বাড়ছে ডেঙ্গুর শঙ্কা, চাই জনসচেতনতা

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

দেশে প্রতিদিন ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে। মৌসুম শুরুর আগেই এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। এখনই মশা নিধনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সরকারি হিসাবেই চলতি মে মাসের ১৮ দিনে ৩৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপর দিকে চলতি বছরের জানুয়ারি প্রথম দিন থেকে ১৮ মে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচ মাসে এত মৃত্যু আর কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। সামনের জুন মাস থেকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি বাড়লে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কারণ আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরটি যেতে পারে তীব্র গরম ও খরা পরিস্থিতির মধ্যে। আর্দ্র ও গরম থাকতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া। এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির সঙ্গে আর্দ্রতা ও গরমের সম্পর্ক রয়েছে। চলতি বছর জুন থকে অক্টোবর মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব কম থাকতে পারে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন। ফলে বৃষ্টিপাতও কম হতে পারে এবং হতে পারে বেশ কিছু দিন পরপর। ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এই পরিবেশটা আদর্শ।

বাংলাদেশে ২০০১-০২ সালে প্রথমবার বিস্তৃতভাবে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। ডেঙ্গুজ্বর সংক্রমণের উচ্চ হার লক্ষ্য করা যায় বর্ষাকালে শহর ও উপশহর এলাকার জনগোষ্ঠীতে। ২০২২ সালে সারা দেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন, এর বাইরে আরো অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছেন এবং অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। এদের হিসাব সরকারি খাতায় ওঠানোর সুযোগ নেই। অন্য দিকে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। ডেঙ্গুজ্বর আমাদের কাছে অতিমারী না হলেও কোনো অংশে কম নয়। প্রতি বছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করছে। আর ডেঙ্গু হলে অনেকে সকাল-বিকেল প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন বা প্লাটিলেট একটু কমতে থাকলেই আতঙ্কিত হতে থাকেন। এর কোনোই দরকার নেই। বারবার পরীক্ষা করালে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বাড়া ছাড়া আর কোনো উপকার হয় না। আবার মেশিনে গুনলে এই সংখ্যা ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট ক্লাম্প বা গুচ্ছ হিসাবে থাকায় মেশিন অনেকগুলোকে একটা হিসেবে ধরে সংখ্যা নিরূপণ করে।

মূলত ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে রক্তের বদলে রক্ত দেয়াই উত্তম, প্লাটিলেট নয়। তাছাড়া প্লাটিলেট সঞ্চালন খুবই ব্যয়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এক ইউনিটের জন্য চারজন দাতাকে রক্ত দিতে হয়। সর্বত্র প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।

সব মিলিয়ে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমা ও প্লাটিলেট জোগাড় নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা ও ছোটাছুটি করবেন না। সাধারণ ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথেষ্ট তরল খাবার খান। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে যেমনিভাবে ব্যক্তি সচেতন থাকতে হবে তেমনিভাবে অন্যকেও সচেতন করতে হবে। আর বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। ১৯৮২-৮৩ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মহানগরের স্কুলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে সর্বমোট ২,৪৫৬ রক্তের নমুনার মধ্যে ২৭৮টিতে ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়ে। ১৯৮৪-৮৬ সালে ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত রক্তের ২১টি নমুনার সবগুলোতেই সংক্রমণের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা প্রায় ১১% রোগীর (২৫০ জনের মধ্যে ২৭ জন) মধ্যে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেনের পজেটিভ অ্যান্টিবডি টাইটার ধরা পড়েছিল। ১৯৯৯ সালে ঢাকার মহাখালির স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো সন্দেহজনক রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪১টির মধ্যে ৯৮টিতে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব পেয়েছিল। ওই ইনস্টিটিউট প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্যে এগুলোর মধ্যে কয়েকটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরও তথ্য ছিল। ঢাকা শহরের চিকিৎসকদের দেয়া তথ্য থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর অস্তিত্বের কথা জানা গেছেÑ

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ : ডেঙ্গুজ্বর ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানা রকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যুও ঘটে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি এবং লাল ফুসকুড়ি। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছুদিন ক্লান্তি অনুভব করতে পারে এবং এরপর সেরে ওঠে।

বেশির ভাগ সংক্রমণই, বিশেষত ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ লক্ষণহীন অথবা ন্যূনতম লক্ষণযুক্ত হতে পারে। ত্বকে স্ফোট দেখা দেয় প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে, যা প্রথমে হাতে, পায়ে এবং পরে ঘাড়ে ছড়িয়ে যায়। জ্বর চলাকালীন সময় মুখ, গলা বা বুক রক্তাভ দেখায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চোখে রক্তক্ষরণ।

ডেঙ্গুজ্বরের ক্লিনিক্যাল কোর্স : ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে (সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন) রোগের উপসর্গ দেখা যায়। এই কালপর্বকে বলা হয় ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’। উপসর্গগুলো ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর জীবাণুতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা থাকে উপসর্গবিহীন কিংবা থাকে সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ নিয়ে।

ডেঙ্গুজ্বরের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : প্রথম সাত দিনে পিসিআর, ভাইরাল অ্যান্টিজেন ডিটেকশন প্রায় নির্ভুলভাবে রোগ শনাক্ত করতে পারে। জ্বরের পাঁচ-সাত দিন পর থেকে আইজি অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় এবং উপসর্গসহ সেরোলজি টেস্টে এই অ্যান্টিবডির শনাক্তকরণ রোগনিরূপক বলে গণ্য করা হয়।

ডেঙ্গুজ্বরের জটিলতা হলো রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে যাওয়া। রক্তে অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মান প্রতি মিলিলিটার ১,৫০০০০ থেকে ২,৫০০০০। ডেঙ্গুজ্বরে তা দ্রুত কমে যায়। তা যদি প্রতি মিলিলিটারের ২০,০০০-এ থাকে, তবে রোগী মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে দু-চার দিনের মধ্যে অণুচক্রিকার সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে থাকে। রক্তে হিমাটোক্রিটের বাড়তি মানও খারাপ। রক্তের প্লাজমা রক্তনালি ভেদ করে বাইরে টিস্যুতে নিঃসরিত হওয়ার কারণে এটা ঘটে। এছাড়া রক্তের শ্বেতকণিকা কমে যাওয়া, অ্যালবুমিন মান কমে যাওয়ার মতো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। ক্যাপিলারি লিকেজের কারণে বুকে ও পেটে পানি জমতে পারে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা : ডেঙ্গুজ্বরের সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সাধারণ ডেঙ্গুরোগী আরোগ্য লাভ করে। প্রায় ৮৫ শতাংশ ডেঙ্গুজ্বর থাকে সাধারণ মাত্রার, বাড়িতে যার চিকিৎসা করানো সম্ভব। যেমন জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল গ্রহণ করতে হবে। অ্যাসপিরিন বা এ-জাতীয় ওষুধ কখনোই জ্বর নিবারণে ব্যবহার করা যাবে না। এতে রক্তপাতের আশঙ্কা বাড়ে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে, বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান করতে হবে। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষত জ্বর সম্পূর্ণ চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার পরে যদি রোগী বেশি অসুস্থতা অনুভব করে, তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে প্রয়োজনে রক্ত বা প্লাজমা সঞ্চালন করতে হয়। সাধারণত ডেঙ্গুজ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েডের কোনো ভূমিকা নেই। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বিশেষভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী? : প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু উত্তম বললেও কম বলা হয়। এটাই বাঁচার ভালো উপায়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মুলের কোন বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোন অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সব প্রকারের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেও এগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।

ডেঙ্গুজ্বর হলে আতঙ্ক নয় জটিলতাভিত্তিক চিকিৎসা করা হলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই ডেঙ্গুর লাভা যেন গঠিত হতে না পারে সে ব্যাপারে বাড়ির চারদিকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত অভ্যাসগুলোকে মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা গঠন করা দরকার। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকে সচেতন করা এবং জনসাধারণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা জরুরি। শহরকেন্দ্রিক সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তা করা। আর জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক নগরীর কাউন্সিলররা যদি উদ্যোগ নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে উপস্থিতদের মধ্যে ডেঙ্গু সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন ও ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি এ ব্যাপারে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ বেশি জরুরি।

[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

সোমবার, ২২ মে ২০২৩ , ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০২ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

বাড়ছে ডেঙ্গুর শঙ্কা, চাই জনসচেতনতা

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

দেশে প্রতিদিন ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে। মৌসুম শুরুর আগেই এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। এখনই মশা নিধনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সরকারি হিসাবেই চলতি মে মাসের ১৮ দিনে ৩৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপর দিকে চলতি বছরের জানুয়ারি প্রথম দিন থেকে ১৮ মে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচ মাসে এত মৃত্যু আর কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। সামনের জুন মাস থেকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি বাড়লে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কারণ আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরটি যেতে পারে তীব্র গরম ও খরা পরিস্থিতির মধ্যে। আর্দ্র ও গরম থাকতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া। এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির সঙ্গে আর্দ্রতা ও গরমের সম্পর্ক রয়েছে। চলতি বছর জুন থকে অক্টোবর মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব কম থাকতে পারে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন। ফলে বৃষ্টিপাতও কম হতে পারে এবং হতে পারে বেশ কিছু দিন পরপর। ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এই পরিবেশটা আদর্শ।

বাংলাদেশে ২০০১-০২ সালে প্রথমবার বিস্তৃতভাবে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। ডেঙ্গুজ্বর সংক্রমণের উচ্চ হার লক্ষ্য করা যায় বর্ষাকালে শহর ও উপশহর এলাকার জনগোষ্ঠীতে। ২০২২ সালে সারা দেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন, এর বাইরে আরো অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছেন এবং অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। এদের হিসাব সরকারি খাতায় ওঠানোর সুযোগ নেই। অন্য দিকে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। ডেঙ্গুজ্বর আমাদের কাছে অতিমারী না হলেও কোনো অংশে কম নয়। প্রতি বছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করছে। আর ডেঙ্গু হলে অনেকে সকাল-বিকেল প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন বা প্লাটিলেট একটু কমতে থাকলেই আতঙ্কিত হতে থাকেন। এর কোনোই দরকার নেই। বারবার পরীক্ষা করালে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বাড়া ছাড়া আর কোনো উপকার হয় না। আবার মেশিনে গুনলে এই সংখ্যা ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট ক্লাম্প বা গুচ্ছ হিসাবে থাকায় মেশিন অনেকগুলোকে একটা হিসেবে ধরে সংখ্যা নিরূপণ করে।

মূলত ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে রক্তের বদলে রক্ত দেয়াই উত্তম, প্লাটিলেট নয়। তাছাড়া প্লাটিলেট সঞ্চালন খুবই ব্যয়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এক ইউনিটের জন্য চারজন দাতাকে রক্ত দিতে হয়। সর্বত্র প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।

সব মিলিয়ে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমা ও প্লাটিলেট জোগাড় নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা ও ছোটাছুটি করবেন না। সাধারণ ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথেষ্ট তরল খাবার খান। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে যেমনিভাবে ব্যক্তি সচেতন থাকতে হবে তেমনিভাবে অন্যকেও সচেতন করতে হবে। আর বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। ১৯৮২-৮৩ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মহানগরের স্কুলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে সর্বমোট ২,৪৫৬ রক্তের নমুনার মধ্যে ২৭৮টিতে ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়ে। ১৯৮৪-৮৬ সালে ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত রক্তের ২১টি নমুনার সবগুলোতেই সংক্রমণের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা প্রায় ১১% রোগীর (২৫০ জনের মধ্যে ২৭ জন) মধ্যে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেনের পজেটিভ অ্যান্টিবডি টাইটার ধরা পড়েছিল। ১৯৯৯ সালে ঢাকার মহাখালির স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো সন্দেহজনক রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪১টির মধ্যে ৯৮টিতে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব পেয়েছিল। ওই ইনস্টিটিউট প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্যে এগুলোর মধ্যে কয়েকটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরও তথ্য ছিল। ঢাকা শহরের চিকিৎসকদের দেয়া তথ্য থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর অস্তিত্বের কথা জানা গেছেÑ

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ : ডেঙ্গুজ্বর ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানা রকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যুও ঘটে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি এবং লাল ফুসকুড়ি। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছুদিন ক্লান্তি অনুভব করতে পারে এবং এরপর সেরে ওঠে।

বেশির ভাগ সংক্রমণই, বিশেষত ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ লক্ষণহীন অথবা ন্যূনতম লক্ষণযুক্ত হতে পারে। ত্বকে স্ফোট দেখা দেয় প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে, যা প্রথমে হাতে, পায়ে এবং পরে ঘাড়ে ছড়িয়ে যায়। জ্বর চলাকালীন সময় মুখ, গলা বা বুক রক্তাভ দেখায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চোখে রক্তক্ষরণ।

ডেঙ্গুজ্বরের ক্লিনিক্যাল কোর্স : ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে (সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন) রোগের উপসর্গ দেখা যায়। এই কালপর্বকে বলা হয় ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’। উপসর্গগুলো ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর জীবাণুতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা থাকে উপসর্গবিহীন কিংবা থাকে সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ নিয়ে।

ডেঙ্গুজ্বরের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : প্রথম সাত দিনে পিসিআর, ভাইরাল অ্যান্টিজেন ডিটেকশন প্রায় নির্ভুলভাবে রোগ শনাক্ত করতে পারে। জ্বরের পাঁচ-সাত দিন পর থেকে আইজি অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় এবং উপসর্গসহ সেরোলজি টেস্টে এই অ্যান্টিবডির শনাক্তকরণ রোগনিরূপক বলে গণ্য করা হয়।

ডেঙ্গুজ্বরের জটিলতা হলো রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে যাওয়া। রক্তে অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মান প্রতি মিলিলিটার ১,৫০০০০ থেকে ২,৫০০০০। ডেঙ্গুজ্বরে তা দ্রুত কমে যায়। তা যদি প্রতি মিলিলিটারের ২০,০০০-এ থাকে, তবে রোগী মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে দু-চার দিনের মধ্যে অণুচক্রিকার সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে থাকে। রক্তে হিমাটোক্রিটের বাড়তি মানও খারাপ। রক্তের প্লাজমা রক্তনালি ভেদ করে বাইরে টিস্যুতে নিঃসরিত হওয়ার কারণে এটা ঘটে। এছাড়া রক্তের শ্বেতকণিকা কমে যাওয়া, অ্যালবুমিন মান কমে যাওয়ার মতো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। ক্যাপিলারি লিকেজের কারণে বুকে ও পেটে পানি জমতে পারে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা : ডেঙ্গুজ্বরের সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সাধারণ ডেঙ্গুরোগী আরোগ্য লাভ করে। প্রায় ৮৫ শতাংশ ডেঙ্গুজ্বর থাকে সাধারণ মাত্রার, বাড়িতে যার চিকিৎসা করানো সম্ভব। যেমন জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল গ্রহণ করতে হবে। অ্যাসপিরিন বা এ-জাতীয় ওষুধ কখনোই জ্বর নিবারণে ব্যবহার করা যাবে না। এতে রক্তপাতের আশঙ্কা বাড়ে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে, বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান করতে হবে। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষত জ্বর সম্পূর্ণ চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার পরে যদি রোগী বেশি অসুস্থতা অনুভব করে, তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে প্রয়োজনে রক্ত বা প্লাজমা সঞ্চালন করতে হয়। সাধারণত ডেঙ্গুজ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েডের কোনো ভূমিকা নেই। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বিশেষভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী? : প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু উত্তম বললেও কম বলা হয়। এটাই বাঁচার ভালো উপায়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মুলের কোন বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোন অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সব প্রকারের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেও এগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।

ডেঙ্গুজ্বর হলে আতঙ্ক নয় জটিলতাভিত্তিক চিকিৎসা করা হলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই ডেঙ্গুর লাভা যেন গঠিত হতে না পারে সে ব্যাপারে বাড়ির চারদিকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত অভ্যাসগুলোকে মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা গঠন করা দরকার। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকে সচেতন করা এবং জনসাধারণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা জরুরি। শহরকেন্দ্রিক সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তা করা। আর জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক নগরীর কাউন্সিলররা যদি উদ্যোগ নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে উপস্থিতদের মধ্যে ডেঙ্গু সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন ও ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি এ ব্যাপারে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ বেশি জরুরি।

[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]