নজরুল কাব্য-চারিত্র্য

আতিক আজিজ

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সাহিত্য জগতে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বাঙলার সাহিত্য-গগন ‘রবি-দীপ্তি’তে যখন পূর্ণতেজে দেদীপ্যমান ঠিক সেই সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যে একটা স্বকীয়, স্বতন্ত্র মর্যাদাসুলভ গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠা লাভ করা কম গৌরবের কথা নয়। নজরুল প্রতিভার বিকীরণ স্বল্প সময়ের বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই অতি অল্পকালের মধ্যেই মানুষের মনের মনিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ নেন নজরুল ইসলাম।

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপমা এবং রূপকারগুলির একটিও গঠন-মুখী নয়। আমরা যাকে বলি ধ্বংসাত্মক, ঐগুলি ঠিক তাই। কিন্তু যখনই শেষ পর্যায়ে এসে উচ্চারিত হলো :

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার

নঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

আমি হল বলরাম-স্কন্ধে

আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে!

এবং সেই সংগে একটি শর্ত:

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যাবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-

তখনই সমগ্র কবিতাটিরই উপমা রূপকল্প প্রয়োগের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গেল বদলে। কবিতার শব্দ বা অন্যায় আলঙ্কারিকতাকে গঠনমুখী হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু কাব্যবিবর্তনের এক পর্যয়ে এসে আমরা লক্ষ্য করছি যে, কাব্য জীবনের স্পষ্টতর সত্যাসত্যের সংগে সম্বন্ধ স্থাপনের দিকে মুখ ফিরিয়েছে এবং ফলে এতে ব্যবহৃত উপকরণ-মালাও হয়ে উঠেছে অনেকাংশেই উপযোগিতামূলক (utilitarian)। কল্পনার এবং হৃদয়-উদ্ভাবনার স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বর্ণপীঠ থেকে খলিত হয়ে পড়েছে কাবা এবং অনেক গুপ্ত হলেও তার উদ্দেশ্যপ্রবণতা যেন আর অগোচর থাকতে নারাজ। ভূগু ব্রাহ্মকে জানবার সাধনায় পরিশেষে এইটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রহ্ম একই সঙ্গে অন্ন এবং আনন্দের সমন্বয়। রোমান্টিকতার পরিণতি লগ্নে এসে কাব্যও এই পরম সত্য উপলব্ধির সন্ধিসূত্র। ‘বিদ্রোহী’র সেতু বেয়ে বাংলা সাহিত্যে কাব্যের অমৃত সিংহাসন কল্পলোক থেকে মর্ত্যলোকে নেমে এসেছে। কল্পনা ও বিশুদ্ধ সৌন্দর্যানুভূতির উৎস থেকে জীবনের মাটিতে কবিতার মূল শিকড় প্রোথিত হয়েছে। সেখানে অন্ন ও আনন্দ দুই-ই আছে, কিন্তু উৎসটি আর অলীকে নেই, ঘটমান সঞ্চরণমান ও গতিশীল পরিবর্তনশীল জীবনের বাস্তব হাতে বিধৃত। জীবন পার স্পর্শে পূর্ণ। ফলে কাব্যও পারম্পর্যের খাতে প্রবাহিত হলো, তার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিন গেল ফুরিয়ে।

কিন্তু কাব্যের এই উপযোগিতামূলক স্বভাব পরিগ্রহণের মূলগতভাবে পরিবর্তিত চারিত্র্যটি বাংলা কাব্যের অগ্রসরধারায় আচমকা নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাও ভূঁইফোঁড় নয়। এর অনিবার্য ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে তা ছিল উদ্গমের প্রবণতায় আবির্ভাব চঞ্চল, সন্ধিমুহূর্তে একটি সংস্থিত ও প্রতিষ্ঠিত আদল থেকে অবধারিত নবজন্মের উৎসাহে, আগ্রহে, প্রয়োজনসিদ্ধ ও সচেতনতায় তা ছিল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। রবীন্দ্রনাথে তা সর্বস্ব ছিল না, ছিল সজ্ঞান, ছিল উন্মেষ-উদ্বিগ্ন। কিন্তু নজরুলে তা হয়ে উঠেছে সর্বাত্মক। বক্তব্যের নিঃসরণে, উপমা ও রূপকল্প প্রয়োগে, চিত্রধর্মী সংস্থাপনে, আবেগের উত্থান-পতনে এবং বিষয়ের প্রতি আনুগত্য ও পটভূমির প্রতি চেতনায়- কাব্যের এই উপযোগিতামূলক (utilitarian) আদর্শ কাব্যের বিবর্তন-উদ্বেগের অন্তর্ভুক্ত। কারণেই নজরুলের রক্তমজ্জায় জড়িত ছিল। ফলে তা পরিশেষে বাংলা কবিতায় প্রধান সুর ও বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। এই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের আবির্ভাব সে সময় ও সমাজ নিহিত মূল্যচেতনার বিবর্তনে একটি স্বাভাবিক উত্তরণ। একথা প্রমাণসিদ্ধ তথ্য হিসাবে উপস্থিত করা যায়।

কবির সামাজিক বা রাজনৈতিক বোধ, ধারণা বা আদর্শের দিক থেকে নয়, কাব্যের উপকরণ ব্যবহারের উপরোক্ত উপযোগিতামূলক প্রবণতার প্রাধান্য থেকেই নজরুলের সমকালীন এবং তাঁর পরবর্তী কবিতার ভিন্ন চারিত্র্য গ্রহণের মৌলিক পরিচয় আমরা খুঁজে পেতে পারি।এই মাপকাঠি আমরা যেমন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তীর বেলায় প্রয়োগ করতে পারি, তেমনি এইটি আরো পরবর্তী কবিদের বেলাতেও প্রযোজ্য। অবশ্যই এ-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু তা সচেতন ব্যতিক্রম এবং অন্যপক্ষে কাব্যের শিকড়-নিবিষ্ট নূতনতর ধারাই এ পর্যায়ের প্রধান সুর ও স্বাভাবিক উৎসারণ। কথাটা কিছু উদ্ধৃতির সাহায্যে স্পষ্ট করা যাক:

(ক)

ক্ষুধা মিটাবার খাদা নহে যে মানব,

কেহ নহে তোমার আমার।

... ... ...

লও তার মধুর সৌরভ,

দেখো তার সৌন্দর্য বিকাশ,

মধু তার করো তুমি পান,

ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী

চেয়ো না তাহারে।

আকাক্সক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।

শান্ত সন্ধ্যা স্তব্ধ কোলাহল। নিভাও বাসনাবহ্নি

নয়নের নীড়ে। চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।

(নিষ্ফল কামনা, মানসী, রচনাকাল ১২৯৪)

(খ)

আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ-খেলা নিশীথ বেলা।

সঘন বরষা, গগন আঁধার,

হেরো বারিধারে কাদে চারিধার- ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে ভাসাই ভেলা;

বাহির হয়েছি স্বপ্ন শয়ন করিয়া হেলা

রাত্রি বেলা।।

(ঝুলন, সোনার তরী, ১২৯৯)

এরূপ অজস্র উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু তাতে ফল একই। এক্ষেত্রে প্রকৃত কথাটি এই যে, স্তবকগুলির বক্তব্য ও অলঙ্কার-বিন্যাস সংশ্লিষ্ট কবিতাগুলির গাদপীঠেই সীমাবদ্ধ, এসবের উৎস অন্যত্র নিহিত নয়। এদের দ্যোতনার সঞ্চরণশীলতা আছে ঠিকই, কিন্তু এগুলির আনুগত্য নিজস্ব কাব্য-আঁধারের বাইরে প্রসারিত নয়। এই কবিতাগুলিতে প্রকাশিত বক্তব্য এবং ললিত-বিচ্ছুরণ এদের আপন সীমার মধ্যেই চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করেছে। এই আত্মস্ব-উৎকটেই এদের পরিণতি এবং সাংসম্পূর্ণতাই এদের মোক্ষ। নিজ কায়ার সম্পূর্ণ গঠনেই এর উচ্ছ্বাসের সিদ্ধি এবং বক্তব্যের পরিসমাপ্তি। নিজের সীমার বাইরে কোনক্রমেই এর লক্ষ্য নিবন্ধ নয় এবং বৃহত্তর কোনো পটভূমির দিকে এর কোনো ব্যঞ্জনাই প্রস্তুতও নয়। ভাবাদর্শ এর যাই থাকুক না কেন, তা নিজের মধ্যেই পরিপূণর্রূপে ধারণ করে আছে। কিন্তু,

(ক) চিরযুবা ই যে চিরজীবী, জীর্ণজরা করিয়ে দিয়ে

প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।

সবুজ নেশায় ভোর করেছিস ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরই তড়িৎ ভরা, বসন্তেরে পরাস আকুল করা আপন গলার বকুল মালা-গাছা আর রে অমর আয়রে আমার কাঁচা

(সবুজের অভিযান, বলাকা রচনাকাল : ১৩২১

(থ) ঘরের মঙ্গল শঙ্খ নহে তোর তরে

নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক

নহে প্রেয়সীর অশ্রুচোখ

পথে পথে অপেক্ষিছে

কালবৈশাখীর আশীর্বাদ

শ্রাবণ রাত্রির বজ্রনাদ;

পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা পথে পথে গুপ্তসর্প গূঢ় কণা।

নিশা দেবে জয় শঙ্খনাদ

সেই তোর রুদ্রের প্রসাদ।

( নববর্ষ, বলাকা)

এই উদ্ধৃতিগুলিতে লক্ষ্য করতে পারছি যে, এতে ব্যবহৃত উপমা, শব্দ, চিত্র ও রূপকল্প এবং ইংগিতসমূহ নিজস্ব আঙ্গিকে আর সীমাবদ্ধ নয়। কেবল জীবন সম্পর্কিত ধনংঃৎধপঃ ধারণামাত্র নয়, জীবনের ঘটমানতা ও ব্যাপকতর প্রেক্ষিতের সঙ্গেও এসব জড়িত। ফলে একটি অন্যতর প্রয়োজন সাধনের প্রবণতায় এসব যেমন উদগ্রীব, তেমনি একটা উপযো- গিতামূলক চারিত্র্যও এরা অর্জন করে বসে আছে। এগুলির ঝাঁচ স্বয়ং সম্পূর্ণতার নয়, এক বিস্তৃততর পটভূমির যোগাযোগে এসবের উদ্ভব। এবং অন্যপক্ষে একটি নিবিড় সত্যাসত্যের প্রকাশনায় যে এসবের প্রেরণা অক্ষর উৎসর্গিত, তা সহজেই আঁচ করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এইটি প্রধান সুর নয়। তাঁর সর্বগ্রাসী উত্তরণ প্রয়াসী সচেতন মন আগ বাড়িয়ে পরবর্তী বিবর্তনের কাজ করে গেছে। ফলে পরবর্তী ধাপে দেখছি এই লক্ষণ নজরুলে সর্বাত্মক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে এবং কার্যত: বাংলা কাব্যেরও প্রধান সুর হয়ে উঠেছে।

এই লক্ষণ ও প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করার জন্যে নজরুল থেকে কিছু উদাহরণ উপস্থাপিত করা হলো:

(ক)

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু,

কাপল ভূধর, কানন তরু

বিশ্ব ডুবান আসল তুফান উছলে উজান

ভৈরবীদের গান ভাসে,

মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বাম পাশে।

(সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে, দোলন চাঁপা)

খ)

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সায়ীরা সাবধান!

যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান !

ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার।।

(কান্ডারী হুঁশিয়ার, সর্বহারা)

(গ)

ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা চোরাবালির চর

ওরে পাগল। কে বেধেছিস

সেই চরে তোর ঘর?

শূন্য তড়িৎ দেয় ইশারা,

হাট তুলে দে সর্বহারা,

মেঘ-জননীর অশ্রুধারা

ঝরছে মাথার ’পর,

দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি

দুলিয়ে তরু কর।

(সর্বহারা, সর্বহারা )

(ঘ) এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া

বালির বাঁধ?

কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন

উঠেছে চাঁদ?

(যৌবন-জলতরঙ্গ, সন্ধ্যা)

নজরুলের কাব্যিক চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য বাংলা কাব্যের একটা প্রধান সুর হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে তা পরিশীলিত ও বিকশিত হয়। রবীন্দ্রনাথে নানা দিক থেকে রোমান্টিকতার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছিল এবং রবীন্দ্রনাথেই আবার কার্যতার নতুন দিগদর্শন অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল। নজরুলে এই অঙ্কুর স্থায়ীরূপে প্রস্ফুটিত হয়। নজরুল রোমান্টিকতা বিবর্জিত নয়- তবে তাঁর মধ্যে বিশ্লেষাত্মক প্রবণতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং তাঁর হাতেই কাব্য জীবনের ক্লাসিকধর্মী রূপায়ণের ও সমালোচনার কাজে উপযোগিতা-মূলক স্বভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে।

‘শুনরে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’- এ কথায় যে সার্বজনীন বিমূর্ত মানববোধ রয়েছে, স্পষ্টতই নজরুলের মানববোধ বা জীবন-জিজ্ঞাসা তা নয়। নজরুলের কাব্য উৎসারণে যে দায়িত্ববোধ ও নির্দিষ্ট চেতনা সঞ্জাত হয়েছে তা একেবারেই নতুন এবং পরবর্তী বিবর্তনে তা হয়ে উঠেছে আরো অনেক ব্যাপক, গূঢ় ও গভীর, সর্বাত্মক ও সর্বভূক।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

নজরুল কাব্য-চারিত্র্য

আতিক আজিজ

image

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সাহিত্য জগতে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বাঙলার সাহিত্য-গগন ‘রবি-দীপ্তি’তে যখন পূর্ণতেজে দেদীপ্যমান ঠিক সেই সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যে একটা স্বকীয়, স্বতন্ত্র মর্যাদাসুলভ গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠা লাভ করা কম গৌরবের কথা নয়। নজরুল প্রতিভার বিকীরণ স্বল্প সময়ের বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই অতি অল্পকালের মধ্যেই মানুষের মনের মনিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ নেন নজরুল ইসলাম।

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপমা এবং রূপকারগুলির একটিও গঠন-মুখী নয়। আমরা যাকে বলি ধ্বংসাত্মক, ঐগুলি ঠিক তাই। কিন্তু যখনই শেষ পর্যায়ে এসে উচ্চারিত হলো :

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার

নঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

আমি হল বলরাম-স্কন্ধে

আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে!

এবং সেই সংগে একটি শর্ত:

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যাবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-

তখনই সমগ্র কবিতাটিরই উপমা রূপকল্প প্রয়োগের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গেল বদলে। কবিতার শব্দ বা অন্যায় আলঙ্কারিকতাকে গঠনমুখী হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু কাব্যবিবর্তনের এক পর্যয়ে এসে আমরা লক্ষ্য করছি যে, কাব্য জীবনের স্পষ্টতর সত্যাসত্যের সংগে সম্বন্ধ স্থাপনের দিকে মুখ ফিরিয়েছে এবং ফলে এতে ব্যবহৃত উপকরণ-মালাও হয়ে উঠেছে অনেকাংশেই উপযোগিতামূলক (utilitarian)। কল্পনার এবং হৃদয়-উদ্ভাবনার স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বর্ণপীঠ থেকে খলিত হয়ে পড়েছে কাবা এবং অনেক গুপ্ত হলেও তার উদ্দেশ্যপ্রবণতা যেন আর অগোচর থাকতে নারাজ। ভূগু ব্রাহ্মকে জানবার সাধনায় পরিশেষে এইটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রহ্ম একই সঙ্গে অন্ন এবং আনন্দের সমন্বয়। রোমান্টিকতার পরিণতি লগ্নে এসে কাব্যও এই পরম সত্য উপলব্ধির সন্ধিসূত্র। ‘বিদ্রোহী’র সেতু বেয়ে বাংলা সাহিত্যে কাব্যের অমৃত সিংহাসন কল্পলোক থেকে মর্ত্যলোকে নেমে এসেছে। কল্পনা ও বিশুদ্ধ সৌন্দর্যানুভূতির উৎস থেকে জীবনের মাটিতে কবিতার মূল শিকড় প্রোথিত হয়েছে। সেখানে অন্ন ও আনন্দ দুই-ই আছে, কিন্তু উৎসটি আর অলীকে নেই, ঘটমান সঞ্চরণমান ও গতিশীল পরিবর্তনশীল জীবনের বাস্তব হাতে বিধৃত। জীবন পার স্পর্শে পূর্ণ। ফলে কাব্যও পারম্পর্যের খাতে প্রবাহিত হলো, তার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিন গেল ফুরিয়ে।

কিন্তু কাব্যের এই উপযোগিতামূলক স্বভাব পরিগ্রহণের মূলগতভাবে পরিবর্তিত চারিত্র্যটি বাংলা কাব্যের অগ্রসরধারায় আচমকা নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাও ভূঁইফোঁড় নয়। এর অনিবার্য ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে তা ছিল উদ্গমের প্রবণতায় আবির্ভাব চঞ্চল, সন্ধিমুহূর্তে একটি সংস্থিত ও প্রতিষ্ঠিত আদল থেকে অবধারিত নবজন্মের উৎসাহে, আগ্রহে, প্রয়োজনসিদ্ধ ও সচেতনতায় তা ছিল বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। রবীন্দ্রনাথে তা সর্বস্ব ছিল না, ছিল সজ্ঞান, ছিল উন্মেষ-উদ্বিগ্ন। কিন্তু নজরুলে তা হয়ে উঠেছে সর্বাত্মক। বক্তব্যের নিঃসরণে, উপমা ও রূপকল্প প্রয়োগে, চিত্রধর্মী সংস্থাপনে, আবেগের উত্থান-পতনে এবং বিষয়ের প্রতি আনুগত্য ও পটভূমির প্রতি চেতনায়- কাব্যের এই উপযোগিতামূলক (utilitarian) আদর্শ কাব্যের বিবর্তন-উদ্বেগের অন্তর্ভুক্ত। কারণেই নজরুলের রক্তমজ্জায় জড়িত ছিল। ফলে তা পরিশেষে বাংলা কবিতায় প্রধান সুর ও বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। এই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের আবির্ভাব সে সময় ও সমাজ নিহিত মূল্যচেতনার বিবর্তনে একটি স্বাভাবিক উত্তরণ। একথা প্রমাণসিদ্ধ তথ্য হিসাবে উপস্থিত করা যায়।

কবির সামাজিক বা রাজনৈতিক বোধ, ধারণা বা আদর্শের দিক থেকে নয়, কাব্যের উপকরণ ব্যবহারের উপরোক্ত উপযোগিতামূলক প্রবণতার প্রাধান্য থেকেই নজরুলের সমকালীন এবং তাঁর পরবর্তী কবিতার ভিন্ন চারিত্র্য গ্রহণের মৌলিক পরিচয় আমরা খুঁজে পেতে পারি।এই মাপকাঠি আমরা যেমন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তীর বেলায় প্রয়োগ করতে পারি, তেমনি এইটি আরো পরবর্তী কবিদের বেলাতেও প্রযোজ্য। অবশ্যই এ-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু তা সচেতন ব্যতিক্রম এবং অন্যপক্ষে কাব্যের শিকড়-নিবিষ্ট নূতনতর ধারাই এ পর্যায়ের প্রধান সুর ও স্বাভাবিক উৎসারণ। কথাটা কিছু উদ্ধৃতির সাহায্যে স্পষ্ট করা যাক:

(ক)

ক্ষুধা মিটাবার খাদা নহে যে মানব,

কেহ নহে তোমার আমার।

... ... ...

লও তার মধুর সৌরভ,

দেখো তার সৌন্দর্য বিকাশ,

মধু তার করো তুমি পান,

ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী

চেয়ো না তাহারে।

আকাক্সক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।

শান্ত সন্ধ্যা স্তব্ধ কোলাহল। নিভাও বাসনাবহ্নি

নয়নের নীড়ে। চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।

(নিষ্ফল কামনা, মানসী, রচনাকাল ১২৯৪)

(খ)

আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ-খেলা নিশীথ বেলা।

সঘন বরষা, গগন আঁধার,

হেরো বারিধারে কাদে চারিধার- ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে ভাসাই ভেলা;

বাহির হয়েছি স্বপ্ন শয়ন করিয়া হেলা

রাত্রি বেলা।।

(ঝুলন, সোনার তরী, ১২৯৯)

এরূপ অজস্র উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু তাতে ফল একই। এক্ষেত্রে প্রকৃত কথাটি এই যে, স্তবকগুলির বক্তব্য ও অলঙ্কার-বিন্যাস সংশ্লিষ্ট কবিতাগুলির গাদপীঠেই সীমাবদ্ধ, এসবের উৎস অন্যত্র নিহিত নয়। এদের দ্যোতনার সঞ্চরণশীলতা আছে ঠিকই, কিন্তু এগুলির আনুগত্য নিজস্ব কাব্য-আঁধারের বাইরে প্রসারিত নয়। এই কবিতাগুলিতে প্রকাশিত বক্তব্য এবং ললিত-বিচ্ছুরণ এদের আপন সীমার মধ্যেই চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করেছে। এই আত্মস্ব-উৎকটেই এদের পরিণতি এবং সাংসম্পূর্ণতাই এদের মোক্ষ। নিজ কায়ার সম্পূর্ণ গঠনেই এর উচ্ছ্বাসের সিদ্ধি এবং বক্তব্যের পরিসমাপ্তি। নিজের সীমার বাইরে কোনক্রমেই এর লক্ষ্য নিবন্ধ নয় এবং বৃহত্তর কোনো পটভূমির দিকে এর কোনো ব্যঞ্জনাই প্রস্তুতও নয়। ভাবাদর্শ এর যাই থাকুক না কেন, তা নিজের মধ্যেই পরিপূণর্রূপে ধারণ করে আছে। কিন্তু,

(ক) চিরযুবা ই যে চিরজীবী, জীর্ণজরা করিয়ে দিয়ে

প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।

সবুজ নেশায় ভোর করেছিস ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরই তড়িৎ ভরা, বসন্তেরে পরাস আকুল করা আপন গলার বকুল মালা-গাছা আর রে অমর আয়রে আমার কাঁচা

(সবুজের অভিযান, বলাকা রচনাকাল : ১৩২১

(থ) ঘরের মঙ্গল শঙ্খ নহে তোর তরে

নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক

নহে প্রেয়সীর অশ্রুচোখ

পথে পথে অপেক্ষিছে

কালবৈশাখীর আশীর্বাদ

শ্রাবণ রাত্রির বজ্রনাদ;

পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা পথে পথে গুপ্তসর্প গূঢ় কণা।

নিশা দেবে জয় শঙ্খনাদ

সেই তোর রুদ্রের প্রসাদ।

( নববর্ষ, বলাকা)

এই উদ্ধৃতিগুলিতে লক্ষ্য করতে পারছি যে, এতে ব্যবহৃত উপমা, শব্দ, চিত্র ও রূপকল্প এবং ইংগিতসমূহ নিজস্ব আঙ্গিকে আর সীমাবদ্ধ নয়। কেবল জীবন সম্পর্কিত ধনংঃৎধপঃ ধারণামাত্র নয়, জীবনের ঘটমানতা ও ব্যাপকতর প্রেক্ষিতের সঙ্গেও এসব জড়িত। ফলে একটি অন্যতর প্রয়োজন সাধনের প্রবণতায় এসব যেমন উদগ্রীব, তেমনি একটা উপযো- গিতামূলক চারিত্র্যও এরা অর্জন করে বসে আছে। এগুলির ঝাঁচ স্বয়ং সম্পূর্ণতার নয়, এক বিস্তৃততর পটভূমির যোগাযোগে এসবের উদ্ভব। এবং অন্যপক্ষে একটি নিবিড় সত্যাসত্যের প্রকাশনায় যে এসবের প্রেরণা অক্ষর উৎসর্গিত, তা সহজেই আঁচ করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এইটি প্রধান সুর নয়। তাঁর সর্বগ্রাসী উত্তরণ প্রয়াসী সচেতন মন আগ বাড়িয়ে পরবর্তী বিবর্তনের কাজ করে গেছে। ফলে পরবর্তী ধাপে দেখছি এই লক্ষণ নজরুলে সর্বাত্মক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে এবং কার্যত: বাংলা কাব্যেরও প্রধান সুর হয়ে উঠেছে।

এই লক্ষণ ও প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করার জন্যে নজরুল থেকে কিছু উদাহরণ উপস্থাপিত করা হলো:

(ক)

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু,

কাপল ভূধর, কানন তরু

বিশ্ব ডুবান আসল তুফান উছলে উজান

ভৈরবীদের গান ভাসে,

মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বাম পাশে।

(সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে, দোলন চাঁপা)

খ)

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সায়ীরা সাবধান!

যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান !

ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার।।

(কান্ডারী হুঁশিয়ার, সর্বহারা)

(গ)

ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা চোরাবালির চর

ওরে পাগল। কে বেধেছিস

সেই চরে তোর ঘর?

শূন্য তড়িৎ দেয় ইশারা,

হাট তুলে দে সর্বহারা,

মেঘ-জননীর অশ্রুধারা

ঝরছে মাথার ’পর,

দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি

দুলিয়ে তরু কর।

(সর্বহারা, সর্বহারা )

(ঘ) এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া

বালির বাঁধ?

কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন

উঠেছে চাঁদ?

(যৌবন-জলতরঙ্গ, সন্ধ্যা)

নজরুলের কাব্যিক চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য বাংলা কাব্যের একটা প্রধান সুর হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে তা পরিশীলিত ও বিকশিত হয়। রবীন্দ্রনাথে নানা দিক থেকে রোমান্টিকতার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছিল এবং রবীন্দ্রনাথেই আবার কার্যতার নতুন দিগদর্শন অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল। নজরুলে এই অঙ্কুর স্থায়ীরূপে প্রস্ফুটিত হয়। নজরুল রোমান্টিকতা বিবর্জিত নয়- তবে তাঁর মধ্যে বিশ্লেষাত্মক প্রবণতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং তাঁর হাতেই কাব্য জীবনের ক্লাসিকধর্মী রূপায়ণের ও সমালোচনার কাজে উপযোগিতা-মূলক স্বভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে।

‘শুনরে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’- এ কথায় যে সার্বজনীন বিমূর্ত মানববোধ রয়েছে, স্পষ্টতই নজরুলের মানববোধ বা জীবন-জিজ্ঞাসা তা নয়। নজরুলের কাব্য উৎসারণে যে দায়িত্ববোধ ও নির্দিষ্ট চেতনা সঞ্জাত হয়েছে তা একেবারেই নতুন এবং পরবর্তী বিবর্তনে তা হয়ে উঠেছে আরো অনেক ব্যাপক, গূঢ় ও গভীর, সর্বাত্মক ও সর্বভূক।