ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণে নয়ছয়

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পে যেন হরিলুট চলছে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ঋণ সহয়তায় নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নতুন ভবন জন্য নির্মাণে নকশা তৈরি থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণে পদে পদে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২ বছরের এ প্রকল্প এখন ৯ বছরে গড়ালেও শেষ হয়নি কাজ। এমনকি নৌ অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। কাজ না করেও বাড়তি খরচ দেখানো হয়েছে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে। প্রকল্প পরিচালক, ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিলেমিশে এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও মন্ত্রণালয় মুখে ক্লুপ দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নিজস্ব ১১ তলা ভবন নির্মাণের কাজসহ উপকূলীয় কয়েকটি এলাকায় রেডিও স্টেশন ও লাইটার হাউজ নির্মাণের কাজে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি এ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌ অধিদপ্তরের ১১ তলা নির্মাণাধীন ভবনটি সরজমিন পরিদর্শনে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দিয়ে নকশা তৈরি না করা, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, অধিদপ্তরের নতুন ভবনটি নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রয়েছে। প্রকল্পের সময়সীমা ও ব্যয় বৃদ্ধি করে অর্থলোপাটের উদ্দেশেই ধীরগতিতে নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও ঠিকাদারসহ নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দিকেই এই অভিযোগের তীর। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পিডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌখাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালে গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) নামে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় নৌ অধিদপ্তরকে। প্রকল্পের মোট ৩৮২ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের ঋণ সহায়তা ৭০ শতাংশ ও বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে দুই দফায় প্রকল্পটির কাজের পরিধি বাড়িয়ে এর নামকরণ হয় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’। একই সঙ্গে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় আরও রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জন্য একটি ১১ তলা ভবন নির্মাণ। ভবনটির নির্মাণকাল ছিল ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়।

সূত্র মতে, ভবনের নিচতলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা; যা দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেশটির এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে দেবে। ৯-১১ তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা; যা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরিয়ান কোম্পানি এলজি সামিহ। তবে কোরিয়ান ঠিকাদার এ কাজে বাগদাদ কনস্ট্রাকশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টর বা সহ-ঠিকাদার নিয়োগ করেছে। তারাই ভবন নির্মাণসহ ইন্টেরিয়র ও ডেকোরেশনের কাজ করছে।

গত ১৬ মে সরজমিনে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় ফায়ার ফিটিংসের যে কাজ করা হয়েছে তাতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। এমনকি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের যে ছাড়পত্র জমা দেয়া হয়েছে তাও জাল। গত ৭ মে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়, এই ভবনের অনুকুলে তারা কোন ছাড়পত্র প্রদান করেনি। ভবনের বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউজ পাশাপাশি স্থাপন করায় ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই ঝুঁকি এড়াতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে স্থাপনা দুটি আলাদা করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলা ছিদ্র করে সিঁড়ির সামনে ফায়ারফাইটিং কেস বসানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটাও যেকোন সময় মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। দ্বিতীয় তলার সিলিংয়ে কিছু এয়ারকন্ডিশনের (এসি) তার এলোমেলো থাকলেও এ পর্যন্ত একটিও এসি লাগানো হয়নি।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে কাকতালীয়ভাবে সেখানে উপস্থিত মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক নিজেই সাংবাদিকদের তৃতীয় তলায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেখানকার চিত্র দেখান। সেখানে বিলাসবহুল বা একজন মহাপরিচালকের ব্যবহার উপযোগী কোন ফিটিংস নেই। এমনকি তার নিজের কক্ষেও না। মহাপরিচালকের ওয়াশরুমের কোন কাজই এখনও শুরু হয়নি। তার কক্ষ ছাড়া তৃতীয় তলার কোথাও মার্বেল টাইলস নেই। এছাড়া তৃতীয় তলায় কোন এসি লাগানো হয়নি, লাইটিং নেই। অথচ ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচের কথা বলা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনটির ৭ তলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন তলায় অধিকাংশ দরজা প্লাস্টিকের তৈরি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কাঠের তৈরি দরজা লাগানোর কথা। এছাড়া কয়েকটি তলায় মেঝেতে টাইলস বসানো হয়নি। ওয়াশরুমে স্থাপন করা বেসিন, কমোড ও অন্যান্য ফিটিংসও নিম্নমানের। বৈদ্যুতিক তারও মানসম্মত বলে মনে হয়নি।

এদিকে সাংবাদিকরা নির্মাণাধীন ভবনটি দেখতে গেছেন- এ খবর পেয়ে প্রকল্প পরিচালক ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের পক্ষে এক ব্যক্তি ওইদিনই ফোন দিয়ে জানান, তিনি প্রককেল্পর বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। পরে পিডি আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের পক্ষে ১৮ মে দুপুরে উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ফরহাদ জলিল বিপ্লব নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শনকারী কয়েকজন সাংবাদিকের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, পিডি অসুস্থ। ডিপিডি দাবি করেন, ১১ তলা ভবন নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়নি। দরপত্রের শর্ত এবং এ সংক্রান্ত সরকারি বিধিবিধান মেনেই সবকিছুই করা হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের কাজ তদারকির ক্ষেত্রে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থাকার বিধান থাকালেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ একজন ডিপ্লোমা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কাজ করিয়েছেন। এর ফলে ভবনের কাজে নানা ধরনের ক্রটি হয়েছে। ভবনটিও পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি নিয়ে কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করার বিধান থাকলেও কাজের সময় সেই অনুমোদন নেয়া হয়নি। ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ সাব কন্ট্রাকে দিয়েছে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ। দক্ষিণ কোরিয়ার এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্প পরিচালক, মন্ত্রণালয়ের সঠিক নজরদারি না থাকায় মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি শুরু থেকে। এ অবস্থায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন আদৌ শেষ হবে কি না তা নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩ জন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্পের শুরুতে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল প্রকল্প পরিচালক হন। তিনি ঘুষসহ দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রকল্পের নতুন পরিচালকের দায়িত্ব পান আরেকজন কর্মকর্তা। তিনি তার চাকরির মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পরিচালক।

জানতে চাইলে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ নিজামুল হক বলেন, তাকে না জানিয়ে এবং কোন ধরনের অনুমোদন না নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। এজন্য পিডি দেলোয়ার রহমান ও কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহকে সরাসরি দায়ী করেন তিনি। মহাপরিচালক বলেন, এই সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পের কাজে যে গতি এসেছিল তাতে ভাটা পড়েছে। তার দাবি, আগে প্রকল্পের কাজ ৩০-৩৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকল্পের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে কমডোর নিজামুল হক বলেন, পিডি ও ঠিকাদারের অনিয়ম ও দুর্নীতি আমার নজরে আসার পর এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নৌ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি, কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও বলেছি। পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি।

আরও খবর
সামনে সংসদ নির্বাচন : দুই মাস আগে পাঠ্যবই ছাপতে চায় এনসিটিবি
ভেঙেপড়া গাছে ধাক্কা লেগে বগি লাইনচ্যুত, ১৫ ঘণ্টা পর উদ্ধার
কাঁদলেন সিলেটের মেয়র আরিফ সরে দাঁড়ালেন নির্বাচন থেকে
গাজীপুর : মেয়র প্রার্থীদের হলফনামা
৫ সিটি নির্বাচন ট্রায়াল হিসেবে নিয়েছি : ইসি সচিব
সামনে সংসদ নির্বাচন : দুই মাস আগে পাঠ্যবই ছাপতে চায় এনসিটিবি
পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষ
ওলামা লীগ চাইলে প্রোগ্রামের খরচ ‘শেখ হাসিনা দেবেন’, জানালেন কাদের
রাজশাহী : বিএনপি সরে গেছে মেয়র পদ থেকে, কাউন্সিলর প্রার্থীরা নৌকার কাছে ভিড়ছে
পাবিপ্রবি : ভর্তি পরীক্ষার দিন ছাত্রলীগে অর্ন্তদ্বন্দ্ব, আহত ১০

রবিবার, ২১ মে ২০২৩ , ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ৩০ শাওয়াল ১৪৪৪

ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণে নয়ছয়

সাইফ বাবলু

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পে যেন হরিলুট চলছে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ঋণ সহয়তায় নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নতুন ভবন জন্য নির্মাণে নকশা তৈরি থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণে পদে পদে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২ বছরের এ প্রকল্প এখন ৯ বছরে গড়ালেও শেষ হয়নি কাজ। এমনকি নৌ অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। কাজ না করেও বাড়তি খরচ দেখানো হয়েছে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে। প্রকল্প পরিচালক, ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিলেমিশে এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও মন্ত্রণালয় মুখে ক্লুপ দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নিজস্ব ১১ তলা ভবন নির্মাণের কাজসহ উপকূলীয় কয়েকটি এলাকায় রেডিও স্টেশন ও লাইটার হাউজ নির্মাণের কাজে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি এ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌ অধিদপ্তরের ১১ তলা নির্মাণাধীন ভবনটি সরজমিন পরিদর্শনে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দিয়ে নকশা তৈরি না করা, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, অধিদপ্তরের নতুন ভবনটি নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রয়েছে। প্রকল্পের সময়সীমা ও ব্যয় বৃদ্ধি করে অর্থলোপাটের উদ্দেশেই ধীরগতিতে নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও ঠিকাদারসহ নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দিকেই এই অভিযোগের তীর। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেও এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পিডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌখাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালে গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) নামে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় নৌ অধিদপ্তরকে। প্রকল্পের মোট ৩৮২ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের ঋণ সহায়তা ৭০ শতাংশ ও বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে দুই দফায় প্রকল্পটির কাজের পরিধি বাড়িয়ে এর নামকরণ হয় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’। একই সঙ্গে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় আরও রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জন্য একটি ১১ তলা ভবন নির্মাণ। ভবনটির নির্মাণকাল ছিল ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়।

সূত্র মতে, ভবনের নিচতলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা; যা দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেশটির এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে দেবে। ৯-১১ তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা; যা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরিয়ান কোম্পানি এলজি সামিহ। তবে কোরিয়ান ঠিকাদার এ কাজে বাগদাদ কনস্ট্রাকশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টর বা সহ-ঠিকাদার নিয়োগ করেছে। তারাই ভবন নির্মাণসহ ইন্টেরিয়র ও ডেকোরেশনের কাজ করছে।

গত ১৬ মে সরজমিনে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় ফায়ার ফিটিংসের যে কাজ করা হয়েছে তাতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। এমনকি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের যে ছাড়পত্র জমা দেয়া হয়েছে তাও জাল। গত ৭ মে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়, এই ভবনের অনুকুলে তারা কোন ছাড়পত্র প্রদান করেনি। ভবনের বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউজ পাশাপাশি স্থাপন করায় ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই ঝুঁকি এড়াতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে স্থাপনা দুটি আলাদা করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলা ছিদ্র করে সিঁড়ির সামনে ফায়ারফাইটিং কেস বসানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটাও যেকোন সময় মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। দ্বিতীয় তলার সিলিংয়ে কিছু এয়ারকন্ডিশনের (এসি) তার এলোমেলো থাকলেও এ পর্যন্ত একটিও এসি লাগানো হয়নি।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে কাকতালীয়ভাবে সেখানে উপস্থিত মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক নিজেই সাংবাদিকদের তৃতীয় তলায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেখানকার চিত্র দেখান। সেখানে বিলাসবহুল বা একজন মহাপরিচালকের ব্যবহার উপযোগী কোন ফিটিংস নেই। এমনকি তার নিজের কক্ষেও না। মহাপরিচালকের ওয়াশরুমের কোন কাজই এখনও শুরু হয়নি। তার কক্ষ ছাড়া তৃতীয় তলার কোথাও মার্বেল টাইলস নেই। এছাড়া তৃতীয় তলায় কোন এসি লাগানো হয়নি, লাইটিং নেই। অথচ ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচের কথা বলা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনটির ৭ তলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন তলায় অধিকাংশ দরজা প্লাস্টিকের তৈরি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কাঠের তৈরি দরজা লাগানোর কথা। এছাড়া কয়েকটি তলায় মেঝেতে টাইলস বসানো হয়নি। ওয়াশরুমে স্থাপন করা বেসিন, কমোড ও অন্যান্য ফিটিংসও নিম্নমানের। বৈদ্যুতিক তারও মানসম্মত বলে মনে হয়নি।

এদিকে সাংবাদিকরা নির্মাণাধীন ভবনটি দেখতে গেছেন- এ খবর পেয়ে প্রকল্প পরিচালক ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের পক্ষে এক ব্যক্তি ওইদিনই ফোন দিয়ে জানান, তিনি প্রককেল্পর বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। পরে পিডি আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের পক্ষে ১৮ মে দুপুরে উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ফরহাদ জলিল বিপ্লব নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শনকারী কয়েকজন সাংবাদিকের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, পিডি অসুস্থ। ডিপিডি দাবি করেন, ১১ তলা ভবন নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়নি। দরপত্রের শর্ত এবং এ সংক্রান্ত সরকারি বিধিবিধান মেনেই সবকিছুই করা হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের কাজ তদারকির ক্ষেত্রে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থাকার বিধান থাকালেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ একজন ডিপ্লোমা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কাজ করিয়েছেন। এর ফলে ভবনের কাজে নানা ধরনের ক্রটি হয়েছে। ভবনটিও পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি নিয়ে কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করার বিধান থাকলেও কাজের সময় সেই অনুমোদন নেয়া হয়নি। ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ সাব কন্ট্রাকে দিয়েছে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ। দক্ষিণ কোরিয়ার এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্প পরিচালক, মন্ত্রণালয়ের সঠিক নজরদারি না থাকায় মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি শুরু থেকে। এ অবস্থায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন আদৌ শেষ হবে কি না তা নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩ জন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্পের শুরুতে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল প্রকল্প পরিচালক হন। তিনি ঘুষসহ দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রকল্পের নতুন পরিচালকের দায়িত্ব পান আরেকজন কর্মকর্তা। তিনি তার চাকরির মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পরিচালক।

জানতে চাইলে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ নিজামুল হক বলেন, তাকে না জানিয়ে এবং কোন ধরনের অনুমোদন না নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। এজন্য পিডি দেলোয়ার রহমান ও কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহকে সরাসরি দায়ী করেন তিনি। মহাপরিচালক বলেন, এই সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পের কাজে যে গতি এসেছিল তাতে ভাটা পড়েছে। তার দাবি, আগে প্রকল্পের কাজ ৩০-৩৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকল্পের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে কমডোর নিজামুল হক বলেন, পিডি ও ঠিকাদারের অনিয়ম ও দুর্নীতি আমার নজরে আসার পর এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নৌ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি, কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও বলেছি। পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি।