আর্থিকখাতে নীতিমালা ও সুশাসনের অভাবকেই সবচেয়ে বড় দুর্র্বলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও সুশাসন না থাকাই অর্থনীতির বড় দুর্বলতা। এখন আর বলা যাচ্ছে না যে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় ধরনের সংকট। এখন ভেতরের দুর্বলতাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল সংস্থাটির ধানমন্ডির কার্যালয়ে আগামী ২০২৩-২৪ সালের জাতীয় বাজেট নিয়ে আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এমন মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. তৌফিক ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সামনে যে বাজেট প্রণয়ন হবে সেটি বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের সর্বশেষ বাজেট। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে অর্থনীতিতে। তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও এটা পুনরুদ্ধার করা, সরকারের যে অর্জন রয়েছে সেটাকে সুসংহত করা এবং নতুন বাস্তবতার প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার মধ্যে এক সমন্বয় সাধন, অর্থাৎ কোনটাকে ছাড় দিয়ে কোনটাকে অগ্রাধিকার দেব সেটাই বিবেচনা।’

স্থিতিশীল বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী বছরের যে জাতীয় নির্বাচন, সেই নির্বাচনকে বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়ন হবে। এটা করতে গিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। তাই ছয়টি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন ফাহমিদা।

তিনি বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব কাঠামো, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ও মূল্যস্ফীতি, সামাজিক বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত আগামী বাজেটে বড় বিবেচ্য বিষয়। জাতীয় উন্নয়ন ব্যয় অনেকখানি কমছে। রিজার্ভ সংরক্ষিত রাখতে আমদানি সীমিত রাখা হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক চাকাগুলোর অনেকটা শ্লথ গতি দেখা যাচ্ছে।’

রাজস্ব আহরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আহরণ মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। ৩.১ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রথম ৬ মাসে। প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক সূচকে আনা ও আগামী ছয় মাসে কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর এনবিআরকে বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া এবং সেটা কখনই পূরণ করতে পারে না। ভ্যাট ও আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। সরকারের আমদানি নির্ভরতায় শুল্কখাত থেকে বড় ধরনের রাজস্ব এলেও আমদানি সীমাবদ্বতায় সেটাও কমে গেছে। যার প্রতিফলন রাজস্ব আহরণের দেখছি। রাজস্বের যে সূচক আমরা দেখছি, এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রাজস্ব আদায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও গত ডিসেম্বরে সিপিডি রাজস্ব ঘাটতির কথা ৬৪ হাজার কোটি টাকা বলেছিল। কিন্তু অবস্থার উন্নতি যেহেতু হচ্ছে না, তাই ঘাটতি আর একটু বেশি হতে পারে। সে হিসেবে রাজস্ব আহরণ ৩ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। ২০২৩ সালের রাজস্ব আহরণের ঘাটতি নিয়ে আইএমএফের যে আশঙ্কা, সেটা আমাদেরও মনে হচ্ছে। এনবিআরের সম্পদ আহরণের দুর্বলতা রয়েছে। রাজস্ব আহরণের আওতা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সরকারের ব্যায়ের লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে বাজেট ঘাটতি বেশি ছিল।’

অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও সুশাসন না হওয়াই বড় দুর্বলতা উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় ধরনের সংকট এখন আর বলা যাচ্ছে না। অর্থনীতির ভেতরের দুর্বলতা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা কারণ হয়ে থাকলেও বড় প্রতিবন্ধকতা নয়। অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও সুশাসন না হওয়াই বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের প্রতিঘাত বিবেচ্য বিষয় হলেও মূল নিয়ামক নয়। সেটা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের আগের বছরে সেটা নেয়া কতটা সহজ হবে সেটা সময় বলে দেবে।’

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সংস্থাটি বলছে, ‘অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকগুলো পণ্যের দাম নিম্নমুখী। কিন্তু আমাদের দেশে সেগুলোর প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও তার প্রতিফলন আমাদের দেশে দেখছি না। বাণিজ্য ভারসাম্যে ঝুঁকি রয়েছে। রিজার্ভের তেমন উন্নতি দেখতে পারছি না। তবে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৯.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। যদিও নন-গার্মেন্টেস পণ্যের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও কাক্সিক্ষত রেমিটেন্স আসছে না। বৈদেশিক সাহায্য ১২.২ শতাংশ কমেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগেরও খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি। এক সময় জাতীয় সঞ্চয়পত্রের অনেক প্রবৃদ্ধি দেখে শঙ্কিত হতাম, এখন আবার উল্টো দিকে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে ঋণ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিছু কিছু বাণিজ্য ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর বাইরে আবার টাকার সরবরাহ বাড়ছে। বাজারে এক ধরনের অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করছি। সুশাসনের অভাব রয়েছে। আইএমএফ থেকেও ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা বার বার বলা হচ্ছে।’