বিন্যাস
প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী
স্নায়ুর ভিতরে জাগে বাক্যবাণ, মহাবাক্যবাণ
গড়িয়ে গড়িয়ে নামে অস্থি আর ধমনী মজ্জায়
সকালে আলোর কাছে যাওয়া হয়, থাকা হয় না তো!
মাথার ভিতরে শুধু ঘাই মারে শব্দের কুঠার
বিগত জন্মের কোনও ভ্রমণের স্মৃতি জেগে ওঠে
গুম্ফার ভিতর থেকে উঠে আসা ‘মণি পদ্মে হুম্?’
মুহূর্তেই উবে যায়। তখনই সম্বিত ফেরে যেন
খাদের ধারের মন আসলে তো মালিন্য-অধীন...
শুভ-অশুভ
আলম হোসেন
কাকের কান্নাকে শুভ মনে করবেন না
আমার দাদী, দাঁড়কাক ডাকলে তো দূর দূর
করে তাড়িয়ে দিতেন
নেড়ি কুকুরটা যখন বিউগলের সুর তুলতো
দাদীর মনটা খারাপ হয়ে যেত
বলতেন, কোন মুরুব্বি মরে কে জানে!
তখন দাদীর দিকে তাকিয়ে বলতাম,
এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করতে নেই।
টিকটিকিকে গনক মনে করতেন
কবিরাজকে বলতেন প্রতারক
সন্ধ্যার পর যখন হুতোম প্যাঁচা আমাদের
পাকঘরের পাশে কর্পিলা গাছে এসে
বসতো, দাদী বলতেন, জলদি এই
অলক্ষ্মীটা খ্যাদা।
পাশের বাড়ির বৃদ্ধা সামাদের মা যখন
মারা গেল, রেজি বুবুও দীর্ঘদিন বিছানায়
পড়ে থাকলো, টিকটিকি-টুকটুকিতে যখন
শত্রু শনাক্ত হলো, তখন দাদী বললো :
পশু-পাখিরা অনেক কিছু আগাম টের পায়;
দেখ না, পাখির ওড়াওড়ি দেখেই কৃষক তার
কাজের পরিকল্পনা রচনা করে।
অয়ি মম মহাভারত
নাসরীন জাহান
যখন দেবতার ঘুম ভেঙে যায়,
আর শূন্যলোক দুহাত আঁকড়ে থাকে,
মানুষ, বলতে থাকে প্রভু তুমি আইয়ো,
প্রভাত তুমি আইয়ো,প্রস্তর যুগ আইয়ো।
তখন যুধিষ্ঠির
জেগে ওঠে।
তখন মানুষের কোরাসে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়।
সহসা আমার হৃদয়ে কমলা,সফেদ অথবা
গেরুয়া রঙের আর আকাশ জেগে ওঠে।
আর বিশ্বাসহীন প্রস্তরযুগের মানুষেরা জগতের
প্রথম আগুন জ্বালাতে থাকে পাথরে থাপ্পড় দিতে দিতে।
যখন যুধিষ্ঠির সত্যের আড়ালে মিথ্যে কথা বলে,
ওপর আসমান থেকে দেবতা নেমে আমার দিকে তাকিয়ে গায়
আহিরভৈরবী। উপচানো উলুখড়ের মতো, ঠাণ্ডা রোদের মতো
সব আলুথালু চুপ হতে থাকে।
অয়িমম দ্রৌপদী, অয়িমম ঈশ্বরী, অয়িমম সুন্দরজানি,
বলতে বলতে, যুধিষ্ঠিরের ভুলে স্পষ্ট দেখতে পাই,
রক্তাক্ত মহাভারত জেগে উঠেছে,
সুতোয় মন বাঁধিলাম
সালাম তাসির
একদিন আমার দু’চোখে যতটুকু রোদ্দুর
ততটুকুই উষ্ণতা তোমার।
সন্ধেবেলায় যে হাওয়ায় ঘুড়ি উড়তো
সে হাওয়ায় এখন মন ওড়ে
যে সুতোয় মন বেঁধে তুমি নাটাই ঘোরাতে
সে সুতোয় কখন যে বাঁধা পড়ে গেলাম!
একদিন নিভে যাওয়া প্রদীপ হাতে
তুমি অপেক্ষায় সারারাত
ঝুম বৃষ্টিতে দিনের কোলাহল ঘুমিয়ে গেলে
তোমার দু’চোখে নদী বহমান।
সেদিন শিলাইদহ স্টেশনে দু’পায়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে দু’জন
অথচ কোন এক অজানা শংকায় আমরা বধির হয়ে গেলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিলে তুমি বাতাসে ভর দিয়ে সন্ধ্যেবেলার ঘুড়ি;
আমি সুতোয় মন বাঁধিলাম।
মৃতদের গল্প
জুনান নাশিত
আকাশ যে নীল নয়
এ কথা জেনে গেছে মৃতরাও
তারাও ওড়াত ঘুড়ি এতকাল
রঙধনু কেটে কেটে ভাসাত ধীবরকালে
কতশত সাতরঙা নাও।
নেবুলা গুঞ্জনে আকাশ কি আজ ফালা ফালা?
শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে মৃতদের?
আকাশ যে নীল নয় এ কথা জানার পর
মৃতরাও পালালো শহর ছেড়ে
আকাশের গল্প নিয়ে সেই থেকে
খেদ নেই কারো আর
আকাশবিহীন অন্ধকার রাত পৃথিবীতে নেমে এলে
মিল্কিওয়ে ঘুরে ঘুরে
একাকী জোনাকি শুধু জ্বলে আর নেভে।
অবহেলা
অদিতি
সে কোন রাত্রি মুখ জেগে ওঠে ঘুমের মাঝে অতিকায়
সকাল জড়ালো যাকে সে তাকে বেঁধেছে পরম মায়ায়
পক্ষ থেকে পক্ষ কাটে, ফিরে আসে তৃষ্ণা ভেজা চাঁদ
এই মাটিতে ফসলের মানে সুখের সাথে চিরবিবাদ।
ধূসর বা কিছুটা তারই মতো অতীত কিংবা ইতিহাস
আর্দ্রতা মেপে জনপদ হেঁটে গেছে চিরকাল লোকালয়ে
মুগ্ধতা নিয়ম মেনে বৃষ্টি নামায়, মেঘের ওপারে পরবাস
জেনেছে পৃথিবী অভিগত অন্ধকারের রোশনাইয়ে।
সুবর্ণরেখা থেকে বালির তটে রেখা মেপে ক্লান্ত চরাচর
তবুও তো উঁচু ঢেউ গোনে, বুকেতে লুকানো জলোচ্ছ্বাস
ইতিউতি কেঁপে ওঠা ঝাউয়ের বন, নাবিকের দীর্ঘশ্বাস
যে শুনেছে একাকী, সে তো তারই সংলাপে লেখা দোসর।
এত কিছু পরে এত যুগ ধরে একই কথা এই যে বলে চলা
বিদ্রোহ, ভালোবাসা, অকপট ঘৃণা সবই তো অজুহাতে অবহেলা।
দখলী নগর
শাহ বুলবুল
ধৌলি পাহাড়ের দেশে নির্মম রক্তপাত
ছুঁড়ে যায় মৃত্যুর সিংহাসন
অনাহারের দামামায় ভাঙ্গা আগ্রাসী সংঘাত।
দামামার মুখোমুখি আকাশ সীমানা হারায়
ন্যাটোর বাতাসে প্রতিহত রিলিফ রেশন
হত্যার আদেশ পড়ে প্রিয় রাইফেলের ভাষায়।
পরমাণুর দেহ থেকে শান্তির ডানায়
যুবতীর দখলী নগর
ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করে বারুদের কামনায়।
প্রবল অন্ধকারে বমির চিৎকার
ছাই হয় একচেটিয়া যুদ্ধের মহড়ায়
পরাজিত বেদনার বিরাণ সংসার।
ভাসান
নাজমুস সামস্
পাখিদের রির্হারসেলে আমি গান গাইতে পারিনা
একা যেসব পাখিরা হারমোনিয়াম বাজায়
আমি তা বাজাতে পারিনা
তাই ইকারুস হয়ে ঘুরি আকাশে বাতাসে
তোমাদের আঙ্গিনায় একদিন বকুল হয়ে ফুটবো
তুমি তো জানই কমলা রানির কথা
যে প্রতিদিন দুপুরে পুকুরে বকুল ফুল ভাসাতো
আর হয়ে যেত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ।
বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪
বিন্যাস
প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী
স্নায়ুর ভিতরে জাগে বাক্যবাণ, মহাবাক্যবাণ
গড়িয়ে গড়িয়ে নামে অস্থি আর ধমনী মজ্জায়
সকালে আলোর কাছে যাওয়া হয়, থাকা হয় না তো!
মাথার ভিতরে শুধু ঘাই মারে শব্দের কুঠার
বিগত জন্মের কোনও ভ্রমণের স্মৃতি জেগে ওঠে
গুম্ফার ভিতর থেকে উঠে আসা ‘মণি পদ্মে হুম্?’
মুহূর্তেই উবে যায়। তখনই সম্বিত ফেরে যেন
খাদের ধারের মন আসলে তো মালিন্য-অধীন...
শুভ-অশুভ
আলম হোসেন
কাকের কান্নাকে শুভ মনে করবেন না
আমার দাদী, দাঁড়কাক ডাকলে তো দূর দূর
করে তাড়িয়ে দিতেন
নেড়ি কুকুরটা যখন বিউগলের সুর তুলতো
দাদীর মনটা খারাপ হয়ে যেত
বলতেন, কোন মুরুব্বি মরে কে জানে!
তখন দাদীর দিকে তাকিয়ে বলতাম,
এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করতে নেই।
টিকটিকিকে গনক মনে করতেন
কবিরাজকে বলতেন প্রতারক
সন্ধ্যার পর যখন হুতোম প্যাঁচা আমাদের
পাকঘরের পাশে কর্পিলা গাছে এসে
বসতো, দাদী বলতেন, জলদি এই
অলক্ষ্মীটা খ্যাদা।
পাশের বাড়ির বৃদ্ধা সামাদের মা যখন
মারা গেল, রেজি বুবুও দীর্ঘদিন বিছানায়
পড়ে থাকলো, টিকটিকি-টুকটুকিতে যখন
শত্রু শনাক্ত হলো, তখন দাদী বললো :
পশু-পাখিরা অনেক কিছু আগাম টের পায়;
দেখ না, পাখির ওড়াওড়ি দেখেই কৃষক তার
কাজের পরিকল্পনা রচনা করে।
অয়ি মম মহাভারত
নাসরীন জাহান
যখন দেবতার ঘুম ভেঙে যায়,
আর শূন্যলোক দুহাত আঁকড়ে থাকে,
মানুষ, বলতে থাকে প্রভু তুমি আইয়ো,
প্রভাত তুমি আইয়ো,প্রস্তর যুগ আইয়ো।
তখন যুধিষ্ঠির
জেগে ওঠে।
তখন মানুষের কোরাসে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়।
সহসা আমার হৃদয়ে কমলা,সফেদ অথবা
গেরুয়া রঙের আর আকাশ জেগে ওঠে।
আর বিশ্বাসহীন প্রস্তরযুগের মানুষেরা জগতের
প্রথম আগুন জ্বালাতে থাকে পাথরে থাপ্পড় দিতে দিতে।
যখন যুধিষ্ঠির সত্যের আড়ালে মিথ্যে কথা বলে,
ওপর আসমান থেকে দেবতা নেমে আমার দিকে তাকিয়ে গায়
আহিরভৈরবী। উপচানো উলুখড়ের মতো, ঠাণ্ডা রোদের মতো
সব আলুথালু চুপ হতে থাকে।
অয়িমম দ্রৌপদী, অয়িমম ঈশ্বরী, অয়িমম সুন্দরজানি,
বলতে বলতে, যুধিষ্ঠিরের ভুলে স্পষ্ট দেখতে পাই,
রক্তাক্ত মহাভারত জেগে উঠেছে,
সুতোয় মন বাঁধিলাম
সালাম তাসির
একদিন আমার দু’চোখে যতটুকু রোদ্দুর
ততটুকুই উষ্ণতা তোমার।
সন্ধেবেলায় যে হাওয়ায় ঘুড়ি উড়তো
সে হাওয়ায় এখন মন ওড়ে
যে সুতোয় মন বেঁধে তুমি নাটাই ঘোরাতে
সে সুতোয় কখন যে বাঁধা পড়ে গেলাম!
একদিন নিভে যাওয়া প্রদীপ হাতে
তুমি অপেক্ষায় সারারাত
ঝুম বৃষ্টিতে দিনের কোলাহল ঘুমিয়ে গেলে
তোমার দু’চোখে নদী বহমান।
সেদিন শিলাইদহ স্টেশনে দু’পায়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে দু’জন
অথচ কোন এক অজানা শংকায় আমরা বধির হয়ে গেলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিলে তুমি বাতাসে ভর দিয়ে সন্ধ্যেবেলার ঘুড়ি;
আমি সুতোয় মন বাঁধিলাম।
মৃতদের গল্প
জুনান নাশিত
আকাশ যে নীল নয়
এ কথা জেনে গেছে মৃতরাও
তারাও ওড়াত ঘুড়ি এতকাল
রঙধনু কেটে কেটে ভাসাত ধীবরকালে
কতশত সাতরঙা নাও।
নেবুলা গুঞ্জনে আকাশ কি আজ ফালা ফালা?
শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে মৃতদের?
আকাশ যে নীল নয় এ কথা জানার পর
মৃতরাও পালালো শহর ছেড়ে
আকাশের গল্প নিয়ে সেই থেকে
খেদ নেই কারো আর
আকাশবিহীন অন্ধকার রাত পৃথিবীতে নেমে এলে
মিল্কিওয়ে ঘুরে ঘুরে
একাকী জোনাকি শুধু জ্বলে আর নেভে।
অবহেলা
অদিতি
সে কোন রাত্রি মুখ জেগে ওঠে ঘুমের মাঝে অতিকায়
সকাল জড়ালো যাকে সে তাকে বেঁধেছে পরম মায়ায়
পক্ষ থেকে পক্ষ কাটে, ফিরে আসে তৃষ্ণা ভেজা চাঁদ
এই মাটিতে ফসলের মানে সুখের সাথে চিরবিবাদ।
ধূসর বা কিছুটা তারই মতো অতীত কিংবা ইতিহাস
আর্দ্রতা মেপে জনপদ হেঁটে গেছে চিরকাল লোকালয়ে
মুগ্ধতা নিয়ম মেনে বৃষ্টি নামায়, মেঘের ওপারে পরবাস
জেনেছে পৃথিবী অভিগত অন্ধকারের রোশনাইয়ে।
সুবর্ণরেখা থেকে বালির তটে রেখা মেপে ক্লান্ত চরাচর
তবুও তো উঁচু ঢেউ গোনে, বুকেতে লুকানো জলোচ্ছ্বাস
ইতিউতি কেঁপে ওঠা ঝাউয়ের বন, নাবিকের দীর্ঘশ্বাস
যে শুনেছে একাকী, সে তো তারই সংলাপে লেখা দোসর।
এত কিছু পরে এত যুগ ধরে একই কথা এই যে বলে চলা
বিদ্রোহ, ভালোবাসা, অকপট ঘৃণা সবই তো অজুহাতে অবহেলা।
দখলী নগর
শাহ বুলবুল
ধৌলি পাহাড়ের দেশে নির্মম রক্তপাত
ছুঁড়ে যায় মৃত্যুর সিংহাসন
অনাহারের দামামায় ভাঙ্গা আগ্রাসী সংঘাত।
দামামার মুখোমুখি আকাশ সীমানা হারায়
ন্যাটোর বাতাসে প্রতিহত রিলিফ রেশন
হত্যার আদেশ পড়ে প্রিয় রাইফেলের ভাষায়।
পরমাণুর দেহ থেকে শান্তির ডানায়
যুবতীর দখলী নগর
ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করে বারুদের কামনায়।
প্রবল অন্ধকারে বমির চিৎকার
ছাই হয় একচেটিয়া যুদ্ধের মহড়ায়
পরাজিত বেদনার বিরাণ সংসার।
ভাসান
নাজমুস সামস্
পাখিদের রির্হারসেলে আমি গান গাইতে পারিনা
একা যেসব পাখিরা হারমোনিয়াম বাজায়
আমি তা বাজাতে পারিনা
তাই ইকারুস হয়ে ঘুরি আকাশে বাতাসে
তোমাদের আঙ্গিনায় একদিন বকুল হয়ে ফুটবো
তুমি তো জানই কমলা রানির কথা
যে প্রতিদিন দুপুরে পুকুরে বকুল ফুল ভাসাতো
আর হয়ে যেত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ।