স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ রাজত্বকালে প্রান্তিক জনপদের এক সাধারন পল্লীতে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রাম বাংলার আবহে প্রান্তিক মানুষের মাঝে তার বেড়ে ওঠা। কে জানতো সেদিনের সেই বালক শেখ মুজিব ওরফে খোকা একদিন বাঙালির মহানায়ক, জাতির পিতাতে পরিণত হবেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেধে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই শতাব্দীর মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ছাপ্পান্নর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, আটান্নর মার্শাল ল’বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে সত্তরের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সবই বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসনামলে দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা, কয়েকবার ফাঁসির কাষ্ঠের মুখোমুখি, অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারাবরণ করার পরও এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া তার বক্তব্য বাঙালিদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল। হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনামূলক উদাত্ত আহ্বানে গোটা জাতি প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন তার সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আমাদের রিজার্ভে তখন কোনো বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা ৮০ ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বের কল্যাণে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং সত্যিকার অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তখন তার হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। তিনি সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানুষের মনে আস্থা স্থাপন করেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী অর্থে জাতীয় আন্দোলন। এ সময়ে বিশ্বে দিকে দিকে শোষিত নির্যাতিত মানুষের আন্দোলনও চলছিল। এটা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল ছয় দফার। তিনি বুঝেছিলেন, এখানকার মানুষ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি। সবার ভাষা বাংলা। বঙ্গবন্ধু চীন গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেছিলেন কিভাবে মানুষ মুক্তির সংগ্রাম করেছে। কিভাবে মানুষ রাতারাতি পাল্টে গেছে। এর প্রভাব তার মধ্যে পড়েছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতা, পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেন। ধীরে ধীরে তিনি সমগ্র বাঙালির জাতীয় নেতা হয়ে উঠলেন। জাতীয় নেতা যখন হয়েছেন তখন তার চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। জাতিকে মুক্ত করতে হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে ভেবেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে। তবে ছয় দফা মুক্তির সনদ এ ভিত্তিতেই নির্বাচনে লড়েছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন সমাজতন্ত্র এসেছে প্রবলভাবে। আওয়ামী লীগ তথা বাঙালি যখন ভোটে বেশির ভাগ আসন জিতেছে, তখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা ঘোষণা করেন। ছয় দফার পুরোটায় জাতির বিকাশ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে এ দেশে সব কলকারখানা বন্ধ হয়েগিয়েছিল। মাত্র দুটি ব্যাংক বাঙালিরা করেছিল। কিছু মিল-কারখানা (জুট মিল) সবে বাঙালিরা করতে শুরু করেছিল। এ দেশের বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা ছিল আদমজী, বাওয়ানী তথা অবাঙালিদের। তারা এ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পাকিস্তানিদের মালিকানায় অন্য যেসব শিল্পকারখানা ছিল তারাও পালিয়ে গেছে। সেগুলোর কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না। অন্যদিকে এগুলোকে বাঙালির হাতে ছেড়ে দিলে লুটপাটের আশঙ্কা ছিল। অতএব ২৬ মার্চ এগুলো জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়। সমাজতন্ত্রের ভিত্তিটা এভাবে গড়ে উঠেছিল। এ সমাজতন্ত্রে শোষণের হাতিয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর নীতি হলো- এ দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের আয় বাড়ানো, জীবনমানের উন্নয়ন করা। এটাই বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা।

বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এবং জীবনের বড় একটা সময় কারাগারে থেকে তিনি এদেশের মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনার তল খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তিনি ‘ছয় দফা’কে বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তিকামী বাঙালির কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি এই ছয় দফার পক্ষে গণরায় দেয়। ভোটে জিতেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে শপথ পাঠ করান এ ছয় দফার পক্ষে অবিচল থাকার জন্য। ছয় দফার মূল ভাবনাকে সংবিধানে কী করে প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়টি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন তার সহনেতা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। ওই সময় ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। এ আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে এক বিরাট জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির ডাক দেন। সেই ডাকের পটভূমিতেই নির্মম পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে গণহত্যা শুরু করে। এর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ ও ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ দুটি দিক আমাদের সামনে চলে আসে। ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত অনেক রাষ্ট্রের মতো বঙ্গবন্ধুও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় শাসনের বিধান সংযোজিত করেছিলেন বটে, কিন্তু তার নিজেরই এতে পুরোপুরি সায় ছিল বলে মনে হয় না। সমাজের পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন ‘বহুমুখী সমবায়’-এর ওপর। ১৯৭৫-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে সমবায় বা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। গান্ধীজি যেমন চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে স্বদেশি হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুও বাঁশকে বিদেশি খাম্ব^ার বদলে বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দেশপ্রেমের নজির তুলে ধরেছেন।

নতুন প্রজন্মের বোঝা উচিত যে, স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়,শুধু নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনও নয়। স্বাধীনতা হলো- স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস এগিয়ে আসুক, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এছাড়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনাকে কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। তাই স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এ কর্তব্যবোধে জাতীয়তাবোধ জেগে উঠবে এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ব্রত গ্রহণে বিশ্বে এ স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও মহিমান্বিত করবে-বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটাই প্রত্যাশা।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩ , ১৩ চৈত্র ১৪২৯, ০৪ রমজান ১৪৪৪

স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ রাজত্বকালে প্রান্তিক জনপদের এক সাধারন পল্লীতে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রাম বাংলার আবহে প্রান্তিক মানুষের মাঝে তার বেড়ে ওঠা। কে জানতো সেদিনের সেই বালক শেখ মুজিব ওরফে খোকা একদিন বাঙালির মহানায়ক, জাতির পিতাতে পরিণত হবেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেধে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই শতাব্দীর মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ছাপ্পান্নর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, আটান্নর মার্শাল ল’বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে সত্তরের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সবই বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসনামলে দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা, কয়েকবার ফাঁসির কাষ্ঠের মুখোমুখি, অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারাবরণ করার পরও এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া তার বক্তব্য বাঙালিদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল। হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনামূলক উদাত্ত আহ্বানে গোটা জাতি প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন তার সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর আমাদের রিজার্ভে তখন কোনো বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা ৮০ ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বের কল্যাণে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং সত্যিকার অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তখন তার হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। তিনি সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানুষের মনে আস্থা স্থাপন করেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী অর্থে জাতীয় আন্দোলন। এ সময়ে বিশ্বে দিকে দিকে শোষিত নির্যাতিত মানুষের আন্দোলনও চলছিল। এটা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল ছয় দফার। তিনি বুঝেছিলেন, এখানকার মানুষ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি। সবার ভাষা বাংলা। বঙ্গবন্ধু চীন গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেছিলেন কিভাবে মানুষ মুক্তির সংগ্রাম করেছে। কিভাবে মানুষ রাতারাতি পাল্টে গেছে। এর প্রভাব তার মধ্যে পড়েছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতা, পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেন। ধীরে ধীরে তিনি সমগ্র বাঙালির জাতীয় নেতা হয়ে উঠলেন। জাতীয় নেতা যখন হয়েছেন তখন তার চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। জাতিকে মুক্ত করতে হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে ভেবেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে। তবে ছয় দফা মুক্তির সনদ এ ভিত্তিতেই নির্বাচনে লড়েছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন সমাজতন্ত্র এসেছে প্রবলভাবে। আওয়ামী লীগ তথা বাঙালি যখন ভোটে বেশির ভাগ আসন জিতেছে, তখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা ঘোষণা করেন। ছয় দফার পুরোটায় জাতির বিকাশ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে এ দেশে সব কলকারখানা বন্ধ হয়েগিয়েছিল। মাত্র দুটি ব্যাংক বাঙালিরা করেছিল। কিছু মিল-কারখানা (জুট মিল) সবে বাঙালিরা করতে শুরু করেছিল। এ দেশের বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা ছিল আদমজী, বাওয়ানী তথা অবাঙালিদের। তারা এ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পাকিস্তানিদের মালিকানায় অন্য যেসব শিল্পকারখানা ছিল তারাও পালিয়ে গেছে। সেগুলোর কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না। অন্যদিকে এগুলোকে বাঙালির হাতে ছেড়ে দিলে লুটপাটের আশঙ্কা ছিল। অতএব ২৬ মার্চ এগুলো জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়। সমাজতন্ত্রের ভিত্তিটা এভাবে গড়ে উঠেছিল। এ সমাজতন্ত্রে শোষণের হাতিয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর নীতি হলো- এ দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের আয় বাড়ানো, জীবনমানের উন্নয়ন করা। এটাই বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা।

বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এবং জীবনের বড় একটা সময় কারাগারে থেকে তিনি এদেশের মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনার তল খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তিনি ‘ছয় দফা’কে বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে মুক্তিকামী বাঙালির কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি এই ছয় দফার পক্ষে গণরায় দেয়। ভোটে জিতেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে শপথ পাঠ করান এ ছয় দফার পক্ষে অবিচল থাকার জন্য। ছয় দফার মূল ভাবনাকে সংবিধানে কী করে প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়টি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন তার সহনেতা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। ওই সময় ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। এ আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে এক বিরাট জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির ডাক দেন। সেই ডাকের পটভূমিতেই নির্মম পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে গণহত্যা শুরু করে। এর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও উন্নয়ন দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ ও ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ দুটি দিক আমাদের সামনে চলে আসে। ‘জাতীয় গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত অনেক রাষ্ট্রের মতো বঙ্গবন্ধুও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় শাসনের বিধান সংযোজিত করেছিলেন বটে, কিন্তু তার নিজেরই এতে পুরোপুরি সায় ছিল বলে মনে হয় না। সমাজের পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন ‘বহুমুখী সমবায়’-এর ওপর। ১৯৭৫-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে সমবায় বা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। গান্ধীজি যেমন চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে স্বদেশি হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুও বাঁশকে বিদেশি খাম্ব^ার বদলে বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দেশপ্রেমের নজির তুলে ধরেছেন।

নতুন প্রজন্মের বোঝা উচিত যে, স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়,শুধু নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনও নয়। স্বাধীনতা হলো- স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এই মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস এগিয়ে আসুক, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এছাড়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনাকে কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। তাই স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এ কর্তব্যবোধে জাতীয়তাবোধ জেগে উঠবে এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ব্রত গ্রহণে বিশ্বে এ স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও মহিমান্বিত করবে-বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটাই প্রত্যাশা।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]