নজরুল-মূল্যায়নে মানস-প্রতিবন্ধ

যতীন সরকার

উনিশ শতকের বাংলা কবিতার বিচার করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন যে, ‘মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি।’ আর ঈশ্বর গুপ্তের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ বলে। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছিলেন, ‘এখন আর খাঁটি বাঙালি কবি জন্মে না- জন্মিবার জো নাই- জন্মিয়া কাজ নাই।’

বঙ্কিমচন্দ্র যখন এসব কথা বলেছিলেন, তার অনেক পরে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা মিথ্যা করে দিয়েই যেন এমন একজন কবির আবির্ভাব ঘটল যিনি খাঁটি বাঙালি কবি। এই কবিই কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ তাঁকে আমরা খাঁটি বাঙালি বলে চিনে নিতে পারলাম না; বরং তাঁর কবি পরিচয়কে নানাভাবে খণ্ডিত করলাম। কারণ, এ কালের বাংলা কবিতার পাঠক হচ্ছি আমরা নিজেদের যারা আধুনিক ও নাগরিক শিক্ষায় ‘শিক্ষিত বাঙালি’ বলে মনে করি। কবিতার বিচারক-সমালোচকও এই আমরাই। আমাদের সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষা আমাদেরকে অর্থাৎ বাংলা কবিতার এই ‘বিদগ্ধ’ পাঠক ও সমালোচককুলকে খাঁটি বাঙালিত্বকে উপলব্ধি করার শক্তিই নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ককোষ যেসব ভাবনায় পূর্ণ, সেসবের সঙ্গে খাঁটি বাঙালিত্বের সম্পর্ক একান্তই ক্ষীণ। আমরা গ্রাম্যতা পরিহার করে বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে সতত আগ্রহী, খাঁটি বাঙালিত্ব আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্ত গ্রাম্যতা বৈ অন্য কিছু নয়। গ্রাম্য প্রতিবেশীর থেকে অনায়াসে আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি, কিন্তু নাগরিক বিদেশির প্রতি আমাদের প্রীতি একান্ত সীমাহীন। সেই প্রীতি প্রকাশের জন্য নিতান্ত কাঙালপনা করতেও আমাদের রুচিতে বাধে না।

আমাদের এ রকম মানস-প্রতিবন্ধের দরুনই এ পর্যন্ত আমরা নজরুল-মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি। এসব মানস-প্রতিবন্ধ থেকে মুক্ত হতে না পারলে সে ব্যর্থতা কোনোদিনই ঘুচবে না।

আমাদের মধ্যে যারা আরো অগ্রসর, যাদের মনমানসে প্রতীচ্যের সাহিত্যভাবনা সর্বাতিশয়ী প্রভাব বিস্তার করে বসেছে, তারা বাংলা ও বাঙালিকেও প্রতীচ্যের দর্পণে অবলোকন করেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কবিতা-বিচারেও প্রতীচ্যের মানদণ্ডই তাদের অবলম্বন, অন্য কোনো মানদণ্ডের কথা তারা ভাবতেই পারেন না। তাদের কাছে গ্রাহ্য ওই একমাত্র মানদণ্ডটি দিয়ে নজরুল ও তার কবিতাকে মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব যে নয়, সে কথা তাদের প্রায় কেউই বুঝতে চান না। কিংবা কেউ কেউ কখনো কখনো বুঝলেও সব সময় তা মানতে পারেন না। তাই আধুনিক বাংলার কোনো কোনো বিদগ্ধ কবি-সমালোচক একেক সময় একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নজরুল সম্পর্কে কিছু বিমুগ্ধ বাক্য উচ্চারণ করে ফেলেছেন বটে, কিন্তু সেই বিমুগ্ধতাকে বেশ দূর ধরে রাখতে পারেননি। কিংবা ধরে রেখে স্বস্তি পাননি। আধুনিকতা, নাগরিকতা ও বৈশ্বিকতা সংস্কার তথা মানস-প্রতিবন্ধ তাদের অন্য পথে নিয়ে গেছে। সেই মানস-প্রতিবন্ধের দরুন নজরুলের ভেতর তারা আধুনিকতার সন্ধান পান না। এক কৃত্রিম নাগরিকতার বৃত্তসীমায় বন্দি হয়ে এক ধরনের উন্নাসিক রুচি তাদের ভেতর গড়ে উঠেছে। সেই রুচির সঙ্গে যা মেলে না, তার সব কিছুই তাদের বিবেচনায় রুচি-বিগর্হিত। সে কারণেই নজরুলের কবিতায় তারা ‘রুচির স্খলন’ দেখতে পান। তার কবিতার বহিরঙ্গে ও অন্তর্গত বক্তব্যে, প্রকরণে ও প্রসঙ্গে তাদের প্রত্যাশিত আধুনিকতার ও নাগরিকতার কিংবা যুদ্ধোত্তরকালে পুঁজিবাদী প্রতীচ্যভাবিত বৈশ্বিকতার দেখা না পেয়ে নজরুলকে তাদের বিবেচনার বাইরে রেখে দেয়াই সমীচীন মনে করেন। এ রকম অনেক সমালোচকের বাংলা কবিতা নিয়ে লিখিত বইগুলোর পাতায় চোখ বুলিয়ে গেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। বাংলা কবিতার আলোচনায় নজরুলের প্রসঙ্গ তারা হয় পুরোপুরি এড়িয়ে যান, অথবা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র কায়দামাফিক কিছু মামুলি বা দ্ব্যর্থক কথা বলে দায় সারেন।

নজরুলের কবিতায় অনেক অনন্যসাধারণ উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পর তথা কলানৈপুণ্যের প্রয়োগ যখন তাদের অভিভূত করে ফেলে, তখনও তারা সেই অভিভূতিকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চান এই বলে যে, নজরুলের কোনো পুরো কবিতাই কবিতা হয়ে ওঠেনি; তার কোনো কোনো কবিতার কোনো কোনো চরণে শৈল্পিকতার ঝিলিক দেখিয়ে তিনি হয়ে থেকেছেন নিতান্তই ‘চরণের কবি’ কিংবা বড়জোর ‘স্তবকের কবি’, প্রকরণের ক্ষেত্রে তার কিছু কিছু মুন্সিয়ানাকে বাহবা দিলেও বাংলা কবিতার আধুনিকতাবাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী, নয়াকলাকৈবল্যবাদী ও বিশুদ্ধতাবাদী বিদগ্ধ সমালোচকরা নজরুলের কবিতার বিষয়বস্তুর প্রতি একান্তই বিরূপ। সে বিরূপতা তারা গোপন করেন না। তারা দেখেন নজরুল বড় বেশি সাময়িকতাতাড়িত, নানা সাময়িক ঘটনা ও দুর্ঘটনা তার ভেতর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, সেই প্রতিক্রিয়াকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পদ্যের পঙ্ক্তিতে বন্দি করে ফেলেন, আর তার সেই পদ্যপঙ্ক্তিগুলোকেই কাব্যবোধহীন প্রাকৃতজন কবিতা বলে বাহবা দেয়। এসব পদ্যপঙ্ক্তিতে প্রায়শই কোনো গভীরতা থাকে না, রহস্যময়তা থাকে না, আলো-আঁধারির বা বোঝা-না বোঝার খেলা থাকে না। তার বদলে থাকে কিছু চাঁছাছোলা একান্ত নিরাবরণ বস্তুততান্ত্রিক সত্য ও তথ্যের এবং বিশেষ কিছু রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যের একান্ত স্পষ্ট, নিঃশঙ্ক, নিঃসংকোচ ও উচ্চকণ্ঠ উচ্চারণ। সাধারণ্যে কবিতা বলে প্রচারিত এইসব পদ্যপঙ্ক্তি বিদগ্ধ কাব্য সমালোচকদের কাছে ছন্দের গাঁথা স্লোগান মাত্র- কবিতা নয় কোনোমতেই।

তবু বাঙালি প্রাকৃতজনের অন্তর আসনে কবিরূপেই নজরুলের প্রতিষ্ঠা দৃঢ় হয়ে থাকতে দেখে বিদগ্ধ কাব্যসমালোচকরাও নজরলকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করতে পারেন না, তবে কাব্যকৃতিকে কোনো না কোনোভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। সে রকম মেনে নেওয়ার জন্য নজরুলকে তাদের সুবিধানুযায়ী ব্যবচ্ছেদ করে নেন, এবং তার কিছু খণ্ডিত অংশের জন্য প্রশস্তিÍ বাক্য উচ্চারণ করেন। তাদের কেউ নজরুলের গানের উচ্চ প্রশংসা করে তাকে প্রথম শ্রেণির সঙ্গীতকারের আসনে বসান এবং তার কবিতার উৎকর্ষকে পেছনে ঠেলে দেন। কেউ বা দেখাতে চান যে কিছু প্রেমের কবিতাতেই নজরুলের কিছুটা সিদ্ধিলাভ ঘটেছে, অন্য ধরনের কবিতায় তার কৃতি নিতান্তই নিষ্প্রভ। এ রকমভাবে কেবলই যারা বিশুদ্ধ কবিতা কিংবা কবিতায় বিশুদ্ধতা খুঁজে ফেরেন, তথাকথিত বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে ‘কবিতা’ আর অকবিতা’র ভেদ নির্ণয় করে চলেন প্রতিনিয়ত, তাদের পক্ষে নজরুলকে এ রকম খণ্ড-বিখণ্ড করে দেখাই স্বাভাবিক।

খণ্ডিতকরণের আরেকটি কারণ ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালির খণ্ডিত ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষা। আমরা জানি ব্রিটিশরাজ-প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রথম থেকেই সমস্ত বাঙালির জন্য খুলে যায়নি। সে শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পেরেছিল তারাই যারা বিদেশি রাজার অধীনে সৃষ্ট নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। নানা ঐতিহাসিক কার্যকারণের সূত্রে সে শ্রেণিটি গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়ে। এরাই পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘ভদ্রলোক’ নামে। গোড়া থেকেই এই ‘ভদ্রলোক’রা ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘ছোটলোকদের’ থেকে বিচ্ছিন্ন। মূলত চাষি-মজুর ও বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীরাই ছোটলোক বলে বিবেচিত। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিচারে এই ছোটলোকদের মধ্যে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। তবু ‘ভদ্রলোক’রা হিন্দু বলেই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেও হিন্দু ঐতিহ্যের উপাদানেই তাদের মনমানস পুষ্ট হতে থাকে। হিন্দুর ঐতিহ্যিক দৃষ্টি দিয়েই তারা তাদের সমকালীন জগৎকে দেখে, হিন্দু ঐতিহ্যের নবায়ন ঘটিয়েই তাদের হাত দিয়ে আধুনিক শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসারণ ঘটে। তাই হিন্দুত্বের সূত্র ধরে হিন্দু ‘ছোটলোক’দের সঙ্গে ওই ‘ভদ্রলোক’দের সম্পর্কের একটা ক্ষীণ ধারা বজায় থাকলেও মুসলমানদের ভাবজগতের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। বাঙালির সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যে কিংবা প্রাক ব্রিটিশযুগের কাব্য সাধনায় যে সম্মিলিত ঐতিহ্যসমৃদ্ধ খাঁটি বাঙালিত্ব ভিত গেড়েছিল, নতুন শিক্ষাপুষ্ট আধুনিকতা সে ভিতটি ভেঙে ফেলল। ‘খাঁটি বাঙালি’ থেকে শিক্ষিত বাঙালির ব্যবধান ক্রমেই দুস্তর হয়ে পড়তে লাগল। শিক্ষিত বাঙালি কবির পক্ষেও লোকসাহিত্যের খাঁটি বাঙালি কবির মতো কোরান-পুরাণের মেলবন্ধ ঘটানো সম্ভব হলো না। কিংবা সম্ভব হলো না প্রাক-আধুনিককালের শেষ শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের মতো প্রয়োজনমাফিক ‘যাবনী মেশাল’ বাংলায় ‘কাব্যরসের’ জোগান দেওয়া।

যে ঈশ্বর গুপ্তকে বঙ্কিমচন্দ্র শেষতম ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ বলে বিবেচনা করেছেন, সেই গুপ্ত কবির বাঙালিত্বকেও তো নির্ভেজাল ‘খাঁটি’ বলে মেনে নেওয়া কঠিন। নবসৃষ্ট কলকাতার নাগরিক সমাজ তার খাঁটিত্বকেও বহুল পরিমাণে খর্ব ও খণ্ডিত করেছে। খাঁটি বাঙালি লোককবির মতো তার চেতনায় ‘পুবের ভানুশ্বর’ ‘আলির মাল্লামের পাথর’ ‘মক্কাহেন স্থান’ ও ‘ক্ষীরনদী সাগর’-এর সহাবস্থান নেই। যেসব পার্বণের কথা নিয়ে তিনি পদ্য রচনা করেছেন সেসবই হিন্দু বাঙালির পার্বণ।

মুসলমান বাঙালির পার্বণ বা পার্বণের আনন্দ তার চৈতন্যে অনুপস্থিত। অর্থাৎ বলতে হয় যে, হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমানের নানা ভাবধারার সংঘাত সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যমণ্ডিত বাঙালি সমাজের বহুমাত্রিকতা থেকে বহুদূরে সরে এসেছিলেন ‘যুগসন্ধির কবি’ বলে খ্যাত ঈশ্বর গুপ্তও। ঈশ্বর গুপ্ত যদি ‘খাঁটি বাঙালির কবি’ হয়েও থাকেন, তবু সকল শ্রেণি ও গোষ্ঠীর খাঁটি বাঙালির প্রতিনিধিত্ব তিনি করতে পারেননি। এবং ঈশ্বর গুপ্তের পরবর্তী যেসব কবিকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘শিক্ষিত বাঙালির কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাদের সৃষ্টিসম্ভার বাংলাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সম্মানের আসনে বসিয়ে দিতে পারলেও সমগ্র বাঙালি সমাজের পুরো ঐতিহ্যকে যে ধারণ করতে পারেনি সে সত্যকে কে অস্বীকার করতে পারবে?

নজরুল যখন আবহমান বাঙালির সামগ্রিক ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বিশ শতকের নাগরিক বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলে প্রবেশ করলেন, তখন তার অভিনবত্বে মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয়েও খণ্ডিত ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষায় শিক্ষিত কাব্যরসলিপ্সুরা (আরও বিশেষ করে কাব্যের বিচারক ও বিশ্লেষকরা) খুবই ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। তারা নজরুলের কবিতার এক অংশে গুণগ্রাহী হতে পারলেও অন্য অংশে তাদের বোধ প্রবিষ্ট হলো না। নজরুলের কবিতার ঈশান বিষানের ওঙ্কার’টি যাদের পরিচিত, ‘ইস্রাফিলের শিঙার মহাহুংকার’ তাদের কাছে একান্ত তাৎপর্যহীন। ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’র প্রশস্তি কিংবা ‘আনন্দময়ী’র প্রতি নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা তাদের আনন্দিত করলেও ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহম’ কিংবা ‘কোরবানী’র মতো কবিতা তেমনভাবে তাদের চিত্তস্পর্শী হতে পারেনি। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত বা বৈষ্ণবভাবাশ্রিত গানগুলো যাদের প্রীত করেছে, তার হামদ-নাত বা ইসলামী সঙ্গীতসমূহকে যে তারা তেমনভাবে আপন ভাবতে পারেননি, সে কথাও মিথ্যা নয়।

আবার হিন্দুদের তুলনায় অনেক বিলম্বে উদ্ভূত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিক থেকে। তাদের কাছে সমন্বয়ী বাঙালিত্বের চেয়ে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে কারণেই নজরুলের কাছে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ‘মুসলিম সাহিত্য’ দাবি করেছেন, তার কবিতায় হিন্দু পুরাণের ব্যবহারকে তারা ভালো চোখে দেখেননি। রক্ষণশীল ও গোঁড়া মুসলমানদের দৃষ্টিতে তো নজরুল ‘কাফের’ হয়ে উঠেছেন। তাই শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত হিন্দুর মতো স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলমানরাও নজরুলের খণ্ডীকরণেই প্রবৃত্ত হলেন, তার সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বাঙালি সত্তাটিকে আড়াল করে তাকে ‘মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি’ বলে প্রতিনিয়ত প্রচার করে চলবেন।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে যাদের অবস্থান, সেই বামপন্থিরাও নজরুলের অখণ্ড রূপটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা বিদ্রোহী ও সাম্যবাদী নজরুলের গুণগ্রাহী অবশ্য। কিন্তু তার রচনায় ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহারটির তাৎপর্য তারা বুঝে উঠতে পারেননি। তারই ফলে বামপন্থি সমালোচকদের হাতেও ঘটে নজরুলের আরেক রকম খণ্ডীকরণ। অর্থাৎ এখানে কাজ করেছে অন্য এক ধরনের মানস প্রতিবন্ধ।

এ রকম নানা মানস-প্রতিবন্ধজাত বিভিন্নমুখী খণ্ডীকরণের হাত থেকে নজরুলেরকে উদ্ধার করে তার অখণ্ড রূপমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনবোধ যে বাঙালি বুধমণ্ডলীর মধ্যে একেবারেই জাগেনি, তা নয়। সেই প্রয়োজন সাধনে প্রয়াসীও হয়েছেন কেউ কেউ। তবু সে প্রয়াস যে এখনও বাঞ্ছিত বিন্দুটিকে স্পর্শ করতে পারেনি, সে কথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

নজরুল-মূল্যায়নে মানস-প্রতিবন্ধ

যতীন সরকার

image

কাজী নজরুল ইসলাম / জন্ম : ১১ জৈষ্ঠ ১৩০৬ (২৪ মে ১৮৯৯); মৃত্যু : ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ আগস্ট ১৯৭৬)

উনিশ শতকের বাংলা কবিতার বিচার করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন যে, ‘মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি।’ আর ঈশ্বর গুপ্তের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ বলে। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছিলেন, ‘এখন আর খাঁটি বাঙালি কবি জন্মে না- জন্মিবার জো নাই- জন্মিয়া কাজ নাই।’

বঙ্কিমচন্দ্র যখন এসব কথা বলেছিলেন, তার অনেক পরে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা মিথ্যা করে দিয়েই যেন এমন একজন কবির আবির্ভাব ঘটল যিনি খাঁটি বাঙালি কবি। এই কবিই কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ তাঁকে আমরা খাঁটি বাঙালি বলে চিনে নিতে পারলাম না; বরং তাঁর কবি পরিচয়কে নানাভাবে খণ্ডিত করলাম। কারণ, এ কালের বাংলা কবিতার পাঠক হচ্ছি আমরা নিজেদের যারা আধুনিক ও নাগরিক শিক্ষায় ‘শিক্ষিত বাঙালি’ বলে মনে করি। কবিতার বিচারক-সমালোচকও এই আমরাই। আমাদের সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষা আমাদেরকে অর্থাৎ বাংলা কবিতার এই ‘বিদগ্ধ’ পাঠক ও সমালোচককুলকে খাঁটি বাঙালিত্বকে উপলব্ধি করার শক্তিই নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ককোষ যেসব ভাবনায় পূর্ণ, সেসবের সঙ্গে খাঁটি বাঙালিত্বের সম্পর্ক একান্তই ক্ষীণ। আমরা গ্রাম্যতা পরিহার করে বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে সতত আগ্রহী, খাঁটি বাঙালিত্ব আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্ত গ্রাম্যতা বৈ অন্য কিছু নয়। গ্রাম্য প্রতিবেশীর থেকে অনায়াসে আমরা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি, কিন্তু নাগরিক বিদেশির প্রতি আমাদের প্রীতি একান্ত সীমাহীন। সেই প্রীতি প্রকাশের জন্য নিতান্ত কাঙালপনা করতেও আমাদের রুচিতে বাধে না।

আমাদের এ রকম মানস-প্রতিবন্ধের দরুনই এ পর্যন্ত আমরা নজরুল-মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি। এসব মানস-প্রতিবন্ধ থেকে মুক্ত হতে না পারলে সে ব্যর্থতা কোনোদিনই ঘুচবে না।

আমাদের মধ্যে যারা আরো অগ্রসর, যাদের মনমানসে প্রতীচ্যের সাহিত্যভাবনা সর্বাতিশয়ী প্রভাব বিস্তার করে বসেছে, তারা বাংলা ও বাঙালিকেও প্রতীচ্যের দর্পণে অবলোকন করেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কবিতা-বিচারেও প্রতীচ্যের মানদণ্ডই তাদের অবলম্বন, অন্য কোনো মানদণ্ডের কথা তারা ভাবতেই পারেন না। তাদের কাছে গ্রাহ্য ওই একমাত্র মানদণ্ডটি দিয়ে নজরুল ও তার কবিতাকে মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব যে নয়, সে কথা তাদের প্রায় কেউই বুঝতে চান না। কিংবা কেউ কেউ কখনো কখনো বুঝলেও সব সময় তা মানতে পারেন না। তাই আধুনিক বাংলার কোনো কোনো বিদগ্ধ কবি-সমালোচক একেক সময় একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নজরুল সম্পর্কে কিছু বিমুগ্ধ বাক্য উচ্চারণ করে ফেলেছেন বটে, কিন্তু সেই বিমুগ্ধতাকে বেশ দূর ধরে রাখতে পারেননি। কিংবা ধরে রেখে স্বস্তি পাননি। আধুনিকতা, নাগরিকতা ও বৈশ্বিকতা সংস্কার তথা মানস-প্রতিবন্ধ তাদের অন্য পথে নিয়ে গেছে। সেই মানস-প্রতিবন্ধের দরুন নজরুলের ভেতর তারা আধুনিকতার সন্ধান পান না। এক কৃত্রিম নাগরিকতার বৃত্তসীমায় বন্দি হয়ে এক ধরনের উন্নাসিক রুচি তাদের ভেতর গড়ে উঠেছে। সেই রুচির সঙ্গে যা মেলে না, তার সব কিছুই তাদের বিবেচনায় রুচি-বিগর্হিত। সে কারণেই নজরুলের কবিতায় তারা ‘রুচির স্খলন’ দেখতে পান। তার কবিতার বহিরঙ্গে ও অন্তর্গত বক্তব্যে, প্রকরণে ও প্রসঙ্গে তাদের প্রত্যাশিত আধুনিকতার ও নাগরিকতার কিংবা যুদ্ধোত্তরকালে পুঁজিবাদী প্রতীচ্যভাবিত বৈশ্বিকতার দেখা না পেয়ে নজরুলকে তাদের বিবেচনার বাইরে রেখে দেয়াই সমীচীন মনে করেন। এ রকম অনেক সমালোচকের বাংলা কবিতা নিয়ে লিখিত বইগুলোর পাতায় চোখ বুলিয়ে গেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। বাংলা কবিতার আলোচনায় নজরুলের প্রসঙ্গ তারা হয় পুরোপুরি এড়িয়ে যান, অথবা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র কায়দামাফিক কিছু মামুলি বা দ্ব্যর্থক কথা বলে দায় সারেন।

নজরুলের কবিতায় অনেক অনন্যসাধারণ উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পর তথা কলানৈপুণ্যের প্রয়োগ যখন তাদের অভিভূত করে ফেলে, তখনও তারা সেই অভিভূতিকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চান এই বলে যে, নজরুলের কোনো পুরো কবিতাই কবিতা হয়ে ওঠেনি; তার কোনো কোনো কবিতার কোনো কোনো চরণে শৈল্পিকতার ঝিলিক দেখিয়ে তিনি হয়ে থেকেছেন নিতান্তই ‘চরণের কবি’ কিংবা বড়জোর ‘স্তবকের কবি’, প্রকরণের ক্ষেত্রে তার কিছু কিছু মুন্সিয়ানাকে বাহবা দিলেও বাংলা কবিতার আধুনিকতাবাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী, নয়াকলাকৈবল্যবাদী ও বিশুদ্ধতাবাদী বিদগ্ধ সমালোচকরা নজরুলের কবিতার বিষয়বস্তুর প্রতি একান্তই বিরূপ। সে বিরূপতা তারা গোপন করেন না। তারা দেখেন নজরুল বড় বেশি সাময়িকতাতাড়িত, নানা সাময়িক ঘটনা ও দুর্ঘটনা তার ভেতর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, সেই প্রতিক্রিয়াকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পদ্যের পঙ্ক্তিতে বন্দি করে ফেলেন, আর তার সেই পদ্যপঙ্ক্তিগুলোকেই কাব্যবোধহীন প্রাকৃতজন কবিতা বলে বাহবা দেয়। এসব পদ্যপঙ্ক্তিতে প্রায়শই কোনো গভীরতা থাকে না, রহস্যময়তা থাকে না, আলো-আঁধারির বা বোঝা-না বোঝার খেলা থাকে না। তার বদলে থাকে কিছু চাঁছাছোলা একান্ত নিরাবরণ বস্তুততান্ত্রিক সত্য ও তথ্যের এবং বিশেষ কিছু রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যের একান্ত স্পষ্ট, নিঃশঙ্ক, নিঃসংকোচ ও উচ্চকণ্ঠ উচ্চারণ। সাধারণ্যে কবিতা বলে প্রচারিত এইসব পদ্যপঙ্ক্তি বিদগ্ধ কাব্য সমালোচকদের কাছে ছন্দের গাঁথা স্লোগান মাত্র- কবিতা নয় কোনোমতেই।

তবু বাঙালি প্রাকৃতজনের অন্তর আসনে কবিরূপেই নজরুলের প্রতিষ্ঠা দৃঢ় হয়ে থাকতে দেখে বিদগ্ধ কাব্যসমালোচকরাও নজরলকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করতে পারেন না, তবে কাব্যকৃতিকে কোনো না কোনোভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। সে রকম মেনে নেওয়ার জন্য নজরুলকে তাদের সুবিধানুযায়ী ব্যবচ্ছেদ করে নেন, এবং তার কিছু খণ্ডিত অংশের জন্য প্রশস্তিÍ বাক্য উচ্চারণ করেন। তাদের কেউ নজরুলের গানের উচ্চ প্রশংসা করে তাকে প্রথম শ্রেণির সঙ্গীতকারের আসনে বসান এবং তার কবিতার উৎকর্ষকে পেছনে ঠেলে দেন। কেউ বা দেখাতে চান যে কিছু প্রেমের কবিতাতেই নজরুলের কিছুটা সিদ্ধিলাভ ঘটেছে, অন্য ধরনের কবিতায় তার কৃতি নিতান্তই নিষ্প্রভ। এ রকমভাবে কেবলই যারা বিশুদ্ধ কবিতা কিংবা কবিতায় বিশুদ্ধতা খুঁজে ফেরেন, তথাকথিত বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে ‘কবিতা’ আর অকবিতা’র ভেদ নির্ণয় করে চলেন প্রতিনিয়ত, তাদের পক্ষে নজরুলকে এ রকম খণ্ড-বিখণ্ড করে দেখাই স্বাভাবিক।

খণ্ডিতকরণের আরেকটি কারণ ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালির খণ্ডিত ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষা। আমরা জানি ব্রিটিশরাজ-প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রথম থেকেই সমস্ত বাঙালির জন্য খুলে যায়নি। সে শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পেরেছিল তারাই যারা বিদেশি রাজার অধীনে সৃষ্ট নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। নানা ঐতিহাসিক কার্যকারণের সূত্রে সে শ্রেণিটি গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়ে। এরাই পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘ভদ্রলোক’ নামে। গোড়া থেকেই এই ‘ভদ্রলোক’রা ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘ছোটলোকদের’ থেকে বিচ্ছিন্ন। মূলত চাষি-মজুর ও বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীরাই ছোটলোক বলে বিবেচিত। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিচারে এই ছোটলোকদের মধ্যে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। তবু ‘ভদ্রলোক’রা হিন্দু বলেই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেও হিন্দু ঐতিহ্যের উপাদানেই তাদের মনমানস পুষ্ট হতে থাকে। হিন্দুর ঐতিহ্যিক দৃষ্টি দিয়েই তারা তাদের সমকালীন জগৎকে দেখে, হিন্দু ঐতিহ্যের নবায়ন ঘটিয়েই তাদের হাত দিয়ে আধুনিক শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসারণ ঘটে। তাই হিন্দুত্বের সূত্র ধরে হিন্দু ‘ছোটলোক’দের সঙ্গে ওই ‘ভদ্রলোক’দের সম্পর্কের একটা ক্ষীণ ধারা বজায় থাকলেও মুসলমানদের ভাবজগতের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। বাঙালির সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যে কিংবা প্রাক ব্রিটিশযুগের কাব্য সাধনায় যে সম্মিলিত ঐতিহ্যসমৃদ্ধ খাঁটি বাঙালিত্ব ভিত গেড়েছিল, নতুন শিক্ষাপুষ্ট আধুনিকতা সে ভিতটি ভেঙে ফেলল। ‘খাঁটি বাঙালি’ থেকে শিক্ষিত বাঙালির ব্যবধান ক্রমেই দুস্তর হয়ে পড়তে লাগল। শিক্ষিত বাঙালি কবির পক্ষেও লোকসাহিত্যের খাঁটি বাঙালি কবির মতো কোরান-পুরাণের মেলবন্ধ ঘটানো সম্ভব হলো না। কিংবা সম্ভব হলো না প্রাক-আধুনিককালের শেষ শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের মতো প্রয়োজনমাফিক ‘যাবনী মেশাল’ বাংলায় ‘কাব্যরসের’ জোগান দেওয়া।

যে ঈশ্বর গুপ্তকে বঙ্কিমচন্দ্র শেষতম ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ বলে বিবেচনা করেছেন, সেই গুপ্ত কবির বাঙালিত্বকেও তো নির্ভেজাল ‘খাঁটি’ বলে মেনে নেওয়া কঠিন। নবসৃষ্ট কলকাতার নাগরিক সমাজ তার খাঁটিত্বকেও বহুল পরিমাণে খর্ব ও খণ্ডিত করেছে। খাঁটি বাঙালি লোককবির মতো তার চেতনায় ‘পুবের ভানুশ্বর’ ‘আলির মাল্লামের পাথর’ ‘মক্কাহেন স্থান’ ও ‘ক্ষীরনদী সাগর’-এর সহাবস্থান নেই। যেসব পার্বণের কথা নিয়ে তিনি পদ্য রচনা করেছেন সেসবই হিন্দু বাঙালির পার্বণ।

মুসলমান বাঙালির পার্বণ বা পার্বণের আনন্দ তার চৈতন্যে অনুপস্থিত। অর্থাৎ বলতে হয় যে, হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমানের নানা ভাবধারার সংঘাত সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যমণ্ডিত বাঙালি সমাজের বহুমাত্রিকতা থেকে বহুদূরে সরে এসেছিলেন ‘যুগসন্ধির কবি’ বলে খ্যাত ঈশ্বর গুপ্তও। ঈশ্বর গুপ্ত যদি ‘খাঁটি বাঙালির কবি’ হয়েও থাকেন, তবু সকল শ্রেণি ও গোষ্ঠীর খাঁটি বাঙালির প্রতিনিধিত্ব তিনি করতে পারেননি। এবং ঈশ্বর গুপ্তের পরবর্তী যেসব কবিকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘শিক্ষিত বাঙালির কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাদের সৃষ্টিসম্ভার বাংলাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সম্মানের আসনে বসিয়ে দিতে পারলেও সমগ্র বাঙালি সমাজের পুরো ঐতিহ্যকে যে ধারণ করতে পারেনি সে সত্যকে কে অস্বীকার করতে পারবে?

নজরুল যখন আবহমান বাঙালির সামগ্রিক ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বিশ শতকের নাগরিক বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলে প্রবেশ করলেন, তখন তার অভিনবত্বে মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয়েও খণ্ডিত ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষায় শিক্ষিত কাব্যরসলিপ্সুরা (আরও বিশেষ করে কাব্যের বিচারক ও বিশ্লেষকরা) খুবই ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। তারা নজরুলের কবিতার এক অংশে গুণগ্রাহী হতে পারলেও অন্য অংশে তাদের বোধ প্রবিষ্ট হলো না। নজরুলের কবিতার ঈশান বিষানের ওঙ্কার’টি যাদের পরিচিত, ‘ইস্রাফিলের শিঙার মহাহুংকার’ তাদের কাছে একান্ত তাৎপর্যহীন। ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’র প্রশস্তি কিংবা ‘আনন্দময়ী’র প্রতি নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা তাদের আনন্দিত করলেও ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহম’ কিংবা ‘কোরবানী’র মতো কবিতা তেমনভাবে তাদের চিত্তস্পর্শী হতে পারেনি। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত বা বৈষ্ণবভাবাশ্রিত গানগুলো যাদের প্রীত করেছে, তার হামদ-নাত বা ইসলামী সঙ্গীতসমূহকে যে তারা তেমনভাবে আপন ভাবতে পারেননি, সে কথাও মিথ্যা নয়।

আবার হিন্দুদের তুলনায় অনেক বিলম্বে উদ্ভূত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিক থেকে। তাদের কাছে সমন্বয়ী বাঙালিত্বের চেয়ে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে কারণেই নজরুলের কাছে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ‘মুসলিম সাহিত্য’ দাবি করেছেন, তার কবিতায় হিন্দু পুরাণের ব্যবহারকে তারা ভালো চোখে দেখেননি। রক্ষণশীল ও গোঁড়া মুসলমানদের দৃষ্টিতে তো নজরুল ‘কাফের’ হয়ে উঠেছেন। তাই শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত হিন্দুর মতো স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলমানরাও নজরুলের খণ্ডীকরণেই প্রবৃত্ত হলেন, তার সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বাঙালি সত্তাটিকে আড়াল করে তাকে ‘মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি’ বলে প্রতিনিয়ত প্রচার করে চলবেন।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে যাদের অবস্থান, সেই বামপন্থিরাও নজরুলের অখণ্ড রূপটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা বিদ্রোহী ও সাম্যবাদী নজরুলের গুণগ্রাহী অবশ্য। কিন্তু তার রচনায় ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহারটির তাৎপর্য তারা বুঝে উঠতে পারেননি। তারই ফলে বামপন্থি সমালোচকদের হাতেও ঘটে নজরুলের আরেক রকম খণ্ডীকরণ। অর্থাৎ এখানে কাজ করেছে অন্য এক ধরনের মানস প্রতিবন্ধ।

এ রকম নানা মানস-প্রতিবন্ধজাত বিভিন্নমুখী খণ্ডীকরণের হাত থেকে নজরুলেরকে উদ্ধার করে তার অখণ্ড রূপমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনবোধ যে বাঙালি বুধমণ্ডলীর মধ্যে একেবারেই জাগেনি, তা নয়। সেই প্রয়োজন সাধনে প্রয়াসীও হয়েছেন কেউ কেউ। তবু সে প্রয়াস যে এখনও বাঞ্ছিত বিন্দুটিকে স্পর্শ করতে পারেনি, সে কথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই।