিয়েছেন শেখ হাসিনাকে।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. ইউনূসের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে সুইডিশ একাডেমি থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তিনি শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুনরায় কী ধরনের স্বীকৃতি চান তা বিশিষ্টজনের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট হয়নি। শুধু ড. ইউনূস নন, পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ী নিজ দেশে এবং দেশের বাইরে নানা কারণে সমালোচিত হয়েছেন। ড. ইউনূসের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের আবদুস সালামকে শুধু ধর্মীয় কারণে নাজেহাল করা হয়েছে। মৃত্যুর পরও নিজ দেশের সরকার ও জনগণের আক্রোশ থেকে রক্ষা পাননি তিনি। তার সমাধির এপিটাফে প্রথমে লেখা ছিল ‘প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী’, পরে পাকিস্তান সরকার ‘মুসলিম’ শব্দটি মুছে ফেলে। জীবিতকালে নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাকে ব্রিটিশ ও ইতালিয়ান নাগরিকত্বের অফার দেয়া হলেও মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবিকে, কবির কবিতাকে এবং সুইডিশ একাডেমিকে আক্রমণ শুরু করা হয়।

শান্তিতে যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের যোগ্যতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বারেক ওবামার শাসনামলে আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কারের জন্য তাকে নির্বাচন করে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত ও গুলি করে হত্যা করার জন্য দায়ী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মায়ানমারের অং সান সূচির নোবেল পুরস্কার ফেরত নেওয়ার আবেদন করেছেন বহুলোক; কারণ রোহিঙ্গা গণহত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। কম্বোডিয়ায় আমেরিকার বোমাবর্ষণ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসনের সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পান।

ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কোন ভূমিকা আমাদের নজরে আসেনি। ক্ষুদ্রঋণ বা অর্থনীতির ওপর তার নোবেল প্রাপ্তি অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতো। ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা গেলেও তিনি কখনো বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিসৌধে যাননি, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে গিয়েছেন বলেও শোনা যায়নি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অথবা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি। ঈদ-পার্বনে গরিবদের সাথে কুশল বিনিময়ের কোন ছবি আজ পর্যন্ত মিডিয়ায় আসেনি। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না, খেলাধুলায় বাংলাদেশের বিজয়ে তাকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি, আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা বন্ধ করা নিয়ে তিনি নীরব থাকেন, সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন না, দেশের বিপদে-আপদে, আনন্দ-উল্লাসে তিনি একজন নির্লিপ্ত ব্যক্তি।

অতি দরিদ্র ও সবচেয়ে বিপদাপন্ন মানুষদের জন্য ড. ইউনূসের অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সম্মানিত মর্মে খোলা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিবৃতির কিছু বক্তব্য এমন- ‘মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম বা গ্রামীণফোন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। বরং তিনি যেসব সংগঠন গড়ে তুলেছেন সেগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং ঢাকায় সাদামাটাভাবে বসবাস করছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো আপনার সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে।’

কথাটি অসত্য নয়, বিগত কয়েক বছর ধরে ড. ইউনূসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম শনাক্ত হচ্ছে। গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা আদালতে বিচারাধীন। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- শ্রমিকদের অর্থ লোপাট, কল্যাণ তহবিলের অর্থ বিতরণ না করে আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর। তাই ড. ইউনূসের সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকা- তদন্ত করার সাথে ড. ইউনুসকে অসম্মান করার প্রশ্নটি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা উত্থাপিত হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন ও তদন্ত করা জরুরি। তদন্ত করে ভুল ও অনিয়ম পেলে তার প্রতিকার করাও জরুরি। ড. ইউনূস শুধু নোবেল বিজয়ী নন, তিনি অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে জড়িত। উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকা- তদন্তে চিহ্নিত অনিয়মের জবাব প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে ড. ইউনূসকেই দিতে হবে, এতে হয়রানি হলেও কিছু করার নেই। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের পাওনা ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধ না করায় মামলা করেছিল, পরে অর্থপ্রদানের দাবি নিয়ে সমঝোতা হলে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এখানে আরেকটি অনুসন্ধানের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে; এই মামলার কর্মচারীদের আইনজীবী এবং মীমাংসায় মধ্যস্থতাকারী ইউসুফ আলী আকন্দকে গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে ১৬ কোটি টাকা ফি দেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই আইনজীবী নাকি অন্যান্য খরচ বাবত আরও ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন। একজন আইনজীবীর ফি বাবত এত বড় অংকের অর্থ দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থ পাচার নিয়েও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুদানের অর্থের উৎস জানতে যুক্তরাষ্ট্র কানাডা জাপানসহ বিশ্বের সাতটি দেশে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। কর সংক্রান্ত বিষয়েও এনবিআর তদন্ত করেছে- এসব তদন্ত হয়রানির পর্যায়ে পড়ে বলে মনে হয় না। তবে তদন্ত করার নামে অহেতুক হয়রানি করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য হয়। সরকার ইচ্ছে করলে যে কোনো লোককে বিভিন্ন অজুহাতে হেনস্তা করতে পারে। প্রতিটি সরকারের আমলে তদন্তের নামে কত সৎ ও কর্মঠ ব্যক্তিকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা হেনস্তা করছে তার হিসাব-নিকাশ করা কঠিন। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন নিরীহ ব্যক্তিরা ঘুষ দিয়ে তদন্তের হয়রানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন, তাদের সমর্থনে ড. ইউনূসের মতো বিবৃতি দেওয়ার মতো কোন লোক খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

মামলা শুধু সরকার করছে না, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে ড. ইউনূসও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ড. ইউনূসের পক্ষে লড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। দুর্ভাগ্য ড. ইউনূসের, তিনি হেরে যান। তিনি দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার জন্য মামলা করেছিলেন। একজন সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা নিয়মিত চাকরি ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত এবং চুক্তিভিত্তিক ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সংসদে পাস করা আইনে ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ড. ইউনূসের বয়স ৭০ বছর পার হওয়ার পর হঠাৎ বিষয়টি সরকারের নজরে আসে, তখন তাকে তড়িঘড়ি করে উক্ত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তাকে উপদেষ্টা পদে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল সরকার, ড. ইউনূস রাজি হননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে জবাব দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ হয়ে যায়। তাই ড. ইউনূস ৭০ বছর পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে অবস্থান করে শুধু তিনি আইনের লঙ্ঘন করেননি, এ লঙ্ঘনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌন সম্মতিও ছিল।

এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের বক্তব্য হচ্ছে- তিনি নিজের পদের জন্য মামলা করেননি, মামলা করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের স্বতন্ত্র মর্যাদা রক্ষা করতে। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ তাকে এমডি পদে বহাল করতে বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার ফোন করা হয়েছে। এতে ধারণা করা যায়, পদটির প্রতি তার একটা লোভও ছিল।

১৯৮১ সালের মার্চ মাসে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘প্রথম শ্রেণীর অফিসার’ পদে যোগদান করে এক বছর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষিঋণ বিভাগে ড. ইউনূসের প্রবর্তিত ‘জোবরা’ প্রকল্প নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি। বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণের আইডিয়াকে একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে তাকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তখন আমার মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের নারীদের আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে ড. ইউনূসের কমিটমেন্ট রয়েছে। পরে মনে হয়েছে, ঘরের বাইরে বিরাজমান বিরাট কর্মক্ষেত্রে নারীদের টেনে এনে অধিকার সচেতন করে তুলেছেন ড. ইউনূস। এছাড়াও ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ গ্রামীণ নারী সমাজের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৮৩ সালে প্রণীত আইনে গ্রামীণ প্রকল্প গ্রামীণ ব্যাংকে উন্নীত হয়। প্রথমদিকে সরকারের অংশ ছিল ৬০ শতাংশ, এখন সরকারের মালিকানা মাত্র ৩ শতাংশ। ড. ইউনূসের প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বারবার তদন্ত হোক, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ঠিক হবে না। সরকারের কর্তৃত্বাধীন কোন প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলেছে- এমন কোন নজির আমাদের কাছে নেই, আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শুধু হোঁচট খেয়ে অকালে মারা যায় না, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি আর ঘুষের আখড়া।

সারা বিশ্বের নামিদামি অসংখ্য লোকের সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বিভিন্ন উদ্যোগে এক সময় সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। দেশ ও জাতির অধিকতর মঙ্গলে তাকে কেন সংশ্লিষ্ট করা গেল না তার গূঢ় রহস্য এখনো অজ্ঞাত। সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সাথে কোন কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হলে তা নিরসনে উক্ত চল্লিশজন বিবৃতিদাতা তাদের বক্তব্য প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ করে পত্রিকায় প্রকাশ না করে সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে পাঠাতে পারতেন। এখানেও রাজনীতির খেলা। এই খেলাটি খেলানো হয়েছে আমেরিকান কৌশলে, যে কৌশলে রাশিয়া প্রলুব্ধ হয়েছিল ইউক্রেন আক্রমণ করতে। তাই এই খেলা ড. ইউনূস এবং শেখ হাসিনার বিরাজমান সম্পর্ককে আরও তলানিতে নামিয়ে দিতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩ , ১১ চৈত্র ১৪২৯, ০২ রমজান ১৪৪৪

অরক্ষিত নন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি একটি বিবৃতি, যাতে স্বাক্ষর করেছেন পৃথিবীর বিশিষ্ট ৪০ জন ব্যক্তি। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, সাবেক মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির পুত্র টেড কেনেডি, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন প্রমুখ।

তারা তাদের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতা এবং সমাজসেবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করে দেয়া বিবৃতি বা খোলা চিঠিতে ড. ইউনূসের অবদানকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিয়ে তাকে বিভিন্ন তদন্তের আওতায় এনে হয়রানি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। ইতিহাসে ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া যে ৭ জন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে ড. ইউনূস অন্যতম বলে বিবৃতি দাতারা ড. ইউনূসের গুরুত্ব বোঝার ইঙ্গিত দিয়েছেন শেখ হাসিনাকে।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় ড. ইউনূসের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে সুইডিশ একাডেমি থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তিনি শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুনরায় কী ধরনের স্বীকৃতি চান তা বিশিষ্টজনের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট হয়নি। শুধু ড. ইউনূস নন, পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ী নিজ দেশে এবং দেশের বাইরে নানা কারণে সমালোচিত হয়েছেন। ড. ইউনূসের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক না হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের আবদুস সালামকে শুধু ধর্মীয় কারণে নাজেহাল করা হয়েছে। মৃত্যুর পরও নিজ দেশের সরকার ও জনগণের আক্রোশ থেকে রক্ষা পাননি তিনি। তার সমাধির এপিটাফে প্রথমে লেখা ছিল ‘প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী’, পরে পাকিস্তান সরকার ‘মুসলিম’ শব্দটি মুছে ফেলে। জীবিতকালে নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাকে ব্রিটিশ ও ইতালিয়ান নাগরিকত্বের অফার দেয়া হলেও মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবিকে, কবির কবিতাকে এবং সুইডিশ একাডেমিকে আক্রমণ শুরু করা হয়।

শান্তিতে যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের যোগ্যতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বারেক ওবামার শাসনামলে আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কারের জন্য তাকে নির্বাচন করে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত ও গুলি করে হত্যা করার জন্য দায়ী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মায়ানমারের অং সান সূচির নোবেল পুরস্কার ফেরত নেওয়ার আবেদন করেছেন বহুলোক; কারণ রোহিঙ্গা গণহত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। কম্বোডিয়ায় আমেরিকার বোমাবর্ষণ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসনের সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পান।

ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কোন ভূমিকা আমাদের নজরে আসেনি। ক্ষুদ্রঋণ বা অর্থনীতির ওপর তার নোবেল প্রাপ্তি অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতো। ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা গেলেও তিনি কখনো বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিসৌধে যাননি, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে গিয়েছেন বলেও শোনা যায়নি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অথবা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি। ঈদ-পার্বনে গরিবদের সাথে কুশল বিনিময়ের কোন ছবি আজ পর্যন্ত মিডিয়ায় আসেনি। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না, খেলাধুলায় বাংলাদেশের বিজয়ে তাকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি, আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা বন্ধ করা নিয়ে তিনি নীরব থাকেন, সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন না, দেশের বিপদে-আপদে, আনন্দ-উল্লাসে তিনি একজন নির্লিপ্ত ব্যক্তি।

অতি দরিদ্র ও সবচেয়ে বিপদাপন্ন মানুষদের জন্য ড. ইউনূসের অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সম্মানিত মর্মে খোলা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিবৃতির কিছু বক্তব্য এমন- ‘মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম বা গ্রামীণফোন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। বরং তিনি যেসব সংগঠন গড়ে তুলেছেন সেগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং ঢাকায় সাদামাটাভাবে বসবাস করছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো আপনার সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে।’

কথাটি অসত্য নয়, বিগত কয়েক বছর ধরে ড. ইউনূসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম শনাক্ত হচ্ছে। গ্রামীণ টেলিকমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা আদালতে বিচারাধীন। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- শ্রমিকদের অর্থ লোপাট, কল্যাণ তহবিলের অর্থ বিতরণ না করে আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর। তাই ড. ইউনূসের সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকা- তদন্ত করার সাথে ড. ইউনুসকে অসম্মান করার প্রশ্নটি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা উত্থাপিত হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন ও তদন্ত করা জরুরি। তদন্ত করে ভুল ও অনিয়ম পেলে তার প্রতিকার করাও জরুরি। ড. ইউনূস শুধু নোবেল বিজয়ী নন, তিনি অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে জড়িত। উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকা- তদন্তে চিহ্নিত অনিয়মের জবাব প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে ড. ইউনূসকেই দিতে হবে, এতে হয়রানি হলেও কিছু করার নেই। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের পাওনা ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধ না করায় মামলা করেছিল, পরে অর্থপ্রদানের দাবি নিয়ে সমঝোতা হলে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এখানে আরেকটি অনুসন্ধানের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে; এই মামলার কর্মচারীদের আইনজীবী এবং মীমাংসায় মধ্যস্থতাকারী ইউসুফ আলী আকন্দকে গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে ১৬ কোটি টাকা ফি দেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই আইনজীবী নাকি অন্যান্য খরচ বাবত আরও ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন। একজন আইনজীবীর ফি বাবত এত বড় অংকের অর্থ দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থ পাচার নিয়েও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুদানের অর্থের উৎস জানতে যুক্তরাষ্ট্র কানাডা জাপানসহ বিশ্বের সাতটি দেশে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। কর সংক্রান্ত বিষয়েও এনবিআর তদন্ত করেছে- এসব তদন্ত হয়রানির পর্যায়ে পড়ে বলে মনে হয় না। তবে তদন্ত করার নামে অহেতুক হয়রানি করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য হয়। সরকার ইচ্ছে করলে যে কোনো লোককে বিভিন্ন অজুহাতে হেনস্তা করতে পারে। প্রতিটি সরকারের আমলে তদন্তের নামে কত সৎ ও কর্মঠ ব্যক্তিকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা হেনস্তা করছে তার হিসাব-নিকাশ করা কঠিন। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন নিরীহ ব্যক্তিরা ঘুষ দিয়ে তদন্তের হয়রানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন, তাদের সমর্থনে ড. ইউনূসের মতো বিবৃতি দেওয়ার মতো কোন লোক খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

মামলা শুধু সরকার করছে না, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে ড. ইউনূসও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ড. ইউনূসের পক্ষে লড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। দুর্ভাগ্য ড. ইউনূসের, তিনি হেরে যান। তিনি দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার জন্য মামলা করেছিলেন। একজন সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা নিয়মিত চাকরি ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত এবং চুক্তিভিত্তিক ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সংসদে পাস করা আইনে ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ড. ইউনূসের বয়স ৭০ বছর পার হওয়ার পর হঠাৎ বিষয়টি সরকারের নজরে আসে, তখন তাকে তড়িঘড়ি করে উক্ত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তাকে উপদেষ্টা পদে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল সরকার, ড. ইউনূস রাজি হননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে জবাব দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ হয়ে যায়। তাই ড. ইউনূস ৭০ বছর পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে অবস্থান করে শুধু তিনি আইনের লঙ্ঘন করেননি, এ লঙ্ঘনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌন সম্মতিও ছিল।

এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের বক্তব্য হচ্ছে- তিনি নিজের পদের জন্য মামলা করেননি, মামলা করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের স্বতন্ত্র মর্যাদা রক্ষা করতে। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ তাকে এমডি পদে বহাল করতে বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার ফোন করা হয়েছে। এতে ধারণা করা যায়, পদটির প্রতি তার একটা লোভও ছিল।

১৯৮১ সালের মার্চ মাসে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘প্রথম শ্রেণীর অফিসার’ পদে যোগদান করে এক বছর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষিঋণ বিভাগে ড. ইউনূসের প্রবর্তিত ‘জোবরা’ প্রকল্প নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি। বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণের আইডিয়াকে একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে তাকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তখন আমার মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের নারীদের আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে ড. ইউনূসের কমিটমেন্ট রয়েছে। পরে মনে হয়েছে, ঘরের বাইরে বিরাজমান বিরাট কর্মক্ষেত্রে নারীদের টেনে এনে অধিকার সচেতন করে তুলেছেন ড. ইউনূস। এছাড়াও ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ গ্রামীণ নারী সমাজের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৮৩ সালে প্রণীত আইনে গ্রামীণ প্রকল্প গ্রামীণ ব্যাংকে উন্নীত হয়। প্রথমদিকে সরকারের অংশ ছিল ৬০ শতাংশ, এখন সরকারের মালিকানা মাত্র ৩ শতাংশ। ড. ইউনূসের প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বারবার তদন্ত হোক, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ঠিক হবে না। সরকারের কর্তৃত্বাধীন কোন প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলেছে- এমন কোন নজির আমাদের কাছে নেই, আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শুধু হোঁচট খেয়ে অকালে মারা যায় না, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি আর ঘুষের আখড়া।

সারা বিশ্বের নামিদামি অসংখ্য লোকের সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বিভিন্ন উদ্যোগে এক সময় সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। দেশ ও জাতির অধিকতর মঙ্গলে তাকে কেন সংশ্লিষ্ট করা গেল না তার গূঢ় রহস্য এখনো অজ্ঞাত। সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সাথে কোন কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হলে তা নিরসনে উক্ত চল্লিশজন বিবৃতিদাতা তাদের বক্তব্য প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ করে পত্রিকায় প্রকাশ না করে সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে পাঠাতে পারতেন। এখানেও রাজনীতির খেলা। এই খেলাটি খেলানো হয়েছে আমেরিকান কৌশলে, যে কৌশলে রাশিয়া প্রলুব্ধ হয়েছিল ইউক্রেন আক্রমণ করতে। তাই এই খেলা ড. ইউনূস এবং শেখ হাসিনার বিরাজমান সম্পর্ককে আরও তলানিতে নামিয়ে দিতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]