ভেল্কি

অরুণিমা

মাঝেমাঝে টের পাই, আমি আজকাল একটা সংকীর্ণ সেতুর ওপর হাঁটছি, সামলে সামলে দুলে দুলে পড়তে পড়তে আবার সামলে এগিয়ে যাচ্ছি। কথাগুলো নিজের মনে বলে ওঠে রিনি। চোখে ভেসে ওঠে মফস্বলে ছোটোবেলার স্কুল ফিরতি পথের দৃশ্য।

একটা ধুলোমাখা মেয়ে রুক্ষ খোলা চুলে দুহাতে একটা বাঁশ ধরে এগিয়ে চলেছে একটা দড়ির ওপর দিয়ে। তার হাতে পায়ে ডান বাঁয়ের অদ্ভুত সামঞ্জস্য। কেঁপে ওঠা দড়ি ভিড় করে থাকা লোকের মনে জাগিয়ে তুলছে উত্তেজনা। তারা কখনও হইহই করে উঠছে, কখনও করছে ফিসফিস। মেয়েটা হেঁটে চলেছে একটা ছন্দে একটা লয়ে যেমনটা শেখানো হয়েছে তাকে, যেমনটা স্থির করে দেওয়া হয়েছে তার লক্ষ্য। এ কথাটা মনে হতে একটা চমক লেগে এবার দৃশ্যটা পরিবর্তন হয়ে গেল বছর চল্লিশের রিনির চোখে। ঠিক যেমন বাইরে থেকে মন দৃশ্য পাল্টায়, পাল্টায় মনের ইচ্ছে, চাওয়া পাওয়া, নীরবতা, বিদ্রোহ, অথবা শুধুই বিদ্রোহ করার ইচ্ছে বা অনিচ্ছে।

এবার দড়ির ওপর হাঁটতে থাকা মেয়েটার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। যদিও তার এই হাঁটার দৈর্ঘ্য বেশি নয়, কিন্তু মেয়েটাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সে যেন এগিয়ে চলেছে আসলে অন্য কোনও একটা গন্তব্যে, এমনি তার চোখের দৃষ্টি, এমনি তার চোখের রং সাদা। এমনকি যখন সে দড়িটার প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তখনও! এই যে লোকের ফিসফাস আর উত্তেজিত কণ্ঠ, কোনোকিছুই আসলে মেয়েটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। তাকে হয়ত ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধুই গরম ভাতের গন্ধ। তার সাদা সাদা উদাসীন চোখ মনে হয় কখনও শূন্যতায়, কখনও অচেনা স্বপ্নে নিবদ্ধ। অথবা হয়ত তার সাদা চোখ আসলে শুধুই ভাতের সাদা রং।

কী আশ্চর্য! কখনও তো এসব মনে হয়নি আগে। সামনে থেকে মেয়েটাকে দেখেও এমন কিছু মনে হয়নিÑযা আজ তার আবছা মুখ মনে করে হচ্ছে। স্কুল ফিরতি মেয়েদের কাছে সে তখন আজব খেলা দেখানো রুক্ষ মেয়ে, অন্য গোত্র। এই মেয়েদের পরিপাটি জামা আর চুল কোনোকিছুই মিল হয় না এমন ভেল্কি খেলা দেখানো আজব মেয়ের সাথে। মিল হয় না লক্ষ্যের, মিল হয় না গন্তব্যের, ভাললাগা রং গন্ধ অথবা স্পর্শের।

ভেল্কি নাকি একাগ্রতা! যে একই একাগ্রতায় স্থির লক্ষ্যে বড় হয়ে উঠেছে রিনিও। কিন্তু আজ তবে কেন মনে হচ্ছে যে, সে আসলে ওই মেয়েটার মতো অন্য কোনও না পাওয়া লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে, আর শূন্যে রাখা একটা সেতুর ওপর দুলছে সে, দুলছে তার মন! আর অনিশ্চয়তায় দুলছে তার সমস্ত সত্তা। ভাবছে, এই বুঝি সব শেষ! পড়ে যাচ্ছে সে, আবার মুহূর্তে সামলে নিচ্ছে আবেগ, সামলে নিচ্ছে ক্ষত, সামলে নিচ্ছে একইসাথে মনের ভেতরের একাকীত্ব আর বাইরের জুড়ে থাকা ঘিরে থাকা প্রয়োজনীয়তা, সামলে নিচ্ছে ভরাডুবি সোশ্যাল সিকিউরিটি, সোশ্যাল স্টেটাস।

এই সামলে নেওয়া মুহূর্তে নিজেকে একা অথচ সাহসী লাগে রিনির। ভিড় থাকলে সব আবেগের ওপর থাকে অপরিসীম নিয়ন্ত্রন, যেমন নিয়ন্ত্রণে ভেল্কি দেখানো মেয়ে হেঁটে চলে। শুধু অন্য গোত্র বলে রিনির চুলের রুক্ষতাকে বলতে হয় স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর একা হলে বুক হয়ে ওঠে আবেগঘন, আর কান্নায় ভিজে চুল হয়ে ওঠে নরম। আচ্ছা, ভেল্কি দেখানো সেই মেয়ে কখনও কাঁদে কি!

উত্তর পায় না রিনি, যেমন উত্তর পায় না স্থির লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরও যদি কোনোদিন মেলেনি গরম ভাত আর সাদা চোখ তৃপ্তিতে ফিরে আসেনি স্বাভাবিক রঙে কি করেছে মেয়েটা তখন! আফসোস হয়, মেয়েটাকে জানা হয়নি বলে। আর একবার যদি দেখা হতো তার সাথে তাহলে হয়ত...

অনেক লোকের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে সামনে এগিয়ে যেতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রিনি। ভেল্কির খেলা দেখানো দলের একটা লোকের হাতের ভাঙা আয়নায় দেখতে পায় নিজের মুখ। এ কি! অদ্ভুত রুক্ষ দেখাচ্ছে তাকে। কাঁচাপাকা অযতেœর চুল নেমে এসেছে মুখের ওপর। হঠাৎ হাসির শব্দে তাকায় সে চারিপাশে। দেখে তাকে লক্ষ্য করেই হাসছে ভিড়-এ জমে থাকা সব মানুষেরা। আর সেইসব হাসিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে একটা অট্টহাসি। দড়ির খেলা থেকে নেমে সেই অট্টহাসি সরে যেতে থাকে দূরে! কোনো রকমে সামলে ওঠে রিনি, হোঁচট খায়, আবার সামলে উঠে হাত বাড়িয়ে ছুটে ধরতে চায় মেয়েটাকে। কিন্তু পারে না, সে দূরে আরও দূরে সরে যেতে থাকে। প্রাণপন শক্তিতে ছুটতে চায় রিনি, চিৎকার করে বলতে চায়- শোনোওও ভেল্কি দেখানো মেয়ে, তুমি আর আমি আসলে একই গোত্রের। পারে না, তার গলা থেকে কোনও আওয়াজ বেরোয় না, দম বন্ধ হয়ে আসে...

খুব কষ্টে ছটফট করতে করতে ঘুমটা ভেঙে যায়। মুখটা বালিশে চেপে যাওয়াতে দম আটকে আসছিল বুঝতে পারে। আয়নায় দেখে তার চেহারা আগের মতোই আছে। স্বস্তি আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে ওঠানামা করে তার বুক। দেখে গলাটা ঠিক আছে, আওয়াজও বের হচ্ছে। তবু আর চিৎকার করে বলতে পারে না রিনি, কিছুতেই পারে না, শুধু নিজের মনে বলে ওঠে- শোনো ভেল্কি দেখানো মেয়ে, তুমি আর আমি আসলে একই গোত্রের!

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

ভেল্কি

অরুণিমা

image

মাঝেমাঝে টের পাই, আমি আজকাল একটা সংকীর্ণ সেতুর ওপর হাঁটছি, সামলে সামলে দুলে দুলে পড়তে পড়তে আবার সামলে এগিয়ে যাচ্ছি। কথাগুলো নিজের মনে বলে ওঠে রিনি। চোখে ভেসে ওঠে মফস্বলে ছোটোবেলার স্কুল ফিরতি পথের দৃশ্য।

একটা ধুলোমাখা মেয়ে রুক্ষ খোলা চুলে দুহাতে একটা বাঁশ ধরে এগিয়ে চলেছে একটা দড়ির ওপর দিয়ে। তার হাতে পায়ে ডান বাঁয়ের অদ্ভুত সামঞ্জস্য। কেঁপে ওঠা দড়ি ভিড় করে থাকা লোকের মনে জাগিয়ে তুলছে উত্তেজনা। তারা কখনও হইহই করে উঠছে, কখনও করছে ফিসফিস। মেয়েটা হেঁটে চলেছে একটা ছন্দে একটা লয়ে যেমনটা শেখানো হয়েছে তাকে, যেমনটা স্থির করে দেওয়া হয়েছে তার লক্ষ্য। এ কথাটা মনে হতে একটা চমক লেগে এবার দৃশ্যটা পরিবর্তন হয়ে গেল বছর চল্লিশের রিনির চোখে। ঠিক যেমন বাইরে থেকে মন দৃশ্য পাল্টায়, পাল্টায় মনের ইচ্ছে, চাওয়া পাওয়া, নীরবতা, বিদ্রোহ, অথবা শুধুই বিদ্রোহ করার ইচ্ছে বা অনিচ্ছে।

এবার দড়ির ওপর হাঁটতে থাকা মেয়েটার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। যদিও তার এই হাঁটার দৈর্ঘ্য বেশি নয়, কিন্তু মেয়েটাকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সে যেন এগিয়ে চলেছে আসলে অন্য কোনও একটা গন্তব্যে, এমনি তার চোখের দৃষ্টি, এমনি তার চোখের রং সাদা। এমনকি যখন সে দড়িটার প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তখনও! এই যে লোকের ফিসফাস আর উত্তেজিত কণ্ঠ, কোনোকিছুই আসলে মেয়েটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। তাকে হয়ত ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধুই গরম ভাতের গন্ধ। তার সাদা সাদা উদাসীন চোখ মনে হয় কখনও শূন্যতায়, কখনও অচেনা স্বপ্নে নিবদ্ধ। অথবা হয়ত তার সাদা চোখ আসলে শুধুই ভাতের সাদা রং।

কী আশ্চর্য! কখনও তো এসব মনে হয়নি আগে। সামনে থেকে মেয়েটাকে দেখেও এমন কিছু মনে হয়নিÑযা আজ তার আবছা মুখ মনে করে হচ্ছে। স্কুল ফিরতি মেয়েদের কাছে সে তখন আজব খেলা দেখানো রুক্ষ মেয়ে, অন্য গোত্র। এই মেয়েদের পরিপাটি জামা আর চুল কোনোকিছুই মিল হয় না এমন ভেল্কি খেলা দেখানো আজব মেয়ের সাথে। মিল হয় না লক্ষ্যের, মিল হয় না গন্তব্যের, ভাললাগা রং গন্ধ অথবা স্পর্শের।

ভেল্কি নাকি একাগ্রতা! যে একই একাগ্রতায় স্থির লক্ষ্যে বড় হয়ে উঠেছে রিনিও। কিন্তু আজ তবে কেন মনে হচ্ছে যে, সে আসলে ওই মেয়েটার মতো অন্য কোনও না পাওয়া লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে, আর শূন্যে রাখা একটা সেতুর ওপর দুলছে সে, দুলছে তার মন! আর অনিশ্চয়তায় দুলছে তার সমস্ত সত্তা। ভাবছে, এই বুঝি সব শেষ! পড়ে যাচ্ছে সে, আবার মুহূর্তে সামলে নিচ্ছে আবেগ, সামলে নিচ্ছে ক্ষত, সামলে নিচ্ছে একইসাথে মনের ভেতরের একাকীত্ব আর বাইরের জুড়ে থাকা ঘিরে থাকা প্রয়োজনীয়তা, সামলে নিচ্ছে ভরাডুবি সোশ্যাল সিকিউরিটি, সোশ্যাল স্টেটাস।

এই সামলে নেওয়া মুহূর্তে নিজেকে একা অথচ সাহসী লাগে রিনির। ভিড় থাকলে সব আবেগের ওপর থাকে অপরিসীম নিয়ন্ত্রন, যেমন নিয়ন্ত্রণে ভেল্কি দেখানো মেয়ে হেঁটে চলে। শুধু অন্য গোত্র বলে রিনির চুলের রুক্ষতাকে বলতে হয় স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর একা হলে বুক হয়ে ওঠে আবেগঘন, আর কান্নায় ভিজে চুল হয়ে ওঠে নরম। আচ্ছা, ভেল্কি দেখানো সেই মেয়ে কখনও কাঁদে কি!

উত্তর পায় না রিনি, যেমন উত্তর পায় না স্থির লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরও যদি কোনোদিন মেলেনি গরম ভাত আর সাদা চোখ তৃপ্তিতে ফিরে আসেনি স্বাভাবিক রঙে কি করেছে মেয়েটা তখন! আফসোস হয়, মেয়েটাকে জানা হয়নি বলে। আর একবার যদি দেখা হতো তার সাথে তাহলে হয়ত...

অনেক লোকের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে সামনে এগিয়ে যেতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রিনি। ভেল্কির খেলা দেখানো দলের একটা লোকের হাতের ভাঙা আয়নায় দেখতে পায় নিজের মুখ। এ কি! অদ্ভুত রুক্ষ দেখাচ্ছে তাকে। কাঁচাপাকা অযতেœর চুল নেমে এসেছে মুখের ওপর। হঠাৎ হাসির শব্দে তাকায় সে চারিপাশে। দেখে তাকে লক্ষ্য করেই হাসছে ভিড়-এ জমে থাকা সব মানুষেরা। আর সেইসব হাসিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে একটা অট্টহাসি। দড়ির খেলা থেকে নেমে সেই অট্টহাসি সরে যেতে থাকে দূরে! কোনো রকমে সামলে ওঠে রিনি, হোঁচট খায়, আবার সামলে উঠে হাত বাড়িয়ে ছুটে ধরতে চায় মেয়েটাকে। কিন্তু পারে না, সে দূরে আরও দূরে সরে যেতে থাকে। প্রাণপন শক্তিতে ছুটতে চায় রিনি, চিৎকার করে বলতে চায়- শোনোওও ভেল্কি দেখানো মেয়ে, তুমি আর আমি আসলে একই গোত্রের। পারে না, তার গলা থেকে কোনও আওয়াজ বেরোয় না, দম বন্ধ হয়ে আসে...

খুব কষ্টে ছটফট করতে করতে ঘুমটা ভেঙে যায়। মুখটা বালিশে চেপে যাওয়াতে দম আটকে আসছিল বুঝতে পারে। আয়নায় দেখে তার চেহারা আগের মতোই আছে। স্বস্তি আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে ওঠানামা করে তার বুক। দেখে গলাটা ঠিক আছে, আওয়াজও বের হচ্ছে। তবু আর চিৎকার করে বলতে পারে না রিনি, কিছুতেই পারে না, শুধু নিজের মনে বলে ওঠে- শোনো ভেল্কি দেখানো মেয়ে, তুমি আর আমি আসলে একই গোত্রের!