দুই মাস ধরে শুল্ক-কর আদায় কমেছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুল্ক-কর আদায়ের গতি বাড়ে। কিন্তু এবার চিত্রটি উল্টো। মূলত ডলার সংকটে পণ্য আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। চলতি মাসেও শুল্ক-কর আদায়ে খুব বেশি গতি নেই।
চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এনবিআরকে। এরমধ্যে ৮ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৯৭৮ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক ছিল। জুলাই মাসে ১৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে শুল্ক-কর আদায় বাড়তে বাড়তে নভেম্বরে গিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়। কিন্তু এরপরই বিপত্তি। জানুয়ারিতে শুল্ক-কর আদায় কমে ২৭ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
শুল্ক-কর আদায় কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমদানি কমে যাওয়া। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। গাড়ি, বিলাস পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে, কঠিন করা হয়েছে শর্ত। সাধারণত গাড়ি ও বিলাস পণ্যেই সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় আমদানিকারকেরাও পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এরপর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে গত জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১০ কোটি ডলারের। ২০২১ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে এক হাজার কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা কমেছে।
সবচেয়ে বেশি ঋণপত্র খোলা কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে প্রায় ৬৫ শতাংশ ঋণপত্র খোলা কমেছে। মধ্যবর্তী পণ্যে কমেছে ৩৩ শতাংশের মতো। ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ায় শুল্ক-কর আদায়ও কমে যাচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন আমদানি শুল্ক কমেছে, অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। নতুন শিল্প কারখানায় নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভ্যাট আদায়ে। আয়করেও এর প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রতিটি কমিশনারেটকে আলাদা আলাদা মাসওয়ারি লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিশনারদের বকেয়া আদায় বাড়াতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর কথাও প্রতি মাসে রাজস্ব পর্যালোচনা বৈঠকে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা আদায়ে উদ্যোগী হয়েছে এনবিআর। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বকেয়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আদায়ে আলোচনা চলছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাবে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা আদায়ের।
চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য এনবিআরের। এ লক্ষ্য পূরণে গতবারের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ। এ কারণে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে সাড়ে তিন লাখ করতে চায় এনবিআর। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এখনও তাতে সায় দেয়নি।
রবিবার, ২৬ মার্চ ২০২৩ , ১২ চৈত্র ১৪২৯, ০৩ রমজান ১৪৪৪
অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক
দুই মাস ধরে শুল্ক-কর আদায় কমেছে। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুল্ক-কর আদায়ের গতি বাড়ে। কিন্তু এবার চিত্রটি উল্টো। মূলত ডলার সংকটে পণ্য আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। চলতি মাসেও শুল্ক-কর আদায়ে খুব বেশি গতি নেই।
চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এনবিআরকে। এরমধ্যে ৮ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৯৭৮ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক ছিল। জুলাই মাসে ১৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে শুল্ক-কর আদায় বাড়তে বাড়তে নভেম্বরে গিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়। কিন্তু এরপরই বিপত্তি। জানুয়ারিতে শুল্ক-কর আদায় কমে ২৭ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
শুল্ক-কর আদায় কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমদানি কমে যাওয়া। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। গাড়ি, বিলাস পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে, কঠিন করা হয়েছে শর্ত। সাধারণত গাড়ি ও বিলাস পণ্যেই সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর আদায় হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় আমদানিকারকেরাও পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এরপর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে গত জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১০ কোটি ডলারের। ২০২১ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪০১ কোটি ডলার। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে এক হাজার কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা কমেছে।
সবচেয়ে বেশি ঋণপত্র খোলা কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে প্রায় ৬৫ শতাংশ ঋণপত্র খোলা কমেছে। মধ্যবর্তী পণ্যে কমেছে ৩৩ শতাংশের মতো। ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ায় শুল্ক-কর আদায়ও কমে যাচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন আমদানি শুল্ক কমেছে, অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। নতুন শিল্প কারখানায় নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভ্যাট আদায়ে। আয়করেও এর প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রতিটি কমিশনারেটকে আলাদা আলাদা মাসওয়ারি লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিশনারদের বকেয়া আদায় বাড়াতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর কথাও প্রতি মাসে রাজস্ব পর্যালোচনা বৈঠকে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা আদায়ে উদ্যোগী হয়েছে এনবিআর। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বকেয়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আদায়ে আলোচনা চলছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ২২ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাবে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা আদায়ের।
চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য এনবিআরের। এ লক্ষ্য পূরণে গতবারের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ। এ কারণে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে সাড়ে তিন লাখ করতে চায় এনবিআর। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এখনও তাতে সায় দেয়নি।