নজরুল মানসে প্রেম-পরিণয়

আবদুল লতিফ

নারী ও প্রকৃতি একজন কবির জীবনে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। কবির কবিতায় প্রকৃতির রূপ বর্ণে বর্ণে রেঙে ওঠে। আর নারীর প্রেম তার অনুভূতিকে মহিমান্বিত করে। কখনো রোমান্টিকতার জোয়ারে ভেসে যায়, কখনো বিরহ বেদনায় তার কাব্য পাঠকের মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। আর বিরহবেদনায় সিক্ত কাব্য পাঠকের কাছে মধুরতম কবিতা হয়ে যায়। নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছে একাধিক নারীর সান্নিধ্যে, তার প্রভাব পড়েছে তাঁর কাব্যে, রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস। সবকিছুই পাঠক মনে সঞ্চারিত হয়েছে গভীরভাবে।

না পাওয়ার বেদনা বারে বারে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে। “জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ”, এই যেন তাঁর জীবনের বিধিলিপি। জীবনের প্রথম বিবাহ, মিলন রসে ভরলো না বরং বাসরের দীপ নিভে গেল বিবাহের প্রথম দিনেই। কী ছিল না তাঁর মধ্যে? প্রতিভা, মহানুভবতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, লোকরঞ্জনের ক্ষমতা, সব মিলিয়ে এক মহান চরিত্রের মানুষ। শুধু তাঁর সুষ্ঠু বিবেচনাবোধ আর ভুল সিদ্ধান্তের ফলে সারা জীবন তাঁকে অপরিসীম যন্ত্রণা পেতে হয়েছে।

নার্গিস আসার খানম (ওরফে সৈয়দা খাতুন) এর সাথে নজরুলের পরিচয় হয়েছিলো কবির এক অজ্ঞাতবাসের সময়। ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যালয়ে কবি সে সময় বন্ধুবর মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে এক কামরায় বাস করছিলেন। এই সমিতির মধ্যমনি সদা হাস্যালাপী, দিলখোলা নজরুল। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের সঙ্গীত আর সদালাপী ব্যক্তিত্বের মাঝে ছিল এক অসাধারণ আকর্ষণীয় শক্তি যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলো।

১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনাব মুজফ্ফর আহমেদ ও নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নবযুগ পত্রিকা। কিন্তু হঠাৎ কবি তাঁর কর্মমুখর জীবন থেকে বিদায় নিয়ে সাময়িক অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন। সময়টা ছিলো ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস। কুমিল্লা মহকুমার অধীনস্থ এক গ্রাম দৌলতপুর। সাহিত্য সমিতির কার্যালয় ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে কবি সেখানে চলে গেলেন।

কবির এই অজ্ঞাতবাসের পেছনে যার অশুভ ভূমিকা ছিলো তাঁর নাম আলী আকবর খান। এই লোকটি সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তিনি ছিলেন দাম্ভিক, অসৎ, প্রবঞ্চক এবং চরিত্রহীন। কবির সাথে পরিচয় করার জন্য তিনি ঘন ঘন তাঁর সমিতির কার্যালয়ে যাতায়াত করতেন এবং হঠাৎ একদিন কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে সমিতির একটা ঘরে বিছানা বিছিয়ে নিজের স্থায়ী আস্তানা গেড়ে নিলেন। জানা যায় যে এই সময় তিনি একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং নজরুল তাঁকে সেবা করে সারিয়ে তোলেন।

সেরে ওঠার পর তিনি কুমিল্লায় তাঁর বাড়িতে যাবার জন্যে অনুরোধ জানাতে থাকেন। মুজফ্ফর সাহেব কবিকে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ না করার জন্যে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে আকস্মিকভাবে কবি কলকাতা থেকে অন্তর্ধান করেন। এ সম্পর্কে কবির অন্তরঙ্গ গায়ক বন্ধু শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে:

“নজরুলের প্রাত্যহিক গতিবিধি ও কার্যসূচির সন্ধান আগে থেকেই আমার জানা থাকতো। একদিন সারা বিকালটা নজরুলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঠিক তার পরদিন সকালবেলায় দেখি নজরুল ঘরে নেই। তাঁর একজন সহকক্ষবাসী বন্ধু হাসতে হাসতে বলেন, সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লায় চলে গেছে।”

নজরুলকে নিয়ে কুমিল্লায় যাবার পথে আলী আকবর খান প্রথমে কুমিল্লার বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে ছিলেন আলী আকবরের সহপাঠী শ্রীবীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, তাঁর মা বিরজাসুন্দরী দেবী, তাঁর দুটি ছোট বোন বাচ্চি ও জটু এবং এক জেঠিমা শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবী ও তাঁর একমাত্র সন্তান প্রমীলা। এই প্রমীলাকে আমরা পরবর্তী সময় জানবো শ্রীমতী প্রমীলা নজরুল হিসেবে। নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে মা বলে সম্বোধন করতেন।

কয়েকদিন বিরজাসুন্দরীর পরিবারে সাহিত্যসঙ্গীত আবহাওয়ার মধ্যে কাটিয়ে কবি চলে এলেন দৌলতপুরে- আলী আকবর খানের নিজ বাড়িতে। সেখানে ছিল তাঁর এক বোনের একটি ছেলে ও একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা। ছেলেটি জাহাজে চাকরি নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতো। আলী আকবরের বিবাহযোগ্যা এই ভাগ্নির সাথে কবির পরিচয় হয়। এই পরিচয় সম্পর্কে মুজফ্ফর সাহেব লিখেছেন,“সত্যই নজরুলের লোক আকর্ষণ করার অসাধারণ শক্তি ছিল। বিবাহযোগ্যা মেয়েটির সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। তিনি নাকি তাঁর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

প্রাথমিক পরিচয়ের পর মেয়েটির সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে থাকে এবং তিনি মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেন। মন দেয়া নেয়া পর্ব সমাপ্ত হলে উভয়ের বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু কোলকাতার বন্ধুরা এ বিবাহে উৎসাহ প্রকাশ করেননি। মুজফ্ফর আহমদ এ বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কারণ প্রবঞ্চক আলী আকবর খানকে তিনি খুব ভালো চোখে দেখতেন না। এই অল্প সময়ের মধ্যে মন দেয়া নেয়া পর্বটি তাঁর কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি।

এ সম্পর্কে অনেক চিঠির মধ্যে শুধু মুজফ্ফর আহমদের একটি চিঠি উদ্ধৃত করা হলো। আহমদ সাহেব যে কেবল নজরুলের বন্ধু নন অভিভাবক, কেবল সঙ্গী নন, আদর্শ পরামর্শদাতা।

“পরম প্রীতিভাজনেষু,

কাজী সাহেব, আপনার পত্রাদি আর মোটেই পাওয়া যাইতেছে না, তার কারণ কী? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম। পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড়ই অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংশ্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয় আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। “মোহাম্মদী”তে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তাঁহারা তো নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন।... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম।”

এ সময় আলী আকবর খানের আচরণ সহজ সীমা অতিক্রম করে প্রকট হয়ে উঠছিলো। বিয়ের সময় প্রায় এসে গিয়েছিলো, নিমন্ত্রনপত্র বিলি করা হয়ে গেছে। এমন সময় নজরুলের মন গেল বিষিয়ে। তিনি পরিপূর্ণ অন্তরে এ বিয়েকে আর সমর্থন করতে পারছিলেন না। কারণ হিসেবে যতটুকু জানা যায় তার মধ্যে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের একটি উক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে।

“তাঁর আপনভোলা স্বভাব ও বিষয় বিরাগ নিয়ে তাঁর দৌলতপুরের শ্বশুরালয়ে দাস দাসীরা ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি। নব পরিণীতা বালিকাবধূর অবজ্ঞা তাঁকে হেনেছিলো সবচেয়ে বড় আঘাত। আহত অভিমানে বিবাহবাসর ত্যাগ করে নজরুল সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লায় চলে যান।”

কোন এক প্রবন্ধে জনাব এম আবদুর রহমান লিখেছেন,“বিবাহের দু’একদিন আগে কবি তাঁর ভাবী বধূ এবং বধূর সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তির কথা ও কার্যে এবং আচরণে ভীষণভাবে অপমানে আহত হয়েছিলেন।”

পরবর্তীতে কবির একটি চিঠিতে প্রকাশ পায় যে তিনি আলী আকবর খানের দ্বারা অপমানিত ও প্রতারিত হয়েছেন। বিয়ের সময় শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবী তাঁর পরিবারের সদস্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। নজরুল তাঁকে সকল কথা খুলে বললেন। প্রবীণ মহিলা সব শুনে বিয়েটা যে নজরুলের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই শান্তির ও শুভ হতে পারেনা, তা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন।

ওদিকে বিয়ের লগ্ন এসে গেল। নজরুলকে বাধ্য হয়ে বর সেজে বিয়ের আসরে বসতে হলো। আর তারপর অতি প্রত্যুষে তিনি দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লায় চলে গেলেন। বিবাহ জীবনের ইতি এখানেই। স্বামী-স্ত্রী রূপে কোনদিন তাঁদের বসবাস করা হলো না। সৈয়দা খাতুন কিন্তু পরবর্তীতে নজরুলের দেয়া নাম নার্গিস আসার খানমকে নার্গিস খানম নামেই নিজেকে সবার কাছে পরিচয় দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।

কোনোদিন দেখা হলো না, তবু এই ক্ষনিক পরিচয়ের স্মৃতি নজরুল তাঁর সারা জীবন বহন করে গিয়েছেন। আর ওদিকে নার্গিস আবার পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হলেন। ১৫ বছর পর কবির কাছে তিনি একটি পত্র লিখেছিলেন। সে পত্রের উত্তরে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন তাকে একটি অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমি সে পত্র উল্লেখ করছি না, শুধু পত্রের শেষে যে কথাটিলেখা ছিলো তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “পুনশ্চ: আমার চক্রবাক নামক কবিতা পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিলো। ইতি”

এই ঘটনায় কবি আহত হয়েছেন। আর আমরা পাঠকেরা তাঁর বেদনাক্লিষ্ট কলম থেকে পেয়েছি, অসাধারণ সব কবিতা। ছোট পরিসরে সব কিছু লেখার সুযোগ নেই। শুধু কবির হিংসাতুর কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করলাম-

“অপরাধ শুধু মনে আছে তার, মনে নাই কিছু আর?

মনে নাই তুমি দলেছ দু’পায়ে কবে কার ফুলহার!

কাঁদায়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়খাই,

পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই?

সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী,

কি হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি।”

সময়টা ছিলো ১৯২১ সালের মার্চ মাসে। আগেই বলেছি নার্গিসের সাথে পরিচয়ের মাত্র একদিন আগে কুমিল্লায় নজরুলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে। দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু তার আগে ১৯২২ সালে নজরুলের জীবনে দ্বিতীয যে নারীর আবির্ভাব ঘটেছিলো তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় কবির ব্যথার দান নামক উপন্যাসে। এই বইটির উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন,“মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি। তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।”

কে এই মানসী? জানা যায় তিনি ছিলেন আসানসোলের দারোগার মেয়ে স্বর্ণলতা গঙ্গোপাধ্যায়। স্বর্ণলতা সম্পর্কে নজরুল গবেষকদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু উৎসর্গপত্রের কথা সেই সম্পর্কের গভীরতার ইঙ্গিত বহন করে।

কলকাতার সঙ্গীতশিল্পী দিলীপ রায়ের কাছ থেকে কবি খোঁজ পান ঢাকার বনগ্রামের এক সুন্দরী সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী কিশোরীর, রানু সোম। কবি নিজে একজন গীতিকার এবং শিল্পী। স্বভাবতই তিনি সঙ্গীতশিল্পীদের খোঁজ করছিলেন। রানু সোমকে তিনি খুঁজে পেলেন ১৯২৮ সালে কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায়। তিনি তাঁর বাসায় হাজির হন এবং সাথে সাথেই তার গানের শিক্ষক হয়ে যান। কবি রানু সোমকে একমাস ধরে গান শেখাতে যেতেন। রানুর কাছ থেকে জানা যায় যে কবির “আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী, এ কোন সোনার গাঁয়” গানটি লেখা হয়েছিলো রাতে। কথা এবং সুর সম্পূর্ণ হবার আগেই কবি গানটি শেখাতে পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে গানটি সম্পূর্ণ করলেন এবং সুরারোপ করে পূর্ণতা দিলেন। এর দিন তিনেক পর কবি লিখলেন, “এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে”।

পরবর্তী জীবনে রানু সোম কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। কবি তাঁর চোখের কাজল কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, কল্যাণীয় বীণাকণ্ঠী শ্রীমতি প্রতিভা সোম, জয়যুক্তাসু।

‘চক্রবাক’ নামক কবিতার বইয়ের কবিতায় ব্যথাতুর হৃদয়ে কবি নার্গিসের অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রকে। সুরেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা নোটন, ভালো নাম উমা মৈত্র। নোটনকে গান শেখাবার সময় কবি তার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর গান,“তুমি নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল” অথবা তুমি মোরে ভুলিয়াছ কবিতার “তোমার অঙ্গনে, প্রিয়! সেদিন সন্ধ্যায় ভুলে পরেছিলে ফুল নোটন-খোঁপায়!” নোটনের প্রতি তাঁর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ। নজরুল নোটনকে বেশ কিছু গান শেখান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

“নিশি ভোর হলো জাগিয়া, পরাণ প্রিয়া”

“আজি এ কুসুমহার, সহি কেমনে”

“বসিয়া বিজনে কেন একা মনে”

গানগুলি বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয়।

নজরুল জীবনের প্রেমের অধ্যায়ে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নোটন ওরফে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে গানের আড়াল কবিতায় উমা মৈত্রের উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন:

তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান-

এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?

অন্তর-তলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,

গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?

... ... ...

ভোলো মোর গান, কী হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়,

আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়!

জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-

কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।

কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে, নজরুলের প্রেমের আগ্রহের প্রত্যুত্তরে উমা মিত্রের কাছ থেকে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ওপরে উল্লিখিত গানের আড়াল কবিতার শেষ চারটি চরণে কবির হতাশার দুঃখ ফুটে উঠেছে।

১৯৩০ সালে কবির বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার পরিচয় করিয়ে দেন আলতাফ চৌধুরীর সাথে। নলিনীকান্ত নিজে একজন গানের শিক্ষক, সঙ্গীত শিল্পী এবং সাহিত্যজগতে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। সে সময় তিনি ছিলেন সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার সম্পাদক। তিনি একদিন কবিকে নিয়ে এলেন আলতাফ চৌধুরীর পার্ক সার্কাসের বাসায়। কবির চিরাচরিত স্বভাবগুণে আলতাফ চৌধুরীর পরিবারের সাথে গভীর বন্ধুত্ব আর আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠতে দেরি হলো না। আলতাফের বোন জাহানারা চৌধুরী। কবিতা ও গানের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা। কবির কাছে জাহানারার আব্দার, তাঁকে কবিতা লিখে দিতে হবে, সে কবিতা অন্য কেউ ছাপবে না। সে হবে তাঁর একান্ত নিজের। কবি ভক্তের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। জাহানারা বেগমের দেয়া লাল কাপড়ে মোড়ানো খাতায় তিনি কবিতা আর গান লিখে দিয়েছেন আর উৎসর্গ করেছেন এই বলে, “মীরাকে, নজরুল ইসলাম”। মীরা জাহানারার ডাক নাম।

১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্যসমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে কবির সাথে পরিচয় হয় মহীয়সী নারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে। কবির জীবনে এ ছিল এক একতরফা প্রেম। তিনি এই নারীকে নিয়ে অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এসব কবিতা ও গানে নজরুলের ব্যাকুলতা প্রকাশ পেলেও ফজিলাতুন্নেসার পক্ষ থেকে তার কোন সাড়া মেলেনি। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে শামসুজ্জোহা নামে এক উচ্চশিক্ষিত যুবকের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।

সে আমলের বিখ্যাত শিল্পী কানন দেবীর সাথে নজরুলের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম রটনায় মেতে উঠতো সজনীকান্তের সম্পাদিত শনিবারের চিঠি পত্রিকা। যদিও কানন দেবীর সাথে কবির সম্পর্ক ছিলো নিতান্তই গুরু-শিষ্যের। কানন দেবী ছাড়াও কবির কাছে গান শিখেছেন, ইন্দুবালা দেবী, বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার, সুপ্রভা সরকার এবং ফিরোজা বেগমের মতো অনেক নামীদামী শিল্পী।

নার্গিস আসার খানমের সাথে নজরুলের বিবাহ ভেঙে যাবার পর তিনি যে নারীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন তিনি হলেন দুলি বা দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপাকে নিয়ে তিনি লিখলেন:

হে মোর রাণী। তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,

আমার বিজয়কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।

কবি দোলনচাঁপার নাম দিলেন প্রমীলা। এই অসম বিবাহ সেনগুপ্ত পবিবারের সবাই মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু প্রমীলার মা গিরিবালা সেনগুপ্ত নজরুলকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তিনি মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নজরুলের সাথে বিয়ে দেন। ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ সালে ছিল এই বিয়ের দিন। প্রমীলা নজরুলকে উপহার দিয়েছেন কাজী অনিরুদ্ধ ও কাজী সব্যসাচীর মতো দুই কৃতী সন্তান। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মারা যান। নজরুল তখন অসুস্থ, বাকশক্তিরুদ্ধ।

অনেকের জীবনে চলার পথে প্রেম আসে কিন্তু কবি জীবনের প্রেম অঙ্কুরিত হয়ে পুষ্পপর্ণে ডালপালা মেলেছে সাহিত্য আর কাব্যে। সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্য, পাঠক পেয়েছে সাহিত্যের এক অমূল্য খনি।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

নজরুল মানসে প্রেম-পরিণয়

আবদুল লতিফ

image

নারী ও প্রকৃতি একজন কবির জীবনে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। কবির কবিতায় প্রকৃতির রূপ বর্ণে বর্ণে রেঙে ওঠে। আর নারীর প্রেম তার অনুভূতিকে মহিমান্বিত করে। কখনো রোমান্টিকতার জোয়ারে ভেসে যায়, কখনো বিরহ বেদনায় তার কাব্য পাঠকের মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। আর বিরহবেদনায় সিক্ত কাব্য পাঠকের কাছে মধুরতম কবিতা হয়ে যায়। নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছে একাধিক নারীর সান্নিধ্যে, তার প্রভাব পড়েছে তাঁর কাব্যে, রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস। সবকিছুই পাঠক মনে সঞ্চারিত হয়েছে গভীরভাবে।

না পাওয়ার বেদনা বারে বারে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে। “জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ”, এই যেন তাঁর জীবনের বিধিলিপি। জীবনের প্রথম বিবাহ, মিলন রসে ভরলো না বরং বাসরের দীপ নিভে গেল বিবাহের প্রথম দিনেই। কী ছিল না তাঁর মধ্যে? প্রতিভা, মহানুভবতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, লোকরঞ্জনের ক্ষমতা, সব মিলিয়ে এক মহান চরিত্রের মানুষ। শুধু তাঁর সুষ্ঠু বিবেচনাবোধ আর ভুল সিদ্ধান্তের ফলে সারা জীবন তাঁকে অপরিসীম যন্ত্রণা পেতে হয়েছে।

নার্গিস আসার খানম (ওরফে সৈয়দা খাতুন) এর সাথে নজরুলের পরিচয় হয়েছিলো কবির এক অজ্ঞাতবাসের সময়। ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যালয়ে কবি সে সময় বন্ধুবর মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে এক কামরায় বাস করছিলেন। এই সমিতির মধ্যমনি সদা হাস্যালাপী, দিলখোলা নজরুল। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের সঙ্গীত আর সদালাপী ব্যক্তিত্বের মাঝে ছিল এক অসাধারণ আকর্ষণীয় শক্তি যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলো।

১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনাব মুজফ্ফর আহমেদ ও নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নবযুগ পত্রিকা। কিন্তু হঠাৎ কবি তাঁর কর্মমুখর জীবন থেকে বিদায় নিয়ে সাময়িক অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন। সময়টা ছিলো ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস। কুমিল্লা মহকুমার অধীনস্থ এক গ্রাম দৌলতপুর। সাহিত্য সমিতির কার্যালয় ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে কবি সেখানে চলে গেলেন।

কবির এই অজ্ঞাতবাসের পেছনে যার অশুভ ভূমিকা ছিলো তাঁর নাম আলী আকবর খান। এই লোকটি সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তিনি ছিলেন দাম্ভিক, অসৎ, প্রবঞ্চক এবং চরিত্রহীন। কবির সাথে পরিচয় করার জন্য তিনি ঘন ঘন তাঁর সমিতির কার্যালয়ে যাতায়াত করতেন এবং হঠাৎ একদিন কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে সমিতির একটা ঘরে বিছানা বিছিয়ে নিজের স্থায়ী আস্তানা গেড়ে নিলেন। জানা যায় যে এই সময় তিনি একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং নজরুল তাঁকে সেবা করে সারিয়ে তোলেন।

সেরে ওঠার পর তিনি কুমিল্লায় তাঁর বাড়িতে যাবার জন্যে অনুরোধ জানাতে থাকেন। মুজফ্ফর সাহেব কবিকে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ না করার জন্যে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে আকস্মিকভাবে কবি কলকাতা থেকে অন্তর্ধান করেন। এ সম্পর্কে কবির অন্তরঙ্গ গায়ক বন্ধু শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে:

“নজরুলের প্রাত্যহিক গতিবিধি ও কার্যসূচির সন্ধান আগে থেকেই আমার জানা থাকতো। একদিন সারা বিকালটা নজরুলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঠিক তার পরদিন সকালবেলায় দেখি নজরুল ঘরে নেই। তাঁর একজন সহকক্ষবাসী বন্ধু হাসতে হাসতে বলেন, সে তো কাল রাত্তিরে কুমিল্লায় চলে গেছে।”

নজরুলকে নিয়ে কুমিল্লায় যাবার পথে আলী আকবর খান প্রথমে কুমিল্লার বিখ্যাত সেনগুপ্ত পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে ছিলেন আলী আকবরের সহপাঠী শ্রীবীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, তাঁর মা বিরজাসুন্দরী দেবী, তাঁর দুটি ছোট বোন বাচ্চি ও জটু এবং এক জেঠিমা শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবী ও তাঁর একমাত্র সন্তান প্রমীলা। এই প্রমীলাকে আমরা পরবর্তী সময় জানবো শ্রীমতী প্রমীলা নজরুল হিসেবে। নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে মা বলে সম্বোধন করতেন।

কয়েকদিন বিরজাসুন্দরীর পরিবারে সাহিত্যসঙ্গীত আবহাওয়ার মধ্যে কাটিয়ে কবি চলে এলেন দৌলতপুরে- আলী আকবর খানের নিজ বাড়িতে। সেখানে ছিল তাঁর এক বোনের একটি ছেলে ও একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা। ছেলেটি জাহাজে চাকরি নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতো। আলী আকবরের বিবাহযোগ্যা এই ভাগ্নির সাথে কবির পরিচয় হয়। এই পরিচয় সম্পর্কে মুজফ্ফর সাহেব লিখেছেন,“সত্যই নজরুলের লোক আকর্ষণ করার অসাধারণ শক্তি ছিল। বিবাহযোগ্যা মেয়েটির সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। তিনি নাকি তাঁর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

প্রাথমিক পরিচয়ের পর মেয়েটির সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে থাকে এবং তিনি মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেন। মন দেয়া নেয়া পর্ব সমাপ্ত হলে উভয়ের বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু কোলকাতার বন্ধুরা এ বিবাহে উৎসাহ প্রকাশ করেননি। মুজফ্ফর আহমদ এ বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কারণ প্রবঞ্চক আলী আকবর খানকে তিনি খুব ভালো চোখে দেখতেন না। এই অল্প সময়ের মধ্যে মন দেয়া নেয়া পর্বটি তাঁর কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি।

এ সম্পর্কে অনেক চিঠির মধ্যে শুধু মুজফ্ফর আহমদের একটি চিঠি উদ্ধৃত করা হলো। আহমদ সাহেব যে কেবল নজরুলের বন্ধু নন অভিভাবক, কেবল সঙ্গী নন, আদর্শ পরামর্শদাতা।

“পরম প্রীতিভাজনেষু,

কাজী সাহেব, আপনার পত্রাদি আর মোটেই পাওয়া যাইতেছে না, তার কারণ কী? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম। পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড়ই অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংশ্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয় আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। “মোহাম্মদী”তে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তাঁহারা তো নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন।... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম।”

এ সময় আলী আকবর খানের আচরণ সহজ সীমা অতিক্রম করে প্রকট হয়ে উঠছিলো। বিয়ের সময় প্রায় এসে গিয়েছিলো, নিমন্ত্রনপত্র বিলি করা হয়ে গেছে। এমন সময় নজরুলের মন গেল বিষিয়ে। তিনি পরিপূর্ণ অন্তরে এ বিয়েকে আর সমর্থন করতে পারছিলেন না। কারণ হিসেবে যতটুকু জানা যায় তার মধ্যে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের একটি উক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে।

“তাঁর আপনভোলা স্বভাব ও বিষয় বিরাগ নিয়ে তাঁর দৌলতপুরের শ্বশুরালয়ে দাস দাসীরা ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি। নব পরিণীতা বালিকাবধূর অবজ্ঞা তাঁকে হেনেছিলো সবচেয়ে বড় আঘাত। আহত অভিমানে বিবাহবাসর ত্যাগ করে নজরুল সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লায় চলে যান।”

কোন এক প্রবন্ধে জনাব এম আবদুর রহমান লিখেছেন,“বিবাহের দু’একদিন আগে কবি তাঁর ভাবী বধূ এবং বধূর সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তির কথা ও কার্যে এবং আচরণে ভীষণভাবে অপমানে আহত হয়েছিলেন।”

পরবর্তীতে কবির একটি চিঠিতে প্রকাশ পায় যে তিনি আলী আকবর খানের দ্বারা অপমানিত ও প্রতারিত হয়েছেন। বিয়ের সময় শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবী তাঁর পরিবারের সদস্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। নজরুল তাঁকে সকল কথা খুলে বললেন। প্রবীণ মহিলা সব শুনে বিয়েটা যে নজরুলের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই শান্তির ও শুভ হতে পারেনা, তা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন।

ওদিকে বিয়ের লগ্ন এসে গেল। নজরুলকে বাধ্য হয়ে বর সেজে বিয়ের আসরে বসতে হলো। আর তারপর অতি প্রত্যুষে তিনি দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লায় চলে গেলেন। বিবাহ জীবনের ইতি এখানেই। স্বামী-স্ত্রী রূপে কোনদিন তাঁদের বসবাস করা হলো না। সৈয়দা খাতুন কিন্তু পরবর্তীতে নজরুলের দেয়া নাম নার্গিস আসার খানমকে নার্গিস খানম নামেই নিজেকে সবার কাছে পরিচয় দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।

কোনোদিন দেখা হলো না, তবু এই ক্ষনিক পরিচয়ের স্মৃতি নজরুল তাঁর সারা জীবন বহন করে গিয়েছেন। আর ওদিকে নার্গিস আবার পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হলেন। ১৫ বছর পর কবির কাছে তিনি একটি পত্র লিখেছিলেন। সে পত্রের উত্তরে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন তাকে একটি অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমি সে পত্র উল্লেখ করছি না, শুধু পত্রের শেষে যে কথাটিলেখা ছিলো তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “পুনশ্চ: আমার চক্রবাক নামক কবিতা পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিলো। ইতি”

এই ঘটনায় কবি আহত হয়েছেন। আর আমরা পাঠকেরা তাঁর বেদনাক্লিষ্ট কলম থেকে পেয়েছি, অসাধারণ সব কবিতা। ছোট পরিসরে সব কিছু লেখার সুযোগ নেই। শুধু কবির হিংসাতুর কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করলাম-

“অপরাধ শুধু মনে আছে তার, মনে নাই কিছু আর?

মনে নাই তুমি দলেছ দু’পায়ে কবে কার ফুলহার!

কাঁদায়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়খাই,

পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই?

সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী,

কি হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি।”

সময়টা ছিলো ১৯২১ সালের মার্চ মাসে। আগেই বলেছি নার্গিসের সাথে পরিচয়ের মাত্র একদিন আগে কুমিল্লায় নজরুলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে। দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু তার আগে ১৯২২ সালে নজরুলের জীবনে দ্বিতীয যে নারীর আবির্ভাব ঘটেছিলো তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় কবির ব্যথার দান নামক উপন্যাসে। এই বইটির উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন,“মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি। তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।”

কে এই মানসী? জানা যায় তিনি ছিলেন আসানসোলের দারোগার মেয়ে স্বর্ণলতা গঙ্গোপাধ্যায়। স্বর্ণলতা সম্পর্কে নজরুল গবেষকদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু উৎসর্গপত্রের কথা সেই সম্পর্কের গভীরতার ইঙ্গিত বহন করে।

কলকাতার সঙ্গীতশিল্পী দিলীপ রায়ের কাছ থেকে কবি খোঁজ পান ঢাকার বনগ্রামের এক সুন্দরী সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী কিশোরীর, রানু সোম। কবি নিজে একজন গীতিকার এবং শিল্পী। স্বভাবতই তিনি সঙ্গীতশিল্পীদের খোঁজ করছিলেন। রানু সোমকে তিনি খুঁজে পেলেন ১৯২৮ সালে কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায়। তিনি তাঁর বাসায় হাজির হন এবং সাথে সাথেই তার গানের শিক্ষক হয়ে যান। কবি রানু সোমকে একমাস ধরে গান শেখাতে যেতেন। রানুর কাছ থেকে জানা যায় যে কবির “আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী, এ কোন সোনার গাঁয়” গানটি লেখা হয়েছিলো রাতে। কথা এবং সুর সম্পূর্ণ হবার আগেই কবি গানটি শেখাতে পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে গানটি সম্পূর্ণ করলেন এবং সুরারোপ করে পূর্ণতা দিলেন। এর দিন তিনেক পর কবি লিখলেন, “এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে”।

পরবর্তী জীবনে রানু সোম কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। কবি তাঁর চোখের কাজল কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, কল্যাণীয় বীণাকণ্ঠী শ্রীমতি প্রতিভা সোম, জয়যুক্তাসু।

‘চক্রবাক’ নামক কবিতার বইয়ের কবিতায় ব্যথাতুর হৃদয়ে কবি নার্গিসের অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রকে। সুরেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা নোটন, ভালো নাম উমা মৈত্র। নোটনকে গান শেখাবার সময় কবি তার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর গান,“তুমি নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল” অথবা তুমি মোরে ভুলিয়াছ কবিতার “তোমার অঙ্গনে, প্রিয়! সেদিন সন্ধ্যায় ভুলে পরেছিলে ফুল নোটন-খোঁপায়!” নোটনের প্রতি তাঁর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ। নজরুল নোটনকে বেশ কিছু গান শেখান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

“নিশি ভোর হলো জাগিয়া, পরাণ প্রিয়া”

“আজি এ কুসুমহার, সহি কেমনে”

“বসিয়া বিজনে কেন একা মনে”

গানগুলি বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয়।

নজরুল জীবনের প্রেমের অধ্যায়ে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নোটন ওরফে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে গানের আড়াল কবিতায় উমা মৈত্রের উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন:

তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান-

এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?

অন্তর-তলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,

গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?

... ... ...

ভোলো মোর গান, কী হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়,

আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়!

জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-

কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।

কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে, নজরুলের প্রেমের আগ্রহের প্রত্যুত্তরে উমা মিত্রের কাছ থেকে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ওপরে উল্লিখিত গানের আড়াল কবিতার শেষ চারটি চরণে কবির হতাশার দুঃখ ফুটে উঠেছে।

১৯৩০ সালে কবির বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার পরিচয় করিয়ে দেন আলতাফ চৌধুরীর সাথে। নলিনীকান্ত নিজে একজন গানের শিক্ষক, সঙ্গীত শিল্পী এবং সাহিত্যজগতে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। সে সময় তিনি ছিলেন সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার সম্পাদক। তিনি একদিন কবিকে নিয়ে এলেন আলতাফ চৌধুরীর পার্ক সার্কাসের বাসায়। কবির চিরাচরিত স্বভাবগুণে আলতাফ চৌধুরীর পরিবারের সাথে গভীর বন্ধুত্ব আর আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠতে দেরি হলো না। আলতাফের বোন জাহানারা চৌধুরী। কবিতা ও গানের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা। কবির কাছে জাহানারার আব্দার, তাঁকে কবিতা লিখে দিতে হবে, সে কবিতা অন্য কেউ ছাপবে না। সে হবে তাঁর একান্ত নিজের। কবি ভক্তের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। জাহানারা বেগমের দেয়া লাল কাপড়ে মোড়ানো খাতায় তিনি কবিতা আর গান লিখে দিয়েছেন আর উৎসর্গ করেছেন এই বলে, “মীরাকে, নজরুল ইসলাম”। মীরা জাহানারার ডাক নাম।

১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্যসমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে কবির সাথে পরিচয় হয় মহীয়সী নারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে। কবির জীবনে এ ছিল এক একতরফা প্রেম। তিনি এই নারীকে নিয়ে অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এসব কবিতা ও গানে নজরুলের ব্যাকুলতা প্রকাশ পেলেও ফজিলাতুন্নেসার পক্ষ থেকে তার কোন সাড়া মেলেনি। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে শামসুজ্জোহা নামে এক উচ্চশিক্ষিত যুবকের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।

সে আমলের বিখ্যাত শিল্পী কানন দেবীর সাথে নজরুলের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম রটনায় মেতে উঠতো সজনীকান্তের সম্পাদিত শনিবারের চিঠি পত্রিকা। যদিও কানন দেবীর সাথে কবির সম্পর্ক ছিলো নিতান্তই গুরু-শিষ্যের। কানন দেবী ছাড়াও কবির কাছে গান শিখেছেন, ইন্দুবালা দেবী, বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার, সুপ্রভা সরকার এবং ফিরোজা বেগমের মতো অনেক নামীদামী শিল্পী।

নার্গিস আসার খানমের সাথে নজরুলের বিবাহ ভেঙে যাবার পর তিনি যে নারীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন তিনি হলেন দুলি বা দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপাকে নিয়ে তিনি লিখলেন:

হে মোর রাণী। তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,

আমার বিজয়কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।

কবি দোলনচাঁপার নাম দিলেন প্রমীলা। এই অসম বিবাহ সেনগুপ্ত পবিবারের সবাই মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু প্রমীলার মা গিরিবালা সেনগুপ্ত নজরুলকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তিনি মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নজরুলের সাথে বিয়ে দেন। ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ সালে ছিল এই বিয়ের দিন। প্রমীলা নজরুলকে উপহার দিয়েছেন কাজী অনিরুদ্ধ ও কাজী সব্যসাচীর মতো দুই কৃতী সন্তান। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মারা যান। নজরুল তখন অসুস্থ, বাকশক্তিরুদ্ধ।

অনেকের জীবনে চলার পথে প্রেম আসে কিন্তু কবি জীবনের প্রেম অঙ্কুরিত হয়ে পুষ্পপর্ণে ডালপালা মেলেছে সাহিত্য আর কাব্যে। সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্য, পাঠক পেয়েছে সাহিত্যের এক অমূল্য খনি।