বিদায় কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ

নেছার আহমদ

হাজার বছরের ঐতিহ্য জ্ঞানগরিমায় গর্বিত চট্টগ্রাম। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চট্টগ্রামের মানুষ শিক্ষায়-দীক্ষায় অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছেন এবং চট্টগ্রামকে করেছেন আলোকিত। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায়- ‘চট্টগ্রাম সবার অগ্রে’। এ কথাটি চট্টগ্রাম তার কাজের মধ্য দিয়ে সর্বদা প্রমাণ করেছে। চট্টগ্রামের যেসব আলোকিত সন্তান নিজ জ্ঞান ও গরিমায় বিশ^কে আলোকিত করেছেন তাদের অন্যতম কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম।

বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের কাছে অর্থনীতির অবিসংবাদিত শিক্ষাগুরু। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারও আগে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত তিনি তৈরি করেছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্বের’ প্রণেতা হিসেবে।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একাধিক বই ও লেখায় সেই সময়কার অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময়ের যেসব খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকেই বোঝা যায়, তাঁর বুদ্ধি বিবেচনার ওপর কতখানি আস্থা রাখতেন বঙ্গবন্ধু। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের এযাবৎকালের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিম-লে তাঁর মতো প্রভাবশালী আর কেউ ছিলেন না। সেটি উন্নয়ন গবেষণার ক্ষেত্রেই হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেই হোক বা বাংলাদেশের স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক। তিনি চাইলে পৃথিবীর সেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বা আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ পদে থেকে কর্মজীবন পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার তাগিদেই ওই সব কোনো পদে নিজের পেশাগত স্বার্থে লেগে থাকেননি তিনি। সারা জীবন তাঁর মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষ করা পর্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে তখনকার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম তুখোড় প্রফেসর হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রবাদতুল্য।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি সংস্থায় গবেষণা এই তিন পর্বে তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শিক্ষকতা পেশায় থাকা অবস্থায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন ড. এমটি হক, এ সাদেক, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ ফারুক ও নুরুল ইসলাম। ওই সম্মেলনে তাঁরা প্রথম দ্বৈত অর্থনীতির ধারণা উত্থাপন করেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স (পিআইডিই)। সেখানে প্রধান হিসেবে ১৯৬৫ সালে যোগ দেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকর্মের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য আরও স্পষ্ট হয়। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান বিদায় নেওয়ার পর তিনি ছয় দফা অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নে সহায়তা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে ছয় দফা বাস্তবায়নের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ।

৭০-এর নির্বাচনে জয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফাভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে যে প্যানেল করেছিলেন, তার প্রধানও ছিলেন তিনি। এই পরিকল্পনা তৈরির সময় বঙ্গবন্দু ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত বৈঠক হতো। একপর্যায়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করলে তো এক পাকিস্তান থাকে না। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ১৯৭১ সালের মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকেও সেই রূপরেখা পেশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলের শুরুতে তিনি আগরতলা হয়ে দিল্লিতে যান। সেখান থেকে নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। নিক্সন প্রশাসন প্রচ-ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন তাঁরা পান।

স্বাধীনতার পরপরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে চট্টগ্রামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় এসেই শুনতে পেলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথায় নুরুল ইসলাম কাজে লেগে পড়লেন। একটি নতুন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ খুবই কঠিন কাজ হলেও সানন্দে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ নিলেন। তাঁরা দুই বছরের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিলেন ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে। এরপর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন (১৯৭৩-৭৮)।

১৯৭৫ সালে মার্চ-এপ্রিলের দিকে ছুটি নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দেশের বাইরে যান। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা। একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। নুরুল ইসলামের আর দেশে ফেরা হলো না।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মৃত্যুর আগপর্যন্ত খাদ্য নীতিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি সংস্থাটির মহাপরিচালকের জ্যেষ্ঠ নীতি পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন।

সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি আজকের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেও অধ্যাপনা করেন তিনি। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিজিটিং একাডেমিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উয়েল, অক্সফোর্ড কেমব্রিজ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস। বিভিন্ন সময়ে বিশে^র বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি কর্মজীবনের শেষটা অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকলেও প্রতিনিয়ত দেশের উন্নতির জন্য ভাবতেন, উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন দেশের নীতি-নির্ধারকদের গঠনমূলক পরামর্শ দিতে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। সভা-সেমিনারে যেকোনো মঞ্চে আমন্ত্রণ পেলেই দেশে ছুটে এসেছেন স্বাস্থ্যগত বা অন্য নানান বাধা উপেক্ষা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এ দেশে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আর কখনই করা হয়নি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শনিবার, ১৩ মে ২০২৩ , ৩০ বৈশাখ ১৪৩০, ২২ ‍শাওয়াল ১৪৪৪

বিদায় কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ

নেছার আহমদ

হাজার বছরের ঐতিহ্য জ্ঞানগরিমায় গর্বিত চট্টগ্রাম। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চট্টগ্রামের মানুষ শিক্ষায়-দীক্ষায় অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছেন এবং চট্টগ্রামকে করেছেন আলোকিত। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায়- ‘চট্টগ্রাম সবার অগ্রে’। এ কথাটি চট্টগ্রাম তার কাজের মধ্য দিয়ে সর্বদা প্রমাণ করেছে। চট্টগ্রামের যেসব আলোকিত সন্তান নিজ জ্ঞান ও গরিমায় বিশ^কে আলোকিত করেছেন তাদের অন্যতম কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম।

বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের কাছে অর্থনীতির অবিসংবাদিত শিক্ষাগুরু। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারও আগে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত তিনি তৈরি করেছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্বের’ প্রণেতা হিসেবে।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একাধিক বই ও লেখায় সেই সময়কার অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময়ের যেসব খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকেই বোঝা যায়, তাঁর বুদ্ধি বিবেচনার ওপর কতখানি আস্থা রাখতেন বঙ্গবন্ধু। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের এযাবৎকালের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিম-লে তাঁর মতো প্রভাবশালী আর কেউ ছিলেন না। সেটি উন্নয়ন গবেষণার ক্ষেত্রেই হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেই হোক বা বাংলাদেশের স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক। তিনি চাইলে পৃথিবীর সেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বা আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ পদে থেকে কর্মজীবন পার করে দিতে পারতেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার তাগিদেই ওই সব কোনো পদে নিজের পেশাগত স্বার্থে লেগে থাকেননি তিনি। সারা জীবন তাঁর মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষ করা পর্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে তখনকার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম তুখোড় প্রফেসর হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রবাদতুল্য।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা এবং দেশি-বিদেশি সংস্থায় গবেষণা এই তিন পর্বে তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কর্মজীবন বিভক্ত হলেও শিক্ষকতা পেশাটি তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শিক্ষকতা পেশায় থাকা অবস্থায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৬ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন ড. এমটি হক, এ সাদেক, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ ফারুক ও নুরুল ইসলাম। ওই সম্মেলনে তাঁরা প্রথম দ্বৈত অর্থনীতির ধারণা উত্থাপন করেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স (পিআইডিই)। সেখানে প্রধান হিসেবে ১৯৬৫ সালে যোগ দেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকর্মের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য আরও স্পষ্ট হয়। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান বিদায় নেওয়ার পর তিনি ছয় দফা অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নে সহায়তা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে ছয় দফা বাস্তবায়নের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ।

৭০-এর নির্বাচনে জয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফাভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে যে প্যানেল করেছিলেন, তার প্রধানও ছিলেন তিনি। এই পরিকল্পনা তৈরির সময় বঙ্গবন্দু ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত বৈঠক হতো। একপর্যায়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করলে তো এক পাকিস্তান থাকে না। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ১৯৭১ সালের মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকেও সেই রূপরেখা পেশ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলের শুরুতে তিনি আগরতলা হয়ে দিল্লিতে যান। সেখান থেকে নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। নিক্সন প্রশাসন প্রচ-ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন তাঁরা পান।

স্বাধীনতার পরপরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে চট্টগ্রামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় এসেই শুনতে পেলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথায় নুরুল ইসলাম কাজে লেগে পড়লেন। একটি নতুন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ খুবই কঠিন কাজ হলেও সানন্দে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ নিলেন। তাঁরা দুই বছরের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিলেন ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে। এরপর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন (১৯৭৩-৭৮)।

১৯৭৫ সালে মার্চ-এপ্রিলের দিকে ছুটি নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দেশের বাইরে যান। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা। একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। নুরুল ইসলামের আর দেশে ফেরা হলো না।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মৃত্যুর আগপর্যন্ত খাদ্য নীতিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি সংস্থাটির মহাপরিচালকের জ্যেষ্ঠ নীতি পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন।

সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি আজকের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেও অধ্যাপনা করেন তিনি। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিজিটিং একাডেমিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উয়েল, অক্সফোর্ড কেমব্রিজ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস। বিভিন্ন সময়ে বিশে^র বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি কর্মজীবনের শেষটা অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকলেও প্রতিনিয়ত দেশের উন্নতির জন্য ভাবতেন, উদ্বিগ্ন থাকতেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন দেশের নীতি-নির্ধারকদের গঠনমূলক পরামর্শ দিতে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। সভা-সেমিনারে যেকোনো মঞ্চে আমন্ত্রণ পেলেই দেশে ছুটে এসেছেন স্বাস্থ্যগত বা অন্য নানান বাধা উপেক্ষা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এ দেশে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আর কখনই করা হয়নি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]