মালাকারটোলা গণহত্যা : দুঃসহ স্মৃতি

বাবুল দে

একাত্তরে ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা স্তব্ধ করে দিতে এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানিরা নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল। একের পর এলাকায় হামলা করে, মানুষ হত্যা পুরো ঢাকা শহরকে পাকিস্তানিরা পরিণত করেছিল মৃত্যুপুরিতে। এমনি এক মৃত্যুপুরি ছিল ঐতিহ্যবাহী পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ার মালাকারটোলা। রাতের অন্ধকারে মালাকারটোলার হিন্দু মহল্লায় পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছিল।

একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে মারাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িয়ে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐহিত্যবাহী লোহারপুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা একলাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুর মুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন।

সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। যখনই আমি একাত্তরের কোন ঘটনার কথা শুনি আঁতকে উঠি, আমার ভাই হারানো আর বাবার আহত হয়ে বেঁচে যাওয়ার করুণকাহিনী মনে পড়ে, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় মন।

এক সময় ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ছিল গেন্ডারিয়া। সেই গেন্ডারিয়ার একটি মহল্লা মালাকারটোলা। এ মালাকারটোলা পুরনো ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মহল্লা। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক সে এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও সে এলাকায় ছিল বেশি।

আমাদের পরিবার ছিল পুরনো ঢাকার বাম রাজনীতির সমর্থক। মালাকারটোলায় আমাদের বাড়িটি ছিল ঢাকার বাম রাজনীতির একটি কেন্দ্র। আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন মা-বাবার সঙ্গে সে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা ও ভাইরা সবাই ছিলেন বাম আদর্শের কর্মী। বাবা কালিপদ দে ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তার সমর্থক এবং ভাই দুলাল দে তখন ন্যাপের কর্মী ছিলেন। আমাদের বাড়ি প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার আবহ ছিল।

আমি তখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। একুশের ফেব্রুয়ারিতে আমরা গেন্ডারিয়া এলাকার ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষার পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন তৈরি করে প্রভাতফেরি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতাম। সেসব প্ল্যাকার্ড লেখা এবং জমা করা হতো আমাদের বাড়িতে। একবার আমাদের একুশের প্রভাতফেরি এত সুন্দর হয়েছিল যে, আমাদের প্রভাতফেরির ছবি তুলে তা জহির রায়হানের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ব্যবহার করা হয়।

পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাঁখারিপট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভিতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে।

শহরের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার মনে ভয় ধরে যায়। এরপর নিশ্চয়ই আমাদের পাড়ায়ও হামলা হবে। এমন ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমারা ঢাকা ছেড়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাব। এসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের এক বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। সারা এলাকায় থমথমে, মানুষের সাড়া শব্দ নেই, শুধু পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়েছে।

পাকিস্তান বাহিনী রাত ১১টার দিকে এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণকণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।

মধ্যরাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গুলিবিদ্ধ সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দু-তিনজন বেঁচে যায়। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দু-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।

আহত হওয়ায় তার ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। ওঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা দ্রুত একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান।

বাবা-ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর আমি যে বাড়িতে রাতে থাকতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে পালিয়ে দোলাইখালের দিকে চলে যাই। সেখানে নিরাপদ মনে না হওয়ায় খালের পাড়ে কাঁচা পায়খানার নিচে ময়লার মধ্যে শুয়ে পড়ি। সেখানে ৩/৪ ঘণ্টা মরা মানুষের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি। ভোর হলে খালে নেমে শরীর পরিষ্কার করে ভেজা কাপড়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে জিঞ্জিরায় চলে যাই।

মালাকারটোলা হত্যাকান্ডের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি, তা হলো বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহারপুলে যে স্থানে পাকিস্তান আর্মি তাদের দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য গুলি করেছিল ঠিক সে জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসতো। আমিও এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম।

সেই হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রায় দেখা হতো মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন। তারা আক্ষেপ করতেন তাদের যে স্বজনরা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। তারা কেউ শহীদের মর্যাদা পাননি। সরকারও তাদের সম্পর্কে কোন খোঁজখবর নেয়নি।

দেখতে দেখতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেল। এই ৫২ বছরেও আমরা যারা ঐহিত্যবাহী পুরনো ঢাকার মালাকারটোলা মহল্লার অদিবাসী তারা ভুলতে পারিনি মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার দুঃসহ ম্মৃতি। ৫২ বছর ধরে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েও স্বাধীন দেশে শহীদের মর্যাদা না পাওয়া- সব মিলে মনে হয় কত অবহেলিত জীবন আমাদের শহীদ পরিবারগুলোর।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩ , ১৩ চৈত্র ১৪২৯, ০৪ রমজান ১৪৪৪

মালাকারটোলা গণহত্যা : দুঃসহ স্মৃতি

বাবুল দে

একাত্তরে ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা স্তব্ধ করে দিতে এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানিরা নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল। একের পর এলাকায় হামলা করে, মানুষ হত্যা পুরো ঢাকা শহরকে পাকিস্তানিরা পরিণত করেছিল মৃত্যুপুরিতে। এমনি এক মৃত্যুপুরি ছিল ঐতিহ্যবাহী পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ার মালাকারটোলা। রাতের অন্ধকারে মালাকারটোলার হিন্দু মহল্লায় পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছিল।

একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে মারাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িয়ে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐহিত্যবাহী লোহারপুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা একলাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুর মুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন।

সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। যখনই আমি একাত্তরের কোন ঘটনার কথা শুনি আঁতকে উঠি, আমার ভাই হারানো আর বাবার আহত হয়ে বেঁচে যাওয়ার করুণকাহিনী মনে পড়ে, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় মন।

এক সময় ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ছিল গেন্ডারিয়া। সেই গেন্ডারিয়ার একটি মহল্লা মালাকারটোলা। এ মালাকারটোলা পুরনো ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মহল্লা। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক সে এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও সে এলাকায় ছিল বেশি।

আমাদের পরিবার ছিল পুরনো ঢাকার বাম রাজনীতির সমর্থক। মালাকারটোলায় আমাদের বাড়িটি ছিল ঢাকার বাম রাজনীতির একটি কেন্দ্র। আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন মা-বাবার সঙ্গে সে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা ও ভাইরা সবাই ছিলেন বাম আদর্শের কর্মী। বাবা কালিপদ দে ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তার সমর্থক এবং ভাই দুলাল দে তখন ন্যাপের কর্মী ছিলেন। আমাদের বাড়ি প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার আবহ ছিল।

আমি তখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। একুশের ফেব্রুয়ারিতে আমরা গেন্ডারিয়া এলাকার ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষার পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন তৈরি করে প্রভাতফেরি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতাম। সেসব প্ল্যাকার্ড লেখা এবং জমা করা হতো আমাদের বাড়িতে। একবার আমাদের একুশের প্রভাতফেরি এত সুন্দর হয়েছিল যে, আমাদের প্রভাতফেরির ছবি তুলে তা জহির রায়হানের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ব্যবহার করা হয়।

পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাঁখারিপট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভিতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে।

শহরের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার মনে ভয় ধরে যায়। এরপর নিশ্চয়ই আমাদের পাড়ায়ও হামলা হবে। এমন ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমারা ঢাকা ছেড়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাব। এসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের এক বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। সারা এলাকায় থমথমে, মানুষের সাড়া শব্দ নেই, শুধু পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়েছে।

পাকিস্তান বাহিনী রাত ১১টার দিকে এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণকণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।

মধ্যরাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গুলিবিদ্ধ সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দু-তিনজন বেঁচে যায়। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দু-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।

আহত হওয়ায় তার ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। ওঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা দ্রুত একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান।

বাবা-ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর আমি যে বাড়িতে রাতে থাকতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে পালিয়ে দোলাইখালের দিকে চলে যাই। সেখানে নিরাপদ মনে না হওয়ায় খালের পাড়ে কাঁচা পায়খানার নিচে ময়লার মধ্যে শুয়ে পড়ি। সেখানে ৩/৪ ঘণ্টা মরা মানুষের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি। ভোর হলে খালে নেমে শরীর পরিষ্কার করে ভেজা কাপড়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে জিঞ্জিরায় চলে যাই।

মালাকারটোলা হত্যাকান্ডের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি, তা হলো বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহারপুলে যে স্থানে পাকিস্তান আর্মি তাদের দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য গুলি করেছিল ঠিক সে জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসতো। আমিও এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম।

সেই হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রায় দেখা হতো মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন। তারা আক্ষেপ করতেন তাদের যে স্বজনরা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। তারা কেউ শহীদের মর্যাদা পাননি। সরকারও তাদের সম্পর্কে কোন খোঁজখবর নেয়নি।

দেখতে দেখতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেল। এই ৫২ বছরেও আমরা যারা ঐহিত্যবাহী পুরনো ঢাকার মালাকারটোলা মহল্লার অদিবাসী তারা ভুলতে পারিনি মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার দুঃসহ ম্মৃতি। ৫২ বছর ধরে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েও স্বাধীন দেশে শহীদের মর্যাদা না পাওয়া- সব মিলে মনে হয় কত অবহেলিত জীবন আমাদের শহীদ পরিবারগুলোর।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]