সরকারি কলেজে আসবাব কেনায় একাট্টা আ’লীগ বিএনপি ঠিকাদাররা

প্রায় অর্ধশত সরকারি কলেজের জন্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকার আসবাবপত্র কেনার কাজ ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘বিএনপি’র ঠিকাদারের মধ্যে ভাগাভাগি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোট ১৭টি লটে আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে। এর আটটি লট বিএনপির এক নেতার প্রতিষ্ঠানকে; বাকি ৯টি লটের কাজ আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের ‘ভাগ করে’ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া একটি ‘অভিযুক্ত’ প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দেয়া হয়েছে, নিম্নমানের আসবাবপত্র সরবরাহের দায়ে মাউশি সম্প্রতি যে প্রতিষ্ঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত করেছে। এসব ঘটনায় ‘ক্ষুদ্ধ’ মাউশি কর্মকর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির কাজও শুরু হয়েছে।

কাজ ভাগাভাগির পাশাপাশি ক্রয়প্রক্রিয়ায় নিয়েও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোট তিন ধাপে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরমধ্যে প্রথম ধাপে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে সর্বনিম্ন দরতাদাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ দরতাদাকে কাজ দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় অন্তত তিন কোটি ৩০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কেনাকাটায় এ ঘটনা ঘটেছে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত (৭০) পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্পে।’ প্রকল্পটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বাস্তবায়ন হচ্ছে।

তাছাড়াও দুর্নীতির কারণে এই প্রকল্পভুক্ত তিনটি কলেজে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এই তিন কলেজের জন্যও আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে। তিন প্রতিষ্ঠান হলো-ভোলা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ও রাজশাহী সরকারি কলেজ।

প্রকল্পের এই অনিয়ম ও কাজ ভাগাভাগির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে লিখিত অভিযোগও জমা পরেছে। এর আলোকে মাউশি থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হলেও প্রকল্প কর্মকর্তারা এটি আমলেই নিচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ক্রয় প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তারা এরও তোয়াক্কা করেনি। তারা তড়িগড়ি করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে এবং কার্যাদেশ চূড়ান্ত করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ সংবাদকে বলেন, মাউশিতেও অভিযোগ এসেছে। প্রকল্প পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তারা কোন জবাব দেয়নি।

এ প্রকল্পের কেনাকাটার কোন অনিয়মের দায় তিনি নেবেন না জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘শুনেছি বিএনপির এক নেতাকেই নাকি আটটি লটের কাজ দেয়া হচ্ছে। এটি খুবই বিস্ময়কর। আমি কারো অপকর্মের দায় নেব না।’

মাউশির কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব না দেয়ায় প্রকল্পটির অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৯ মার্চ গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মাহমুদুল আলম এবং সদস্য হলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) নির্বাহী পরিচালক এসএম সাফিন হাসান। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব ড. ফরহাদ হোসেন।

তদন্ত কমিটির কার্য পরিধি সর্ম্পকে বলা হয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা, দরপত্রের ‘অনিয়মসমূহ যথাযথভাবে চিহ্নিত’ করা এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব নিরুপণ করবেন। তদন্ত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, তদন্ত কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা শুরু করেছে। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে একটি ‘প্রভাবশালী’ মহল নানা রকম ‘প্রতিবন্ধকতা’ সৃষ্টি করছেন।

‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত (৭০) পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প’র পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের দাবি, কেনাকাটায় কোন অনিয়ম হয়নি।

তিনি সংবাদকে বলেন, এ সংক্রান্ত ক্রয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ দেয়া হচ্ছে। এরপরও কোন ‘ভুল-ত্রুটি’ হয়ে থাকলে সেটিও ক্রয় কমিটির সুপারিশের আলোকেই হচ্ছে। এর দায়-দায়িত্বও তাদেরই।

বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হচ্ছে কীনা জানতে চাইলে পিডি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রে কাজ দেয়া হচ্ছে। এতে ‘বিএনপি-জামায়াত নেতা, নাকি আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠান কাজ পেলো সেটা তাদের দেখার বিষয় নয় বলে জানান তিনি।

তবে ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জুনের মধ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতেই হবে। তা না হলে টাকা ফেরত চলে যাবে।’

জানা গেছে, তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্রয়-কমিটির আহ্বায়কসহ দু’জন একই প্রকল্পের কর্মকর্তা, যাদের একজনের সঙ্গে ‘বিএনপি’ নেতারা যোগসাজশ রয়েছে। এ দু’জনই পিডির ‘অনুগত’। কমিটির অন্যজন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন সিস্টেম এনালিস্ট।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতার মধ্যে কাজ ভাগাভাগির বিষয়ে ক্রয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ কাজের বিলের জামানত (১০ শতাংশ) এক বছর আটকে থাকবে। এতে আগামীতে যদি আওয়ামী লীগ পূণরায় সরকারের আসতে না পারে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতা বা ঠিকাদারের জামানত অনিশ্চিত হয়ে পরবে। এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা সহযোগীতার প্রয়োজন হবে।

কাজ ভাগাভাগির কৌশল

প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম আটটি লটের দরপত্রে অন্যতম শর্ত ছিল দরতাদা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপেও একই শর্ত রেখে পাঁচটি লটের দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিএনপি নেতার প্রতিষ্ঠানকে এ দুটি ধাপের অন্তত আটটি লটের কাজ দেয়ার পরিকল্পনা ‘সাজায়’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কারণে এ ধাপেও ‘আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুযোগ হয়নি।

পরবর্তীতে তৃতীয় ধাপে আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে দারদাতা প্রতিষ্ঠানের শর্ত শিথিল করে আট বছর ঠিক করা হয়। এতে ‘আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠানকে দুটি লটের কাজ দেয়ার সুযোগ হয়। এতে টাকার অংকও বৃদ্ধি পায়। এর চেয়ে বেশি কাজ করার ‘সক্ষমতা’ ওই প্রতিষ্ঠানটির নেই বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ‘সুশিতা’ ও ‘রয়েল’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ্য থেকে প্রকল্পের পুরো ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। একই অভিযোগপত্র মাউশি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে সুশিতা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার শফিউল আলমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যা অভিযোগ আছে তা লিখিতভাবে করা হয়েছে। এর বাইরে কোন বক্তব্য নেই।’ তার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তার প্রতিষ্ঠান অন্তত চারটি লটের কাজে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। এসব লটের কাজ অন্যদের ভাগাভাগি করে দেয়া হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক নোটিশে আগামী ২৯ মার্চ সকালে অভিযোগকারী ঠিকাদার, প্রকল্প কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। গতকাল জারি হওয়া নোটিশে প্রকল্প পরিচালককে ওইদিন দরপত্রের সব নথিপত্র নিয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

প্রকল্প অফিস থেকে জানা গেছে, ১৭টি লটে আসবাবপত্র কেনার খাতে মোট ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এ টাকা খরচ দেখাতে হবে।

দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেয়া হলে মোট ২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। কিন্তু পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে গিয়ে এখন সরকারের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩৩ কোটি টাকার বেশি।

সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩ , ১৩ চৈত্র ১৪২৯, ০৪ রমজান ১৪৪৪

সরকারি কলেজে আসবাব কেনায় একাট্টা আ’লীগ বিএনপি ঠিকাদাররা

রাকিব উদ্দিন

প্রায় অর্ধশত সরকারি কলেজের জন্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকার আসবাবপত্র কেনার কাজ ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘বিএনপি’র ঠিকাদারের মধ্যে ভাগাভাগি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোট ১৭টি লটে আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে। এর আটটি লট বিএনপির এক নেতার প্রতিষ্ঠানকে; বাকি ৯টি লটের কাজ আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের ‘ভাগ করে’ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া একটি ‘অভিযুক্ত’ প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দেয়া হয়েছে, নিম্নমানের আসবাবপত্র সরবরাহের দায়ে মাউশি সম্প্রতি যে প্রতিষ্ঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত করেছে। এসব ঘটনায় ‘ক্ষুদ্ধ’ মাউশি কর্মকর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির কাজও শুরু হয়েছে।

কাজ ভাগাভাগির পাশাপাশি ক্রয়প্রক্রিয়ায় নিয়েও স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোট তিন ধাপে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরমধ্যে প্রথম ধাপে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে সর্বনিম্ন দরতাদাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ দরতাদাকে কাজ দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় অন্তত তিন কোটি ৩০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কেনাকাটায় এ ঘটনা ঘটেছে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত (৭০) পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্পে।’ প্রকল্পটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বাস্তবায়ন হচ্ছে।

তাছাড়াও দুর্নীতির কারণে এই প্রকল্পভুক্ত তিনটি কলেজে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এই তিন কলেজের জন্যও আসবাবপত্র কেনা হচ্ছে। তিন প্রতিষ্ঠান হলো-ভোলা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ও রাজশাহী সরকারি কলেজ।

প্রকল্পের এই অনিয়ম ও কাজ ভাগাভাগির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে লিখিত অভিযোগও জমা পরেছে। এর আলোকে মাউশি থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হলেও প্রকল্প কর্মকর্তারা এটি আমলেই নিচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ক্রয় প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তারা এরও তোয়াক্কা করেনি। তারা তড়িগড়ি করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে এবং কার্যাদেশ চূড়ান্ত করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ সংবাদকে বলেন, মাউশিতেও অভিযোগ এসেছে। প্রকল্প পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তারা কোন জবাব দেয়নি।

এ প্রকল্পের কেনাকাটার কোন অনিয়মের দায় তিনি নেবেন না জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘শুনেছি বিএনপির এক নেতাকেই নাকি আটটি লটের কাজ দেয়া হচ্ছে। এটি খুবই বিস্ময়কর। আমি কারো অপকর্মের দায় নেব না।’

মাউশির কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব না দেয়ায় প্রকল্পটির অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৯ মার্চ গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মাহমুদুল আলম এবং সদস্য হলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) নির্বাহী পরিচালক এসএম সাফিন হাসান। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব ড. ফরহাদ হোসেন।

তদন্ত কমিটির কার্য পরিধি সর্ম্পকে বলা হয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা, দরপত্রের ‘অনিয়মসমূহ যথাযথভাবে চিহ্নিত’ করা এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব নিরুপণ করবেন। তদন্ত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, তদন্ত কমিটি নথিপত্র পর্যালোচনা শুরু করেছে। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে একটি ‘প্রভাবশালী’ মহল নানা রকম ‘প্রতিবন্ধকতা’ সৃষ্টি করছেন।

‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত (৭০) পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প’র পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের দাবি, কেনাকাটায় কোন অনিয়ম হয়নি।

তিনি সংবাদকে বলেন, এ সংক্রান্ত ক্রয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ দেয়া হচ্ছে। এরপরও কোন ‘ভুল-ত্রুটি’ হয়ে থাকলে সেটিও ক্রয় কমিটির সুপারিশের আলোকেই হচ্ছে। এর দায়-দায়িত্বও তাদেরই।

বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হচ্ছে কীনা জানতে চাইলে পিডি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রে কাজ দেয়া হচ্ছে। এতে ‘বিএনপি-জামায়াত নেতা, নাকি আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠান কাজ পেলো সেটা তাদের দেখার বিষয় নয় বলে জানান তিনি।

তবে ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জুনের মধ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতেই হবে। তা না হলে টাকা ফেরত চলে যাবে।’

জানা গেছে, তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্রয়-কমিটির আহ্বায়কসহ দু’জন একই প্রকল্পের কর্মকর্তা, যাদের একজনের সঙ্গে ‘বিএনপি’ নেতারা যোগসাজশ রয়েছে। এ দু’জনই পিডির ‘অনুগত’। কমিটির অন্যজন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন সিস্টেম এনালিস্ট।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতার মধ্যে কাজ ভাগাভাগির বিষয়ে ক্রয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ কাজের বিলের জামানত (১০ শতাংশ) এক বছর আটকে থাকবে। এতে আগামীতে যদি আওয়ামী লীগ পূণরায় সরকারের আসতে না পারে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতা বা ঠিকাদারের জামানত অনিশ্চিত হয়ে পরবে। এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা সহযোগীতার প্রয়োজন হবে।

কাজ ভাগাভাগির কৌশল

প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম আটটি লটের দরপত্রে অন্যতম শর্ত ছিল দরতাদা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপেও একই শর্ত রেখে পাঁচটি লটের দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিএনপি নেতার প্রতিষ্ঠানকে এ দুটি ধাপের অন্তত আটটি লটের কাজ দেয়ার পরিকল্পনা ‘সাজায়’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কারণে এ ধাপেও ‘আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার সুযোগ হয়নি।

পরবর্তীতে তৃতীয় ধাপে আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে দারদাতা প্রতিষ্ঠানের শর্ত শিথিল করে আট বছর ঠিক করা হয়। এতে ‘আওয়ামী লীগ’ নেতার প্রতিষ্ঠানকে দুটি লটের কাজ দেয়ার সুযোগ হয়। এতে টাকার অংকও বৃদ্ধি পায়। এর চেয়ে বেশি কাজ করার ‘সক্ষমতা’ ওই প্রতিষ্ঠানটির নেই বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ‘সুশিতা’ ও ‘রয়েল’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ্য থেকে প্রকল্পের পুরো ক্রয়-প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। একই অভিযোগপত্র মাউশি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে দেয়া হয়েছে।

এরমধ্যে সুশিতা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার শফিউল আলমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যা অভিযোগ আছে তা লিখিতভাবে করা হয়েছে। এর বাইরে কোন বক্তব্য নেই।’ তার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তার প্রতিষ্ঠান অন্তত চারটি লটের কাজে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। এসব লটের কাজ অন্যদের ভাগাভাগি করে দেয়া হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক নোটিশে আগামী ২৯ মার্চ সকালে অভিযোগকারী ঠিকাদার, প্রকল্প কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। গতকাল জারি হওয়া নোটিশে প্রকল্প পরিচালককে ওইদিন দরপত্রের সব নথিপত্র নিয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

প্রকল্প অফিস থেকে জানা গেছে, ১৭টি লটে আসবাবপত্র কেনার খাতে মোট ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এ টাকা খরচ দেখাতে হবে।

দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেয়া হলে মোট ২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। কিন্তু পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দিতে গিয়ে এখন সরকারের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩৩ কোটি টাকার বেশি।