পরিযায়ী পাখির প্রতি সদয় হোন

সুমাইয়া আকতার

অতিথি পাখিদের বেশিরভাগই হয় পরিযায়ী পাখি। একটি বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এসব পাখির আগমন ঘটে এবং তারা তাদের নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে- পাফিক্স, গোল্ডেন সারস, সাইবেরিয়ান ক্রেন পাখি।

পৃথিবীর প্রায় ১০,০০০ প্রজাতি পাখির মধ্যে প্রায় ১৮৫৫ প্রজাতি পাখি পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশে ৭০০-এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। পাখিরা বিভিন্ন কারণেই পরিযায়ন করতে পারে। যেমন- প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে পরিত্রাণ, পর্যাপ্ত খাদ্যের জন্য, নিরাপদ প্রজননের জন্য, বংশানুক্রমিক ধারাও হতে পারে।

পাখিদের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিযায়ী পাখিদের আগে অতিথি পাখি বলা হতো; কিন্তু এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে।

পরিবেশ অধিদফতর জানায়, সাধারণত হেমন্তের শুরুতে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি আসার মওসুম শুরু হয়। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে খঞ্জন, সুইচোরা, চ্যাগা ও চা পাখি, চখাচোখি, মানিকজোড়, গেওলা ও গুলিন্দা।

পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলার সমতল ও সুন্দরবনকে লক্ষ্য করে প্রায় আটটি পথ ধরে পাখিরা এখানে আসে। দেশের হাওর এলাকা ও বিস্তৃৃত সুন্দরবন এলাকা পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া সুনামগঞ্জের হাওর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চিড়িয়াখানাসহ বেশ কিছু এলাকায় পাখিদের দেখা যায়।

পরিযায়ী পাখিকে পরিব্রাজক বা যাযাবর পাখিও বলা হয়। সারস, ঈগল, বাজসহ বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি মধ্য ও উত্তর ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিদের এক বিস্ময়কর প্রজাতি দাগি মাথা রাজহাঁস। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে সক্ষম। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ প্রজাতির হাঁস পরিযায়ন করে।

পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওর, বাঁওড়, হ্রদ, নদ, নদী, নালা, সাগর ও জলাভূমিতে বাস করে থাকে। পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে।

পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখা ও বিচরণস্থল সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতি বছর ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ পালিত হয়।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বলছে, প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের স্বাদু পানির হাওর-বাঁওড়, বিল এবং জলাশয়গুলোতে দুই লাখেরও বেশি হাঁস এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিচরণ করে।

শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই শুধু পরিযায়ী পাখি এবং তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা সম্ভব না, সেই সঙ্গে জরুরি সবার সচেতনতা।

অতিথি পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পাখিরা হারাচ্ছে তাদের বিচরণ ভূমি ও নিরাপদ আশ্রয়। ফসলি জমিতে কৃত্রিম সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বিষে আক্রান্ত কীটপতঙ্গ খেয়ে তারা মারা যাচ্ছে। যেখানে পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধু।

আসুন পরিযায়ী পাখিদের আমরা মেহমানের দৃষ্টিতে দেখি, তাদের মুক্ত চলাচলে সহায়তা করি এবং স্বীয় নাগরিক দায়িত্ব পালন করি এবং অন্যকে সোচ্চার ও সহানুভূতিশীল হতে অনুপ্রাণিত করি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শনিবার, ১৩ মে ২০২৩ , ৩০ বৈশাখ ১৪৩০, ২২ ‍শাওয়াল ১৪৪৪

পরিযায়ী পাখির প্রতি সদয় হোন

সুমাইয়া আকতার

অতিথি পাখিদের বেশিরভাগই হয় পরিযায়ী পাখি। একটি বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এসব পাখির আগমন ঘটে এবং তারা তাদের নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে- পাফিক্স, গোল্ডেন সারস, সাইবেরিয়ান ক্রেন পাখি।

পৃথিবীর প্রায় ১০,০০০ প্রজাতি পাখির মধ্যে প্রায় ১৮৫৫ প্রজাতি পাখি পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশে ৭০০-এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। পাখিরা বিভিন্ন কারণেই পরিযায়ন করতে পারে। যেমন- প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে পরিত্রাণ, পর্যাপ্ত খাদ্যের জন্য, নিরাপদ প্রজননের জন্য, বংশানুক্রমিক ধারাও হতে পারে।

পাখিদের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিযায়ী পাখিদের আগে অতিথি পাখি বলা হতো; কিন্তু এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে।

পরিবেশ অধিদফতর জানায়, সাধারণত হেমন্তের শুরুতে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি আসার মওসুম শুরু হয়। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে খঞ্জন, সুইচোরা, চ্যাগা ও চা পাখি, চখাচোখি, মানিকজোড়, গেওলা ও গুলিন্দা।

পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলার সমতল ও সুন্দরবনকে লক্ষ্য করে প্রায় আটটি পথ ধরে পাখিরা এখানে আসে। দেশের হাওর এলাকা ও বিস্তৃৃত সুন্দরবন এলাকা পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া সুনামগঞ্জের হাওর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চিড়িয়াখানাসহ বেশ কিছু এলাকায় পাখিদের দেখা যায়।

পরিযায়ী পাখিকে পরিব্রাজক বা যাযাবর পাখিও বলা হয়। সারস, ঈগল, বাজসহ বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি মধ্য ও উত্তর ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিদের এক বিস্ময়কর প্রজাতি দাগি মাথা রাজহাঁস। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে সক্ষম। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ প্রজাতির হাঁস পরিযায়ন করে।

পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওর, বাঁওড়, হ্রদ, নদ, নদী, নালা, সাগর ও জলাভূমিতে বাস করে থাকে। পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে।

পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখা ও বিচরণস্থল সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতি বছর ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ পালিত হয়।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বলছে, প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের স্বাদু পানির হাওর-বাঁওড়, বিল এবং জলাশয়গুলোতে দুই লাখেরও বেশি হাঁস এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিচরণ করে।

শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই শুধু পরিযায়ী পাখি এবং তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা সম্ভব না, সেই সঙ্গে জরুরি সবার সচেতনতা।

অতিথি পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পাখিরা হারাচ্ছে তাদের বিচরণ ভূমি ও নিরাপদ আশ্রয়। ফসলি জমিতে কৃত্রিম সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বিষে আক্রান্ত কীটপতঙ্গ খেয়ে তারা মারা যাচ্ছে। যেখানে পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধু।

আসুন পরিযায়ী পাখিদের আমরা মেহমানের দৃষ্টিতে দেখি, তাদের মুক্ত চলাচলে সহায়তা করি এবং স্বীয় নাগরিক দায়িত্ব পালন করি এবং অন্যকে সোচ্চার ও সহানুভূতিশীল হতে অনুপ্রাণিত করি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]