‘রজতরেখার তীরে’ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে

অনামিকা পারভীন

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সাল এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছে। একাত্তরের আগে বাঙালির ইতিহাস ছিল একরকম, একাত্তরের পরে ইতিহাস অনন্য আরেক রূপ নিয়েছে। নতুন এই ইতিহাসে নতুন একটি নক্ষত্র শুকতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে এবং চিরকাল থাকবে। সেই নক্ষত্রের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। নয় মাস-ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। এই সময়কালে বাংলাদেশে এবং বাঙালির জীবনে অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেছে। পদ্মা, গঙ্গা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে জলস্রোত লাখো শহীদের রক্ত নিয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছে। শহীদের রক্তে উর্বর ৫৬ হাজার বর্গ মাইলে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন অথবা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সবার হৃদয়ে গেঁথে আছে স্থায়ীভাবে চার অক্ষরের একটি শব্দ- মুক্তিযুদ্ধ। এই একটি শব্দের পেছনে রয়েছে লক্ষ কোটি শব্দের বিশাল ইতিহাস- যা এখনও সম্পূর্ণ রচিত বা গ্রন্থিত হয় নি। গত ৫২ বছর ধরে আমাদের ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক, লেখক, এককথায় বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখে যাচ্ছেন। কেউ লিখছেন তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, কেউ লিখছেন ইতিহাস খণ্ড খণ্ড ভাবে, অথবা গল্প-উপন্যাস-কবিতা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প-উপন্যাস মূলত সাহিত্যকর্ম হলেও এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটে ওঠে- যা ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করে। লেখক-বুদ্ধিজীবীদের এই প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। তারা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের না-বলা ইতিহাস রেখে যাচ্ছেন।

সাংবাদিক-লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা চপল বাশার তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ইতিহাসের কিছু খণ্ড খণ্ড চিত্র উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাতটি গল্প নিয়ে রচিত তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘রজতরেখার তীরে’ একটি অনবদ্য সৃষ্টি। সাতটি গল্পের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন হলেও, মূল বিষয় একটি, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। কোনো গল্প গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, কোনো গল্প শহর কেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো বাংলাদেশের সব শহরে ও সব গ্রামে। কোথাও ব্যাপকভাবে, কোথাও অতটা নয়। একাত্তরে নগণ্যসংখ্যক পাকিস্তানপন্থী রাজাকার বাদে সকল বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন- কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষভাবে। যারা অংশ নিতে পারেননি, তারা সমর্থন দিয়েছিলেন। যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সত্যিকার অর্থেই একাত্তরে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে উঠেছিলো। বাঙালির সেই অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্যই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

‘রজতরেখার তীরে’ শীর্ষক গল্পটির নামেই গ্রন্থের নামকরণ হয়েছে। রজতরেখা মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের কাছেই একটি ছোট নদী। একসময়, বিশেষ করে সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত, রজতরেখা স্বচ্ছ জলের সুন্দর নদী হিসেবে বিখ্যাত ছিল। নদীর দুই তীরেই ছিল সুন্দর সুন্দর গ্রাম, তারই একটি স্বর্ণগ্রাম। ঐ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। স্বর্ণগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতের একটি ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছে ‘রজতরেখার তীরে’। মূলত সংলাপ-ভিত্তিক গল্পটি এমনভাবে লেখা যে, পড়তে শুরু করলে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।

গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘লাল সবুজের বলরাম’ কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার একটি গ্রামের তরুণ যুবকদের যুদ্ধের কাহিনি। এই গল্পের মাধ্যমে লেখক সেই সময়ে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রামের জীবনযাত্রা সেই সময়ে কেমন ছিল, তা অনুভব করা যায় এই গল্পের মাধ্যমে। তরুণ বলরামকে সবাই অপদার্থ বলতো, কারণ সে কোনো কাজকর্ম করে না। অথচ যুদ্ধের সময়ে হানাদার বাহিনীর উপর গ্রেনেড আক্রমণ চালিয়ে এবং নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করলো সে অপদার্থ নয়। বলরামের মতো গ্রামের হাজার হাজার তরুণ যুবক জীবন দিয়েছে বলেই বাংলার মাটিতে লাল-সবুজ পতাকা উড়েছে।

‘জননী ও পতাকা’ নামে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি ছোটগল্প রয়েছে, যেখানে দেখা যায় বাড়ির গৃহিণী স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা বালিশের খোলের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন যুদ্ধের নয় মাস। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে বাড়ি ফিরে এলে তার হাতে পতাকাটি দিয়ে বলছেন,- ‘নে তোর পতাকা, ছাদে গিয়ে আবার উড়িয়ে দে।’ এমন সাহসী জননীরাও মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রেখেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে সে সময়ে বাঙালি পুলিশরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বহু পুলিশ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এমনই একজন পুলিশ কনস্টেবল লিয়াকত। তিনি কর্মস্থল থেকে পালিয়ে নিজ জেলা নোয়াখালিতে চলে যান এবং জেলার চরাঞ্চলে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব দেন। এভাবেই লিয়াকতের মতো বহু পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখেছেন সারাদেশে। ‘হতভাগা পুলিশ’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ লিয়াকতের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

‘আবু রায়হানের স্মৃতি বিস্মৃতি’ গল্পে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার আবু রায়হানের প্রবীণ জীবনের কাহিনি বলা হয়েছে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলতে পারেন নি। এখনও তিনি স্বপ্নে মুক্তিযুদ্ধ দেখেন। খুঁজে বেড়ান তার স্টেনগান যেটা যুদ্ধ শেষে জমা দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। গল্পটি প্রতিটি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে।

চপল বাশারের গল্পগ্রন্থে আরও দুটি গল্প রয়েছে-‘মালেকের যুদ্ধযাত্রা’ এবং ‘এস.পি সাহেব, একুশে, একাত্তর’। ‘মালেকের যুদ্ধযাত্রা’ চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কাহিনি। কোনো বাধাই কিশোর মালেককে আটকে রাখতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। মালেকের মতো হাজার হাজার কিশোর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো, অদম্য সাহস নিয়ে অস্ত্রহাতে তারা শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে, হানাদার মেরেছে, নিজেরাও প্রাণ দিয়েছে অকাতরে। তাই তো মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত হয়েছে।

‘এস.পি সাহেব, একুশে, একাত্তর’ একটু ভিন্ন ধরনের গল্প। গল্পের শুরু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন ভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয়। গল্পের নায়ক পুলিশের একজন বাঙালি এস.পি তার আয়ত্বাধীন জেলা শহরে কীভাবে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সংযত রাখলেন, সংঘাত হলো না, রক্তপাত হলো না। তখনই তিনি বলেছিলেন,

- ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকবে না, পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে যাবে।’

উনিশ বছর পরে তাই হলো। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পরে তিনি বললেন, -‘প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধ।... এই যুদ্ধে বাঙালিরাই জিতবে, কারণ তারা সঠিক পথেই রয়েছে।’

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তাদের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধকে অনেক শক্তিশালী করেছে।

‘রজতরেখার তীরে’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল। প্রচ্ছদের ছবিটি এককথায় অপূর্ব। পাঠকদের কাছে বইটির আকর্ষণ অনেক বাড়িয়েছে। লেখকের মনের কথা প্রচ্ছদে ফুটে উঠেছে। একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম উপহার দেয়ার জন্য মাসুক হেলালকে ধন্যবাদ।

বইটির ভূমিকায় প্রকাশক বলেছেন, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা চপল বাশার নিজের ও সহযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই গল্পগুলি রচনা করেছেন। আমারও মনে হয়েছে বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতেই গল্পগুলি রচিত, না হলে কল্পিত কাহিনি এত বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত হয় না। মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক চপল বাশারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আরও গল্প ও উপন্যাস চাই, এটা সময়ের দাবি।’

রজতরেখার তীরে ॥ মুক্তিযুদ্ধের সাতটি গল্প ॥ প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২৩॥ প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল॥ প্রকাশক- জনান্তিক, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৮৪, মূল্য ২০০ টাকা

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

‘রজতরেখার তীরে’ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে

অনামিকা পারভীন

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সাল এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছে। একাত্তরের আগে বাঙালির ইতিহাস ছিল একরকম, একাত্তরের পরে ইতিহাস অনন্য আরেক রূপ নিয়েছে। নতুন এই ইতিহাসে নতুন একটি নক্ষত্র শুকতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে এবং চিরকাল থাকবে। সেই নক্ষত্রের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। নয় মাস-ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। এই সময়কালে বাংলাদেশে এবং বাঙালির জীবনে অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেছে। পদ্মা, গঙ্গা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে জলস্রোত লাখো শহীদের রক্ত নিয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছে। শহীদের রক্তে উর্বর ৫৬ হাজার বর্গ মাইলে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন অথবা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সবার হৃদয়ে গেঁথে আছে স্থায়ীভাবে চার অক্ষরের একটি শব্দ- মুক্তিযুদ্ধ। এই একটি শব্দের পেছনে রয়েছে লক্ষ কোটি শব্দের বিশাল ইতিহাস- যা এখনও সম্পূর্ণ রচিত বা গ্রন্থিত হয় নি। গত ৫২ বছর ধরে আমাদের ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক, লেখক, এককথায় বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখে যাচ্ছেন। কেউ লিখছেন তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, কেউ লিখছেন ইতিহাস খণ্ড খণ্ড ভাবে, অথবা গল্প-উপন্যাস-কবিতা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প-উপন্যাস মূলত সাহিত্যকর্ম হলেও এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটে ওঠে- যা ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করে। লেখক-বুদ্ধিজীবীদের এই প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। তারা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের না-বলা ইতিহাস রেখে যাচ্ছেন।

সাংবাদিক-লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা চপল বাশার তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ইতিহাসের কিছু খণ্ড খণ্ড চিত্র উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাতটি গল্প নিয়ে রচিত তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘রজতরেখার তীরে’ একটি অনবদ্য সৃষ্টি। সাতটি গল্পের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন হলেও, মূল বিষয় একটি, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। কোনো গল্প গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, কোনো গল্প শহর কেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো বাংলাদেশের সব শহরে ও সব গ্রামে। কোথাও ব্যাপকভাবে, কোথাও অতটা নয়। একাত্তরে নগণ্যসংখ্যক পাকিস্তানপন্থী রাজাকার বাদে সকল বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন- কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষভাবে। যারা অংশ নিতে পারেননি, তারা সমর্থন দিয়েছিলেন। যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সত্যিকার অর্থেই একাত্তরে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে উঠেছিলো। বাঙালির সেই অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্যই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

‘রজতরেখার তীরে’ শীর্ষক গল্পটির নামেই গ্রন্থের নামকরণ হয়েছে। রজতরেখা মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের কাছেই একটি ছোট নদী। একসময়, বিশেষ করে সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত, রজতরেখা স্বচ্ছ জলের সুন্দর নদী হিসেবে বিখ্যাত ছিল। নদীর দুই তীরেই ছিল সুন্দর সুন্দর গ্রাম, তারই একটি স্বর্ণগ্রাম। ঐ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। স্বর্ণগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতের একটি ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছে ‘রজতরেখার তীরে’। মূলত সংলাপ-ভিত্তিক গল্পটি এমনভাবে লেখা যে, পড়তে শুরু করলে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।

গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘লাল সবুজের বলরাম’ কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার একটি গ্রামের তরুণ যুবকদের যুদ্ধের কাহিনি। এই গল্পের মাধ্যমে লেখক সেই সময়ে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রামের জীবনযাত্রা সেই সময়ে কেমন ছিল, তা অনুভব করা যায় এই গল্পের মাধ্যমে। তরুণ বলরামকে সবাই অপদার্থ বলতো, কারণ সে কোনো কাজকর্ম করে না। অথচ যুদ্ধের সময়ে হানাদার বাহিনীর উপর গ্রেনেড আক্রমণ চালিয়ে এবং নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করলো সে অপদার্থ নয়। বলরামের মতো গ্রামের হাজার হাজার তরুণ যুবক জীবন দিয়েছে বলেই বাংলার মাটিতে লাল-সবুজ পতাকা উড়েছে।

‘জননী ও পতাকা’ নামে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি ছোটগল্প রয়েছে, যেখানে দেখা যায় বাড়ির গৃহিণী স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা বালিশের খোলের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন যুদ্ধের নয় মাস। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে বাড়ি ফিরে এলে তার হাতে পতাকাটি দিয়ে বলছেন,- ‘নে তোর পতাকা, ছাদে গিয়ে আবার উড়িয়ে দে।’ এমন সাহসী জননীরাও মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান রেখেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে সে সময়ে বাঙালি পুলিশরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বহু পুলিশ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এমনই একজন পুলিশ কনস্টেবল লিয়াকত। তিনি কর্মস্থল থেকে পালিয়ে নিজ জেলা নোয়াখালিতে চলে যান এবং জেলার চরাঞ্চলে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব দেন। এভাবেই লিয়াকতের মতো বহু পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখেছেন সারাদেশে। ‘হতভাগা পুলিশ’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ লিয়াকতের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

‘আবু রায়হানের স্মৃতি বিস্মৃতি’ গল্পে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার আবু রায়হানের প্রবীণ জীবনের কাহিনি বলা হয়েছে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলতে পারেন নি। এখনও তিনি স্বপ্নে মুক্তিযুদ্ধ দেখেন। খুঁজে বেড়ান তার স্টেনগান যেটা যুদ্ধ শেষে জমা দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কাছে। গল্পটি প্রতিটি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে।

চপল বাশারের গল্পগ্রন্থে আরও দুটি গল্প রয়েছে-‘মালেকের যুদ্ধযাত্রা’ এবং ‘এস.পি সাহেব, একুশে, একাত্তর’। ‘মালেকের যুদ্ধযাত্রা’ চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কাহিনি। কোনো বাধাই কিশোর মালেককে আটকে রাখতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। মালেকের মতো হাজার হাজার কিশোর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো, অদম্য সাহস নিয়ে অস্ত্রহাতে তারা শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে, হানাদার মেরেছে, নিজেরাও প্রাণ দিয়েছে অকাতরে। তাই তো মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত হয়েছে।

‘এস.পি সাহেব, একুশে, একাত্তর’ একটু ভিন্ন ধরনের গল্প। গল্পের শুরু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন ভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয়। গল্পের নায়ক পুলিশের একজন বাঙালি এস.পি তার আয়ত্বাধীন জেলা শহরে কীভাবে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সংযত রাখলেন, সংঘাত হলো না, রক্তপাত হলো না। তখনই তিনি বলেছিলেন,

- ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকবে না, পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে যাবে।’

উনিশ বছর পরে তাই হলো। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পরে তিনি বললেন, -‘প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধ।... এই যুদ্ধে বাঙালিরাই জিতবে, কারণ তারা সঠিক পথেই রয়েছে।’

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তাদের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধকে অনেক শক্তিশালী করেছে।

‘রজতরেখার তীরে’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল। প্রচ্ছদের ছবিটি এককথায় অপূর্ব। পাঠকদের কাছে বইটির আকর্ষণ অনেক বাড়িয়েছে। লেখকের মনের কথা প্রচ্ছদে ফুটে উঠেছে। একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম উপহার দেয়ার জন্য মাসুক হেলালকে ধন্যবাদ।

বইটির ভূমিকায় প্রকাশক বলেছেন, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা চপল বাশার নিজের ও সহযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই গল্পগুলি রচনা করেছেন। আমারও মনে হয়েছে বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতেই গল্পগুলি রচিত, না হলে কল্পিত কাহিনি এত বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত হয় না। মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক চপল বাশারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আরও গল্প ও উপন্যাস চাই, এটা সময়ের দাবি।’

রজতরেখার তীরে ॥ মুক্তিযুদ্ধের সাতটি গল্প ॥ প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২৩॥ প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল॥ প্রকাশক- জনান্তিক, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৮৪, মূল্য ২০০ টাকা