যশোরে নান্দনিক কালেক্টরেট ভবন সবার নজর কেড়েছে

যশোর একসময় রাজ্য ছিল। ব্রিটিশ সরকার সেই রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই যশোর যুক্ত বাংলার প্রথম জেলা। জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয়। যার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় মুড়লীেিত। পরে দপ্তরটি কসবায় স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে প্রথম নির্মিত কালেক্টরেট ভবনটি হলো পরিত্যক্ত জেলা রেজিস্ট্রি অফিস। পরে বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এটিও বাংলার প্রথম প্রশাসনিক ভবন।

শতাব্দীকালের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। জেলাবাসীসহ দেশ-বিদেশের মানুষ এই ভবনটিকে শুধু প্রশাসনিক ভবন হিসেবেই দেখেছেন। ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটির নান্দনিক রূপ দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি, ভাবেননিও। বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান সেই অভাব পুরনে হাত বাড়িয়েছেন। তিনি এমনভাবে কালেক্টরেট ভবনসহ এর অঙ্গন সাজিয়েছেন যে তাতে তার সুন্দর মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এইতো সেদিনও মানুষ ভবনটিতে এসে প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ সেরে ক্লান্ত মনে ফিরতেন। কিন্তু আজ তার চিত্র ভিন্ন। মানুষ কাজ সেরে ফুরফুরে মনে ফেরেন। কারণ মন ফুরফুরে হওয়ার অনুষঙ্গ এখানে এখন আছে। যারা এখানে আসেন তাদের প্রত্যেককে জেলা প্রশাসকের অফিসের প্রবেশ মুখে থমকে দাঁড়তে হয়। জেলা প্রশাসকের কাছে জরুরি কাজটির কথা ক্ষণিকের জন্য তাদের ভুলে যেতে হয়। জাতীয় পাখি দোয়েলের সুন্দর ভাস্কর্যটি তাদেরকে আটকে রাখে। এর পরও পা যেন আর বাড়ানো যায় না। একুয়ারিয়ামে নানা রঙের মাছ, দেয়ালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থীদের দুর্দশা আর যুদ্ধবিভীষিকার গল্প ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ উৎকীর্ণ। রয়েছে এক নজরে জেলা পরিচিতি ম্যাপ। টবে নানা জাতের ফুলের গাছ। অভ্যর্থনা কক্ষে অপেক্ষমাণ জন সাধারণের জন্য রয়েছে টেলিভিশন ও বইয়ের তাক। ওই তাকে আছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে রকমারি বই। জেলা প্রশাসকের কাছে কাজের প্রয়োজনে মানুষ এসে অনেক সময় বেশ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর আগে অপেক্ষার এ সময় কাটতে চাইতো না। এখন সময়টা কখন পেরিয়ে যায় তা বুঝতেই পারেন না তারা। সব জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা আছে। তারপরও আছে প্রয়োজনে চা ও পানি পানের ব্যবস্থা।

এত গেল জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনের কথা। কালেক্টরেট পুকুরে পদ্ম ফুলের মেলার নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আর তাই শিশু কিশোর ও বয়স্কদের সকলের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই পুকুরের পাড় তথা কালেক্টরেট চত্বর।

সন্ধ্যায় এখানে এক নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। চোখ ধাঁধানো নয়, নিয়নবাতির নানা রকম নমনীয় কমনীয় আলোয় মানুষ মুগ্ধ হন। এজন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। সে দৃশ্য কেবল অনুভব করা যায় ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা হামিদুল হক বলেন, পূর্বে এত সুন্দর আর মনমুগ্ধকর পরিবেশ ছিল না এখানে। বর্তমানে পাল্টে গেছে ভেতর ও বাইরের পরিবেশ। কোন কাজে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসলে এখন আর অপেক্ষা করতে বিরক্তি লাগে না।

যশোর সদরের করিচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন বলেন, আমি মুক্তি যুদ্ধের ওপর বই পড়ে শেষ করেছি এই অভ্যর্থনা কক্ষে বসে। যদিও বইটি পড়ে শেষ করতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন। বিভিন্ন সময় প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে আসি। একদিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই দেখে তা পড়তে শুরু করি। ভেতর থেকে ডাক না আশা পর্যন্ত বই পড়ি। ভেতর থেকে ডাক আসলে যে পর্যন্ত পড়া হয়েছে তা নোট রাখি পরেরবার এসে আবার ওইখান থেকে পড়া শুরু করি। এভাবেই আমি সম্পূর্ণ একটি বই পড়েছি। এর পর থেকেই বই পড়ার একটি অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এখন সুযোগ পেলেই বই পড়ি।

বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশে তার নন্দিত উদ্যোগ সমাদৃত হয়েছে। তার হাতের ছোঁয়া লেগেছে ঐতিহ্যবাহী বি. সরকার ঘূর্ণয়মান রঙ্গ মঞ্চে। দীর্ঘদিন ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা মঞ্চটি সংস্কার ও নাম পরিবর্তন করে স্বরূপে ফিরিয়েছেন। যশোর ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার স্মরণ উৎসব চালু, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী কালেক্টরেট ভবনে টেরোকোটায় ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা, বঙ্গবন্ধু কর্নার ইত্যাদি চালু করেছেন। কালেক্টরেট ভবনের বর্ণিল সাজসজ্জা ও আলোকসজ্জায় বদলে গেছে দৃশ্যপট। আধুনিকায়ন হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিয়াজ পার্কটিও, যা বর্তমানে পরিচিত কালেক্টরেট পার্ক হিসেবে। তিনি নান্দনিক কাজের মধ্য দিয়ে নান্দনিক জেলা প্রশাসক হিসেবে মানুষের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিটি দেশ বা জেলার এমন একটি জায়গা থাকে যা ওই জেলার পরিচিতি বহন করে। যশোরের কালেক্টরেট ভবনের রয়েছে ২০০ বছরের ঐতিহ্য। বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায় এই ভবনের ছবি দিয়ে যশোরকে উপস্থাপন করা হয়। তাই আমার মনে হয়েছে ভবনটিকে কীভাবে নান্দনিক করা যায়। নান্দনিক পরিবেশের পাশাপাশি নাগরিক সেবার ব্যাপারটিও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেবা নিতে এসে কেউ জেনো বিড়ম্বনার শিকার না হয় সেই বিষয়টিও সব সময় নজরদারি করা হয়। যেহেতু এখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আসেন তাই তাদের জন্য আধুনিক অভ্যর্থনা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১৮ মে ২০২৩ , ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৪

যশোরে নান্দনিক কালেক্টরেট ভবন সবার নজর কেড়েছে

রুকুনউদ্দৌলাহ, যশোর

image

যশোর একসময় রাজ্য ছিল। ব্রিটিশ সরকার সেই রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই যশোর যুক্ত বাংলার প্রথম জেলা। জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয়। যার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় মুড়লীেিত। পরে দপ্তরটি কসবায় স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে প্রথম নির্মিত কালেক্টরেট ভবনটি হলো পরিত্যক্ত জেলা রেজিস্ট্রি অফিস। পরে বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এটিও বাংলার প্রথম প্রশাসনিক ভবন।

শতাব্দীকালের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। জেলাবাসীসহ দেশ-বিদেশের মানুষ এই ভবনটিকে শুধু প্রশাসনিক ভবন হিসেবেই দেখেছেন। ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটির নান্দনিক রূপ দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি, ভাবেননিও। বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান সেই অভাব পুরনে হাত বাড়িয়েছেন। তিনি এমনভাবে কালেক্টরেট ভবনসহ এর অঙ্গন সাজিয়েছেন যে তাতে তার সুন্দর মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এইতো সেদিনও মানুষ ভবনটিতে এসে প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কাজ সেরে ক্লান্ত মনে ফিরতেন। কিন্তু আজ তার চিত্র ভিন্ন। মানুষ কাজ সেরে ফুরফুরে মনে ফেরেন। কারণ মন ফুরফুরে হওয়ার অনুষঙ্গ এখানে এখন আছে। যারা এখানে আসেন তাদের প্রত্যেককে জেলা প্রশাসকের অফিসের প্রবেশ মুখে থমকে দাঁড়তে হয়। জেলা প্রশাসকের কাছে জরুরি কাজটির কথা ক্ষণিকের জন্য তাদের ভুলে যেতে হয়। জাতীয় পাখি দোয়েলের সুন্দর ভাস্কর্যটি তাদেরকে আটকে রাখে। এর পরও পা যেন আর বাড়ানো যায় না। একুয়ারিয়ামে নানা রঙের মাছ, দেয়ালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থীদের দুর্দশা আর যুদ্ধবিভীষিকার গল্প ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ উৎকীর্ণ। রয়েছে এক নজরে জেলা পরিচিতি ম্যাপ। টবে নানা জাতের ফুলের গাছ। অভ্যর্থনা কক্ষে অপেক্ষমাণ জন সাধারণের জন্য রয়েছে টেলিভিশন ও বইয়ের তাক। ওই তাকে আছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে রকমারি বই। জেলা প্রশাসকের কাছে কাজের প্রয়োজনে মানুষ এসে অনেক সময় বেশ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর আগে অপেক্ষার এ সময় কাটতে চাইতো না। এখন সময়টা কখন পেরিয়ে যায় তা বুঝতেই পারেন না তারা। সব জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা আছে। তারপরও আছে প্রয়োজনে চা ও পানি পানের ব্যবস্থা।

এত গেল জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনের কথা। কালেক্টরেট পুকুরে পদ্ম ফুলের মেলার নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আর তাই শিশু কিশোর ও বয়স্কদের সকলের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই পুকুরের পাড় তথা কালেক্টরেট চত্বর।

সন্ধ্যায় এখানে এক নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। চোখ ধাঁধানো নয়, নিয়নবাতির নানা রকম নমনীয় কমনীয় আলোয় মানুষ মুগ্ধ হন। এজন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। সে দৃশ্য কেবল অনুভব করা যায় ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা হামিদুল হক বলেন, পূর্বে এত সুন্দর আর মনমুগ্ধকর পরিবেশ ছিল না এখানে। বর্তমানে পাল্টে গেছে ভেতর ও বাইরের পরিবেশ। কোন কাজে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসলে এখন আর অপেক্ষা করতে বিরক্তি লাগে না।

যশোর সদরের করিচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন বলেন, আমি মুক্তি যুদ্ধের ওপর বই পড়ে শেষ করেছি এই অভ্যর্থনা কক্ষে বসে। যদিও বইটি পড়ে শেষ করতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন। বিভিন্ন সময় প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে আসি। একদিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই দেখে তা পড়তে শুরু করি। ভেতর থেকে ডাক না আশা পর্যন্ত বই পড়ি। ভেতর থেকে ডাক আসলে যে পর্যন্ত পড়া হয়েছে তা নোট রাখি পরেরবার এসে আবার ওইখান থেকে পড়া শুরু করি। এভাবেই আমি সম্পূর্ণ একটি বই পড়েছি। এর পর থেকেই বই পড়ার একটি অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এখন সুযোগ পেলেই বই পড়ি।

বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশে তার নন্দিত উদ্যোগ সমাদৃত হয়েছে। তার হাতের ছোঁয়া লেগেছে ঐতিহ্যবাহী বি. সরকার ঘূর্ণয়মান রঙ্গ মঞ্চে। দীর্ঘদিন ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা মঞ্চটি সংস্কার ও নাম পরিবর্তন করে স্বরূপে ফিরিয়েছেন। যশোর ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার স্মরণ উৎসব চালু, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী কালেক্টরেট ভবনে টেরোকোটায় ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা, বঙ্গবন্ধু কর্নার ইত্যাদি চালু করেছেন। কালেক্টরেট ভবনের বর্ণিল সাজসজ্জা ও আলোকসজ্জায় বদলে গেছে দৃশ্যপট। আধুনিকায়ন হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিয়াজ পার্কটিও, যা বর্তমানে পরিচিত কালেক্টরেট পার্ক হিসেবে। তিনি নান্দনিক কাজের মধ্য দিয়ে নান্দনিক জেলা প্রশাসক হিসেবে মানুষের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিটি দেশ বা জেলার এমন একটি জায়গা থাকে যা ওই জেলার পরিচিতি বহন করে। যশোরের কালেক্টরেট ভবনের রয়েছে ২০০ বছরের ঐতিহ্য। বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায় এই ভবনের ছবি দিয়ে যশোরকে উপস্থাপন করা হয়। তাই আমার মনে হয়েছে ভবনটিকে কীভাবে নান্দনিক করা যায়। নান্দনিক পরিবেশের পাশাপাশি নাগরিক সেবার ব্যাপারটিও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেবা নিতে এসে কেউ জেনো বিড়ম্বনার শিকার না হয় সেই বিষয়টিও সব সময় নজরদারি করা হয়। যেহেতু এখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আসেন তাই তাদের জন্য আধুনিক অভ্যর্থনা কক্ষ তৈরি করা হয়েছে।