বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনা

শেখর ভট্টাচার্য

একাত্তরের নয় মাস আমরা যুগপৎ স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। শুধুমাত্র মুক্তি সংগ্রামের কথা বললে তা- বাঙালি শুরু করেছিল কয়েক শত বছর পূর্বে। মোগল আমল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসন আমলে বাঙালি মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছে। পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সুচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, যেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেই হরতাল সংগঠিত করার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। স্বাধীন পাকিস্তানে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবাস। পাকিস্তানি শাসকরা জানত না বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করে তারা পূর্ববাংলার বাঙালিদের স্বাধীন বাংলাদেশের পথে এগিয়ে দিয়েছিল।

নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যদি সব শ্রেণীর বাঙালির অংশ গ্রহণ না থাকত, তাহলে এই অসম যুদ্ধে আমাদের বিজয় কোনভাবেই সম্ভব হতো না। সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সবাই শ্রেণী, পেশা, রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণ ছিল আমাদের এই গৌরবময় যুদ্ধে। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সব কর্মকান্ড রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল।

সাত মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ লক্ষ্য করুন বঙ্গবন্ধু তার এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণে অত্যন্ত সচেতন ভাবে ‘মুক্তি’ এবং ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি, শব্দাবলীর নিজস্ব অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। রক্তস্নাত যুদ্ধ শেষে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে তাই আমাদের আদি সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে সংবিধানের এই চার মূলনীতির বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত ছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রামেকে সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল উপায়।

গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে বড় ভয়, সামরিক শাসক এবং তাদের বশংবদ সাম্প্রদায়িক, লুটেরা সম্প্রদায়ের। মুক্তি সংগ্রামের সবাই শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা আমাদের মূল বা আদি সংবিধানের এক নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’ সামরিক সরকার এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব যারা মেনে নিতে পারেনি তারা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এই সংবিধানের মৌল চেতনাকে নানা সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের চেতনাবিনাশী এসব সংশোধনীর দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধনী নিয়ে আসা হয়েছিল সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে। প্রস্তাবনার ওপর লেখা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং প্রথম অনুচ্ছেদের যেখানে লেখা ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’- এর কথা, সেখানে তো পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ শুধু তাই নয়, এরপরে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা আছে সেখানেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ কেটে বসানো হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’। অর্থাৎ জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ দিয়েই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস শুরু এবং এর মধ্য দিয়েই মুক্তির সবাই সংগ্রামের ইতি।

সংশোধনীতে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর জন্য যোগ করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থার কথা এবং নির্দয়ভাবে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। আদি সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল এবং তার স্থান ছিল জাতীয়তাবাদের পরেই। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গীকার জাতীয়তাবাদের, দ্বিতীয় অঙ্গীকার সমাজতন্ত্রের। সংশোধনীতে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়া হয়নি সত্য, কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বশেষে এবং সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তাও বলে দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র অর্থ ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’ আদিতে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি, সংশোধনের ফলে তা দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে যেসব প্রগতিশীল দাবিসমূহ মানুষের অন্তরের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, সামরিক ফরমানের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়।

আদি সংবিধানটি দুটি ভাষায় লেখা হয়েছিল- একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজি; বলা হয়েছিল অর্থের ব্যাপারে দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠই গ্রাহ্য হবে। ১৯৭৮-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে বিরোধের ক্ষেত্রে ইংরেজি পাঠই প্রাধান্য পাবে। এই সংশোধনীগুলোকে নিরীহ প্রকৃতির এবং সরল কোন সংশোধন মনে করা হলে ভুল করা হবে। সংশোধনীগুলোর সঙ্গে বহুমাত্রীক সংযোগ রয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষতে প্রলেপ মাখিয়ে আবারও বাংলাদেশের কাঠামোতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। সংশোধনীগুলো ছিল একটি অভিন্ন চিন্তাধারার। সংশোধনীর মূল বৈশিষ্ট্য সূচনাতেই দৃশ্যমান। প্রস্তাবনার সংশোধনীতে যেখানে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’কে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধে’। পাঠ করলেই বোঝা যায় সংশোধনকারীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশকে সাম্প্রদায়িকতার আলখাল্লা পরিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের আস্থা অর্জন। ১৯৭৮-এ যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত তারা যুদ্ধটাকেই দেখতে চেয়েছেন মুক্তির সংগ্রামকে কোনভাবেই দৃশ্যমান করতে চাননি। মুক্তি সংগ্রাম দৃশ্যমান হলে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের অবদানের কথা চলে আসে।

মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারাই ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা পুরনো ধারায় ফিরে যাওয়ার জন্য আট-ঘাট বেঁধে নেমেছিল। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তারা মুক্তির সংগ্রামকে উপেক্ষা করেছিল। এর আরেকটি কারণ ছিল- যারা জাতির জনক এবং তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল তাদের অনেকেই ‘যুদ্ধে’ ছিল কিন্তু মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত ছিল না। মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজলে তাদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তি সংগ্রামকে উপেক্ষা করে তাই তারা ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় স্বস্তি বোধ করে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে ‘মুক্তি’ অনেক ব্যাপক ও গভীর ব্যাপার যা তাদের দর্শেনের সঙ্গে কোনভাবেই মিলে না। স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে উপস্থাপন করা সম্ভব কিন্তু ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে সব ধরনের শোষণ, অপশাসন, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্যের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি অর্জনের পথে হাঁটতে হবে। যে পথে, পথ চলা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বড় কঠিন, দুর্গম এ পথ। লুণ্ঠন, মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠরোধ, সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম থেকে উঠে আসা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম- যা সামরিক শাসকদের মধ্যে ছিল না।

মুক্তি সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে, সংবিধান থেকে ছেটে ফেলে দিয়ে বাঙালির সার্বিক মুক্তি আন্দোলনকে মহিমান্বিত করা যায় না। মুক্তি সংগ্রামের মধ্যেই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ধাপ। যে ধাপে নিরস্ত্র বাঙালি শুধু দেশপ্রেমের হাতিয়ারকে পুঁজি করে বিজয়ী হয়েছিল। এটি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনের মাধ্যমে আমরা ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তি অর্জনের জন্য তাই এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সে আন্দোলন সফল হলে আমরা মুক্তিসংগ্রামের স্বপ্নের কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন দেখতে পেতাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল তারা কোনভাবেই চায়নি বঙ্গবন্ধু মুক্তি সংগ্রামে সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করুক। বঙ্গবন্ধুকে তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তি সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে দেয়।

মহান স্বাধীনতা দিবসে আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যেন একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী স্বাধীনতার মূল্যায়ন না করি। আমাদের স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ করে তুলতে হবে। আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর সাল নিছক কোন ইংরেজি বর্ষ নয়, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবময় বড় বড় মাইল পোস্ট। সেই মাইল পোস্টে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম বিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির ধারকেরা অনুপস্থিত ছিল। তারা জনসম্পৃক্ত সংগ্রামকে ভীষণ ভয় পায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলায় সূচিত সব আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল জনগণ। সেই ধারাকে বজায় রাখতে হলে, সার্বিক মুক্তি অর্জনের লড়াইকে অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ থেকে হীরক জয়ন্তীর পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষণে আমাদের আরও জনভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত অর্জন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে মনে রাখতে হবে আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে বহমান রাখা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

রবিবার, ২৬ মার্চ ২০২৩ , ১২ চৈত্র ১৪২৯, ০৩ রমজান ১৪৪৪

বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনা

শেখর ভট্টাচার্য

image

একাত্তরের নয় মাস আমরা যুগপৎ স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। শুধুমাত্র মুক্তি সংগ্রামের কথা বললে তা- বাঙালি শুরু করেছিল কয়েক শত বছর পূর্বে। মোগল আমল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসন আমলে বাঙালি মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছে। পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সুচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, যেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেই হরতাল সংগঠিত করার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। স্বাধীন পাকিস্তানে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবাস। পাকিস্তানি শাসকরা জানত না বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করে তারা পূর্ববাংলার বাঙালিদের স্বাধীন বাংলাদেশের পথে এগিয়ে দিয়েছিল।

নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যদি সব শ্রেণীর বাঙালির অংশ গ্রহণ না থাকত, তাহলে এই অসম যুদ্ধে আমাদের বিজয় কোনভাবেই সম্ভব হতো না। সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সবাই শ্রেণী, পেশা, রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণ ছিল আমাদের এই গৌরবময় যুদ্ধে। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সব কর্মকান্ড রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল।

সাত মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ লক্ষ্য করুন বঙ্গবন্ধু তার এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণে অত্যন্ত সচেতন ভাবে ‘মুক্তি’ এবং ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি, শব্দাবলীর নিজস্ব অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। রক্তস্নাত যুদ্ধ শেষে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে তাই আমাদের আদি সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে সংবিধানের এই চার মূলনীতির বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত ছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রামেকে সফলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল উপায়।

গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে বড় ভয়, সামরিক শাসক এবং তাদের বশংবদ সাম্প্রদায়িক, লুটেরা সম্প্রদায়ের। মুক্তি সংগ্রামের সবাই শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা আমাদের মূল বা আদি সংবিধানের এক নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে লেখা হয়েছিল- ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’ সামরিক সরকার এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব যারা মেনে নিতে পারেনি তারা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এই সংবিধানের মৌল চেতনাকে নানা সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের চেতনাবিনাশী এসব সংশোধনীর দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধনী নিয়ে আসা হয়েছিল সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে। প্রস্তাবনার ওপর লেখা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং প্রথম অনুচ্ছেদের যেখানে লেখা ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’- এর কথা, সেখানে তো পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ শুধু তাই নয়, এরপরে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা আছে সেখানেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ কেটে বসানো হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’। অর্থাৎ জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ দিয়েই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস শুরু এবং এর মধ্য দিয়েই মুক্তির সবাই সংগ্রামের ইতি।

সংশোধনীতে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর জন্য যোগ করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থার কথা এবং নির্দয়ভাবে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। আদি সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল এবং তার স্থান ছিল জাতীয়তাবাদের পরেই। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গীকার জাতীয়তাবাদের, দ্বিতীয় অঙ্গীকার সমাজতন্ত্রের। সংশোধনীতে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়া হয়নি সত্য, কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বশেষে এবং সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তাও বলে দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র অর্থ ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’ আদিতে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি, সংশোধনের ফলে তা দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে যেসব প্রগতিশীল দাবিসমূহ মানুষের অন্তরের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, সামরিক ফরমানের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়।

আদি সংবিধানটি দুটি ভাষায় লেখা হয়েছিল- একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজি; বলা হয়েছিল অর্থের ব্যাপারে দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠই গ্রাহ্য হবে। ১৯৭৮-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে বিরোধের ক্ষেত্রে ইংরেজি পাঠই প্রাধান্য পাবে। এই সংশোধনীগুলোকে নিরীহ প্রকৃতির এবং সরল কোন সংশোধন মনে করা হলে ভুল করা হবে। সংশোধনীগুলোর সঙ্গে বহুমাত্রীক সংযোগ রয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষতে প্রলেপ মাখিয়ে আবারও বাংলাদেশের কাঠামোতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। সংশোধনীগুলো ছিল একটি অভিন্ন চিন্তাধারার। সংশোধনীর মূল বৈশিষ্ট্য সূচনাতেই দৃশ্যমান। প্রস্তাবনার সংশোধনীতে যেখানে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’কে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধে’। পাঠ করলেই বোঝা যায় সংশোধনকারীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশকে সাম্প্রদায়িকতার আলখাল্লা পরিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের আস্থা অর্জন। ১৯৭৮-এ যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত তারা যুদ্ধটাকেই দেখতে চেয়েছেন মুক্তির সংগ্রামকে কোনভাবেই দৃশ্যমান করতে চাননি। মুক্তি সংগ্রাম দৃশ্যমান হলে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের অবদানের কথা চলে আসে।

মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারাই ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা পুরনো ধারায় ফিরে যাওয়ার জন্য আট-ঘাট বেঁধে নেমেছিল। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তারা মুক্তির সংগ্রামকে উপেক্ষা করেছিল। এর আরেকটি কারণ ছিল- যারা জাতির জনক এবং তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল তাদের অনেকেই ‘যুদ্ধে’ ছিল কিন্তু মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত ছিল না। মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজলে তাদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তি সংগ্রামকে উপেক্ষা করে তাই তারা ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় স্বস্তি বোধ করে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে ‘মুক্তি’ অনেক ব্যাপক ও গভীর ব্যাপার যা তাদের দর্শেনের সঙ্গে কোনভাবেই মিলে না। স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে ভৌগোলিক স্বাধীনতাকে উপস্থাপন করা সম্ভব কিন্তু ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে সব ধরনের শোষণ, অপশাসন, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্যের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি অর্জনের পথে হাঁটতে হবে। যে পথে, পথ চলা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বড় কঠিন, দুর্গম এ পথ। লুণ্ঠন, মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠরোধ, সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম থেকে উঠে আসা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম- যা সামরিক শাসকদের মধ্যে ছিল না।

মুক্তি সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে, সংবিধান থেকে ছেটে ফেলে দিয়ে বাঙালির সার্বিক মুক্তি আন্দোলনকে মহিমান্বিত করা যায় না। মুক্তি সংগ্রামের মধ্যেই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ধাপ। যে ধাপে নিরস্ত্র বাঙালি শুধু দেশপ্রেমের হাতিয়ারকে পুঁজি করে বিজয়ী হয়েছিল। এটি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনের মাধ্যমে আমরা ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তি অর্জনের জন্য তাই এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সে আন্দোলন সফল হলে আমরা মুক্তিসংগ্রামের স্বপ্নের কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন দেখতে পেতাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল তারা কোনভাবেই চায়নি বঙ্গবন্ধু মুক্তি সংগ্রামে সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করুক। বঙ্গবন্ধুকে তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তি সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে দেয়।

মহান স্বাধীনতা দিবসে আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যেন একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী স্বাধীনতার মূল্যায়ন না করি। আমাদের স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ করে তুলতে হবে। আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর সাল নিছক কোন ইংরেজি বর্ষ নয়, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবময় বড় বড় মাইল পোস্ট। সেই মাইল পোস্টে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম বিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির ধারকেরা অনুপস্থিত ছিল। তারা জনসম্পৃক্ত সংগ্রামকে ভীষণ ভয় পায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলায় সূচিত সব আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল জনগণ। সেই ধারাকে বজায় রাখতে হলে, সার্বিক মুক্তি অর্জনের লড়াইকে অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ থেকে হীরক জয়ন্তীর পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষণে আমাদের আরও জনভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত অর্জন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে মনে রাখতে হবে আমাদের মুক্তির সংগ্রামকে বহমান রাখা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]