প্রেমে প্রতিবাদে প্রতিরোধে কলিম শরাফী

গৌতম রায়

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয় নি কো নজরুল’- বিদ্রোহী কবিকে ঘিরে অন্নদাশঙ্করের এই মূল্যায়ন যেন শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো বিস্ময় প্রতিভা কলিম শরাফী সম্পর্কেও সর্বৈবভাবে প্রযোজ্য।কলিম শরাফী নিজের জীবনের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের নাগরিক হিশেবে সসম্মানে কাটানোর পরেও এপার বাংলা থেকে কখনো মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। কবি জয়দেব বসু একবার কলিম শরাফীকে কলকাতার কোনো রাস্তা চেনাচ্ছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। তারপরে কলিমের মন্তব্য ছিল- ওই বাঙালটা আমাকে কলকাতা চেনাবে?

ঢাকা, চট্টগ্রাম, কলকাতা, বীরভূমের খয়রাডিহি- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে অভিন্ন বাঙালি জাতিসত্তার মূর্ত প্রতীক হয়ে-ওঠা কলিম শরাফীর একটাই দুঃখ ছিল, অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে (১৯৪২) প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে এক বছরের ও বেশি সময় জেল খাটা সত্ত্বেও তিনি যেহেতু পরবর্তীতে আর স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থাকেননি, তাই ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামী হিশেবে তাঁকে কখনো কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। তা¤্রপত্র তো দেয়ইনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে ইন্দ্রকুমার গুজরাল যখন বাংলাদেশ সফর করছেন, তখন তাঁকে কথাটা সরাসরি কলিম বলেছিলেন। গুজরাল বিষয়টি তাঁর সফরসঙ্গী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখতে বলেন।’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কলিম, প্রণববাবুর পিতা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সিউড়ি জেলে ছিলেন।কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হিশেবে সাধারণের কাছে পরিচিত প্রণব মুখোপাধ্যায়, কলিম শরাফীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানানোর ক্ষেত্রেও নিজের তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষের উর্ধে উঠতে পারেন নি।ফলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গুজরালের আদেশ সত্ত্বেও অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধা হিশেবে নিজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি কলিম শরাফীর।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাংস্কৃতিক জনজোয়ারের আগুয়ান সৈনিক হিশেবে কলিম শরাফী অত্যন্তশ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তিত্ব।কিন্তু যে মানুষটির প্রথম জীবনের একটা গৌরবজনক অধ্যায় অখণ্ড এবং খণ্ডিত দুই অবস্থার বাংলাতেই বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং কলকাতা মহানগরীর বুকে কেটে গেল, সেই পশ্চিমবঙ্গ জীবৎকালে কতটুকু মর্যাদা দিয়েছিল তাঁকে? আর তাঁর প্রয়াণের পর, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে কতটুকুইবা এপারের বাঙালি স্মরণ করছে তাঁকে? সি পি আই (এম) দল পরিচালিত ‘নন্দন’ পত্রিকা ছাড়া জীবৎকালে পশ্চিমবঙ্গের কোনো পত্রিকাতেই কলিম শরাফীর বিস্তারিত সাক্ষাৎকার বের হয়নি। কলিমের ‘কমরেড’ ঢাকায় গিয়ে কলিমের উদ্যোগে সেখানকার প্রগতিশীল মহলে বহু সমাদর পেয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ সলিল কিন্তু এবার বাংলায় তাঁর ‘কমরেড’ কলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে কোনো উদ্যোগ নেননি।বাংলাদেশের সৃষ্টির পর, কলিম, তাঁর বটুকদাকে (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র) ঢাকাতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম দরবার করে সব ব্যবস্থা করেছিলেন।ঢাকার সেই সময়ের টেলিভিশনে কলিমের নেওয়া জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সাক্ষাৎকারটিই কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রের একমাত্র অডিও ভিসুয়াল সাক্ষাৎকার।

ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী মহঃ সেলিমই প্রথম উদ্যোগ নিয়ে সরকারি স্তরে কলিম শরাফীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন।সেলিমের উদ্যোগেই কলিম শরাফী পঞ্চাশ বছর পরে সস্ত্রীক নিজের জন্মভূমি বীরভূমের খয়রাডিহি গ্রামে পা রেখেছিলেন। সেলিমের উদ্যোগেই কলিম,তাঁর প্রথম জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কলকাতার বাংলা আকাদেমিতে। বুদ্ধবাবু ছোট শিশুর মতো,তাঁর কলিমকাকার কাছে শুনেছিলেন নিজের অকাল প্রয়াত সুকান্ত কাকার জীবনের অনেক অজানা কাহিনি। সেলিমের উদ্যোগেই সেই প্রথম আর সেই শেষবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি হিশেবে এখানকার গান মেলা গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে’র সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন করেছিলেন কলিম শরাফী।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে কলিম শরাফীকে চলে যেতে হয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির চারের দশকের শেষ দিকের সর্বভারতীয় সম্পাদক বি টি রণদিভের সাংস্কৃতিক লাইনের কারণে।কলিম শরাফীকে ঘিরে বিন্দুমাত্র চর্চা না করে কেবলমাত্র তাঁর দুটি বই থেকে কার্যত টুকে এপার বাংলাতে এখন ‘কলিম শরাফী বিশেষজ্ঞ’ হয়ে ওঠার একটা দারুণ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কলিমের স্থায়ীভাবে ভারত ছেড়ে যাওয়ার পিছনে এইসব ‘পণ্ডিতেরাই’ ‘মুসলমান’ হিশেবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কলিমের ভারত ত্যাগের এক আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন- যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।আবার ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্রকে আমি কলিম শরাফীকে বলতে শুনেছি, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যেই তো দেশ ছাড়তে হলো তোমাকে।

স্বাভাবিক ভদ্রতায় ইলা মিত্রের বাসায় বসে রমেন মিত্রের কথার বিরোধিতা কিছু করেননি কলিম। সেখানে ব্যক্তিজীবন ঘিরে এই রুচিহীন কথার উত্তর দিতে নিশ্চয়ই কলিমের আত্মমর্যাদাতে বেঁধেছিল।কিন্তু রমেন মিত্রের এই অসত্য উপস্থাপনাতে কলিম শরাফী যথেষ্ট দুঃখই পেয়েছিলেন।অমর্ত্য সেনের সঙ্গে যখন বৈবাহিক সম্পর্ক নবনীতা দেবসেনের প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে, আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ শুধু সময়ের অপেক্ষা, সেইসময়ে বিদেশে বসে একটা ই পি রেকর্ডে কলিমের কণ্ঠে রবীন্দ্রমন্ত্র, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস না ভাই’, নবনীতাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার শক্তি জুগিয়েছিল।অনেক অনেক বছর পরে ঢাকা যাওয়ার পথে, কলকাতা বিমানবন্দরে নবনীতা সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন কলিমকে।

শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কলিম শরাফীর সম্পর্কটা ছিল একদম মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো। তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে ছিল স্নেহনিবিড় সম্পর্ক। শম্ভু-তৃপ্তির বিচ্ছেদ কলিমকে অসম্ভব দুঃখ দিয়েছিল। বিচ্ছেদের কারণ অনেকটাই নিবিড়ভাবে জানতেন কলিম। কিন্তু তাঁর ‘মেজদা’ শম্ভু মিত্রকে ঘিরে কখনো কোথাও, এমনকি ব্যক্তিগত স্তরেও এতটুকু ঘরের কথা বলেননি কলিম। ‘বৌদি’ তৃপ্তির প্রতি ও অসম্ভব শ্রদ্ধা ছিল তাঁর।হয়ত খানিকটা যন্ত্রণাও অনুভব করতেন তাঁর বৌদির জন্যে।তবুও তাঁদের ব্যক্তি জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে একটা শব্দ কখনও কলিম উচ্চারণ করেননি।এটাই ছিল তাঁর শিষ্টতা বোধ।যখনই কলকাতায় কলিম আসতেন, বেহালার জ্যোতিষ রায় রোডে, তাঁর মেজদা, শম্ভু মিত্রকে দেখা ছিল কলিমের অবশ্য পালনীয় একটা কর্তব্য।শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের অল্প কিছুকাল আগে, শম্ভুবাবু তখন কার্যত শয্যাশায়ী, কলিম দেখা করে গিয়েছিলেন তাঁর মেজদার সঙ্গে।শাঁওলী মিত্র শৈশবে তো জানতেনই না, তাঁর ‘কলিমকাকা’র সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।কন্যাসম শাঁওলী, শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের অনেক বছর পরে সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়কে পুনর্বিবাহ করেন। সেবার কলকাতায় আসবার সময়ে কলিম-নওশেবা নতুন কনের জন্যে দারুণ সুন্দর একটা লাল টুকটুকে ঢাকাই জামদানি শাড়ি এনেছিলেন।

প্রেমে-প্রতিবাদে-প্রতিরোধে চিরপ্রত্যয়ী বাঙালি কলিম শরাফী রাজরোষের পরোয়া না করে যেভাবে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, তেমন ব্যক্তিত্ব তাঁর সমকালে বাংলাদেশে কিছু থাকলেও এপার বাংলাতে অন্নদাশঙ্কর রায় ছাড়া আর কেউই ছিলেন কিনা সন্দেহ। দলীয় রাজনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে নিজের জীবনকে প্রবাহিত না করেও কীভাবে একজন যথার্থ কমিউনিস্ট হওয়া যায় কলিম শরাফী তাঁর গোটা জীবনটা দিয়ে সেটা প্রমাণ করে গিয়েছেন।

কলিমকে ওপার বাংলার দেবব্রত বিশ্বাস বলে বর্ণনা করবার একটা অদ্ভুত চল এপার বাংলাতে, যাঁরা হালে জেনেছেন কলিম শরাফী সম্পর্কে, তাঁদের হরবখত বলতে শোনা যায়। এই অদ্ভুত কথাটি প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, কলিম শরাফী কখনোই রবীন্দ্রনাথের গানে,যাকে চলতি কথায় বলে, খোদার উপর খোদগারি- তার ধার পাশ দিয়ে যান নি।রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে সুর, তাল, লয়- এসবের কোনো ক্ষেত্রেই তিনি নিজের মনমত কোনো কিছু করেন নি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত ‘সঙ্গীত মেলা’তে তৎকালীন মন্ত্রী মহঃ সেলিমের বিশেষ আমন্ত্রণে এসে, মেলা উদ্বোধনের পর, রবীন্দ্রসদনে দর্শকাসনে বসে তিনি গান শুনছেন।শিল্পী মোহন সিং।গান শুনতে শুনতে বিরক্ত কলিম বললেন, রবীন্দ্রনাথের গান, অহেতুক তান কর্তব্যের বিষয় নয়।

রবীন্দ্রনাথের গানে কলিম শরাফী একলব্যের মতো গুরু হিশেবে মানতেন তাঁর বটুকদা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে।প্রথম জীবনে নিজে কলিম কিছুদিন ‘দক্ষিণী’তে শিক্ষানবিশী ছিলেন।শিক্ষকতাও করেছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর শেষদিন পর্যন্ত সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়।তবু বলতে হয়, কলিম শরাফীর পরিব্যাপ্ত মূল্যায়নে ‘দক্ষিণী’র গায়কী শেষ পর্যন্ত তাঁকে তৃপ্তি দেয় নি। নিন্দা করবার সেগুনবাগিচা জনিত গুণ কলিম শরাফীর কোনোদিন ছিল না। তবু, কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যে রেখে রবীন্দ্রনাথের গায়কী তে, ‘মুখে সুপুরি পুড়ে’ গাইবার রীতি ঘিরে বিরক্ত এবং মস্করা- দুটোই তিনি করতেন। এই ‘মুখে সুপুরি পুড়ে’ গাইবার পদ্ধতি বলতে উনি কি বোঝাতে চাইতেন, রসিক শ্রোতার অবশ্য সেটা ধরতে পারাটা মোটেই কঠিন হতো না।

রবীন্দ্রনাথের গানে উদাত্ততার আঙ্গিকটি ছিল কলিমের সব থেকে পছন্দের বিষয়। তাঁর কণ্ঠের, গায়কীর উদাত্ততার সঠিক পরিমাপ, আজকের প্রজন্মের পক্ষে করা সম্ভব নয়।এই অসম্ভবের কারন হল, আজ বাণিজ্যিকভাবে কলিম শরাফীর যন্ত্রে ধারণ করা যেসব গান পাওয়া যায়, সেগুলি তিনি যখন পর পর রেকর্ড করেন, তখন তাঁর বয়স সত্তর উত্তীর্ণ। ‘নবজীবনের গান’ যখন রেকর্ড হয়, তখন একবার হার্ট অ্যাটাক তাঁর হয়ে গেছে। আর তাঁর পূর্ণ যৌবন কালের যে কণ্ঠ এবং গায়কী, তার প্রায় কোনো দৃষ্টান্তই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধারণ করা নেই। কারণ, সেই সময়ে কলিম শরাফী কী? তিনি কি ভারতের চর? তিনি কি পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? তিনি কি কমিউনিস্ট?- এইসব ঘটনাক্রমে প্রায় কোনো বাণিজ্যিক সংস্থাই তাঁর গান রেকর্ডে ধারণ করে রাখবার সাহস দেখাতে পারে নি। কলিম পত্নী নওশেবা খাতুনের আক্ষেপ, তাঁর কণ্ঠের প্রকৃত স্বরূপটা জানবার সুযোগ নতুন প্রজন্মের থাকলোই না- এটা বড় যথার্থ আক্ষেপ।

রবীন্দ্রনাথের গানে, কেবল ব্যারিটোন ভয়েস থাকলেই হলো না, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরে সেই গানের মূর্ছনাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা- সেখানেই রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার সার্থকতা। এই সার্থকতার নিরিখে কলিম শরাফী এবং তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধু, কমরেড, সুচিত্রা মিত্রের যে কালোত্তীর্ণ অবদান, তেমনটা সচরাচর দেখা যায় না। কলিমের একটা অসামান্য পরিমিতি বোধ ছিল রবীন্দ্রনাথের গান নির্বাচন এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রে। কখনোই তিনি রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গ তালের গান বা টপ্পাঙ্গের গান পরিবেশন বা রেকর্ড করবার জন্যে নির্বাচন করেন নি। এই ধরনের গানে সুবিনয় রায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, গীতা ঘটকদের মুন্সিয়ানা ঘিরে অকপট ছিলেন কলিম।কখনো ওইসব শিল্পীর, এ ধরনের গানে পারদর্শিতা ঘিরে গলা খুলে প্রশংসার ক্ষেত্রে কলিমের ভিতরে এতটুকু কার্পণ্য দেখতে পাওয়া যায় নি।

কলিম শরাফী জীবনের প্রায় শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের যে সব গানগুলি সি ডি তে ধারণ করেছিলেন তার ভিতরে, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে, যখন বৃষ্টি নামলো’, গানটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। এই গানটি যে আঙ্গিকে তিনি গেয়েছিলেন, সেই আঙ্গিকটা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন তাঁর বটুকদার কাছ থেকে। সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি অরুণ মিত্র থাকতেন কালীঘাটে। তাঁর বাড়িতে এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই গানটি গেয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। কলিম তাঁর সি ডি তে ধারণ করা এই গানটির শুরু করেছিলেন তাল ছাড়া। প্রথম লাইনটি গাইবার পর,তিনি তালে গাইতে লাগলেন।পুরো গানটাই তালে গাইলেন।একটা গান, যেন একেবারে বর্ষণমুখর সন্ধ্যার আমেজ নিয়ে এলো। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তখন ও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড রয়েছে।আর সেই বোর্ড সম্পর্কে সুচিত্রা মিত্রের মূল্যায়ন, নন পারফর্মার লোকেদের দ্বারা ভর্তি সে বোর্ডে গান অনুমোদনের নামে বোর্ড কর্তাদের বাড়ি, গাড়ি হচ্ছে। স্বভাবতই দুটো সি ডির ভিতরে দু’একটা গান ছাড়া কলিম শরাফীর অনায,গানগুলিকে অনুমোদন দিলো না বিশ্বভারতী। মিউজিক বোর্ড অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর এপার বাংলার জনৈক লোকসঙ্গীত শিল্পী তপন রায় নিজের কোম্পানি থেকে সেইসব সি ডি প্রকাশ করতে চাইলেন, কলিম শরাফীকে মাত্র এক হাজার টাকা সাম্মানিকের বিনিময়ে।বলা বাহুল্য, অর্থের আকাক্সক্ষায় কলিম কখনো গান গান নি।তাই বলে মাত্র এক হাজার টাকাতে ওই তপন রায়ের কোম্পানিকে গানগুলি বাণিজ্যিকভাবে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া ছিল কলিম শরাফীর পক্ষে চরম অপমানজনক।

দেবব্রতের গায়কী, তাঁর শারীরিক সুস্থতাকালেও, ‘আকাশ ভওওওরা সূর্য তারা’, এমন স্ব সুরারোপ এবং স্বপ্রেক্ষণের পথে কলিম কখনোই হাঁটেননি। তাই বলে তাঁর ‘জর্জদা’র প্রতি কলিমের শ্রদ্ধাতে কখনো বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। সৃষ্টিকে উদ্ভাসিত করতে স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যাওয়ার যে বিরক্তিকর প্রবণতা চিরকালই রবীন্দ্রনাথের গান ঘিরে আছে, সেপথে একবারের জন্যেও কলিম হাঁটেননি। তাই অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দূরত্বের পর্বেও কলিম কণ্ঠের, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, সুদূর বিদেশে বসে মনে সাহস জুগিয়েছিল নবনীতা দেবসেনকে। আবার যে ‘জর্জ’কে প্রথমাবস্থায় শার্ট প্যান্ট পরিয়ে ‘রক্তকরবী’র বিশু পাগল চরিত্রে অভিনয় করিয়ে বহু সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু সেই শম্ভু মিত্রও জীবনের শেষপর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মনের শান্তি, প্রাণে খুঁজবার চেষ্টা করতেন জর্জের গানে নয়, তাঁর ভাই কলিমের গানে।এখানেই মানুষ কলিমের সার্থকতা।এখানেই সাফল্য শিল্পী কলিম শরাফীর।

সেগুনবাগিচা সংস্কৃতি কলিমের চেতনালোককে কখনো আকীর্ণ করে নি।তাই সুধী প্রধানের আমিত্ব জাহিরের প্রবণতাকেও কখনো বিদ্বেষী মানসিকতা নিয়ে কাউকে বলেননি কলিম। গণনাট্য সঙ্ঘ শুরুর ও আগে, ‘শহিদের ডাক’ নামক একটা শ্যাডো প্লে নিয়ে তখন কলিম, সলিলেরা বাংলা-আসাম চষে বেড়াচ্ছেন। আসামের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শো সেরে একটা ছোট্ট স্টেশনে এসে দেখেন ট্রেন চলে গেছে। সারা দিনে আর গাড়ি নেই। পরের দিন আবার ট্রেন। কলিমের ভাষায়Ñ জানিস, তখন সলিল একটা বড় শতরঞ্চি ঘাসের উপর বিছিয়ে বলল, এসো, আমরা সবাই ‘আমি প্রধান’কে নিয়ে চর্চা করেই সময় কাটিয়ে দিই।

মহঃ সেলিম একুশ শতকের সূচনায় পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত সরকারি স্তরে কলিম শরাফীকে ঘিরে কোনো ভূমিকা আমরা দেখি নি। আর কলিমও কখনোই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের হোমড়াচোমড়া, যাঁরা এককালে কলিমের সঙ্গেই বামপন্থী রাজনীতি করেছেন, তাঁদের কারো কাছে নিজে থেকে কলিম কখনো যোগাযোগ করেননি। আবার এই কলিমই বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীকালের অতিথি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে নিজে ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন শেরাটন হোটেলে। কলিম শরাফীকে পশ্চিমবঙ্গে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন মহঃ সেলিম। তার আগে একবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই বাণিজ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎ গাঙ্গুলীর আপ্ত সহায়কদের আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে কলিম এসেছিলেন। আয়োজকেরা যে ধরনের ব্যবহার তখন কলিম শরাফীর সঙ্গে করেছিলেন ভাবতেও লজ্জা লাগে। তাঁকে কলকাতা শহর থেকে অনেক দূরে বরানগরে ইন্ডিয়ান স্টাটিসস্টিকাল ইনস্টিটিউটের একটা অতিথি নিবাসে সস্ত্রীক পুরে দিয়ে আমন্ত্রকেরা কার্যত ওঁর কোনো খোঁজ খবরই আর রাখেননি। কলিম শরাফীর সঙ্গে এহেন দুর্বব্যহারের ক্ষেত্রে প্রয়াত এক কবির ভূমিকাটিও ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুর্বাগ্যজনক। অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে কলিম তখন বিষয়টি সি পি আই (এম) নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন। কলিম যেদিন ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন, সেইদিন এয়ারপোর্টে ওঁর সঙ্গে অবশেষে দেখা করবার সময় পেয়েছিলেন ওই কবি।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

প্রেমে প্রতিবাদে প্রতিরোধে কলিম শরাফী

গৌতম রায়

image

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয় নি কো নজরুল’- বিদ্রোহী কবিকে ঘিরে অন্নদাশঙ্করের এই মূল্যায়ন যেন শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো বিস্ময় প্রতিভা কলিম শরাফী সম্পর্কেও সর্বৈবভাবে প্রযোজ্য।কলিম শরাফী নিজের জীবনের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের নাগরিক হিশেবে সসম্মানে কাটানোর পরেও এপার বাংলা থেকে কখনো মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। কবি জয়দেব বসু একবার কলিম শরাফীকে কলকাতার কোনো রাস্তা চেনাচ্ছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। তারপরে কলিমের মন্তব্য ছিল- ওই বাঙালটা আমাকে কলকাতা চেনাবে?

ঢাকা, চট্টগ্রাম, কলকাতা, বীরভূমের খয়রাডিহি- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে অভিন্ন বাঙালি জাতিসত্তার মূর্ত প্রতীক হয়ে-ওঠা কলিম শরাফীর একটাই দুঃখ ছিল, অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে (১৯৪২) প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে এক বছরের ও বেশি সময় জেল খাটা সত্ত্বেও তিনি যেহেতু পরবর্তীতে আর স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থাকেননি, তাই ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামী হিশেবে তাঁকে কখনো কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। তা¤্রপত্র তো দেয়ইনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে ইন্দ্রকুমার গুজরাল যখন বাংলাদেশ সফর করছেন, তখন তাঁকে কথাটা সরাসরি কলিম বলেছিলেন। গুজরাল বিষয়টি তাঁর সফরসঙ্গী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখতে বলেন।’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কলিম, প্রণববাবুর পিতা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সিউড়ি জেলে ছিলেন।কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হিশেবে সাধারণের কাছে পরিচিত প্রণব মুখোপাধ্যায়, কলিম শরাফীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানানোর ক্ষেত্রেও নিজের তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষের উর্ধে উঠতে পারেন নি।ফলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গুজরালের আদেশ সত্ত্বেও অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধা হিশেবে নিজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি কলিম শরাফীর।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাংস্কৃতিক জনজোয়ারের আগুয়ান সৈনিক হিশেবে কলিম শরাফী অত্যন্তশ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তিত্ব।কিন্তু যে মানুষটির প্রথম জীবনের একটা গৌরবজনক অধ্যায় অখণ্ড এবং খণ্ডিত দুই অবস্থার বাংলাতেই বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং কলকাতা মহানগরীর বুকে কেটে গেল, সেই পশ্চিমবঙ্গ জীবৎকালে কতটুকু মর্যাদা দিয়েছিল তাঁকে? আর তাঁর প্রয়াণের পর, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে কতটুকুইবা এপারের বাঙালি স্মরণ করছে তাঁকে? সি পি আই (এম) দল পরিচালিত ‘নন্দন’ পত্রিকা ছাড়া জীবৎকালে পশ্চিমবঙ্গের কোনো পত্রিকাতেই কলিম শরাফীর বিস্তারিত সাক্ষাৎকার বের হয়নি। কলিমের ‘কমরেড’ ঢাকায় গিয়ে কলিমের উদ্যোগে সেখানকার প্রগতিশীল মহলে বহু সমাদর পেয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ সলিল কিন্তু এবার বাংলায় তাঁর ‘কমরেড’ কলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে কোনো উদ্যোগ নেননি।বাংলাদেশের সৃষ্টির পর, কলিম, তাঁর বটুকদাকে (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র) ঢাকাতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম দরবার করে সব ব্যবস্থা করেছিলেন।ঢাকার সেই সময়ের টেলিভিশনে কলিমের নেওয়া জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সাক্ষাৎকারটিই কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রের একমাত্র অডিও ভিসুয়াল সাক্ষাৎকার।

ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী মহঃ সেলিমই প্রথম উদ্যোগ নিয়ে সরকারি স্তরে কলিম শরাফীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন।সেলিমের উদ্যোগেই কলিম শরাফী পঞ্চাশ বছর পরে সস্ত্রীক নিজের জন্মভূমি বীরভূমের খয়রাডিহি গ্রামে পা রেখেছিলেন। সেলিমের উদ্যোগেই কলিম,তাঁর প্রথম জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কলকাতার বাংলা আকাদেমিতে। বুদ্ধবাবু ছোট শিশুর মতো,তাঁর কলিমকাকার কাছে শুনেছিলেন নিজের অকাল প্রয়াত সুকান্ত কাকার জীবনের অনেক অজানা কাহিনি। সেলিমের উদ্যোগেই সেই প্রথম আর সেই শেষবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি হিশেবে এখানকার গান মেলা গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে’র সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন করেছিলেন কলিম শরাফী।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে কলিম শরাফীকে চলে যেতে হয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির চারের দশকের শেষ দিকের সর্বভারতীয় সম্পাদক বি টি রণদিভের সাংস্কৃতিক লাইনের কারণে।কলিম শরাফীকে ঘিরে বিন্দুমাত্র চর্চা না করে কেবলমাত্র তাঁর দুটি বই থেকে কার্যত টুকে এপার বাংলাতে এখন ‘কলিম শরাফী বিশেষজ্ঞ’ হয়ে ওঠার একটা দারুণ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কলিমের স্থায়ীভাবে ভারত ছেড়ে যাওয়ার পিছনে এইসব ‘পণ্ডিতেরাই’ ‘মুসলমান’ হিশেবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কলিমের ভারত ত্যাগের এক আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন- যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।আবার ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্রকে আমি কলিম শরাফীকে বলতে শুনেছি, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যেই তো দেশ ছাড়তে হলো তোমাকে।

স্বাভাবিক ভদ্রতায় ইলা মিত্রের বাসায় বসে রমেন মিত্রের কথার বিরোধিতা কিছু করেননি কলিম। সেখানে ব্যক্তিজীবন ঘিরে এই রুচিহীন কথার উত্তর দিতে নিশ্চয়ই কলিমের আত্মমর্যাদাতে বেঁধেছিল।কিন্তু রমেন মিত্রের এই অসত্য উপস্থাপনাতে কলিম শরাফী যথেষ্ট দুঃখই পেয়েছিলেন।অমর্ত্য সেনের সঙ্গে যখন বৈবাহিক সম্পর্ক নবনীতা দেবসেনের প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে, আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ শুধু সময়ের অপেক্ষা, সেইসময়ে বিদেশে বসে একটা ই পি রেকর্ডে কলিমের কণ্ঠে রবীন্দ্রমন্ত্র, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস না ভাই’, নবনীতাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার শক্তি জুগিয়েছিল।অনেক অনেক বছর পরে ঢাকা যাওয়ার পথে, কলকাতা বিমানবন্দরে নবনীতা সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন কলিমকে।

শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কলিম শরাফীর সম্পর্কটা ছিল একদম মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো। তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে ছিল স্নেহনিবিড় সম্পর্ক। শম্ভু-তৃপ্তির বিচ্ছেদ কলিমকে অসম্ভব দুঃখ দিয়েছিল। বিচ্ছেদের কারণ অনেকটাই নিবিড়ভাবে জানতেন কলিম। কিন্তু তাঁর ‘মেজদা’ শম্ভু মিত্রকে ঘিরে কখনো কোথাও, এমনকি ব্যক্তিগত স্তরেও এতটুকু ঘরের কথা বলেননি কলিম। ‘বৌদি’ তৃপ্তির প্রতি ও অসম্ভব শ্রদ্ধা ছিল তাঁর।হয়ত খানিকটা যন্ত্রণাও অনুভব করতেন তাঁর বৌদির জন্যে।তবুও তাঁদের ব্যক্তি জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে একটা শব্দ কখনও কলিম উচ্চারণ করেননি।এটাই ছিল তাঁর শিষ্টতা বোধ।যখনই কলকাতায় কলিম আসতেন, বেহালার জ্যোতিষ রায় রোডে, তাঁর মেজদা, শম্ভু মিত্রকে দেখা ছিল কলিমের অবশ্য পালনীয় একটা কর্তব্য।শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের অল্প কিছুকাল আগে, শম্ভুবাবু তখন কার্যত শয্যাশায়ী, কলিম দেখা করে গিয়েছিলেন তাঁর মেজদার সঙ্গে।শাঁওলী মিত্র শৈশবে তো জানতেনই না, তাঁর ‘কলিমকাকা’র সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।কন্যাসম শাঁওলী, শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের অনেক বছর পরে সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়কে পুনর্বিবাহ করেন। সেবার কলকাতায় আসবার সময়ে কলিম-নওশেবা নতুন কনের জন্যে দারুণ সুন্দর একটা লাল টুকটুকে ঢাকাই জামদানি শাড়ি এনেছিলেন।

প্রেমে-প্রতিবাদে-প্রতিরোধে চিরপ্রত্যয়ী বাঙালি কলিম শরাফী রাজরোষের পরোয়া না করে যেভাবে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, তেমন ব্যক্তিত্ব তাঁর সমকালে বাংলাদেশে কিছু থাকলেও এপার বাংলাতে অন্নদাশঙ্কর রায় ছাড়া আর কেউই ছিলেন কিনা সন্দেহ। দলীয় রাজনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে নিজের জীবনকে প্রবাহিত না করেও কীভাবে একজন যথার্থ কমিউনিস্ট হওয়া যায় কলিম শরাফী তাঁর গোটা জীবনটা দিয়ে সেটা প্রমাণ করে গিয়েছেন।

কলিমকে ওপার বাংলার দেবব্রত বিশ্বাস বলে বর্ণনা করবার একটা অদ্ভুত চল এপার বাংলাতে, যাঁরা হালে জেনেছেন কলিম শরাফী সম্পর্কে, তাঁদের হরবখত বলতে শোনা যায়। এই অদ্ভুত কথাটি প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, কলিম শরাফী কখনোই রবীন্দ্রনাথের গানে,যাকে চলতি কথায় বলে, খোদার উপর খোদগারি- তার ধার পাশ দিয়ে যান নি।রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে সুর, তাল, লয়- এসবের কোনো ক্ষেত্রেই তিনি নিজের মনমত কোনো কিছু করেন নি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত ‘সঙ্গীত মেলা’তে তৎকালীন মন্ত্রী মহঃ সেলিমের বিশেষ আমন্ত্রণে এসে, মেলা উদ্বোধনের পর, রবীন্দ্রসদনে দর্শকাসনে বসে তিনি গান শুনছেন।শিল্পী মোহন সিং।গান শুনতে শুনতে বিরক্ত কলিম বললেন, রবীন্দ্রনাথের গান, অহেতুক তান কর্তব্যের বিষয় নয়।

রবীন্দ্রনাথের গানে কলিম শরাফী একলব্যের মতো গুরু হিশেবে মানতেন তাঁর বটুকদা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে।প্রথম জীবনে নিজে কলিম কিছুদিন ‘দক্ষিণী’তে শিক্ষানবিশী ছিলেন।শিক্ষকতাও করেছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর শেষদিন পর্যন্ত সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়।তবু বলতে হয়, কলিম শরাফীর পরিব্যাপ্ত মূল্যায়নে ‘দক্ষিণী’র গায়কী শেষ পর্যন্ত তাঁকে তৃপ্তি দেয় নি। নিন্দা করবার সেগুনবাগিচা জনিত গুণ কলিম শরাফীর কোনোদিন ছিল না। তবু, কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যে রেখে রবীন্দ্রনাথের গায়কী তে, ‘মুখে সুপুরি পুড়ে’ গাইবার রীতি ঘিরে বিরক্ত এবং মস্করা- দুটোই তিনি করতেন। এই ‘মুখে সুপুরি পুড়ে’ গাইবার পদ্ধতি বলতে উনি কি বোঝাতে চাইতেন, রসিক শ্রোতার অবশ্য সেটা ধরতে পারাটা মোটেই কঠিন হতো না।

রবীন্দ্রনাথের গানে উদাত্ততার আঙ্গিকটি ছিল কলিমের সব থেকে পছন্দের বিষয়। তাঁর কণ্ঠের, গায়কীর উদাত্ততার সঠিক পরিমাপ, আজকের প্রজন্মের পক্ষে করা সম্ভব নয়।এই অসম্ভবের কারন হল, আজ বাণিজ্যিকভাবে কলিম শরাফীর যন্ত্রে ধারণ করা যেসব গান পাওয়া যায়, সেগুলি তিনি যখন পর পর রেকর্ড করেন, তখন তাঁর বয়স সত্তর উত্তীর্ণ। ‘নবজীবনের গান’ যখন রেকর্ড হয়, তখন একবার হার্ট অ্যাটাক তাঁর হয়ে গেছে। আর তাঁর পূর্ণ যৌবন কালের যে কণ্ঠ এবং গায়কী, তার প্রায় কোনো দৃষ্টান্তই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধারণ করা নেই। কারণ, সেই সময়ে কলিম শরাফী কী? তিনি কি ভারতের চর? তিনি কি পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? তিনি কি কমিউনিস্ট?- এইসব ঘটনাক্রমে প্রায় কোনো বাণিজ্যিক সংস্থাই তাঁর গান রেকর্ডে ধারণ করে রাখবার সাহস দেখাতে পারে নি। কলিম পত্নী নওশেবা খাতুনের আক্ষেপ, তাঁর কণ্ঠের প্রকৃত স্বরূপটা জানবার সুযোগ নতুন প্রজন্মের থাকলোই না- এটা বড় যথার্থ আক্ষেপ।

রবীন্দ্রনাথের গানে, কেবল ব্যারিটোন ভয়েস থাকলেই হলো না, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরে সেই গানের মূর্ছনাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা- সেখানেই রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার সার্থকতা। এই সার্থকতার নিরিখে কলিম শরাফী এবং তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধু, কমরেড, সুচিত্রা মিত্রের যে কালোত্তীর্ণ অবদান, তেমনটা সচরাচর দেখা যায় না। কলিমের একটা অসামান্য পরিমিতি বোধ ছিল রবীন্দ্রনাথের গান নির্বাচন এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রে। কখনোই তিনি রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গ তালের গান বা টপ্পাঙ্গের গান পরিবেশন বা রেকর্ড করবার জন্যে নির্বাচন করেন নি। এই ধরনের গানে সুবিনয় রায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, গীতা ঘটকদের মুন্সিয়ানা ঘিরে অকপট ছিলেন কলিম।কখনো ওইসব শিল্পীর, এ ধরনের গানে পারদর্শিতা ঘিরে গলা খুলে প্রশংসার ক্ষেত্রে কলিমের ভিতরে এতটুকু কার্পণ্য দেখতে পাওয়া যায় নি।

কলিম শরাফী জীবনের প্রায় শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের যে সব গানগুলি সি ডি তে ধারণ করেছিলেন তার ভিতরে, ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে, যখন বৃষ্টি নামলো’, গানটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। এই গানটি যে আঙ্গিকে তিনি গেয়েছিলেন, সেই আঙ্গিকটা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন তাঁর বটুকদার কাছ থেকে। সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি অরুণ মিত্র থাকতেন কালীঘাটে। তাঁর বাড়িতে এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই গানটি গেয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। কলিম তাঁর সি ডি তে ধারণ করা এই গানটির শুরু করেছিলেন তাল ছাড়া। প্রথম লাইনটি গাইবার পর,তিনি তালে গাইতে লাগলেন।পুরো গানটাই তালে গাইলেন।একটা গান, যেন একেবারে বর্ষণমুখর সন্ধ্যার আমেজ নিয়ে এলো। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তখন ও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড রয়েছে।আর সেই বোর্ড সম্পর্কে সুচিত্রা মিত্রের মূল্যায়ন, নন পারফর্মার লোকেদের দ্বারা ভর্তি সে বোর্ডে গান অনুমোদনের নামে বোর্ড কর্তাদের বাড়ি, গাড়ি হচ্ছে। স্বভাবতই দুটো সি ডির ভিতরে দু’একটা গান ছাড়া কলিম শরাফীর অনায,গানগুলিকে অনুমোদন দিলো না বিশ্বভারতী। মিউজিক বোর্ড অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর এপার বাংলার জনৈক লোকসঙ্গীত শিল্পী তপন রায় নিজের কোম্পানি থেকে সেইসব সি ডি প্রকাশ করতে চাইলেন, কলিম শরাফীকে মাত্র এক হাজার টাকা সাম্মানিকের বিনিময়ে।বলা বাহুল্য, অর্থের আকাক্সক্ষায় কলিম কখনো গান গান নি।তাই বলে মাত্র এক হাজার টাকাতে ওই তপন রায়ের কোম্পানিকে গানগুলি বাণিজ্যিকভাবে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া ছিল কলিম শরাফীর পক্ষে চরম অপমানজনক।

দেবব্রতের গায়কী, তাঁর শারীরিক সুস্থতাকালেও, ‘আকাশ ভওওওরা সূর্য তারা’, এমন স্ব সুরারোপ এবং স্বপ্রেক্ষণের পথে কলিম কখনোই হাঁটেননি। তাই বলে তাঁর ‘জর্জদা’র প্রতি কলিমের শ্রদ্ধাতে কখনো বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। সৃষ্টিকে উদ্ভাসিত করতে স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যাওয়ার যে বিরক্তিকর প্রবণতা চিরকালই রবীন্দ্রনাথের গান ঘিরে আছে, সেপথে একবারের জন্যেও কলিম হাঁটেননি। তাই অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দূরত্বের পর্বেও কলিম কণ্ঠের, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, সুদূর বিদেশে বসে মনে সাহস জুগিয়েছিল নবনীতা দেবসেনকে। আবার যে ‘জর্জ’কে প্রথমাবস্থায় শার্ট প্যান্ট পরিয়ে ‘রক্তকরবী’র বিশু পাগল চরিত্রে অভিনয় করিয়ে বহু সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু সেই শম্ভু মিত্রও জীবনের শেষপর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মনের শান্তি, প্রাণে খুঁজবার চেষ্টা করতেন জর্জের গানে নয়, তাঁর ভাই কলিমের গানে।এখানেই মানুষ কলিমের সার্থকতা।এখানেই সাফল্য শিল্পী কলিম শরাফীর।

সেগুনবাগিচা সংস্কৃতি কলিমের চেতনালোককে কখনো আকীর্ণ করে নি।তাই সুধী প্রধানের আমিত্ব জাহিরের প্রবণতাকেও কখনো বিদ্বেষী মানসিকতা নিয়ে কাউকে বলেননি কলিম। গণনাট্য সঙ্ঘ শুরুর ও আগে, ‘শহিদের ডাক’ নামক একটা শ্যাডো প্লে নিয়ে তখন কলিম, সলিলেরা বাংলা-আসাম চষে বেড়াচ্ছেন। আসামের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শো সেরে একটা ছোট্ট স্টেশনে এসে দেখেন ট্রেন চলে গেছে। সারা দিনে আর গাড়ি নেই। পরের দিন আবার ট্রেন। কলিমের ভাষায়Ñ জানিস, তখন সলিল একটা বড় শতরঞ্চি ঘাসের উপর বিছিয়ে বলল, এসো, আমরা সবাই ‘আমি প্রধান’কে নিয়ে চর্চা করেই সময় কাটিয়ে দিই।

মহঃ সেলিম একুশ শতকের সূচনায় পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত সরকারি স্তরে কলিম শরাফীকে ঘিরে কোনো ভূমিকা আমরা দেখি নি। আর কলিমও কখনোই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের হোমড়াচোমড়া, যাঁরা এককালে কলিমের সঙ্গেই বামপন্থী রাজনীতি করেছেন, তাঁদের কারো কাছে নিজে থেকে কলিম কখনো যোগাযোগ করেননি। আবার এই কলিমই বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীকালের অতিথি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে নিজে ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন শেরাটন হোটেলে। কলিম শরাফীকে পশ্চিমবঙ্গে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন মহঃ সেলিম। তার আগে একবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই বাণিজ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎ গাঙ্গুলীর আপ্ত সহায়কদের আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে কলিম এসেছিলেন। আয়োজকেরা যে ধরনের ব্যবহার তখন কলিম শরাফীর সঙ্গে করেছিলেন ভাবতেও লজ্জা লাগে। তাঁকে কলকাতা শহর থেকে অনেক দূরে বরানগরে ইন্ডিয়ান স্টাটিসস্টিকাল ইনস্টিটিউটের একটা অতিথি নিবাসে সস্ত্রীক পুরে দিয়ে আমন্ত্রকেরা কার্যত ওঁর কোনো খোঁজ খবরই আর রাখেননি। কলিম শরাফীর সঙ্গে এহেন দুর্বব্যহারের ক্ষেত্রে প্রয়াত এক কবির ভূমিকাটিও ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুর্বাগ্যজনক। অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে কলিম তখন বিষয়টি সি পি আই (এম) নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন। কলিম যেদিন ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন, সেইদিন এয়ারপোর্টে ওঁর সঙ্গে অবশেষে দেখা করবার সময় পেয়েছিলেন ওই কবি।