টেলিগ্রাম অ্যাপসে গ্রুপ তৈরি করে তরুণীদের নগ্ন ভিডিও বিক্রি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেলিগ্রাম অ্যাপস নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এক সময় জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করতো। সেই অ্যাপস এখন একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ ব্যবহার করছে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪ লাখ সদস্য এ অ্যাপসের ফলোয়ার। বাবা-মায়ের আদরে হাতে স্মার্ট ফোন পাওয়া ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী অর্থ দিয়ে এ অ্যাপস থেকে সংগ্রহ করছে নগ্ন ছবি, ভিডিও কনটেইন্ট। অনেক সময় প্রেমিকরাও তাদের প্রেমিকদের ফাঁদে ফেলে এ অ্যাপসে আপত্তিজনক ছবি আপলোড দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাইবার জগতে বড় ধরনের অপরাধ ও ফাঁদে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। অ্যাপস পরিচালানা গ্রুপটি প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এক ভুক্তভোগীর করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার ইউনিট। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে অ্যাডমিনসহ ৯ জনকে আটকের পর বেশ চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। সেই সঙ্গে প্রকাশ পায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কীভাবে অভিভাবকদের অবহেলা বা নজরদারীর অভাবে বিপদগামী হচ্ছিল। সিআইডি ইতোমধ্যে অ্যাপস বন্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুরোধ জানিয়েছে।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, আবু সাহেম নামের এক যুবক মার্ক সাককারবাগ পরিচয়ে টেলিগ্রাম অ্যাপসে অ্যাডমিন হিসেবে পমপম নামে ৩টি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে। মূলত টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে সে নগ্ন ছবি ও ভিডিও আপলোড করে থাকে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ফলোয়ার হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কৌতুহল বসতো অ্যাপসের ফয়োয়ার হয়। এরপর নগ্ন ছবি বা ভিডিও দেখার আগ্রহ নিয়ে ২ হাজার টাকা পরিশোধ করে পমপম গ্রুপের সদস্য হয়। এরপর সে নিজের চাহিদামতো ছবি ও ভিডিও কিনে নেয় আ্যাডমিন গ্রুপের কাছ থেকে।

সম্প্রতি এক তরুণী এ চক্রের ফাঁদে পড়ে। ওই তরুণীর কিছু নগ্ন ছবি এ গ্রুপে প্রকাশ পায়। পরে ভুক্তভোগী তরুণী এ ঘটনায় একটি মামলা করে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগ তদন্ত করে এ চক্রের সন্ধান পায়। এরপর অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে হোতা মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটকে আটক করে। চক্রটি নিজেদের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচয় দিলেও তাদের মূল কাজ ছিল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ছবি ও ও ভিডিও এ্যাডিটিং করে নগ্ন কনটেইন্ট তৈরি করা। এরপর সেগুলো বিক্রি করা। কখনো কখনো এরা ফলোয়ারদের জিম্মি করে তাদের নগ্ন ভিডিও বা ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিতো।

সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, চক্রের হোতা মার্ক সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েমের একটি ব্যাংক হিসেবে কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৪ লাখ ছাত্রছাত্রী আবু সায়েমকে অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে এ অ্যাপসে ভিডিও বা ছবি দেখার সুযোগ পেতো। এভাবে সে গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে এমন অনেক জুটির মধ্যে কোন কারণে সম্পর্কে ছেদ ধরে। তখন প্রেমিক শিক্ষার্থী তার প্রেমিকা বা সহপাঠির ছবি এ গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়। এরপর গ্রুপের অ্যাডমিনরা সেই ছবিগুলো দ্রুত আপলোড করে রাখে। ছবি ছড়িয়ে দেয়া প্রেমিক যদি কোন কারণে ওই ছবি গ্রুপ থেকে ডিলিট করেও দেয় তারপরও সেগুলো অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপের কাছে থেকে যেতো। পরে সেগুলো তারা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভিডিও এরা অন্যদের কাছে বিক্রি করতো অর্থের বিনিময়ে।

সিআইডি জানান, চক্রটির নেতৃত্ব দেয়া মার্ক-সাকারবাগ নামের ব্যক্তি যার মূল নাম আবু সায়েম। তাকে শুরুতে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। মার্কের আসল নাম আবু সায়েমের নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। চট্টগ্রামে থাকা এ যুবক বেকার ছিল। এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। সে শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাাম থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছে। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এরই মধ্যে এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ঘমঘম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়ায় ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মামলা করেন। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্কের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রাামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডি জানিয়েছে গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে। মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট কিনে সংরক্ষণ করেন।

চক্রটির হোতা মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক সাকারবার্গ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপে আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেইসবুক বা ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো এক সময়।

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ সু-সময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তারা ক্যামেরাবন্দী করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেইসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রমিয়াম সার্ভস কিনতে হয়।

সিআইডি প্রধান বলেন, মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। দেখা যায়, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেয়া। মশিউরের চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।

সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই এডাল্ট গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল স¤্রাট।

মঙ্গলবার, ২৩ মে ২০২৩ , ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৩ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

টেলিগ্রাম অ্যাপসে গ্রুপ তৈরি করে তরুণীদের নগ্ন ভিডিও বিক্রি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেলিগ্রাম অ্যাপস নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এক সময় জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করতো। সেই অ্যাপস এখন একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ ব্যবহার করছে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪ লাখ সদস্য এ অ্যাপসের ফলোয়ার। বাবা-মায়ের আদরে হাতে স্মার্ট ফোন পাওয়া ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী অর্থ দিয়ে এ অ্যাপস থেকে সংগ্রহ করছে নগ্ন ছবি, ভিডিও কনটেইন্ট। অনেক সময় প্রেমিকরাও তাদের প্রেমিকদের ফাঁদে ফেলে এ অ্যাপসে আপত্তিজনক ছবি আপলোড দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাইবার জগতে বড় ধরনের অপরাধ ও ফাঁদে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। অ্যাপস পরিচালানা গ্রুপটি প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এক ভুক্তভোগীর করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার ইউনিট। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে অ্যাডমিনসহ ৯ জনকে আটকের পর বেশ চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। সেই সঙ্গে প্রকাশ পায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কীভাবে অভিভাবকদের অবহেলা বা নজরদারীর অভাবে বিপদগামী হচ্ছিল। সিআইডি ইতোমধ্যে অ্যাপস বন্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুরোধ জানিয়েছে।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, আবু সাহেম নামের এক যুবক মার্ক সাককারবাগ পরিচয়ে টেলিগ্রাম অ্যাপসে অ্যাডমিন হিসেবে পমপম নামে ৩টি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে। মূলত টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে সে নগ্ন ছবি ও ভিডিও আপলোড করে থাকে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ফলোয়ার হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কৌতুহল বসতো অ্যাপসের ফয়োয়ার হয়। এরপর নগ্ন ছবি বা ভিডিও দেখার আগ্রহ নিয়ে ২ হাজার টাকা পরিশোধ করে পমপম গ্রুপের সদস্য হয়। এরপর সে নিজের চাহিদামতো ছবি ও ভিডিও কিনে নেয় আ্যাডমিন গ্রুপের কাছ থেকে।

সম্প্রতি এক তরুণী এ চক্রের ফাঁদে পড়ে। ওই তরুণীর কিছু নগ্ন ছবি এ গ্রুপে প্রকাশ পায়। পরে ভুক্তভোগী তরুণী এ ঘটনায় একটি মামলা করে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগ তদন্ত করে এ চক্রের সন্ধান পায়। এরপর অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে হোতা মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটকে আটক করে। চক্রটি নিজেদের ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচয় দিলেও তাদের মূল কাজ ছিল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ছবি ও ও ভিডিও এ্যাডিটিং করে নগ্ন কনটেইন্ট তৈরি করা। এরপর সেগুলো বিক্রি করা। কখনো কখনো এরা ফলোয়ারদের জিম্মি করে তাদের নগ্ন ভিডিও বা ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিতো।

সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, চক্রের হোতা মার্ক সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েমের একটি ব্যাংক হিসেবে কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৪ লাখ ছাত্রছাত্রী আবু সায়েমকে অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে এ অ্যাপসে ভিডিও বা ছবি দেখার সুযোগ পেতো। এভাবে সে গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে এমন অনেক জুটির মধ্যে কোন কারণে সম্পর্কে ছেদ ধরে। তখন প্রেমিক শিক্ষার্থী তার প্রেমিকা বা সহপাঠির ছবি এ গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়। এরপর গ্রুপের অ্যাডমিনরা সেই ছবিগুলো দ্রুত আপলোড করে রাখে। ছবি ছড়িয়ে দেয়া প্রেমিক যদি কোন কারণে ওই ছবি গ্রুপ থেকে ডিলিট করেও দেয় তারপরও সেগুলো অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপের কাছে থেকে যেতো। পরে সেগুলো তারা ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভিডিও এরা অন্যদের কাছে বিক্রি করতো অর্থের বিনিময়ে।

সিআইডি জানান, চক্রটির নেতৃত্ব দেয়া মার্ক-সাকারবাগ নামের ব্যক্তি যার মূল নাম আবু সায়েম। তাকে শুরুতে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। মার্কের আসল নাম আবু সায়েমের নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। চট্টগ্রামে থাকা এ যুবক বেকার ছিল। এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। সে শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাাম থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছে। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এরই মধ্যে এক ভুক্তভোগী এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ঘমঘম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়ায় ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মামলা করেন। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্কের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রাামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডি জানিয়েছে গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে। মাসে ১ থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট কিনে সংরক্ষণ করেন।

চক্রটির হোতা মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক সাকারবার্গ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপে আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেইসবুক বা ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো এক সময়।

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ সু-সময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তারা ক্যামেরাবন্দী করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেইসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার প্রমিয়াম সার্ভস কিনতে হয়।

সিআইডি প্রধান বলেন, মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। দেখা যায়, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেয়া। মশিউরের চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।

সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই এডাল্ট গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল স¤্রাট।